বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১২

বাঙালির বিচারব্যবস্থার অতীত ও বর্তমান



সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ২৪-১১-২০০৯
যাঁরা পত্রপত্রিকায় উপসম্পাদকীয় রচনা লেখেন তাঁরা সাধারণ মানুষ। তাঁদের মুরোদ বা ক্ষমতা বলতে কিছুই নেই। তলোয়ার নেই; ঢাল নেই, লাঠিয়াল ও পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজ কিছুই নেই। জ্ঞানগম্যিও যে খুব বেশি আছে তাও নয়। কেউ কাগজে লেখেন অভ্যাসবশত, অনেকে লেখেন পেটের দায়ে। 
যাঁরা রাজনীতিবিদ, যাঁরা জনগণকে পরিচালিত করেন—তাঁরা অনেক বড়। রাজনীতিকদের মধ্যে যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান তাঁরা আরও বড়। ক্ষমতা তাঁদের সীমাহীন। শক্তিতে তাঁরা অপ্রতিরোধ্য। একটি রাষ্ট্রে ওপরে আসমানে বিশ্ববিধাতা, আর নিচে মাটিতে সরকার। অনেক ক্ষেত্রে বিধাতার ক্ষমতা সীমিত, কারণ তিনি একটি ব্রিজ, কালভার্ট বা ফ্লাইওভার বানাতে পারেন না; কোনো রকম টেন্ডার আহ্বানের ঝামেলা-ঝক্কির মধ্যে তিনি যান না; কিন্তু একটি সরকার তা পারে, যারা রাষ্ট্রপরিচালক, বিদ্যাবুদ্ধি থেকে শুরু করে বিত্তবিভব, পেশিশক্তি প্রভৃতি জাগতিক ব্যাপার তাদের পূর্ণ করায়ত্ত। সুতরাং তাদের পরামর্শ দেওয়া কোনো কলামলেখক বা অপ-এড রচনালেখকদের কম্ম নয়। তবে কখনো যে কেউ কেউ দেন তাও অভ্যাসবশত—প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য থেকে নয়।
কোনো দেশের জনগণ যখন নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র চায়, তখন তারা একটি সরকারও চায়। এমন একটি সরকার তাদের কাম্য যে সরকার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো পূরণ করতে সক্ষম। সব রাষ্ট্রেই চোরছ্যাঁচড় থাকবেই, তার জন্য এমন দাবি জনগণ করবে না যে তারা ঘরের দরজা খুলে নাক ডেকে ঘুমাবে, কিন্তু কোনো চোর তাদের ঘরে ঢুকবে না। জনগণ চায় আইনকানুন দ্বারা পরিচালিত একটি রাষ্ট্র এবং নিরপেক্ষ আইনকানুন প্রয়োগকারী একটি সরকার। অর্থাত্ রাষ্ট্রে যিনি দারোগা হবেন তিনি ঠিক চোর বা খুনির কোমরেই দড়ি দেবেন, অন্য কারও কোমরে কদাচ নয়। রাষ্ট্রে যিনি কাজী বা বিচারক হবেন তিনি কেউ দোষী সাব্যস্ত হলেই শুধু তাকে বন্দীখানায় আটকে রাখার অথবা ফাঁসিতে বা শূলে চড়িয়ে প্রাণদণ্ড দেওয়ার হুকুম দেবেন। নির্দোষ কোনো ব্যক্তির গায়ে আঁচড়টিও যাতে না লাগে সেদিকে তাঁকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে হবে। 
কোনো আধুনিক রাষ্ট্রে বা প্রজাতন্ত্রে প্রধান বিভাগ তিনটি: নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ। নির্বাহী বিভাগের কাজের সীমাসরহদ্দ নেই, কিন্তু পার্লামেন্ট বা আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগের কাজ সুনির্দিষ্ট। নির্বাহী বিভাগের কাজে সূক্ষ্মতা নাও থাকতে পারে, বহু কাজ তাদের করতে হয়, তাতে কিছু ভুলভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক। আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগের কাজ হতে হবে ত্রুটিহীন—কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে যতটা নির্ভুল করা সম্ভব। তবে মানবিক ভুল ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
বাঙালি জাতির বিচারব্যবস্থার ঐতিহ্য অত্যন্ত গৌরবময়। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে পাকিস্তানি আমলের ২৪ বছর, তার আগে ইংরেজ শাসনের ১৯০ বছর এবং তারও আগে মুঘল ও সুলতানি আমলের ৬০০ বছর আমাদের ভূখণ্ডে যেসব ধরনের বিচারব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা মানের দিক থেকে যেকোনো সভ্য দেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে তুলনীয়। ব্রিটিশ-পূর্ব সময়ের কাজীর বিচারের কথা আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি। তখন শাসকেরা ছিলেন মুসলমান, কিন্তু বিচারব্যবস্থা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। ইসলামি ফিকাহ ও হিন্দুধর্মের স্মৃতিশাস্ত্র রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে ব্যবহূত হতো। কয়েক দিন ধরে আমি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ, মোহাম্মদ হাবিবের সহকর্মী, এস এ কিউ হুসাইনির Administration Under the Mughals নতুন করে পাঠ করেছিলাম। বইটি মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৪৯-এ এবং ঢাকায় মুদ্রিত ১৯৫১ সালে। অমূল্য গ্রন্থটি এখন দুর্লভ। হয় মূল ইংরেজিটি অথবা এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হওয়া দরকার। ভারতের ইতিহাসবিদদের কাছে এই গ্রন্থের কদর আছে বলে আমি জানি। গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়টি মুঘল বিচারব্যবস্থাসংক্রান্ত। এ ছাড়া শ্রীরাম শর্মার Mughal Government and Administration-এও মুঘল বিচারব্যবস্থার বিচারবিশ্লেষণ আছে। তাতে দেখা যাচ্ছে মুঘল প্রশাসনে ন্যায়বিচার ছিল তুলনাহীন। ভারতবর্ষের প্রধান বিচারপতিকে বলা হতো ‘কাজীউল কুজাত’। প্রত্যেক প্রদেশে আলাদা কাজীর আদালত ছিল—এখনকার হাইকোর্টের মতো। জেলা শহরগুলোতেও কাজী ছিলেন। প্রাদেশিক কাজীর নিচের ধাপগুলোয় যাঁরা বিচারক ছিলেন তাঁদের পদবি ছিল এ রকম: সরকার কাজী (ম্যাজিস্ট্রেট), পরগনা কাজী, মুফতি (অ্যাটর্নি), মিরআদল, কাজী-ই-আসকার প্রভৃতি। 
ইংরেজরা এসে মুঘলব্যবস্থা ও ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থার সমন্বয় ঘটান। অন্যদিকে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও শোষণ করলেও ব্রিটিশ ভারতের আদালত ছিল ন্যায়বিচারের পরাকাষ্ঠা। জজরা নিজেদের মনে করতেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। দুর্নীতি বা প্রভাবিত হওয়ার কথা তাঁদের সম্পর্কে কোনো দিন ওঠেনি। 
ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর তাদের বিচারব্যবস্থাই পাকিস্তান ও ভারতে প্রচলিত থাকে। ভারত উচ্চ আদালতের মান রক্ষা করে চলেছে। তবে কোনো কোনো হাইকোর্টের বিচারক দুর্নীতির অভিযোগে চাকরিও খুইয়েছেন। 
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি বিচারব্যবস্থাই চালু থাকে। এখনো আছে। আইনকানুন সব ইংরেজ আমলের, তবে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে যুগের প্রয়োজনে নতুন আইন। কিন্তু পদ্ধটিটি ব্রিটিশ। প্রক্রিয়া হিসেবে যা খুবই জটিল। কেউ মামলায় জড়ালে সে হবে ফতুর এবং ভারী হবে উকিলের পকেট। কোনো কোনো বিচারকের অবিচারকসুলভ আচরণ ও অসাধুতার কথাও কাগজে আসছে। কোনো মানুষই ফেরেশতা নয়, বিচারকও মানুষ। সময়ের হাওয়া যেকোনো পদের মানুষের গায়েও লাগা সম্ভব।
বিচারব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছি কারণ বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মামলা-মোকদ্দমার দেশ। কিছুকাল ধরে বাংলাদেশ সরকারকে এত বেশি মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করতে হচ্ছে যে ন্যাটো জোটভুক্ত সব দেশের সরকারকে সম্মিলিতভাবেও অত মামলায় লড়তে হচ্ছে না। তা ছাড়া আমাদের আদালত যত ঘন ঘন অবমাননা বোধ করে, অন্য কোনো দেশের কোর্ট তা করার প্রয়োজন বোধ করেন না। ভারতে আদালত ও বিচারকদের মধ্যে প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়ে থাকে। প্রধান বিচারপতি থেকে আইন বিশেষজ্ঞগণ তাতে অংশ নেন। ভারতে হাইকোর্টের কোনো কোনো বিচারক অপরাধ করে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন এবং চাকরি খুইয়েছেন। মাস তিনেক আগে কলকাতা হাইকোর্টের একজন বিচারক কোল ইন্ডিয়ার টাকা নিজের নামে ব্যাংকে স্থায়ী জামানত হিসেবে রেখে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন। প্রধান বিচারপতি তাঁকে ইমপিচ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেছেন। সম্ভবত এত দিনে তাঁর চাকরি নেই। 
ব্যবস্থার কোনো দোষ নেই। ব্যবস্থাটা কার নিয়ন্ত্রণে সেটাই বড় কথা। এখনো যে ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত তা খারাপ নয়—আইন কীভাবে কে প্রয়োগ করছেন তাই বিচার্য। উঁচু মানসম্পন্ন আইনজ্ঞ ও বিচারকেরা যদি তা সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করেন তা হলে এ ব্যবস্থা থেকেই ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।
দেশের কাগজগুলোর প্রথম পাতা এখন পূর্ণ থাকে অপরাধ ও বিচার-সালিসের প্রতিবেদনে। সুষ্ঠু বিচারের প্রাথমিক শর্ত নির্ভুল তদন্ত। তদন্ত কর্মকর্তার সঠিক রিপোর্টের ভিত্তিতে সাক্ষীসাবুদের জবানবন্দির মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচারকাজ করা সম্ভব। ইংরেজি রিমান্ড শব্দটি আজ বাংলাদেশে বহুল ব্যবহূত শব্দ। ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত জানে রিমান্ড কী এবং কত প্রকার। অভিযুক্তকে পুলিশের হেফাজতে নিয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ ও স্বীকারোক্তি সংগ্রহের যে ব্যবস্থা বা হেফাজতে পুনঃপ্রেষণ করাকেই রিমান্ড বলে। এ প্রথা আগেও ছিল। কিন্তু এখনকার মতো তার অপব্যবহার ছিল না।
কোনো অভিযুক্তকে একবারই মাত্র রিমান্ডে নেওয়ার বিধান ছিল। সেটাও এক দিন-দুই দিনের জন্য। আজ পাঁচ-দশ দিন পর্যন্ত একজন অভিযুক্ত রিমান্ডে থাকছে। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশ হেফাজতে নিয়ে অভিযুক্তকে কী ধরনের নির্যাতন করা হচ্ছে বা তার সঙ্গে কেমন চাপমূলক আচরণ করা হচ্ছে তা ভুক্তভোগী ও নিপীড়নকারী কর্মকর্তারাই শুধু জানেন। এই প্রথা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তা ছাড়া আরও যা মারাত্মক ব্যাপার তা হলো, রিমান্ডের মাধ্যমে অনেক তদন্তকারী কর্মকর্তা নাকি আর্থিক সুবিধাও লাভ করছেন। যে ধরনের ব্যবস্থা তাতে তা হওয়া সম্ভব। একই অভিযুক্তকে বারবার দীর্ঘ সময়ের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার এই প্রথা আমাদের বিচারব্যবস্থাকে বিশ্বের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করছে। রিমান্ড আজ রাজনৈতিক নির্যাতনের নতুন সংস্করণ। এটা করে যাঁরা স্যাডিস্টিক সুখ পাচ্ছেন, তাঁদের ভবিষ্যত্ও যে শঙ্কামুক্ত নয় তাঁরা তা জানেন না।
সাম্প্রতিককালে আমাদের কাগজগুলো পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের সরবরাহ করা সত্য-মিথ্যা কথা দিয়েই বিরাট শিরোনাম করে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তাদের বক্তব্যও থাকবে, সেই সঙ্গে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকদের অভিযুক্ত ব্যক্তির থেকে সংগ্রহ করা কথাও থাকবে—তবেই তা হবে সত্ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা। গত ১০-১২ বছরের চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর গোয়েন্দা বিভাগ কর্তৃক সরবরাহ করা খবরগুলো পর্যালোচনা করলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়। অধিকাংশ খবরই মনগড়া, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শেষ পর্যন্ত শাস্তি না হোক, আসামিকে সাময়িকভাবে হলেও জনসমক্ষে হেয় করা গেল, সেটাই যেন বড় লাভ। 
বাংলাদেশের বর্তমান বিচারব্যবস্থার আর এক বৈশিষ্ট্য এই যে গায়ের জোরে হোক বা নির্বাচনের মাধ্যমেই হোক সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিচারকের রায় উল্টে যায়। এই প্রবণতা আমাদের বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। বড় বড় রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ সরকারের দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলার ক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহার বা সাজা মওকুফ হতে পারে। কিন্তু ফৌজদারি ও অন্য কোনো অপরাধের মামলায় সাধারণ আদালত থেকে দেওয়া সাজা মওকুফ করা বিচারব্যবস্থার প্রতি রাষ্ট্রের চরম অশ্রদ্ধার প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের চাঞ্চল্যকর ‘সেভেন মার্ডার কেস’-এর সাজাপ্রাপ্ত প্রধান আসামিকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান মুক্তি দিয়েছিলেন। তারপর সেই ব্যক্তিকে জিয়া ও এরশাদ সরকার ‘ভারত প্রতিরোধ সংগ্রামে’ ব্যবহার করেছেন। বহুকাল তাঁকে প্রতি মাসে নিয়মিত দেখা যেত ধানমন্ডি দুই নম্বর সড়কে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে জনা দশেক লোক নিয়ে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, পুলিশের হাতে স্মারকলিপি দিয়ে যেতে। সাবেক সেই ছাত্রলীগ নেতা আজ বিএনপিতে নেই বটে, স্বাধীন দল করেন এবং মুখে তাঁর বোল একটাই: ‘ভারতীয় আগ্রাসন।’ দেশের আর কেউ প্রতিরোধ না করুক তিনি একাই সেটা ঠেকাবেন।
রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদও তাঁর দলের এক খুনের আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়ে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার ক্ষমতা আছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’ রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতার ব্যবহার অতি বিরল। বহু দেশেই তা হয়ে থাকে মানবিক বিবেচনায়। যেমন কোনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যানসারের মতো কঠিন রোগে ভুগছে, বাঁচবেই আর অল্প কিছুদিন, তার নিজের বা মা-বাবার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরামর্শে তাঁর মৃত্যুদণ্ডটা শুধু মওকুফ হতে পারে, জেল থেকে মুক্তি নয়।
ক্ষমা মহত্তম গুণ। বাংলাদেশে তার প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। খবরে জানা গেল: ‘চারটি দুর্নীতির মামলায় ১৮ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি শাহাদাব আকবরের সাজা মওকুফ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। জাতীয় সংসদের উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবর ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালে পলাতক থাকা অবস্থায় সাজাপ্রাপ্ত হন। তিনি কখনো আত্মসমর্পণও করেননি।’ [প্রথম আলো, ১৩.১১.০৯]
সাজা মওকুফ হওয়া ব্যক্তি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২৬(২) ধারায় দুই বছর এবং ২৭(১) ধারার আওতায় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এ ছাড়া [আরও] এক বছর ও পাঁচ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডসহ প্রায় দেড় কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তাকে আরও ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। শাহাদাব আকবরের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানার পুরোটাই রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দিয়েছেন।’
যে আইনে ওই ব্যক্তি সাজা পেয়েছিলেন এবং সৌভাগ্যবশত বেকসুর খালাস হয়ে গেলেন, ওই আইনে আরও অনেকে এখন সাজা ভোগ করছেন অথবা ‘পলাতক’ রয়েছেন পুলিশের নাকের ডগায়। তাঁদের কী উপায় হবে? তাঁরা ক্ষমা প্রার্থনা করলে কি ক্ষমা পাবেন? যদি তা না পান তাহলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য তা হবে এক নির্মম পরিহাস।
বিচারক ও আইনজীবীদের সমন্বয়েই বিচারব্যবস্থা। মানুষ যেহেতু অপরাধপ্রবণ প্রাণী, তাই বিচারব্যবস্থা মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। মানবজ্ঞানের অর্থাত্ দর্শন-বিজ্ঞানের সূচনালগ্নেই ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গটি মানুষের মাথায় এসেছিল। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকেরা ন্যায়-অন্যায় ও ন্যায়বিচার নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিজ্ঞানপন্থী মুসলমান দার্শনিক আল্ কিন্দী, আল্ ফারাবি, আর-রাজী, ইবনে সিনা প্রমুখ এবং তাঁদের পরে ইবনে বাজা, ইবনে তোফায়েল, ইবনে বাজা রুশ্দ, ইবনে খলদুন প্রমুখ ন্যায়বিচার-বিধি বা থিওরি অব জাস্টিস নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনে ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমার চেয়ে বেশি জানেন আমাদের বিজ্ঞ আইনজীবীরা। আইনজীবীদের থেকে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়, উপসম্পাদকীয় লেখকদের থেকে নয়। যত বড় জঘন্য অপরাধেরই হোক না কেন বিচারপ্রক্রিয়া খুবই নিরাবেগ ব্যাপার। জাজমেন্ট বিষয়টিই হলো সত্য অনুসন্ধান করা, সেটা করতে হয় বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী ধারণার তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। চোখ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে হোক বা বোধশক্তির দ্বারা হোক সত্যকে উত্ঘাটন করতে হবে যুক্তি (reason) দ্বারা বা অন্তর্নিহিত explanatory principle ব্যবহার করে, যেখানে বিচারের রায়ে (Judgement) কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। 
আদালতের দেওয়া রায়কে অত্যন্ত সংগত কারণ ছাড়া নাকচ করে দেওয়া অর্থাত্ শাস্তিপ্রাপ্ত দোষীকে ক্ষমা করা কি বিচারব্যবস্থার অবমাননা নয়? স্বজনপ্রীতি জিনিসটি খুবই নিন্দনীয়। এবং স্বজনপ্রীতিরও একটি স্তর থাকে। সেই স্তর অতিক্রম বাঞ্ছনীয় নয়।
আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অনর্গল বলি। সে চেতনা হলো: আত্মসম্মানবোধ, আত্মনির্ভরশীলতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার। একটি উন্নত জাতি হিসেবে যদি আমরা পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত হতে চাই তাহলে বিচারব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা চলবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন