ফেব্রুয়ারি বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির মাস। তাই রচনার বিষয়বস্তু সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ভালো।
কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের ৭৬তম জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কবিতাপাঠ, আড্ডা ও সংগীতায়োজনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি (এবং কবি) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, ‘রাজনীতি আমার দেহ আর কবিতা আমার আত্মা।...আমার দীর্ঘ জীবনে কবিতা একটি বিশেষ অধ্যায়, যা আমার একান্ত উচ্চারণ এবং নিভৃত বাসনা।’ [ডেসটিনি, ৮ ফেব্রুয়ারি]
বাংলা সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধ। কবিতা সাহিত্যের একটি শাখা। বাংলা কাব্যের দীর্ঘ ইতিহাসে কোনো কবিই তাঁর দেহ ও তাঁর কবিতাকে ভাগাভাগি করার প্রয়োজন বোধ করেননি। বৈষ্ণব কবিরাও নন, রবিবাবুও নন, কাজী সাহেবও নন। কবিতা লেখার ক্ষমতা অনেকেরই না থাকতে পারে, কিন্তু কবিতা লেখার অধিকার সবাই রাখেন। এমনকি কোনো কোনো একনায়কের কবিতাচর্চার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার কোনো অধিকার নেই স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের। কবিতার যদি নারীর শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে, রাজনীতির সঙ্গে থাকবে না কেন?
বাংলাদেশে বহু রাজনীতিক কবিতার চর্চাও করেছেন। চিত্তরঞ্জন দাশের মালঞ্চ, সাগরসঙ্গীত প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ শৈশবে পাঠ করেছি। অরবিন্দ ঘোষ ঋষি হওয়ার আগে ছিলেন কবি ও বিপ্লবী-রাজনীতিক। বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা বাকেরগঞ্জের অশ্বিনীকুমার দত্তের একটি কবিতা বা গানের বই আমাদের বাড়িতে দেখেছি। তাঁরা রাজনীতিও করতেন, কবিতাও লিখতেন, কিন্তু শরীর, বস্তু, আত্মা প্রভৃতি আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে ভাবার ফুরসত পাননি। দেশের মানুষের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তাঁদের হাতে ছিল দেদার কাজ।
কোনো কোনো সৈনিকও ছাউনি থেকে চলে এসে কবিতা, গান লিখেছেন। বলেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য’। [বিদ্রোহী] কবি হলেন সত্য, সুন্দর; বিশেষ করে নারী, ফুল প্রভৃতির পূজারি। বিশের দশকের কবিও, আশির দশকের কবিও। সত্যিকারের কবি তাঁর নিজের সম্পর্কে সব বলে দেন। চুরুলিয়ার কাজী ফকির আহমেদের পুত্র লিখেছেন, ‘সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে’। [আমার কৈফিয়ত]
এই কলিকালে মোরগ যদি ডিম দিতে পারে, যে কারও পক্ষে কবিতা লেখাও সম্ভব। দ্য ডেইলি মেইল-এর অনলাইনের এক সংবাদে জানা গেছে, চীনের আনহুই প্রদেশের চুমিয়াও গ্রামের এক কৃষকের একটি মোরগ প্রতিদিন একটি করে ডিম দিচ্ছে। অনেক কবির লেখা কবিতা যে সত্য তারই লেখা, তা যেমন বিশ্বাস করতে চায় না মানুষ, কৃষক হুয়াং লির মোরগটিও যে সত্যি সত্যি মোরগ, তা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাখি বিশেষজ্ঞরা। ওটা মোরগ না মুরগি, তা পরীক্ষা করতে তাঁরা নিয়ে গেছেন।
মানুষের জীবনের প্রেম হোক বা কবিতাই হোক, তার একেকটি অধ্যায় থাকে। বাংলাদেশে আশির দশকটি তেমনি একটি অধ্যায়। রাজনীতি আর কবিতা সেদিন দেহ ও আত্মার মতো একাকার হয়ে গিয়েছিল। আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনতিক্রম্য মেরুকরণ। ২৫ বছর আগে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেরুকরণের আগে কবিতায় মেরুকরণ করা হয়েছিল সেই আশির দশকেই।
রাজনীতিতে মতপার্থক্য ছিল। প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলরা আলাদা আলাদা রাজনীতি করতেন। কিন্তু সহ-অবস্থানও করতেন। আশির দশকে জাতির সংহত চরিত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। সীমাহীন স্বৈরাচার। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান। গণতন্ত্রের জন্য উত্তপ্ত ও রক্তাক্ত রাজপথ। রাষ্ট্রধর্মের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান। প্রতি শুক্রবার মসজিদে বা পীরের আস্তানায় গিয়ে ধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা। এবং একই সঙ্গে প্রবল কাব্য আন্দোলন।
মনে পড়ে, এশীয় কবিতা উৎসবের কথা। উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষককবি বললেন, ‘আমি কবি নই, কবি হওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করিনি, কিন্তু চারদিকের দারিদ্র্য দেখে স্থির থাকতে পারি না। প্রতিবাদের জন্য হাতে কলম তুলি। চাঁদের আলোকে ফিরিয়ে আনার জন্যে কবিতা লিখি। এশিয়ার কাব্যাকাশকে এক নতুন আভায় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে এই কবিতা উৎসব।’ [দৈনিক বাংলা]
ওসব আসরের গালিচার এক কোণে ঠাঁই হলো না আমাদের মতো হতভাগাদের। আমরা জড়ো হলাম শামসুর রাহমানের পেছনে। জন্ম নিল জাতীয় কবিতা উৎসব। পাঁচতারা হোটেলের জলসাঘরে নয়, আমাদের উৎসব রাজপথে: টিএসসির সড়কদ্বীপের কাছে। অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ও প্রগতিশীল কবিদের সেই উৎসব এখনো হয়। আমাদের জনগণের উৎসবে রাজপথে বসে শেষ ছবি এঁকেছিলেন কামরুল হাসান। তবে আশির দশকের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কবিতাটি কাগজে নয়, নিজের দেহে লিখেছিলেন নূর হোসেন।
নূর হোসেন বেঁচে থাকলে আজ বলতেন, রাজনীতি আমার দেহ। কবিতা কী আমি জানি না। তবে গণতন্ত্র আমার আত্মা। কিন্তু নূর হোসেনের আত্মা আজ দেখতে পাচ্ছে: গণতন্ত্র নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, কবিতা নিয়ে আজ বাংলার মাটিতে চলছে তামাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের ৭৬তম জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কবিতাপাঠ, আড্ডা ও সংগীতায়োজনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি (এবং কবি) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, ‘রাজনীতি আমার দেহ আর কবিতা আমার আত্মা।...আমার দীর্ঘ জীবনে কবিতা একটি বিশেষ অধ্যায়, যা আমার একান্ত উচ্চারণ এবং নিভৃত বাসনা।’ [ডেসটিনি, ৮ ফেব্রুয়ারি]
বাংলা সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধ। কবিতা সাহিত্যের একটি শাখা। বাংলা কাব্যের দীর্ঘ ইতিহাসে কোনো কবিই তাঁর দেহ ও তাঁর কবিতাকে ভাগাভাগি করার প্রয়োজন বোধ করেননি। বৈষ্ণব কবিরাও নন, রবিবাবুও নন, কাজী সাহেবও নন। কবিতা লেখার ক্ষমতা অনেকেরই না থাকতে পারে, কিন্তু কবিতা লেখার অধিকার সবাই রাখেন। এমনকি কোনো কোনো একনায়কের কবিতাচর্চার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার কোনো অধিকার নেই স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের। কবিতার যদি নারীর শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে, রাজনীতির সঙ্গে থাকবে না কেন?
বাংলাদেশে বহু রাজনীতিক কবিতার চর্চাও করেছেন। চিত্তরঞ্জন দাশের মালঞ্চ, সাগরসঙ্গীত প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ শৈশবে পাঠ করেছি। অরবিন্দ ঘোষ ঋষি হওয়ার আগে ছিলেন কবি ও বিপ্লবী-রাজনীতিক। বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা বাকেরগঞ্জের অশ্বিনীকুমার দত্তের একটি কবিতা বা গানের বই আমাদের বাড়িতে দেখেছি। তাঁরা রাজনীতিও করতেন, কবিতাও লিখতেন, কিন্তু শরীর, বস্তু, আত্মা প্রভৃতি আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে ভাবার ফুরসত পাননি। দেশের মানুষের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তাঁদের হাতে ছিল দেদার কাজ।
কোনো কোনো সৈনিকও ছাউনি থেকে চলে এসে কবিতা, গান লিখেছেন। বলেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য’। [বিদ্রোহী] কবি হলেন সত্য, সুন্দর; বিশেষ করে নারী, ফুল প্রভৃতির পূজারি। বিশের দশকের কবিও, আশির দশকের কবিও। সত্যিকারের কবি তাঁর নিজের সম্পর্কে সব বলে দেন। চুরুলিয়ার কাজী ফকির আহমেদের পুত্র লিখেছেন, ‘সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে’। [আমার কৈফিয়ত]
এই কলিকালে মোরগ যদি ডিম দিতে পারে, যে কারও পক্ষে কবিতা লেখাও সম্ভব। দ্য ডেইলি মেইল-এর অনলাইনের এক সংবাদে জানা গেছে, চীনের আনহুই প্রদেশের চুমিয়াও গ্রামের এক কৃষকের একটি মোরগ প্রতিদিন একটি করে ডিম দিচ্ছে। অনেক কবির লেখা কবিতা যে সত্য তারই লেখা, তা যেমন বিশ্বাস করতে চায় না মানুষ, কৃষক হুয়াং লির মোরগটিও যে সত্যি সত্যি মোরগ, তা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাখি বিশেষজ্ঞরা। ওটা মোরগ না মুরগি, তা পরীক্ষা করতে তাঁরা নিয়ে গেছেন।
মানুষের জীবনের প্রেম হোক বা কবিতাই হোক, তার একেকটি অধ্যায় থাকে। বাংলাদেশে আশির দশকটি তেমনি একটি অধ্যায়। রাজনীতি আর কবিতা সেদিন দেহ ও আত্মার মতো একাকার হয়ে গিয়েছিল। আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনতিক্রম্য মেরুকরণ। ২৫ বছর আগে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেরুকরণের আগে কবিতায় মেরুকরণ করা হয়েছিল সেই আশির দশকেই।
রাজনীতিতে মতপার্থক্য ছিল। প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলরা আলাদা আলাদা রাজনীতি করতেন। কিন্তু সহ-অবস্থানও করতেন। আশির দশকে জাতির সংহত চরিত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। সীমাহীন স্বৈরাচার। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান। গণতন্ত্রের জন্য উত্তপ্ত ও রক্তাক্ত রাজপথ। রাষ্ট্রধর্মের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান। প্রতি শুক্রবার মসজিদে বা পীরের আস্তানায় গিয়ে ধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা। এবং একই সঙ্গে প্রবল কাব্য আন্দোলন।
মনে পড়ে, এশীয় কবিতা উৎসবের কথা। উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষককবি বললেন, ‘আমি কবি নই, কবি হওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করিনি, কিন্তু চারদিকের দারিদ্র্য দেখে স্থির থাকতে পারি না। প্রতিবাদের জন্য হাতে কলম তুলি। চাঁদের আলোকে ফিরিয়ে আনার জন্যে কবিতা লিখি। এশিয়ার কাব্যাকাশকে এক নতুন আভায় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে এই কবিতা উৎসব।’ [দৈনিক বাংলা]
ওসব আসরের গালিচার এক কোণে ঠাঁই হলো না আমাদের মতো হতভাগাদের। আমরা জড়ো হলাম শামসুর রাহমানের পেছনে। জন্ম নিল জাতীয় কবিতা উৎসব। পাঁচতারা হোটেলের জলসাঘরে নয়, আমাদের উৎসব রাজপথে: টিএসসির সড়কদ্বীপের কাছে। অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ও প্রগতিশীল কবিদের সেই উৎসব এখনো হয়। আমাদের জনগণের উৎসবে রাজপথে বসে শেষ ছবি এঁকেছিলেন কামরুল হাসান। তবে আশির দশকের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কবিতাটি কাগজে নয়, নিজের দেহে লিখেছিলেন নূর হোসেন।
নূর হোসেন বেঁচে থাকলে আজ বলতেন, রাজনীতি আমার দেহ। কবিতা কী আমি জানি না। তবে গণতন্ত্র আমার আত্মা। কিন্তু নূর হোসেনের আত্মা আজ দেখতে পাচ্ছে: গণতন্ত্র নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, কবিতা নিয়ে আজ বাংলার মাটিতে চলছে তামাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।