সোমবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১২

কাঁচা বাঁশের লাঠি

এক শ্রেণীর ঘাস বড় হতে হতে বাঁশে পরিণত হয়েছে। বাঁশ বিধাতা বানিয়েছিলেন প্রধানত মানুষের লাঠি হিসেবে ব্যবহূত হতে। বন্য জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে সুদূর অতীতে মানুষ বাঁশ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত পাথর প্রভৃতির সঙ্গে। তারপর মানুষ বাঁশ ব্যবহার করতে লাগল শত্রুর মাথা ফাটানোর কাজে।
বাঁশের বহু গুণ। বিচিত্র তার ব্যবহার। লাঠির ব্যবহার খুবই সীমিত। কারণ, মানুষ সারাক্ষণ শত্রুবেষ্টিত থাকে না। জীবনের বেশির ভাগ সময় মানুষ মারামারি না করে সুখশান্তিতে বসবাস করে। তা করতেও বাঁশের প্রয়োজন হয়। দালান ও ঘরবাড়ি তৈরির কাজে, ঘরের বেড়া বানাতে, মই বানাতে, ঝুড়ি তৈরি করতে বাঁশের প্রয়োজন। কোথায় কবে কার মাথা ফাটানো হবে, তার জন্য বাঁশকে বসিয়ে না রেখে মানুষ প্রতিদিনের কাজে বিধাতার এই বিচিত্র উদ্ভিদকে ব্যবহার করতে থাকে। সাঁকো ও নৌকার ছই থেকে কবরের ভাড়া হিসেবে বাঁশের ব্যবহার এখন প্রতিমুহূর্তে। নিষ্ঠুরতার মতো সৌন্দর্যবোধও মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। ফুলের সাজি, বিয়ের গায়েহলুদের বরণডালা বানাতে বাঁশ প্রয়োজন। তবে বাঁশের সত্যিকারের সদ্ব্যবহার সম্ভব লাঠি হিসেবেই।
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বাঁশের ইংরেজি নাম বিকৃত করে বলতেন বম্বু। দখলদার ব্রিটিশ সরকারকে বম্বু দিয়ে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে তিনি যুবসমাজকে আহ্বান জানাতেন। তিনি নিজে বাঁশের সদ্ব্যবহার করেছেন জীবনে মাত্র দুইবার। একবার ছাত্রজীবনে। কেউ একজন বলেছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ আর কি এমন কবি—’! রাস্তার পাশে পড়ে ছিল এক বাঁশ। সেটা তুলে বক্তার মাথায় এক বাড়ি। দ্বিতীয় বার তিনি বাঁশের এস্তেমাল করেন ঢাকায়। এখনকার মহাজোটের দক্ষিণ ঢাকার ওয়ারীতে। রানু সোমকে গান শিখিয়ে বেরিয়ে এলে মুসলমান গুণ্ডারা তাঁকে আক্রমণ করে। তারা সংখ্যায় ৮-১০ জন হলেও তাদের ধারণা ছিল না আক্রান্ত লোকটির শরীরে কতটা শক্তি। আশপাশে বিরাট বাঁশ কিছু পড়ে ছিল। নজরুল তার একটি তুলে বন্ বন্ করে ঘোরাতে থাকেন। সেই ঘূর্ণায়মান বাঁশে মাথা ফাটে কয়েকজনের। তারা ওয়ারী থেকে সোজা দক্ষিণ ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল। তবে নজরুল দুইবারই ব্যবহার করেছিলেন শুকনো বাঁশ—কাঁচা বাঁশ নয়।
কুড়ি শতকের শুরুর দিকে বৃহত্তর বাংলায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিল একটি: কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ভাগ্যাহত পূর্ববাংলায় সবেধন নীলমণি ভালো হাসপাতাল ছিল একটি। দক্ষিণ ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতাল। সেটা মেডিকেল কলেজ ছিল না। এখন বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ কত, তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কারণ, আমার লেখা যখন ছাপা হবে, তখন হয়তো দেখা যাবে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা আর একটি বেড়েছে। তবে দেশের ভালো কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজের একটি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
ওই হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ১৮১টি কর্মচারী পদের বিপরীতে আবেদন করেন ৯০০ জন। ২৩ জানুয়ারি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হয়। পরীক্ষা-টরীক্ষা যা-ই হোক মহানগর আওয়ামী লীগ ও মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতারা ৭০ জন কর্মচারী নিয়োগের কোটা দাবি করেন। দাবি পূরণ না হওয়ায় কলেজে ধর্মঘটও পালন করে ছাত্রলীগ। ওদিকে জাতীয় পার্টির সাংসদ ও দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল আসিফ শাহরিয়ার ৪০ জন কর্মচারী নিয়োগের কোটা দাবি করেন। কিন্তু তাতে রাজি হননি হাসপাতালের পরিচালক। এতে ক্রোধ হয় সাংসদের।
পদ ১৮১টি চৌদ্দদলের প্রধান দুই দল যদি ৭০+৪০=১১০টি নেয়, বাকি থাকে ৭১টি। অবশিষ্ট ১২ দলের ১১টি ছয়টি করে কোটা পেতে পারে। একটি দল পাবে পাঁচটি। পাঁচটি যে দল পাবে, তার নেতাদের মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক।
খুবই বিরক্তিকর বাস্তবতা হলো, ১৪ দলের বাইরে সরকারে নেই এমন দলও দেশে আছে। তাদেরও কিছু সমর্থক আছে। তারা ট্যাক্স দেয়। দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। তাদের সাংবিধানিক অধিকার ১৪ দলের লোকদের সমান। যোগ্যতা অনুসারে চাকরিবাকরি পাওয়া তাদেরও সাংবিধানিক অধিকার। তাদের চাকরি পেতে যদি ২০১৫ অথবা ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, তা হবে সরকারের দিক থেকে সংবিধান লঙ্ঘন করা। সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো আইনসংগত পেশা বা বৃত্তিগ্রহণের...অধিকার থাকিবে।’ ঐতিহাসিক পঞ্চম সংশোধনীর সময়ও এমন কোনো কথা যোগ করা হয়নি যে, ‘সরকারি দলগুলির লোকদের বাইরে অন্য কোনো দলের সমর্থক লোকদের যত যোগ্যতাই থাকুক তাহাদের সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো পদে নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সরকারি দলের বাইরের লোকদের চাকরির জন্য আবেদন করা আইনত দণ্ডনীয়।’
কর্মচারী নিয়োগে তাঁর সমর্থকদের কোটারি দাবিতে মাননীয় সাংসদ ‘গঙ্গাচড়া থেকে ১৫টি ট্রাকে সাত-আটশ জাপার নেতা-কর্মী নিয়ে মেডিকেল কলেজ ঘেরাও করতে আসেন। তাঁরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হাসপাতাল গেটে জমায়েত হন।...সেখান থেকে মিছিল নিয়ে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ নিয়ে প্রথমে পুলিশ ও জাপা নেতা-কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া বাধে। পরে সংঘর্ষে যোগ দেয় হাসপাতালের কর্মচারী ও এলাকার সাধারণ মানুষ।’ [দৈনিক সমকাল]
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চাকরির কোটার দাবিতে আসা মাননীয় সাংসদের ‘কর্মী-সমর্থকদের হাতে ছিল কাঁচা বাঁশের লাঠি।’ লাঠিগুলো যে সত্যিই কাঁচা বাঁশের ছিল তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে পত্রপত্রিকায় যে রঙিন ছবি ছাপা হয়েছে, তাতে উত্তোলিত বংশদণ্ডগুলোকে রীতিমতো সবুজ দেখা যাচ্ছে। ধূসর রঙের শুকনো বাঁশের লাঠি একটিও নেই। ঝাড় থেকে সদ্যকাটা বাঁশ দিয়েই তৈরি করা হয়েছে লাঠি। বাঁশ সাবাড় করে বিশেষ উদ্দেশ্যেই লাঠিগুলো তৈরি। এই কাঁঁচা বাঁশের লাঠি মেডিকেল হাসপাতালের পরিচালককে উপহার দেওয়ার জন্য যে তৈরি হয়নি, তা অনুমানেই আমরা বলতে পারি।
আমাদের সাধারণ লোকের বুদ্ধিতে যা বুঝি তা হলো, চাকরির দাবি খালি হাতেও এসে করা যেত। তবে একটি জিনিস আমরা অবশ্যই মূল্যায়ন করব তা হলো, রামদা, চাপাতি ও গোলাবারুদের চেয়ে কাঁচা বাঁশের লাঠি হাজার গুণে ভালো। লাঠি অন্তত হাত দিয়ে ঠেকানো সম্ভব। আমরা জানি, পানির ছিটা দিলে লগির বাড়ি খেতে হয়, ঢিল ছুড়লে পাটকেলটি খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাঁচা বাঁশের লাঠি নিয়ে কাকে মারতে এসেছিলেন জানি না, কিন্তু অনেকেই মার খেয়েছেন, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জখম হয়েছেন অনেকে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক যা তা হলো, মাননীয় সাংসদ নিজেই তাঁরই তৈরি কাঁচা বাঁশের লাঠির আঘাতে মাথা ফাটিয়ে এখন হাসপাতালে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে আক্রমণকারীদের রণনৈপুণ্যের ছবি তুলতে গেলে হাসপাতাল চত্বরে সাতজন সাংবাদিককে বাঁশ দিয়ে পেটান সাংসদের কর্মীরা। সাংবাদিকদের উদ্ধার করতে পুলিশ তাঁদের লাঠিপেটা করে। এক পর্যায়ে হাসপাতালের কর্মচারীরা এসে ধাওয়া দেন সাংসদ ও তাঁর লোকদের। সাংসদ শাহরিয়ারকে মাটিতে ফেলে কাঁচা বাঁশ দিয়ে পেটান কয়েকজন ক্ষুব্ধ কর্মচারী। ১২ জন পুলিশ, সাতজন সাংবাদিক, হাসপাতালের কর্মচারীসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। আতঙ্কে রোগী ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। কোনো রোগী অবশ্য হার্টফেল করে মারা যাননি।
কাঁচা বাঁশওয়ালাদের দল থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ২০১৪ সালে তাঁরা সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। আর বিরোধী দলে নয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিরোধী দলে থাকতে চায় তো থাকুক গিয়ে। তাহলে এই ধৈর্যচ্যুতি কেন? মাত্র দুটি বছরই তো!
সংসদীয় গণতন্ত্রে দুই রকম দল থাকে। এক শ্রেণীর দল ক্ষমতাসীন। আরেক শ্রেণীর দল সরকারের বাইরে, যার নাম বিরোধী দল। এর মাঝে বাংলাদেশে আছে আর এক রকম দল। সে দল যখন প্রয়োজন তখন সরকারি এবং সরকারে থেকেও যখন বিরোধীর ভূমিকায় অভিনয় করার প্রয়োজন তখন বিরোধী। এই রকম দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কয়েকটি আছে। এগুলো সরকারি দলও, বিরোধী দলও। এগুলোকে আমরা নামকরণ করতে পারি: সর-বিরোধী দল, আরও সংক্ষেপে সর্বিরোধী দল।
ক্ষমতায় যেতে চাইলে বেশি আসন, বেশি ভোট দরকার। ভারতবিরোধী যে ভোটগুলো আছে, তা বিএনপি থেকে শুধু নয়, আওয়ামী লীগ থেকেও নিজেদের দিকে আনা দরকার। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশের হতভাগ্য নদনদী।
ভারত সফর করে এসেই উত্তাল গতিতে ছুটছেন নেতা। নদনদীর প্রতি গভীর ভালোবাসা উথলে উঠেছে। দেশের মানুষের পানির অধিকারের প্রশ্নে তিনি মেধা পাটেকারের চেয়ে বেশি আপসহীন। গাড়িতে চড়িয়া নেতা করিছেন লংমার্চ। লংমার্চের কৃতিত্ব একচেটিয়া খালেদা জিয়াকে দেওয়া যায় না। তিস্তার পানির হিস্যা ও টিপাইমুখের জন্য অমূল্য জীবন দিতে প্রস্তুত। ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নদীতে চড়া পড়া নিয়ে লিখেছেন কাঁদো নদী কাঁদো। এখন লংমার্চের বাহার দেখে মৃতপ্রায় নদীগুলোকে আমরা বলব: হাসো নদী হাসো। আগামী নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের নদনদীরা আনন্দে ফেটে পড়বে। নদীদরদি নেতা বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছেন। এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে? তখন দেশবাসী তাঁকে ভূষিত করবে নতুন উপাধিতে: নদীবন্ধু। লংমার্চ শুরুর পর সেটা অবশ্য এখনো দেওয়া যায়।
একটি ছোট দুর্বল দেশ কত রকম অত্যাচার ও উপদ্রব সহ্য করবে? চারদিক হিংসায় সয়লাব। সেটা না হয় মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তার ওপরে ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রও না হয় প্রতিহত করা সম্ভব। কিন্তু মিথ্যাচার? প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, এমনকি প্রচারমাধ্যমের লোকদেরও মিথ্যাচারে বাধ্য করা হচ্ছে। হিংসা, ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচারও মেনে নেওয়া গেল। জনগণের সঙ্গে করা হচ্ছে নানা রকম প্রতারণা ও ছলচাতুরি। এসব তো আছেই, এর মধ্যে কেউ কেউ শুরু করেছেন তামাশা। এত উপসর্গ নিয়ে কীভাবে একটি জাতি টিকে থাকবে?
অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে গেছে, এরপর মানুষ বলবে, আমরা ভাত কাপড়, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, বাসস্থান কিছুই চাই না। আমাদের অন্তত একটুখানি সামাজিকভাবে শান্তিতে থাকতে দাও। আমাদের মনের ওপর অত্যাচার করার অধিকার কারও নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

প্রগতিশীল কর্মীদের জাতীয় সম্মেলনে মকসুদ -খালেদা মৌলবাদের, আর প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসের ‘মা’

বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দেশে ওসমানী রাজত্ব চাচ্ছে। আর বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া চাচ্ছেন গোলাম আযমীয় শাসন। এ অবস্থা আমরা মেনে নিতে পারি না।’
আজ শনিবার সকালে ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চে প্রবীণ বাম রাজনৈতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যের আয়োজনে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক কর্মীদের জাতীয় সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সৈয়দ আবুল মকসুদ এ কথা বলেন। আজ সকালে সম্মেলনটির উদ্বোধন করেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ রণেশ মৈত্র।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘খালেদা জিয়া দাবি করেন, তিনি একজন লিবারেল ডেমোক্র্যাট। অথচ তিনি সম্পর্ক রাখেন স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে। তিনি হচ্ছেন মৌলবাদের ‘মা’। আর সন্ত্রাসের মা হয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।’
সম্মেলনে জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমা বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকার তিন বছরে কোন ভালো কাজটি করেছে? সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করে তাঁর সরকার অগণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মুখোশ খুলে দিয়েছে। সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্র পরিচালনায় যারাই ঘুরে ফিরে আসছে, তাদের কেউই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মানুষের আশা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা নেয়নি।’
বামপন্থীদের নারায়ণগঞ্জের সেলিনা হায়াত্ আইভীর মতো বিকল্প শক্তি হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের শাসন থেকে মানুষ মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে কোথায় যাবে? বিএনপি-জামায়াত ছাড়া যাওয়ার জায়গা নেই। কেন আমরা বামপন্থীরা এক হয়ে বলতে পারি না, মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দিকে আসেন? আমরা দেশ পরিচালনার জন্য প্রস্তুত।’
সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক নুরুর রহমান, রানা দাশ গুপ্ত, কানসাট বিদ্যুত্ আন্দোলনের নেতা গোলাম রাব্বানী প্রমুখ।
তারিখ: ২৯-১০-২০১১ প্রথম আ্লো

হ্যাঁ-ভোট জয়যুক্ত হলো, হ্যাঁ-ভোট জয়যুক্ত হলো

বাহাত্তরের মূল সংবিধানের সঙ্গে চতুর্থ সংশোধনী-পরবর্তী সংবিধানের দূরত্ব দাঁড়ায় প্রায় ৪০ মাইল। পঞ্চম সংশোধনীর পর সেই দূরত্ব আরও বাড়ে, হয় ১৪০ মাইল। অষ্টম সংশোধনীর পর দূরত্ব গিয়ে দাঁড়ায় ২৮০ মাইল। পঞ্চদশ সংশোধনীর পর এখন যে সংবিধান, তার সঙ্গে বাহাত্তরের সংবিধানের দূরত্ব এগার শ মাইল: ঢাকা থেকে ডেরা ইসমাইল খাঁর (পাকিস্তানে) দূরত্ব যতটা। ৩০ জুন অপরাহ্নে যে সংবিধান গৃহীত হয়েছে, তা পৃথিবীর সংবিধানের ইতিহাসে এক অদ্বিতীয় দলিল।
এই সংবিধানে সবই আছে। ধর্ম আছে, ধর্মহীনতাও আছে। সৃষ্টিকর্তা আছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আছে, পাকিস্তানি আদর্শও আছে। সমাজতন্ত্র আছে সংবিধানের শুরুতে, ধর্মতন্ত্র আছে গোটা সংবিধানজুড়ে। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক বাঙালিত্ব আছে, বিমূর্ত জাতীয়তাবাদও আছে। সে এমনই এক জাতীয়তাবাদী মূলনীতি, যা ঘরে ঘরে ডিশ অ্যান্টেনা দিয়ে বিজাতীয় সংস্কৃতি চব্বিশ ঘণ্টা উপভোগের গ্যারান্টি করে দেয়। সংবিধানে সবই আছে, তবু মহাজোটের নেতাসহ সব দল ও সম্প্রদায় বলছে, কিছু কিছু কী যেন নেই। সে কারণে সবারই মন খারাপ।
তবে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও বিভিন্ন চর এলাকার ধর্মনেতাদের মন কেন খারাপ, তা বোঝা যাচ্ছে না। ধারণা করেছিলাম, পঞ্চদশ সংশোধনীর পর মগবাজারে জুসনে জুলুসের আয়োজন হবে। সেখানে সারা রাত কাওয়ালির মজলিস বসবে। পাকিস্তান থেকে আসবেন নামজাদা কাওয়াল। তাঁরা গাইবেন খুশির কাওয়ালি। কারণ, তাঁরা যা চান, তার সবই এই সংশোধিত সংবিধানে আছে: বিসমিল্লাহ থেকে রাষ্ট্রধর্ম—সবই অটুট। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তারাও হরতালের ডাক দিয়েছেন। ঘণ্টা ছয়েকের হরতাল নয়—৪৮ ঘণ্টার হরতাল।
এই সংশোধনী পাস হওয়ার পর চরমোনাইতে যখন খুশিতে ওরস হওয়ার কথা, সেখানে ইসলামী আন্দোলন পালন করল সারা দেশে আধা বেলা হরতাল। সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম থাকার পর তাঁরা আর কী চান? রাষ্ট্রধর্মের চেয়ে বেশি আর যা হতে পারত তা হলো ‘বিশ্বরাষ্ট্রধর্ম’। আর সংখ্যালঘুদের জন্য ‘উপরাষ্ট্রধর্ম’। যা হোক, সম্ভবত তাঁরা আরও হরতাল ইত্যাদিতে যাবেন। কারণ তাঁদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ তাঁদের ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস’ নড়িয়ে দিয়েছে। চরমোনাইয়ের নেতারা চান, বিশ্বাস ও আস্থাটা সর্বশক্তিমানের ওপরই থাকুক, আওয়ামী লীগের নেতাদের অবিচল আস্থা বিদেশি বন্ধুদের ওপর।
ওদিকে হরতালে না গিয়ে নয় ঘণ্টা অনশন কর্মসূচি পালন করেছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের কোনো প্রত্যাশাই পূরণ হয়নি। পরিষদ ও ফোরামের নেতারা পঞ্চদশ সংশোধনীকে সংগত কারণেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, ধর্মাশ্রয়ী এবং ধর্মীয় বিভাজনমূলক বলে তার প্রতিবাদ করেছেন। এই বঙ্গভূমিতে ‘ধর্মাশ্রয়ী’ হতে চায় না কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়? নিশ্চয়ই ধর্মীয় বিভাজনমূলক বিধি জঘন্য অপরাধ। তার কিছু উপাদান এই সংবিধানে আছে।
দুই বাম দল ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন ও জাসদের নেতা হাসানুল হক ইনু সংশোধনীর পক্ষে উচ্চ স্বরে ‘হ্যাঁ’ শুধু বলেননি, সম্মতিসূচক সইস্বাক্ষর দিয়ে ২৪ ঘণ্টা পরে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এই সংশোধনীতে তাঁরা শতভাগ সন্তুষ্ট নন। কমরেড মেনন বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় সরকারের আগ্রহ ছিল, কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি। বিএনপির উচিত ছিল আলোচনায় এসে তাদের প্রস্তাব দেওয়া।’
এককালে আমাদের নেতা ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ কমরেড মেনন যা বলেছেন, নীতিগতভাবে তা আমরা সমর্থন করি। অবশ্যই বিএনপির আলোচনায় যাওয়া এবং প্রস্তাব দেওয়া উচিত ছিল। সেই সঙ্গে সবিশেষ বিষয়ের সঙ্গে একটি প্রশ্নও তাঁকে করতে পারি: আপনারা সরকারের সঙ্গী ও সহযোদ্ধা, আপনারা যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেগুলো কি গ্রহণ করা হয়েছে? আপনারা সরকারের লোক হওয়া সত্ত্বেও আপনাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়েছে, সরকারের পরম শত্রুর অতি উত্তম প্রস্তাবগুলো যে অতি খুশিতে সরকার মেনে নিত, তার নিশ্চয়তা আওয়ামী লীগের কোনো সহসম্পাদকের কাছ থেকেও পেয়েছিলেন কি?
জাসদের সভাপতি ‘মহাজোটের ঐক্য অটুট রাখার ঘোষণা দিয়ে’ বলেছেন, ‘দেশের সংবিধান, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে রক্ষায় এ ঐক্য হয়েছে। জামায়াত ও তাদের দোসরদের প্রতিহত করতে এ ঝান্ডা তুলে ধরে ঐক্য চালিয়ে নেওয়া হবে।’ খালেদা জিয়ার সংঘাতের আশঙ্কার প্রত্যুত্তরে সাবলীলভাবে তিনি বলেছেন, ‘আসুন, আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত।’ এখন এই সংবিধান নিয়ে যুদ্ধ বা মারামারিতে জাসদ চুয়াত্তরের মতো প্রস্তুত থাকলেও জনগণ প্রস্তুত নয়। জনগণ ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং সে ভোট পৌরসভা নির্বাচনে এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তারা দিয়েছে। মহাজোটের ঝান্ডা বহন করার সঙ্গে সঙ্গে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। গত ৭৫ বছরে এবারই প্রথম ক্ষমতাসীন দল স্থানীয় নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছে। সুতরাং কার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হ্যাঁ-ভোট জয়যুক্ত হওয়ার এক দিন পর বলেছেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। আওয়ামী লীগের লক্ষ্য বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া। পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে সংবিধান সংশোধনে কিছুটা আপস করা হলেও ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে হুবহু বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাব।’ আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে চান, আড়াই বছরে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে। তখন হুবহু বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাবেন। বিসমিল্লাহ থাকবে না; রাষ্ট্রধর্ম থাকবে না; ইসলাম, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি শব্দযুক্ত কোনো সংগঠন থাকবে না, সব শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করা হবে ইত্যাদি।
বর্তমান সংবিধান যদি আমেরিকার সংবিধানের মতো টিকে যায় এবং যাবে বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মর্যাদা হবে ভারতের ইতিহাসে বাবা সাহেব আম্বেদকরের যে মর্যাদা, তা-ই। তাঁর ওপরই এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল এবং তিনি বছর খানেক তাঁর দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেছেন। সংশোধনীর এক দিন পর তিনি বলেছেন, ‘এমন একটা সংশোধনী আমরা পাস করলাম, যা দিয়ে কাউকেই খুশি করতে পারলাম না। না ডান, না বাম, আর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে তো নয়ই। কারণ আওয়ামী লীগ ডানও নয়, বামও নয়। এই দুইয়ের কেন্দ্রে রয়েছে আওয়ামী লীগ।’ তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, ডান ও বাম খুশি না হওয়ায় প্রতীয়মান হয়, আওয়ামী লীগ ঠিক কাজটিই করেছে।
সব দলের নেতাদের কথাই বলা হলো, বিএনপি বাদ থাকবে কেন? সংবিধান সংশোধনীতে বিএনপির নেতাদের নাখোশ হওয়ার কারণ বোঝা যায় না। ধারণা করেছিলাম, সংশোধনী পাস হওয়ার পর নয়াপল্টন, গুলশান ও লন্ডনে বিজয় মিছিল বের হবে। তাদের নেতার উপহার দেওয়া উপাদানগুলোর প্রায় সবই এই সংবিধানে অটুট রয়ে গেছে। এ তো তাদের বিরাট বিজয়।
তবে সংবিধান-অসংবিধান, সংশোধন-অসংশোধন কোনো ব্যাপার নয়। বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়। সে জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ধারাটি নিয়েই তাদের দুশ্চিন্তা। ওই ধারাটি ছাড়া সংবিধানের আর কী যোগ-বিয়োগ হলো, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। এমনও যদি হয় যে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে, কিন্তু তারপর বেগম জিয়ার, মির্জা আলমগীরের বেডরুমে বঙ্গবন্ধুর ছবি থাকবে—তাতেও তাদের আপত্তি নেই। এই সংশোধনীর ফলে জনগণের মৌলিক অধিকার সংকুচিত হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখেনি তারা। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় অনুভূতির প্রশ্নে হরতাল ডেকেছে। সেই হরতাল আধা বেলা নয়—দুই দিন দুই রাত।
এই সংশোধনীতে জাতীয় পার্টি এতটাই পরিতৃপ্ত যে জেনারেল এরশাদ জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে তাঁর দল এককভাবে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। এ জন্য ইতিমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে। সব আসনে প্রার্থী দেওয়ার জন্য তালিকা তৈরিও শুরু করা হবে।
এবারের সংশোধনীর ফলে যে সংবিধান রচিত হয়েছে, তাতে এরশাদ সাহেবের সাফল্য আকাশচুম্বী। তিনি যা যা করে গেছেন, তার সবই আছে এবং তিনি যেসব বদ জিনিস পছন্দ করেন না, তা বাদ গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কথাটি তাঁর কানে যাওয়া মাত্র তিনি ঘুমের মধ্যেও তড়াক করে লাফিয়ে ওঠেন। তাঁর কপালে পেরেক ঠুকেছিল যে জিনিস, তা যে উঠে গেছে, তাতেই তাঁর পরম শান্তি। হয়তো এই একটি কারণেই শেষ পর্যন্ত তিনি শেখ হাসিনাকে আর একটি নির্বাচনে সমর্থন দিতেও পারেন। কিন্তু যদি জনমত তাঁর ভাবির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তাহলে প্রথমে ‘একাই নির্বাচন করব’ বলে মহাজোট থেকে বেরিয়ে যাবেন; তারপর দুই-তিন দিন এ-কথা সে-কথা বলে সাংবাদিকদের বিভ্রান্ত করে বলবেন, ‘নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। সুতরাং চললাম পাঁচদলীয় জোট গঠনে।’
এই সংবিধান পেয়ে শুধু যে ধর্মওয়ালা রাজনীতিকদের সুবিধা, তা-ই নয়, ধর্মের বিরুদ্ধে যাঁরা জিহাদ ঘোষণা করতে চান, তাঁদেরও পোয়া বারো। নিজামী-আমিনীসহ বিভিন্ন চর এলাকার পীর সাহেবরা তাঁদের বিরুদ্ধে আট ঘণ্টা নয়, আমরণ অনশন করলেও কাজ হবে না।
ছত্রিশ বছর পর সমাজতন্ত্র ফিরে আসায় বামরা খুশি। তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, বিষ্যুদবার বিকেল থেকে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যেকোনো সময় সরকার কোনো ডায়িং কারখানা অথবা ঢাকা-বরিশালগামী দোতলা স্টিমার লঞ্চ রাষ্ট্রায়ত্ত করতে পারবে। বাম নেতাদের ভয় নেই, কারণ তাঁদের কোনো নেতা অ্যাঙ্গেলসের মতো কারখানার মালিক নন।
বিষ্যুদবার দুপুর দুইটা ৫০ মিনিটে সংসদে বিভক্তি ভোটে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। পক্ষে ২৯১ ভোট, বিপক্ষে মাত্র একটি। বাংলার ঘরে ঘরে টেলিভিশনে মানুষ দেখল, ধ্বনিত হচ্ছে: হ্যাঁ-ভোট জয়যুক্ত হলো, হ্যাঁ-ভোট জয়যুক্ত হলো, হ্যাঁ-ভোট জয়যুক্ত হলো। কে জয়ী হলো, কে পরাজিত হলো, তা বাংলার মানুষ বুঝে ওঠার আগেই যা হওয়ার, তা-ই হয়ে গেল। তবে মাননীয় স্পিকার থেকে জানা গেল, ‘বরাবর রাতের বেলা সংবিধান সংশোধন পাস হয়েছে। এবারই হলো দিনের বেলায়।’ চতুর্থ সংশোধনী পাসের সময় আমি সংসদ গ্যালারিতে ছিলাম। ওটা দিনেই হয়েছিল। অবশ্য যা কিছু রাতে ঘটে, তার সবই খারাপ, তা বলা যাবে না। জীবনের বহু অপরিহার্য ও মধুর কাজ রাতেই হয়।
জীব, উদ্ভিদ, জড়জগৎসহ প্রত্যেক দেশের একটি ভূগোল আছে। খুব বড় বিপর্যয় ছাড়া তা অপরিবর্তনীয়। কিন্তু একটি রাষ্ট্র তার সংবিধান পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড ও জার্মানি এখন যেমন আছে, তা থাকবে না যদি আগামীকাল তাদের সংবিধান সংশোধন করে সৌদি আরবের মতো রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক দেশের সংবিধান একটি চটি বই বটে, কিন্তু তার ওজন এক মণের ওপর। সংবিধান কড়ি দিয়ে কিনলাম-এর মতো কোনো উপন্যাস নয়, শাহনামার মতো মহাকাব্য নয়, রবীন্দ্র-নজরুল রচনাবলিও নয়। এর প্রতিটি বাক্য অতি অর্থবহ। রাষ্ট্রীয় জীবনে তার সুষ্ঠু প্রয়োগ না করা সর্বোচ্চ মাত্রার রাষ্ট্রবিরোধিতা।
বিষ্যুদবার বিকেল থেকে বাংলাদেশ যে সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, তার চরিত্র অনেকটা সৌদি রাজতন্ত্রের, খানিকটা গাদ্দাফির লিবীয় সোশ্যালিস্ট জমহুরিয়ার, খানিকটা ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবার, খানিকটা প্রয়াত কিম ইল সুঙ ও তাঁর ছেলের উত্তর কোরিয়ার, আর খানিকটা নরোদম সিহানুকের কাম্পুচিয়ার। কিন্তু যে তিন রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এখন সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যাবে, তা হলো কারজাইয়ের আফগানিস্তান, মালিকির ইরাক ও জারদারির পাকিস্তান। অন্যদিকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মিল নেই ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে।
বর্তমান সংবিধানটি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে—একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটি ছাড়া।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

নভেম্বর উপাখ্যানের এপিঠ-ওপিঠ

লিখতে বসেছিলাম এক বিষয়ে। সে লেখা সরিয়ে রাখতে হলো। নভেম্বরের প্রথম সাত দিনের ১০টি দৈনিকের ৭০টি সংখ্যা পড়ে মনে হলো, প্রসঙ্গ পাল্টানো দরকার। একটি জাতির সংবাদমাধ্যম যদি ৩৫ বছর পর ভোল পাল্টাতে পারে, রাজনৈতিক নেতারা যদি ভোল পাল্টাতে পারেন, একজন উপসম্পাদকীয় লেখকের পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রসঙ্গ পাল্টাতে অসুবিধা কোথায়?
খুব বড় মিলিটারি রেজিমেন্টেশনের মধ্যে ইতিহাস গায়েব করা হয় অথবা বিকৃত করা হয় এবং সত্য ধামাচাপা দেওয়া হয়। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে এবং সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় ইতিহাসকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলার দৃষ্টান্ত শুধু বাংলাদেশেই পাওয়া যাবে। কঠোর সামরিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রে সাংবাদিককে সত্য চেপে যেতে হয়। কিন্তু গায়ে পড়ে সত্য গোপন করা অতি নিন্দনীয় কাজ। আজ বাংলার রঙ্গমঞ্চে কুশীলবদের রাজনীতির অভিনয় দেখে ক্ষুধিত পাষাণ-এর পাগলা মেহের আলীর মতো বলতে ইচ্ছা হয়: ‘তফাত যাও! তফাত যাও! সব ঝুট্ হ্যায়! সব ঝুট্ হ্যায়!’ আজ বাংলাদেশে যাঁদের বয়স ৬০-এর ওপরে, তাঁদের অধিকাংশের অবস্থা পাগলা মেহের আলীর মতো।
১৯৭৫-এর নভেম্বরের প্রথম হপ্তায় অ্যাবসার্ড নাটকগুলো অভিনীত হয়েছে এখনকার ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষদের সামনে। তাঁরা সব দেখেছেন, তাঁরা সব জানেন। এখন আর নতুন কিছু যোগ করা যাবে না।
বাঙালি স্বার্থসিদ্ধির জন্য সব সময়ই একজন নন্দ ঘোষ খোঁজে। নিজের দোষ তার ওপর চাপিয়ে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বাঙালি দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মহাজোট সরকারের আমলে জিয়াউর রহমানকে নন্দ ঘোষের ভূমিকায় বসানো হয়েছে। অবশ্য জিয়া ও এরশাদের সময় নন্দ ঘোষ ছিলেন অন্য কেউ।
পঁচাত্তরের পরবর্তী ৩১ বছর নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে অজস্র সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলোতে। প্রকাশিত হয়েছে রাশি রাশি প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকার। সেগুলো যদি বন্দুকের নলের মুখে প্রকাশিত না হয়ে থাকে, তাহলে সেসবকে অগ্রাহ্য করা যাবে না।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজের প্রধান গুণই হলো বিশুদ্ধ যুক্তিবাদিতা। কোনো রাষ্ট্রে তা যদি না থাকে, তাহলে জাতীয় জীবনকে অন্ধত্ব গ্রাস করে। সেখানে সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকে না। সেখানে বৈজ্ঞানিক চিন্তার সুযোগও থাকে না। শিক্ষা-সংস্কৃতির অমূল্য উপাদানগুলো চূর্ণ হয়ে যায়। সে অবস্থায় বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে ইতিহাসের নামে বহু রকম কল্পকথা প্রচারিত হয়। তা প্রচারিত হয় কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের অথবা সুবিধাভোগীদের স্বার্থে।
পঁচাত্তরের নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অপরিহার্য অংশ। ওই ঘটনাপ্রবাহের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ছাড়া, কল্পকথা ছড়িয়ে জাতির কোনো উপকার হবে না। কাগজে বা বইপত্রে যা লেখা হলো তা-ই ইতিহাস নয়, মানুষ যা জানে, তা-ই ইতিহাস। মার্কিন দলিলপত্রের মাধ্যমে মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোয় যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচনায় তা সহায়ক। কিন্তু মার্কিন কূটনীতিকদের পাঠানো প্রতিবেদনই ইতিহাস নয়—ইতিহাসসংক্রান্ত মন্তব্য প্রতিবেদন, যে প্রতিবেদন লিখিত হয়েছে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও বিভিন্ন প্রচারপত্রের ভিত্তিতে। সেই সঙ্গে আছে ওই প্রতিবেদন প্রেরকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। ইতিহাস রচনা করতে চাইলে তখনকার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মূল প্রচারপত্র-লিফলেটের সাহায্য নিতে হবে।
বাংলাদেশের পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতি একটি যৌথ রাজনৈতিক প্রকল্প—কোনো এক ব্যক্তি বা একাধিক ব্যক্তির কাজ নয়। যে রাজনীতির প্রবর্তনে গোটা দেশের অধিকাংশ মানুষের নীরব অথবা প্রকাশ্য সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল। তা না থাকলে কোনো ব্যক্তি, তা তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শক্তিমান মানুষও যদি হন, টিকে থাকতে পারতেন না। যৌথ প্রকল্প না হলে ওই ধারার রাজনীতি ২১টি বছর বা তারও বেশি টিকে থাকত পারত না।
নভেম্বর উপাখ্যান সম্পর্কে প্রথম আলোয় দুই দলের দুই জেনারেলের সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে। মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূরণ ও ক্ষমতা সংহত করতেই সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেন।’ তাঁর এই বক্তব্য থেকে ১২-১৪ বছর বয়স্ক যেকোনো পাঠক মনে করবে, যেকোনো জেনারেলই ইচ্ছা করলে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেন। একজন জনপ্রিয় জেনারেল তাঁর বাহিনীকে ব্যবহার করতেই পারেন, অন্যদিকে দুর্বল ও ব্যর্থরা অধীনস্থের অধীনে গোলামি করেন। একজন সেনাশাসক সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করবেন না তো কি রাস্তার হকার, পত্রিকার উপসম্পাদকীয় লেখক, কবি, নাটকের কলাকুশলী বা ট্যাক্সি ড্রাইভারদের ব্যবহার করবেন?
১৭ আগস্ট আমি বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থার মহাব্যবস্থাপক ও সম্পাদক জাওয়াদুল করীমের সঙ্গে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। সেখানে বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে দৃশ্য দেখেছিলাম, তা আজ অবিশ্বাস্য মনে হয়। আমার কাছে তখন ‘বিশ্বাসঘাতক’ বা ‘নিমক হারাম’ শব্দ দুটিকে বাঙালির জন্য যথেষ্ট শক্ত শব্দ মনে হয়নি।
দিনের পর দিন সেনাবাহিনীর কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমে ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছেন। ৭ নভেম্বর উপলক্ষে জেনারেল সফিউল্লাহর স্মৃতি রোমন্থন অথবা পর্যবেক্ষণ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। কারণ, মানবজাতির ইতিহাসে তিনিই একমাত্র সেনাপতি, যিনি ১০টি দিন তিন-চারজন মেজরের অধীনে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করেছেন। এবং সেই মেজররাই তাঁকে, তাঁর ভাষায়, ‘বরখাস্ত’ করেন। তিনি নিজেই বলছেন, ‘বরখাস্ত’, আমরা জানি তাঁকে ‘অবসর’ দেওয়া হয়েছিল। সে জন্যই এখন ‘অব’ লেখা হয়, ‘বরখাস্ত’ লেখা হয় না। তিনিই একমাত্র সেনাপ্রধান, যিনি দুজন রাষ্ট্রপতির অধীনে বহুকাল রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেন—যে দুই রাষ্ট্রপতি একসময় ছিলেন তাঁরই অধীনে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়ে যাওয়ার আগে তিনি যে জবানবন্দি দেন, তা আমাদের অনেকের কাছে আছে। জিয়াউর রহমান বা জেনারেল এরশাদের মতো সামরিক শাসকদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞ থাকার কারণ নেই, সফিউল্লাহর তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। মোশতাক-জিয়া তাঁকে চাকরি দিয়েছেন এবং কখনোই জিয়া তাঁকে কূটনীতিকের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেননি। এটা জিয়ার কম উদারতা নয়।
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের যদি কৃতজ্ঞতাবোধ না থাকে, সৌজন্যবোধ না থাকে ও উপকারী বন্ধুর উপকারের ঋণ তারা স্বীকার না করে—তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। আমাদের মতো মধ্যশ্রেণীর মানুষকে জীবনের বিশেষ বিশেষ অবস্থায় সুখ-শান্তিতে থাকার জন্য আপস করতে হয়। বিত্তবান ও সবলের কাছে নত হতে হয়। মেরুদণ্ড সোজা রাখা যায় না। তা যে বড় দোষ, তা-ও নয়। জিয়ার অব্যাহত নিন্দা সফিউল্লাহর মুখে শোভনীয় নয়।
পঁচাত্তরের নভেম্বর সম্পর্কে মার্কিন দলিল গুরুত্বপূর্ণ; তার চেয়ে বেশি মূল্যবান সেই সময়ের রাজনৈতিক দলগুলোর দলিল, প্রচারপত্র প্রভৃতি। খালেদ মোশাররফের দোষ স্খলনের একটা চেষ্টা চলছে কয়েক বছর ধরে, এখন হচ্ছে তাঁকে একজন চমৎকার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আয়োজন। মিজানুর রহমান খান তাঁর ‘১৯৭৫ নভেম্বর মার্কিন দলিল ৫’-এ লিখেছেন, ‘রব-জলিল এক যৌথ বিবৃতিতে খালেদ মোশাররফকে “বিশ্বাসঘাতক” এবং “ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকার উসকানিতে বাংলাদেশের অস্তিত্ব মুছে ফেলার চক্রান্ত” করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন।’ হাসানুল হক ইনু এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা জাসদের কোনো দলিলে কখনো খালেদ মোশাররফ সম্পর্কে এমন মত দেইনি।...তবে তিনি উচ্চাভিলাষী, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ও সামরিক শাসনের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠাকারী।’ ইনু সাহেবের শেষ বাক্যটির সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নেই, কিন্তু প্রথম কথাটি সঠিক নয়। জাসদের অসংখ্য প্রচারপত্র প্রমাণ দেয় মিজানুর রহমান খানের কথাই ঠিক। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, তাঁদের এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল: ‘১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আধিপত্যবাদী ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সহায়তায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল। জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হলো না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহত অগণিত মানুষের জমাট রক্তের বিনিময়ে সুখের সৌধ নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ল নব্য বুর্জোয়া শাসক ও শোষকগোষ্ঠী। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের কাঁধে ভর দিয়ে ক্ষমতা আত্মসাৎ করল মুজিবেরই এককালীন দোসর খোন্দকার মোশতাক, ৩রা নভেম্বর আবার ঘটল সামরিক অভ্যুত্থান, কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ভারত-রাশিয়ার প্ররোচনায় প্রতিক্রিয়াশীল মহল দেশ ও জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বকে চিরতরে বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র করল; তারপর ঐতিহাসিক ৭ই নভেম্বরে জাসদ ও বিপ্লবী গণবাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতায় সেনাবাহিনীর বিপ্লবী জওয়ানরা মহান সিপাহি অভ্যুত্থানে ফেটে পড়ল; কিন্তু আবার দেশি-বিদেশি শোষকরা জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো, অর্জিত হলো না লক্ষ্য,...।’
ক্ষণিকের জন্য রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করতে গিয়ে দরজার কাছ থেকেই খালেদকে বিদায় নিতে হয়। কিন্তু দেশের সর্বনাশ অর্ধেক করেছিলেন মোশতাক ও মেজররা, বাকি অর্ধেক সম্পন্ন করলেন খালেদ। মোশতাকের সময় ইসলামি চেতনা জোরদার হয়, কিন্তু ভারতবিরোধী জিগির ছিল না। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী চেতনা সুদৃঢ় করে যান খালেদ। সেই চেতনা ব্যবহার করে জিয়া পাঁচ বছর, এরশাদ নয় বছর এবং খালেদা পাঁচ-পাঁচ ১০ বছর ক্ষমতায় থাকেন। নিজের ক্ষমতা পোক্ত করতে আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করতে গিয়ে খালেদ আওয়ামী লীগকে ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যবস্থা করে যান। আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি খালেদ করেছেন আর কেউ তা করেননি। তিনি ভারতপন্থী—নিজেই এ কথা চাউর করে দিয়েছিলেন এই আশায় যে তাতে ভারত সামরিক সাহায্য নিয়ে তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ভারতীয় নেতারা এত কাঁচা নন। কিন্তু ফল যা হওয়ার তা-ই হলো। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন হয়ে গেল বহুদিনের জন্য। দুই বন্ধু প্রতিবেশীর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেল। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে একটি নতুন রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের জন্ম হয় ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বরের তিন দিনে। সেই মনস্তত্ত্ব থেকে জাতি এখনো মুক্ত নয়।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ও ৩-৭ নভেম্বরের দিনগুলো আকাশ থেকে হঠাৎ পড়েনি। সব ঘটনারই একটি পটভূমি থাকে। ওই ঘটনাপ্রবাহেরও একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৭৪-এর ১৩ অক্টোবর জাসদ গণ-আন্দোলনের ডাক দেয় এবং ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী হরতালের আহ্বান জানায়। হরতাল ও গণ-আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের প্রচারপত্রে বলা হয়: ‘ভারতের আধিপত্যবাদী, রাশিয়ার সংশোধনবাদী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সকল চক্রান্ত ও অশুভ প্রভাবের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পূর্ণ বিধানের জন্য; সাম্রাজ্যবাদ ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় সরকার গঠন।’
১৯৭৩-৭৪-এ প্রধান বিরোধী দল ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) ও জাসদ। সরকারের সঙ্গে এই দুই দল ও অন্যান্য বাম দলের সম্পর্ক কেমন ছিল, তা আলোচনা ছাড়া পঁচাত্তরের আগস্ট-নভেম্বরের আলোচনা সম্পন্ন হতে পারে না। ১৯৭৩-৭৫-এ ন্যাপ, জাসদ ও বিভিন্ন বাম দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী ছিলেন কারাগারে। তাঁদের জেলে ঢোকাতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের যাঁরা পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজও ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং দাঁত বের করে হাসেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে চলে যেতে হলো।
অপ্রীতিকর সত্য আলোচনা করে যত খোলাসা করা যায়, তত গণতন্ত্রের উপকার। চাটুকারিতা করে বর্তমান মহাজোটের অসাম্প্রদায়িক সরকারকে সংহত করা যাবে না। তাতে সরকারের বরং ক্ষতি হবে। ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পরে সেই দায় কেউ নেবেন না।
বাস্তবতাকে অস্বীকার করা বোকামি। বোস্টার বোকা ছিলেন না। তাই তিনি তাঁর ছাদের ওপর থেকে তাকিয়ে দেখে লিখেছিলেন: ‘জেনারেল জিয়া ৭ নভেম্বর সম্পূর্ণ ক্ষমতা করায়ত্ত করার একটি চমৎকার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি চাইলেই ক্ষমতা নিতে পারতেন। রাজপথে আমরা ৭ নভেম্বর যা দেখেছি, তা যদি কোনো অর্থ বহন করে থাকে, তাহলে এটাই প্রমাণ দেয়, জিয়ার ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।’
রাজপথে মি. বোস্টার সেদিন যা দেখেছিলেন, তা আর কারও কাছে অর্থ বহন করুক আর না করুক, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কাছে খুবই অর্থবহ ছিল। সেনাবাহিনীর একজন জনপ্রিয় মানুষই তাঁরা খুঁজছিলেন। তা তাঁরা পেয়ে গেলেন ৭ নভেম্বর। শুধু বোস্টার পাননি, বাংলার মাটির বাম ও অতি ডান সংগঠনের নেতারাও পান। জিয়ার নিজের কোনো শক্তি ছিল না। তাঁর শক্তির উৎস ছিল সোভিয়েত বলয়ের বাইরের গোটা পুঁজিবাদী বিশ্ব, মধ্যপ্রাচ্য এবং দেশের ভেতরের বিভিন্ন ক্ষুদ্র শক্তি। চীন তাঁর পক্ষে দাঁড়ায়। তা ছাড়া ১৯৭৫-৭৬-এ দেশের ভেতরে জিয়ার এতই বন্ধু ছিলেন, যাঁদের সংখ্যা প্রথম আলোর বন্ধুসভার সদস্যদের চেয়ে বেশি।
১৬ নভেম্বর জিয়ার সমর্থনে এগিয়ে আসে পাঁচটি বাম সংগঠন: পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল (এম-এল), পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এল-এম), পূর্ব বাংলার গণবিপ্লবী পার্টি এবং কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ। তারা তাদের ‘ভারত-রাশিয়ার নয়া চক্রান্তকে ব্যর্থ করুন’ শীর্ষক প্রচারপত্রে বলে: ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর মূল নেতৃত্ব ভারতের এজেন্ট হিসেবে বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহিতার ভূমিকা পালন করলেও বহু দেশপ্রেমিক তাঁদের সমাজতন্ত্র ও ভারতবিরোধী স্লোগানের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে এখনো সেই সংগঠনে অবস্থান করছেন। তাঁদের কাছে আমাদের আহ্বান, আপনারা দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজ দলের নেতৃত্বের কার্যকলাপ বোঝার চেষ্টা করুন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করুন।’
১৪ নভেম্বর পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল এক প্রচারপত্রে বলে: ‘জাসদের অভ্যন্তরস্থ দেশপ্রেমিক ভাইদের প্রতি আমাদের আহ্বান; আপনারা সংগঠনের ভিতরের বিশেষ করে ভারত-রাশিয়ার ও অপর বিদেশি শক্তির দালালদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, তাদের বিতাড়িত করুন।...হিন্দু ভাইবোনদের প্রতিও আমাদের বিশেষ আহ্বান; আপনাদের দুঃখ-দুর্গতি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্বেষমূলক আচরণ থেকে মুক্তি লাভের জন্য ভারতের ইন্দিরা সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবেন না।’
জিয়ার সেদিন কোনো দল ছিল না, তাঁর কাজ অন্য দলের নেতারাই করে দেন। পূর্ব বাংলার গণবিপ্লবী পার্টি, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, বিভিন্ন ছাত্র, যুব ও শ্রমিক সংগঠন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতারা জিয়ার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ান। কোনো কোনো সংগঠনের প্রচারপত্রের ভাষা লোমহর্ষক অথবা ঘৃণা উদ্রেককারী। সফিউল্লাহ যে বলেন, জিয়া কিচ্ছু না, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন, তা বড়ই করুণ শোনায়। দেশের ভেতরে তাঁর জনপ্রিয়তা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে আমেরিকার পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ওআইসি গঠিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনার একজন নেতা নির্বাচিত হতেন না।
শত্রুকে নিন্দা করারও একটা ভাষা আছে, একটা রীতি আছে। তার বাইরে গিয়ে কিছু করলে শত্রু উপকৃত হয়। শেখ হাসিনাকে খুশি করতে গিয়ে অনেকেই যা করছেন, তাতে জিয়ার উপকার হচ্ছে।
আরেকটি কথা বলে শেষ করতে চাই। বাংলার সংগ্রামী রাজনীতির ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের সীমাহীন ত্যাগের বিনিময়ে। দেশের বারো মাসের নয় মাসের সংবাদপত্র পড়ে মনে হবে—এই দেশের নেতা হলেন কয়েকজন ক্ষমতালোভী ও নষ্ট সেনা কর্মকর্তা। প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের কোনো প্রচার নেই। মিডিয়ায় জামায়াত নেতা গোলাম আযম ও বিভিন্ন চরের পীরেরা যে প্রচার পান, তার এক শ ভাগের এক ভাগ পান না তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা শেখ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। মিডিয়াকে নজরুলের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ।
 সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

বই ও বইমেলা: বাঙালির সৃষ্টিশীলতা ও জ্ঞানচর্চা

বইমেলা নামটি সার্থক। বাংলা একাডেমী চত্বরের মেলাটি বইয়েরই মেলা। তার সঙ্গে সাহিত্যের—বাংলা সাহিত্যের এবং বাঙালির মননের ও জ্ঞানজগতের সম্পর্কও আছে। ওই মেলায় বেত-বাঁশ ও মাটির তৈরি হস্তশিল্প অথবা ফ্রিজ-টিভি-প্রেশার কুকার প্রভৃতি কিংবা বস্ত্রশিল্প বিকিকিনি হয় না। বই বিক্রি হয়। সুতরাং তা বইয়েরই মেলা।
বইয়ের সংজ্ঞা কী? কিছু লেখা ছাপাখানায় কাগজে ছেপে পিচবোর্ড দিয়ে বাঁধাই করে মলাট পরানোর পর যে বস্তুতে পরিণত হয়, তার নাম বই। সব বইয়ের—অধিকাংশ বইয়ের—বিষয়বস্তু সাহিত্য নয়; সব সাহিত্যকর্মই রচিত হওয়ার পর একসময় বই আকারে প্রকাশিত হয়। মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে হাতে লিখে তৈরি হতো বই। প্লেটো, অ্যারিস্টটল, ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন, কৌটিল্য, ওমর খৈয়াম, বৈষ্ণব কবিদের পদাবলি পাঁচ শ বা এক হাজার কপি ছেপে সুদৃশ্য মলাটশোভিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি বই আকারে।
সাহিত্য অতি পুরোনো জিনিস, বইয়ের বয়স কম। শেক্সপিয়ারের নাটক ও সনেটগুলো রচিত হয়েছে আগে, বই হয়েছে বেশ পরে। বৈষ্ণব পদাবলি খাঁটি বাংলা সাহিত্য। বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, চণ্ডীদাসের পদাবলি রচিত হয়েছে আগে, রচয়িতারা বই প্রকাশের কথা চিন্তাও করেননি, কিন্তু তা সংকলিত হয়ে ‘বই’ আকারে বেরিয়েছে বহু পরে।
সাহিত্য—সৃষ্টিশীল রসের সাহিত্য অথবা জ্ঞানের সাহিত্য কী? মানবমনের সূক্ষ্ম আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটে সৃষ্টিশীল বা রসের সাহিত্যে—কবিতায়-গল্পে-নাটকে-গানে। জ্ঞান ও গভীর চিন্তার প্রকাশ ঘটে মননশীল সাহিত্যে। জ্ঞানদাস জ্ঞানের কথা বলেন না, ভাবের কথা ও রসের কথা বলেন: ‘মেঘ যামিনি অতি ঘন আন্ধিয়ার/ ঐছে সময়ে ধনি কর অভিসার।’ অথবা বড়ু চণ্ডীদাস বলেন: ‘সজনি কি হেরিলুঁ যমুনার কূলে।/ ব্রজকুলনন্দন হরিল আমার মন/ ত্রিভঙ্গ দাঁড়াইঞা তরুমূলে।’ মধ্যযুগের সৈয়দ মোর্তজা মন্দ বলেননি: ‘ভুবন মোহন রূপ অতি মনোহর।/ ঝলমল করে রূপ দেখিতে সুন্দর।’ এগুলোর নাম কবিতা অর্থাত্ সাহিত্য।
জ্ঞানের কথা বা বিজ্ঞানবিষয়ক বইও সাহিত্য। ইবনে সিনার ‘কানুন’ মহাবিজ্ঞান সাহিত্য। ইবনে খালদুন নাগরিক সমাজের ধারণা নিয়ে লিখেছেন কোনো রকম গোলটেবিল না করেই। তাঁর ‘মুকাদ্দিমা’ সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মহাসাহিত্য। একালের ডি. ডি. কোশাম্বি বা রোমিলা থাপারের বইগুলোও উঁচুমানের ইতিহাস-সাহিত্য। কার্ল মার্ক্স ও অর্মত্য সেনের বই অর্থনীতি-সাহিত্য। বাতাসে ভেসে থাকা লালন সাঁইয়ের গানগুলো বইয়ে ধারণ করা হয়েছে। এখন তা অমূল্য মরমি ও মানবতাবাদী সাহিত্য। এ-জাতীয় বই যে মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রি হয়, তার নাম বইমেলা।
জ্ঞানের জগতের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। জীবন ও জগেকন্দ্রিক যেকোনো বিষয়ই জ্ঞানের বিষয়। উইলিয়াম মাস্টার্স এবং ভার্জিনিয়া জনসনের Human Sexual Response নর-নারীর যৌনতা বিষয়ে মহাগ্রন্থ অর্থাত্ যৌনবিজ্ঞানসাহিত্য। ছদ্মনামে লেখা একান্ত গোপন কথা বা বাসরঘরে নরনারীর করণীয় শীর্ষক বইকে জ্ঞানজগতের কোনো শ্রেণীতেই ফেলব না। ইসলামি ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বই হয় কিন্তু ‘দোয়া-তাবিজের ফজিলত’ যদি কোনো বইমেলায় বেচাকেনা হয় তখন হতবাক হতে হয়। আলালের ঘরের দুলাল অথবা হুতুম পেঁচার নকশা সাহিত্য, কিন্তু তোরে নিয়াই ঘর করব বা স্বামী সোহাগিনীর মনের কথার লেখককে তাঁর বই বিক্রি করার গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সাধ্য আমাদের নেই, কিন্তু জাতীয় বইমেলায় যখন ওসব বেচাকেনা হবে তখন আমাদের আপত্তি। তা ছাড়া বই মানেই নির্ভুল ও সুলিখিত বই—যা খুশি তা-ই নয়।
আমাদের বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণের একুশে বইমেলা নিয়ে বড় বেশি কথা হয়। কথা বলেন লেখক, প্রকাশক, পাঠক, প্রচ্ছদশিল্পী; এবং যাঁরা বই কেনেনও না, পড়েনও না; মেলায় ঘুরে বেড়ান—সেই সব ভবঘুরেও। পত্রপত্রিকার একটি কোনা তাদের কথা বলার জন্য একটি মাস বরাদ্দ থাকে। টিভি চ্যানেলেও দেয় কিছুটা সময়। হেনরি জেমস বা জেমস জয়েস বা টমাস মান সারা জীবনে যত সাক্ষাত্কার দিয়েছেন, আমাদের লেখকেরা ফেব্রুয়ারি মাসে মেলা সম্পর্কে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি সাক্ষাত্কার দেন। পেঙ্গুইনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার অ্যালেন লেন জীবনে কোনো সাক্ষাত্কার দেননি, আমাদের প্রকাশকেরা দেন ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিন। লেখককে রয়্যালটির টাকা দেওয়ার চেয়ে সাক্ষাত্কার দেওয়া সহজ।
বিখ্যাত লেখকেরাও বলছেন, এটা ‘প্রাণের মেলা’। ফ্র্যাঙ্কফুর্ট, তেহরান, বেইজিং, দিল্লি বা কলকাতার বইমেলা প্রাণহীন জড় পদার্থের মেলা নয়। বিনা পয়সায় ঢোকা যায় বলে দলবেঁধে মেলার মধ্যে যতক্ষণ খুশি ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে প্রাণের প্রকাশ কিছু থাকলেও থাকতে পারে, অলস সময় কাটানোর প্রবণতার প্রকাশই বেশি ঘটে।
কেউ কেউ বলছেন, বাংলা একাডেমীর বইমেলা একুশের ‘প্রত্যক্ষ ফসল’। কথাটার মধ্যে সামান্য সারবস্তু আছে—সম্পূর্ণ সত্য নেই। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে এই বইমেলার সম্পর্ক আছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। তা হলে তো ১৯৫৩-তেই বইমেলা শুরু হতো। প্রকাশকদের উদ্যোগে এবং বাংলা একাডেমীর পৃষ্ঠপোষকতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বইমেলা বিকশিত হয়েছে গত তিন দশকে।
আমার মনে পড়ে, ষাটের দশকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সরদার জয়েনউদ্দীনসহ আরও কারও চেষ্টায় ‘শিশু গ্রন্থমেলা’ ঢাকায় হয়েছে। বাংলাদেশে বইমেলার সূচনা কীভাবে হয়েছে, তা নানা ঝামেলায় থাকার ফলে আমাদের গুণীজনদের অনেকেই অবগত নন। তবে কারও কারও নিশ্চয়ই মনে আছে, ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ‘প্রগতি প্রকাশন’-এর বিপুল বই আমদানি করা হতো। তার মধ্যে অনেক মূল্যবান বই ছিল। রুহুল আমিন নিজামীর স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স এবং ঝিনুক প্রকাশনী থেকে রবীন্দ্রনাথ ও শরত্চন্দ্রের বইয়ের সুলভ সংস্করণ বের হয়েছে। ওসব প্রতিষ্ঠানের অবিক্রীত বই বেশি কমিশনে বিক্রির ধারণা থেকে ঢাকায় একুশে ফেব্রুয়ারির সময় রাস্তায় চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু হয় ১৯৬৯-এ। ১৯৭২ থেকে শহীদ মিনারের আশপাশে এবং বাংলা একাডেমীর রাস্তার পাশে সোভিয়েত ইউনিয়নের বই, মুক্তধারা এবং সম্ভবত তাজুল ইসলামের বর্ণমিছিল ও অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের বই বিক্রি হতে থাকে।
আত্মপ্রসঙ্গে কথা বলা খুবই নিম্নরুচির পরিচায়ক। বাধ্য হয়ে কখনো তা করতে হয়। আজ থেকে নয় বছর আগে প্রথম আলোতে আমার এই উপসম্পাদকীয়র আস্ত একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম চিত্তরঞ্জন সাহা সম্পর্কে। তখন তিনি হাসপাতালে মরণাপন্ন। দীর্ঘ লেখাটি পড়ে দাদা আমার ছেলের, যাকে তিনি আপন ভাতিজার মতো ভালোবাসতেন, হাত ধরে কেঁদে দিয়েছিলেন। তাঁর একটি কথা মনে পড়ে। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার আর কোনো পুরস্কারের বা স্বীকৃতির দরকার নাই।’ তখন তাঁর নামটিও উচ্চারণ করতেন না কোনো লেখক ও তাঁর সহ-প্রকাশকেরা।
বইয়ের আড়ং আর জাতীয় বইমেলা এক জিনিস নয়। যাঁরা যুক্তিতে বিশ্বাস করেন তাঁরা জানেন, কোনো রকম একুশের চেতনা ছাড়াই বাংলা ভাষা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সময় থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত অগ্রগতি অর্জন করেছিল। ১৯৫২ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এর চেয়ে বেশি উন্নতি করেছে কি না, তা যে তিন হাজার ৩৫৪টি নতুন বই ২৮ দিনে বইমেলায় এসেছে, তার দেড় হাজার নতুন লেখক বলতে পারবেন। আমার মতো লেখকের শুধু মনে হচ্ছে, কোনো রকম ভাষা আন্দোলন ছাড়াই বঙ্কিমবাবু, রবিবাবু, শরত্বাবু ও কাজী সাহেবেরা কী করে লিখতে পারলেন?
বই প্রকাশ একটি ব্যবসা—একটি শিল্প। প্রকাশক এখানে পুঁজি খাটান। শখ করে খাটান না, মুনাফার জন্য টাকা খাটান। তিনি চাইবেন, যত দ্রুত সম্ভব টাকা তুলতে এবং লাভবান হতে। সে জন্য তাঁরা জনপ্রিয় লেখকদের বই প্রকাশে বেশি আগ্রহী হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। যে লেখকের বই বছরে ১২ কপি বিক্রি হয়, তাঁকে প্রকাশক বহু দূর থেকেই সালাম জানাবেন।
বারবারা কাটল্যান্ডের দু-তিনটি বই আমি পড়েছিলাম। হালকা ছলোছলো প্রেমের নভেল। ছয় শর মতো উপন্যাস লিখেছেন। প্রতি ১৪ দিনে একটি করে নভেল লিখতেন। একই ঢঙে লেখা। নব্বইয়ের দশকে শুনেছিলাম, তাঁর বই ৬০ কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে ই এম ফরস্টার, ভার্জিনিয়া উলফ, ডি এইচ লরেন্সের সঙ্গে তো নয়ই; রেবেকা ওয়েস্টের সঙ্গেও কার্টল্যান্ডের নাম উচ্চারিত হবে না।
নজরুল, শরত্চন্দ্র, রবিঠাকুর, বঙ্কিম চাটুজ্জেদের মতো কিছু লোক সামান্য লেখালেখি করে গেছেন বলে বাংলা সাহিত্যের একটা মান তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাঁদের মানের লেখা হওয়া দরকার নেই, কিন্তু ন্যূনতম ভাষার শুদ্ধতাটা তো থাকবে। কিছু মানুষ একসঙ্গে তাঁদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বইটি বের করতে গিয়ে জীবনীশক্তি অর্ধেক শেষ করেছেন। সঞ্চিত টাকাকড়ি শেষ করে ফতুর হয়েছেন তা-ই নয়, এমন ঋণে জড়িয়ে পড়েছেন, হয়তো অবশিষ্ট জীবনে তা পরিশোধ হবে না। যে প্রেসে বই ছেপেছেন তার ত্রিসীমানায় ইহজীবনে যাবেন না। অনেক বিত্তবান ও তাদের স্ত্রীদের কোনো পরোয়া নেই। দু-চার লাখ টাকা যায় তো যাক, বই তো মেলায় গেল। এক কপিও বিক্রি না হোক, সারা বছর যাকে পাবেন তাকেই উপহার দেবেন। নাম লিখে লিখবেন—অমুক ভাই বা আপা বা দুলাভাই শ্রদ্ধাস্পদেষু।
বাঙালি উঠতি মধ্যবিত্ত প্রথম চাইত ঢাকায় একটু মাথা গোঁজার মতো বাড়ি। তারপর ১০ বছর যাবত্ চাইছে একটি গাড়ি। কয়েক বছর যাবত্ চাইছে নিজের প্রকাশিত একটি বই। সে বইও প্রকাশ করতে হবে মেলার মধ্যে—অন্য সময় নয়। শুধু তা-ই নয়। নজরুলমঞ্চে বইটির মোড়ক উন্মোচিত না হলে প্রকাশই বৃথা। কোনো কোনো বইয়ের প্রকাশনা উত্সবে যে খরচ হয়, ওই পরিমাণ টাকা অদ্বৈত মল্লবর্মণকে বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিলে তাঁরা আরও তিন বছর বাঁচতেন। নজরুলের পরিবার পেলে ছয় মাস একটু ভালো খেতে পারতেন। লেখক হওয়ার তালিকায় এখন অন্তত দেড় কোটি মানুষ অপেক্ষমাণ। বই প্রকাশের যে বেগ শুরু হয়েছে, তা বাংলা একাডেমীর বুলন্দ দরোজায় কে রুধিবে দিয়ে বালির বাঁধ?
কম্পিউটার ও মুদ্রণপ্রযুক্তির অতি দ্রুত প্রসার ঘটায় এবং পত্রপত্রিকার আনুকূল্য পাওয়া বইমেলার মধ্যে এত বই প্রকাশিত হচ্ছে। শতকরা ৯০টি বইয়ের প্রচ্ছদ একই রকম রংচঙে। কারণ, কম্পিউটার। শিল্পী নন, কম্পিউটারই যা করার করছে। এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল ও চিন্তাশীল সাহিত্যের ভবিষ্যত্ অন্ধকার। সবই গেছে বিভিন্ন চেতনার ঠেলায়। চলচ্চিত্র গেছে। সংগীত গেছে। বাঙালির অহংকার করার মতো সাহিত্যটা ছিল। সেটাও এখন যায়।
মেলা উপলক্ষে হাবিজাবি প্রকাশ করায় ক্ষতিগ্রস্ত যে শুধু ওই লেখক-প্রকাশকেরা হচ্ছেন তা নয়, প্রধান লেখকদেরও সাংঘাতিক ক্ষতি হচ্ছে। তাঁদের দরকারি বই প্রকাশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কাগজ আমদানি করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে বিদেশ থেকে। কাগজের দুষ্প্রাপ্ততা দেখা দেয়। ছাপাখানা কাজ করে কূল পায় না। বাঁধাইখানার লোকদের মরণাপন্ন অবস্থা। ভালো বইটিই হয়তো ঠিক সময়ই বেরোতে পারে না। ক্লাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে না।
প্রতিবছর আমাদের নতুন লেখকও দরকার। এখনকার বিখ্যাত ব্যক্তিরা একদিন নতুন ছিলেন। এবারও মেলার মধ্যে প্রকাশিত নতুনদের শ-খানেক বই যথেষ্ট উন্নত মানের লেখা। কিছু আমি নাড়াচাড়া করে দেখেছি। খুবই সম্ভাবনাময় তাঁরা। আনুকূল্য পেলে তাঁরা ভবিষ্যতে ভালো করবেন। কিন্তু আবর্জনার ভিড়ে একসময় হয়তো তাঁরা হারিয়ে যাবেন।
আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন রবীন্দ্রনাথের চৈতালীর অনুকরণে একটি কবিতার বই ছাপতে গিয়েছিলাম। আমার বাবার ষড়যন্ত্রে সে পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভক্ত। ‘বাঙ্গালা নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ শীর্ষক বঙ্কিমচন্দ্রের একটি ১২-দফা ফতোয়া আছে। আমার বাবা সেটি আমার পড়ার টেবিলের সামনে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। বঙ্কিমবাবুর বিরক্তিকর দফাগুলোর মধ্যে ছিল: ১. যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে। ২. টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং টাকাও পায়, লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সেদিন হয় নাই। ৩. যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন।
চাটুজ্জে সবচেয়ে সর্বনাশা নসিহতটি করেছিলেন পাঁচ নম্বর দফায়। তাঁর ভাষায়: ‘যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাত্ ছাপাইবেন না। কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছুকাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নাটক উপন্যাস দুই এক বত্সর ফেলিয়া রাখিয়া তার পর সংশোধন করিলে বিশেষ উত্কর্ষ লাভ করে।’ এখন যদি তিনি এই কথা নজরুলমঞ্চের গাছতলায় দাঁড়িয়ে বলতেন, স্লোগান উঠত: চাটুজ্জের চামড়া—।
একুশ সামনে রেখে হয় বলে আমরা বলি একুশে বইমেলা, আসলে এটা জাতীয় বইমেলা। সুতরাং এখানে সেই সব বই-ই প্রদর্শিত ও বেচাকেনা হবে, যাতে জাতির চৈতন্যের প্রকাশ ঘটে। আমাদের সৃষ্টিশীল প্রকাশনা সংস্থা ৬৫টি, কিন্তু পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সদস্য ১২ থেকে ১৪ হাজার। এবার ৫০৬ জন প্রকাশক ও প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। স্টলের ইউনিট ছিল ৫২২টি। ‘প্রথমা প্রকাশন’ যে স্টলটি বরাদ্দ পায় তার পরিসর একটি পান দোকানের চেয়ে ছোট। একাডেমী প্রাঙ্গণে জায়গা কম। অসৃজনশীল প্রকাশকেরা ঢুকে পড়লে জায়গাসংকট হবেই। অসুবিধা হবে পাঠক-ক্রেতার, ক্ষতি হবে লেখক ও প্রকাশকের।
মেলা শেষ হওয়ার আগের দিন আমাদের কয়েকজন লেখক ও সৃজনশীল প্রকাশককে ডেকেছিলেন একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। তিনি আমাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন ও দুপুরে খাওয়ালেন। বইমেলার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হলো। আমরা বলেছি, মেলা একাডেমী প্রাঙ্গণেই হোক, প্রয়োজনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও কিছুটা বিস্তৃত করা যেতে পারে। কিন্তু বইমেলাটি হবে সৃজনশীল প্রকাশকদের, অন্য বই প্রকাশক ও বিক্রেতাদের ভিড়ে যেন মেলার পরিবেশ নষ্ট না হয়।
একুশের চেতনাও আমরা বইমেলায় প্রতিফলিত দেখতে চাই। কী সেই চেতনা? সে চেতনা হলো আপসহীন জাতীয়তাবোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা, স্বাধীন চিন্তার বিকাশ এবং সরকারি স্বেচ্ছাচারিতার কাছে আত্মসমর্পণ না করা। ১৯৫১-তে পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষার যে অবস্থা ছিল আজ তার দশা আরও খারাপ। বিজাতীয় দুশমনদের আমরা পরাভূত করেছি, আজ বাংলা ভাষার শত্রু বাঙালি স্বয়ং। যদি উন্নত মানের সাহিত্য, বৈজ্ঞানিক গবেষণার অভিসন্দর্ভ, দার্শনিক তত্ত্বমূলক গ্রন্থ, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রভৃতিবিষয়ক বই যথেষ্ট প্রকাশিত না হয়, তাহলে খুব সুশৃঙ্খল একটি বইমেলা করেও জাতির কোনো উপকার হবে না। প্রতি ফেব্রুয়ারিতে হাজার হাজার বই প্রকাশিত হবে, বইমেলায় ক্রমাগত ভিড় বাড়বে, জনগণ কোনো রকমে টিকে থাকবে, কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা হয়ে যাব বিনষ্ট।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

ষষ্ঠ সংসদের ইতিহাস পাঠ করা প্রয়োজন

নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) মানুষের যুক্তিবুদ্ধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি এ কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য নই যে, যে বিধাতা মানুষকে সুবুদ্ধি, যুক্তিশীলতা ও আক্কেলজ্ঞান দিয়েছেন, তিনিই আবার তা বর্জন করার অধিকারও তাকে দিয়েছেন।’
এই মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানীর জাতীয়তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। জার্মানরা দাবি করে, তিনি জার্মান; পোলিশদের দাবি, তিনি পোলিশ। উত্তর: জার্মানির একেবারে পুব প্রান্তে থর্ন শহরে তাঁর জন্ম। সেকালে সেখানে জার্মানরাও বাস করত, পোলিশ জাতিসত্তার মানুষও ছিল। তাঁর তত্ত্ব সঠিক হওয়ায় জার্মানরা বলে, তিনি আমাদেরই লোক; পোলিশরা দাবি করে, তিনি পোলিশ না হয়ে পারেনই না। যদি তিনি ভুল করতেন, কোনো পক্ষেই তাঁর দাবিদার খুঁজে পাওয়া যেত না।
হতভাগ্য কোপার্নিকাস, ভুল না করেও যাঁকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল—ঠিক একালে যেমন স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ভুল না করেও আদালতে ক্ষমা চাইতে হয়—মানুষের সুবুদ্ধি, যুক্তিশীলতা ও কাণ্ডজ্ঞানের ওপর জোর দিয়েছিলেন। পৃথিবীর রাজনৈতিক নেতারাও মানুষ এবং যেহেতু তাঁরা অগণিত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁদের সুবুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞান ও যুক্তিশীলতা যে কিছুটা বেশি থাকবে, তাতে সন্দেহ কি! কিন্তু তাঁরা যদি ওই মৌলিক মানবিক গুণকে বর্জন করাই শ্রেয় মনে করেন, তাহলে সাধারণ মানুষের কষ্টের শেষ থাকে না।
গণতন্ত্র হলো সমঝোতামূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা—আপসমূলক রাজনীতি। গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরতন্ত্র নয় এবং সংখ্যালঘিষ্ঠের যুক্তিবুদ্ধি-বিবর্জিত আস্ফাালনও নয়। তার মাঝামাঝি একটা ব্যবস্থা, যেখানে সংখ্যায় যাঁরা কম, তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃত্ব মেনে নেন এবং সরকারি দল বিরোধী দলের যুক্তিশীল পরামর্শ গ্রহণ করে উপকৃত হয়। সরকারি দল ও বিরোধী দল তীর-বল্লম, ঢাল-তলোয়ার নিয়ে দুদিকে দাঁড়িয়ে হায়দারি হাঁক হাঁকতে থাকলে তা আর গণতন্ত্র থাকে না।
আল্লাহর অশেষ রহমতে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে তা হবে অন্তত আড়াই বছর পর। নির্বাচন জাতীয় জীবনের অসংখ্য কর্মকাণ্ডের একটি। নির্বাচন ছাড়া রাষ্ট্রের আরও বহু কাজকাম রয়েছে। কিন্তু আড়াই বছর পরের সম্ভাব্য সেই ব্যাপারটি নিয়ে দুটি দল যা শুরু করেছে, তার তুলনা দ্বিতীয় আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই নির্বাচন কেমন সরকারের অধীনে হবে, তা নিয়ে চলছে বিতর্ক। বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞ মানুষের তর্কবিতর্ক উপভোগ্য, কিন্তু তার বিপরীত শ্রেণীর মানুষের তর্কাতর্কি শুধু দুর্বিষহ নয়, তা ভীতির সঞ্চার করে। কোনো গুরুতর ব্যাপারে বিতর্কে এক ধরনের রস আছে, কূটতর্ক জন্ম দেয় বিতৃষ্ণার।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে একটি রায় দিয়েছেন। এবং সে সঙ্গে দিয়েছেন একটি পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সংবিধানের সঙ্গে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সাংঘর্ষিক, সুতরাং তা অসাংবিধানিক। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দ্বারা হতে পারে।ওই রায় ঘোষণার পর সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা মহামান্য আদালতের রায় পর্যালোচনা করে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, তা নির্ধারণ করতে পারতেন। সেখানে দ্বিমত দেখা দিলেও সমঝোতার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারতেন। কারণ, সিদ্ধান্তে তাঁদের পৌঁছাতেই হবে; রাষ্ট্রীয় জীবনে সিদ্ধান্তহীনতা বলে কোনো শব্দ নেই।
সরকার গঠনের পর থেকেই আওয়ামী লীগের কয়েকজন নব্য নেতা প্রকাশ্য সভা-সমাবেশেই বলাবলি করছিলেন: তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার আর প্রয়োজন নেই। তা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ শুরু হয়। এবং বিরোধী দলের সম্ভবত এই ধারণা জন্মে যে, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচন[গুলো]টি নিজেরাই করতে চায়। সচেতন মানুষও মনে করল, নিজেদের নির্বাচন নিজেরা করলে ২৪৩ আসনপ্রাপ্তি রোধ করার সাধ্যি বিধাতারও থাকবে না। মহাজোট থেকে বামদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে। এবং জাতীয় পার্টি পাবে ৩৫ আসন। বিএনপি ১৭ আসন নিয়ে সংসদকক্ষের তিন নম্বর কাতারে ঠাঁই নেবে। তিন-চারটি আসন দেওয়া হবে ‘স্বাধীনতার সপক্ষে’র হুজুরদের।
এর মধ্যে আদালতের রায় ঘোষিত হওয়ায় মহাজোটের সামনে আর কোনো বাধাই রইল না। বিএনপি দেখতে পেল, তার সামনে চীনের মহাপ্রাচীর। প্রধানমন্ত্রী বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার সুযোগ নেই রায়ের আলোকে। সে আলো যত উজ্জ্বলই হোক, বিরোধীদলীয় নেতা চোখে দেখলেন অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকারে চোখ বন্ধ করে রাখার পাত্রী তিনি নন। চোখ লাল করে বললেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আর কিছু মানি না, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না।’ প্রত্যুত্তরে আওয়ামী লীগের নেতারা বললেন, ‘আমাদের তত্ত্বে যখন সায় দিচ্ছেন না, নির্বাচন নির্বাচিত সরকারের অধীনেই হবে। সেই নির্বাচন প্রতিহত করার শক্তি কারও নেই।’
শেষ বাক্যটি টেলিভিশন সেট থেকে তীরের বেগে বেরিয়ে যখন আমার কানে মিসাইলের মতো আঘাত হানল, আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। পৃথিবীর কোনো ক্ষমতাসীন দলের গণতান্ত্রিক নেতাদের মুখ দিয়ে এ ধরনের কথা গত আড়াই শ বছরে উচ্চারিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এবং একদলীয় নির্বাচন প্রতিহত করার শক্তি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের মানুষের আছে কি নেই, তা জানি না; কিন্তু বাংলার মানুষের বিলকুল আছে। এই পলিমাটির মানুষ বড়ই তেঁদড়।
১৯৯৫-এর শেষ এবং ১৯৯৬-এর জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের এই নব্য নেতারা কোথায় ছিলেন, আমার স্মরণ নেই। আমরা দেশেই ছিলাম। আলাদা মর্নিংওয়াক বা সান্ধ্যকালীন হাঁটার প্রয়োজন হয়নি ছয়টি মাস। যত বড়লোক বা বড় অফিসারই হোন না কেন, শ্রীচরণই ছিল ভরসা। কোটি টাকা দামের গাড়ি মৃত তিমি মাছের মতো পড়ে থাকত গ্যারেজে বা পোর্চের নিচে। ‘আরব্য বসন্ত’-এর চেয়েও উত্তাল সেই আন্দোলন। নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার জন্য লাগাতার আন্দোলন-অবরোধ শুধু নয়, নাটক মঞ্চায়ন।
বিএনপি যেনতেন প্রকারে আর এক বা একাধিক মেয়াদ ক্ষমতায় থাকতে চায়। সাধারণ মানুষ যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা তাকে সে সুযোগ দিতে নারাজ। ২৫ বছরে আমরা জাতীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি, কিন্তু ১৯৯৬-এর শুরুতে রাতারাতি স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হলো প্রেসক্লাবের সামনে। সেখানে দিনে ও রাতে এমন সব নাটক অভিনীত হতে লাগল, যা শেক্সপিয়ারিয়ান ট্র্যাজেডিকেও হার মানায়। অভিনেতা-অভিনেত্রী বহু, শুধু সংস্কৃতিজগতের মানুষ নয়। সরকারি কর্মকর্তাদের চোখেও স্বপ্ন টলমল করছিল। সচিবালয়ের ভেতরের চত্বরেও নাটক হতে থাকল। শুধু তাই নয়, বড়কর্তারাও গণতন্ত্র বাঁচাতে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে মালকোঁচা মেরে বেরিয়ে এলেন প্রেসক্লাবের সামনের রঙ্গমঞ্চে। সেখানে যে অমোঘ বাণীটি ঘোষিত হলো তা হলো: সরকারি কর্মচারীরা দলবাজি করার প্রাতিষ্ঠানিক অধিকার অর্জন করেছে। তবে সব দলের নয়, প্রজাতন্ত্রেরও নয়, দুটি দলের ভৃত্য হওয়ার অঙ্গীকার ঘোষিত হলো।
একদলীয় নির্বাচনের কী পরিণাম, তা আশরাফ সাহেবের চেয়ে বেগম জিয়া ভালো জানেন। ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর পঞ্চম জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর সংবিধান অনুযায়ী ১৯৯৬-এর ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন সম্পন্নের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় সরকার ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে ও কারচুপির নির্বাচন হয়। বিএনপি পায় ২৭৮টি আসন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিএনপি সরকার গঠন করে। ১৯ মার্চ সংসদ অধিবেশন বসে। আওয়ামী লীগের দাবি অনুযায়ী ২১ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধানসংবলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল পাস হয়। বিল পাসের পর সংসদের অধিবেশন ৩১ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পদত্যাগের দাবি উঠলে তিনি ৩০ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের কাছে লিখিতভাবে সংসদ ভেঙে দেওয়ার অনুরোধ করেন। সেদিন খালেদা জিয়ার ইতিবাচক ভূমিকাটিরও ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। তাঁকে খাটো করে দেখা যাবে না। তাঁর পক্ষকালের প্রধানমন্ত্রিত্ব ছিল সম্পূর্ণ সাংবিধানিক।
একদলীয় নির্বাচন আমরা বলছি বটে, বস্তুত তা একদলীয় ছিল না। ষষ্ঠ নির্বাচনে ‘৪২টি দল’ অংশ নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও খালেদা জিয়ার শপথ অনুষ্ঠানে বিদেশি কূটনীতিকেরা যোগ দেননি দু-একটি গৌণ দেশের ছাড়া। বহির্বিশ্বে ওই নির্বাচনের কোনো বৈধতা ছিল না। এবারও যদি বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে, সেখানে ১৪ দুগুণে ২৮ দল শুধু নয়, ৫৬ দল পাওয়া যাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য। কিন্তু সেই নির্বাচনকে পৃথিবীর কোনো দেশই বৈধতা দেবে না।
মহাজোট মনে করছে, আমেরিকা ও ভারত পক্ষে আছে; কোনো চিন্তা নেই। ভুল ধারণা। ভারতের মতো মজবুত গণতান্ত্রিক দেশ অন্ধের মতো কাউকে সমর্থন দেবে না। কোনো নেতার সঙ্গে ভারত সরকারের ব্যক্তিগত সম্পর্ক যত উষ্ণই হোক, রাষ্ট্রের জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ভারত দাঁড়াতে পারে না। আর আমেরিকা? সে কী করবে, তা এ মুহূর্তে বারাক হোসেন ওবামাও বলতে পারবেন না। ঠিক সময় তাঁরা ঠিক কাজটি করবেন; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে যা সুচারুভাবে করছেন।
ভারত নেপালে যা করতে পারে, বাংলাদেশে তা পারে না। নেপাল হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। এখানে ব্যক্তি বা দলবিশেষকে রক্ষার জন্য অযাচিত হস্তক্ষেপ করলে সেটা হবে তার জন্য ক্ষতিকর। বহির্বিশ্বে তার গণতান্ত্রিক ও শান্তিবাদী ভাবমূর্তি চূর্ণ হবে।
তত্ত্বাবধায়ক বিষয়টি সাংবিধানিক ও আইনগত। কিন্তু তার চেয়েও বেশি রাজনৈতিক। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া যায়নি। তবে আইনি জটিলতার যদি মীমাংসা হয়েও যায়, তাহলেও আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সর্বদলগ্রহণযোগ্য ভাগ্যবিড়ম্বিত প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন, তা কোনো জ্যোতিষীর পক্ষেও বলা সম্ভব নয়। যিনি হবেন, তাঁর হয়তো মাথা ফাটবে না; কিন্তু তাঁর ‘হতে-যাওয়ার’ যে প্রক্রিয়া, তাতে মাথা ফাটা নয়, জীবন যাবে কত জনের, তা বলা মুশকিল। তবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে দামি গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো।
বিজ্ঞ ও বিখ্যাত সংবিধান-বিশেষজ্ঞেরা বলেছেন, ‘রায় ঘোষণার মুহূর্ত থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে।’ এ বক্তব্যের সঙ্গে আমরা মাথা চুলকে ও ঢোক গিলে যতই মিনমিন করে দ্বিমত পোষণ করি না কেন—তা কোনো কাজে আসবে না। মোরগের কল্লা কোপ দিয়ে কাটার পর তাকে আধা জীবিত মনে করা নির্বুদ্ধিতা। এখন জীবিত মোরগ চাইলে বাজার থেকে কিনে আনতে হবে। হাটবাজার থেকে মোরগ কিনে আনা মানে সংবিধান সংশোধন করে ব্যবস্থাটির আইনি-প্রক্রিয়ার সুরাহা করা। গলাকাটা মোরগের ঠ্যাং ধরে টানাটানি করে লাভ হবে না।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয় না, কিন্তু ইতিহাস পাঠ করার উপদেশ দেওয়া হয় প্রতিদিন। জাতির গোটা ইতিহাস নয়—একটি নির্দিষ্ট সময়ের ইতিহাস। কারণ, অল্প সময়ের ইতিহাস পাঠ করতে সময় লাগবে কম। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিল ১২ দিন মাত্র। ওই সংসদের জন্মের পটভূমি, জন্ম ও মৃত্যুর ইতিহাস পাঠ করুন। তবে গড়গড় করে পাঠ করলে হবে না, মনোযোগ দিয়ে পাঠ করতে হবে এবং তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ষষ্ঠ সংসদের জন্ম-মৃত্যুবৃত্তান্ত পড়তে হবে কোপার্নিকাস কথিত যে আক্কেল, মেধা ও যুক্তিশীলতা বিধাতা মানুষকে দান করেছেন, সেগুলোর সুষ্ঠু প্রয়োগ করে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক হো

আরবি শব্দ ঈদ, যার আক্ষরিক অর্থ আনন্দ বা খুশি। খুশি হওয়ার ক্ষমতা শিশু-কিশোর, যুবকদের যতটা, তার ১ শতাংশের ১ ভাগও প্রবীণ ও বৃদ্ধদের নেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে খুশি হওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। তার পরও বয়স্করা যে আনন্দ করেন বা খুশি হন, তা যেন দায়ে পড়ে। শিশু-কিশোরদের আনন্দের প্রকাশ ও খুশি স্বতঃস্ফূর্ত। ঘরের মধ্যে একটি রঙিন ফড়িং বা প্রজাপতি ঢুকে পড়লে একটি শিশুর চোখে-মুখে নির্মল আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ে। বুড়ো মানুষ বসে থাকেন পাথরের মতো মুখ করে। হাত নেড়ে তাড়িয়েও দিতে পারেন ফড়িং বা প্রজাপতিটিকে।
ঈদুল ফিতর মুসলমানের পবিত্র ধর্মীয় উর‌্যাসবও। ধর্মীয় পরবে নতুন কাপড়চোপড় পরা, ভালো খাওয়াদাওয়া, প্রিয়জনদের সঙ্গে একত্র হওয়া এবং অন্য আনন্দদায়ক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে। ঈদের দিন যতই ঘনিয়ে আসে, শিশু-কিশোরদের চোখের ঘুম হারাম হতে থাকে, কবে মা-বাবা নতুন কাপড় কিনে দেবেন। তবে আমাদের মতো গরিব দেশে ৯০ ভাগ মা-বাবারও চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের জন্য বাজেটের মধ্যে জামা-কাপড়-জুতা কেনা যাবে তো! সুতরাং উর‌্যাসবে ঘুম দুই পক্ষেরই হারাম হয়—এক পক্ষের আনন্দে, আরেক পক্ষের আতঙ্কে।
আজকাল বাজারের যে অবস্থা, তাতে বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটতে পারে ঈদ উপলক্ষে। সেদিন গাউছিয়ার সামনে এক দম্পতি দেখলাম প্রায় হাতাহাতি করার পর্যায়ে। ক্ষিপ্ত ভদ্রলোকের চেহারা ভিমরুলে কামড়াতে থাকলে যেমনটি হয়, সেই রকম। ভদ্রমহিলা গজগজ করছেন। মহিলা শাড়ির প্যাকেটটি ভদ্রলোকের হাতে দিতেই তিনি তা রাস্তার মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিলেন। বাচ্চা দুটি অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মা-বাবার কাণ্ড দেখছিল। তাদের একজনের শুভবুদ্ধি যেকোনো বয়স্ক মানুষের চেয়ে বেশি। সে প্যাকেটটি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিল। ঈদে ওদের ভাগ্যে কী জুটেছে, তা জানা যায়নি।
আজকাল বাংলার মাটিতে ঈদে অন্য রকম ঘটনাও ঘটে। ৫০ বছর বয়স-বয়সিনীর রূপ-যৌবন-শরীর যতই বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের মতো হয়ে থাক, ঈদে ৫০ হাজার টাকা থেকে দেড়-দুই লাখ টাকার শাড়ি দিতেই হবে। ৬০ হাজার টাকা ভরি সোনার এক সেট ভারী গয়নাও চাই। ওই শাড়ি ও গয়নায় রূপ কতটা খোলতাই হলো, সেটা বড় কথা নয়, ওগুলো না দিলে মুখের যে অবস্থা হতো, তার কাছে চুলার হাঁড়ির তলা কিছুই না। ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরে গিয়ে ঈদ করা তো এখন নস্যি! আজকাল অনেকে ঈদে ‘বিজনেসের ব্যাপারে’ ছুটিটা ব্যাংককে কাটান। ওখানে গিয়ে বিভিন্ন অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে বলে স্ত্রীকে সঙ্গে নেন না।
বহু ভাগ্যবান বাঙালি ঈদ করেন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপপুঞ্জে অথবা ব্যাংককে। থাই উপসাগরের বালুকাবেলার বিকেলগুলো রুপার পাতের মতো ঝকঝক করে। সন্ধ্যা নামে মন্দ-মন্থরে। সমুদ্রের পাখিগুলো ওড়াউড়ি বন্ধ করে নীড়ে ফিরে যায়। ঢাকায় থাকা অবস্থায় বাড়িতে ও অফিসের যত যন্ত্রণা, শ্রমিকদের বোনাস প্রভৃতি দেওয়ার মতো যত্ত সব বিরক্তিকর ব্যাপার, কিছুই নেই ব্যাংককের বালুকাবেলায়। পুতুলের মতো থাই যুবতী। মনে হয় যেন মাখনের শরীর। সমুদ্রসৈকতে ও হোটেল-মোটেলের কক্ষে স্বর্গ নেমে আসে। রোমান্টিক মুহূর্তে ঢাকা থেকে স্ত্রীর ফোন যায় ঈদের দিন: ‘তোমার জন্য বাচ্চাদের মন খারাপ।’ ব্যাংককের জবাব: ‘তোমাকে ভীষণ মিস করছি। কাজের চাপে এক মিনিট ফুরসত নেই।’ হোটেলের নির্জন কক্ষে থাই তরুণীটি চেয়ে থাকে। ভাগ্যিস যে বাংলা জানে না।
কিন্তু ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ বাঙালি ব্যাংকক-বালিতে নয়, নিজের বাড়িতেই ঈদ করে। বউ-বাচ্চাদের নিয়ে আনন্দ-খুশি করে। সম্ভব হলে নতুন জামা-কাপড়-জুতা কেনে পরিবারের সদস্যদের জন্য। একটু ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়। আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবের বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এসবের ভেতর দিয়ে ঈদের মতো আনন্দোর‌্যাসব উদ্যাপিত হয়। আমার ধারণা এবং যতটুকু খবর রাখি, তাতে অন্য জাতির চেয়ে বাঙালি মুসলমানের কাছে ঈদুল ফিতর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উর‌্যাসব। কারণ, বাঙালি সংস্কৃতিতে উর‌্যাসবের উপাদান খুব বেশি। ঈদুল ফিতর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উর‌্যাসব হলেও এর ঈদগায় নামাজ আদায় করা ছাড়া সবটাই অসাম্প্রদায়িক। কারণ, অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদেরও ঈদ উদ্যাপনে অংশগ্রহণে বাধা নেই। ছোটবেলায় দেখেছি নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই আমার বাবার হিন্দু বন্ধুরা চলে আসতেন। দুপুরে-বিকেলে-রাতে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হতো। মুসলমানি খানাপিনা তাঁরা উপভোগ করতেন। বিশেষভাবে দেখেছি, শুধু যে সম্ভ্রান্ত ও অবস্থাপন্ন হিন্দুরা ঈদের দিন আসতেন তা নয়, আমাদের পারিবারিক নাপিত লোকনাথ শীলও অবধারিতভাবে দুপুরে খেতেন।
তবে শৈশবের সব ঈদই যে সমান আনন্দপূর্ণ ছিল, তা হয়তো নয়। আজও মনে পড়ে একটি ঈদ বেজায় উপভোগ্য হয়েছিল। আমাদের এলাকায় নেতাগোছের একজন ছিলেন, শেরেবাংলার কৃষক প্রজা পার্টি বা আওয়ামী লীগ করতেন। আমাদের মতো ছোট ছেলেমেয়েদের অকারণে শাসন করতেন ও অনবরত উপদেশ দিতেন। ঈদের দিন তিনি পরতেন বহুকাল আগে তাঁর কোনো পূর্বপুরুষের তৈরি একটি কালো আচকান। কানে গোঁজা থাকত মেশকে আম্বার আতর দেওয়া তুলা। মাথায় আচকানের বয়সীই একটি ফেজ বা তুর্কি টুপি, যার ঝুল যথেষ্ট দীর্ঘ।
আশ্বিন-কার্তিক মাস হবে। ডোবা-পুকুর সব পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ। তিনি ঈদের নামাজ পড়তে এসে কী কারণে হাত ধুতে বা কুলি করতে ঈদগার পাশের পুকুরটিতে যান। ঘাট বানানো ছিল খেজুরগাছের গুঁড়ি দিয়ে। মুহূর্তে পা ফসকে পাম্প শুসহ তিনি পুকুরে পড়ে যান। একেবারে গলা পর্যন্ত নিমজ্জিত। শুধু মাথার তুর্কি টুপিটি ছিল শুকনা। তাঁর পদস্খলন শুধু ছোটদের নয়, উপভোগ্য হয়েছিল সবারই।
জামাত শুরু হয়ে গিয়েছিল। তিনি সিক্ত বসনেই এসে দাঁড়ালেন। নেতা মানুষ, সবার পেছনে দাঁড়াতে পারেন না, ইমামের পেছনেই গিয়ে দাঁড়ালেন। অর্ধেক নামাজের মধ্যে ছোটদের অনেকে হাসি চেপে রাখতে না পেরে মুখ দিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার মতো ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। ইমাম বিরক্ত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ধমক দিলেন, ‘কোন বেতামিজে এমন করে, আমার নামাজে ভুল করাইয়া দিলা।’ এ কথা শুনে উচ্চ স্বরেই হেসে উঠল অধিকাংশ। যা হোক, সে ঈদ আমাদের বড় খুশিতে কাটল। আসলে কাউকে পড়ে যাওয়া বা কারও পতন দেখলে মানুষ খুশি না হয়ে পারে না। তা যেন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
জলবায়ুর অতি দ্রুত পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির যে কী ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, তা নিজের কাছেই বিশ্বাস হয় না। সেকালে দু-এক বছর পর পর ভয়াবহ বন্যা হতো। বাড়িঘর, গাছপালা সব ডুবে যেত।
আমার জীবনে অন্তত দুবার আমি বন্যার মধ্যে ঈদ উদ্যাপন করেছি। সে এক অদ্ভুত অবস্থা। মসজিদ ও ঈদগাহে কোমর পর্যন্ত পানি। মুরব্বিরা সিদ্ধান্ত নিলেন, নৌকায় নামাজ হবে। কুড়ি-পঁচিশটি নৌকা পাশাপাশি জোড়া লাগিয়ে ঈদের জামাত হয়।
আমরা সাহিত্যসমালোচকেরা যেমন বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যকে ভাগ করি দশকওয়ারি—পঞ্চাশের কবিতা, ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা প্রভৃতি, তেমনি এখন দেখছি ঈদ উদ্যাপনও দশকওয়ারি করা যায়। যেমন বাঙালি পঞ্চাশের দশকে একভাবে ঈদ উদ্যাপন করত, ষাটের দশকে আরেক রকম, সত্তর, আশি এবং একুশ শতকের প্রথম দশকে আরেক রকম। সত্তর দশক পর্যন্ত জামাকাপড়ের জৌলুশ এত ছিল না। এক ভাগ লোকও ঈদে নতুন জুতা-স্যান্ডেল কিনত না। নতুন কাপড়ের মধ্যে পাজামা-পাঞ্জাবি ও শার্ট-প্যান্ট। এত বাহারি পাঞ্জাবিও ছিল না।
১০-১৫ বছর ধরে বিলাসিতা ও ভোগবাদ গোটা সমাজকে গ্রাস করেছে। শুনলাম, এবার নাকি তিন-চার হাজার টাকায়ও পাঞ্জাবি বিক্রি হয়েছে। ৩০-৪০ হাজার টাকা দামের শাড়ি বিক্রি হয়েছে দেদার। বাংলাদেশ কবে মধ্যম আয়ের দেশ হবে জানি না, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এখনই শীর্ষ ব্যয়ের দেশ হয়ে গেছে। ১০ তলা দালানে দাঁড়ালে দেখা যায় অন্তহীন গাড়ির স্রোত। মনে হয় উত্তাল সমুদ্রে ইস্পাতের ঢেউ। এক লাখ টাকা দামের শাড়ি বিক্রি হয়েছে এবার। বহু বছর আমার নিজের ঈদের কাপড় কেনা লাগে না। ঘনিষ্ঠরাই দেন। অত কাপড় সারা বছর আমার লাগেও না। এবার দুই সেট লুঙ্গিচাদর পাঠিয়েছেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম শীর্ষ নেতা, যাঁর বক্তৃতা মন্ত্রমুন্ধের মতো মানুষ শুনত, সেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নূরে আলম সিদ্দিকী। হিসাব করে দেখলাম, গত কুড়ি বছরে যাঁরা আমাকে কাপড় উপহার দিয়েছেন, তাঁদের একজন জাতীয়তাবাদী দলের এবং অন্যরা আওয়ামী লীগের নেতা। সেই জাতীয়তাবাদী নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আজ নেই। কমিউনিস্টরা কিছু দিলে খুশি হতাম, কিন্তু তাঁরা দেন না। তাঁদের পার্টি চালানোরই টাকা নেই।
আজ নগরায়ণ ঘটেছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে পঞ্চাশের দশকে ছিল শুধু গ্রাম আর গ্রাম। সেই গ্রামের ঈদ ছিল অন্য রকম। আমাদের জমি বর্গাদারেরা চাষ করলেও দুধের জন্য বাড়িতে গরু পালা হতো। কাজের লোকেরা ঈদের দিন গরুগুলোকে সাবান দিয়ে গোসল করাত।
ঢাকায় লালবাগে থাকতাম বলে ঈদের জামাতে অংশ নিতাম মোগল আমলের শাহি মসজিদে। এখন মনে হয় ওখানে জামাত হয় না, কারণ ওটা এখন পুরাকীর্তি হিসেবে রক্ষিত। মুক্তিযুদ্ধের আগে একবার এবং স্বাধীনতার পরে একবার কি দুবার বঙ্গবন্ধু, আতাউর রহমান খান প্রমুখ নেতার সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়েছি। একবার মনে আছে, খুব শীত ছিল। বঙ্গবন্ধুর চাদর গায়ে জড়ানো।
দেশের বাইরে বার তিনেক আমি ঈদের সময় ছিলাম কলকাতা ও দিল্লিতে। দিল্লির শাহি মসজিদে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে জামাতে দাঁড়িয়েছি। কলকাতা দুবার ঈদের দিন থাকলেও ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। মালয়েশিয়ায় এক ঈদের জামাতে মাহাথির মোহাম্মদের সঙ্গে নামাজ পড়েছি। খুবই অনাড়ম্বর তাদের আয়োজন। মাহাথিরের পরনে লুঙ্গি ও কুর্তা।
বাঙালি সব সময়ই প্রথার মধ্যে পড়ে থাকতে চায়। অর্থার‌্যা যেমনটি আছে তেমনই থাক। সংস্কারে তার অনিচ্ছা। বাঙালি মুসলমানের ঈদ আরও উর‌্যাসবমুখর করা যায়। শুধু খাওয়াদাওয়া ও কাপড় পরার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এর সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিষয়ও যোগ হতে পারে। কিছু যে হয়নি, তা নয়। টিভি চ্যানেলগুলো ঈদ উপলক্ষে বহু নাটক ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করছে। কিছু নাটক-সংগীত প্রভৃতির প্রসার ঘটানো উচিত সাধারণ মানুষের মধ্যে—তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
কুড়ি শতকের শুরুতে মাসিক মোহাম্মদী এবং সাপ্তাহিক ও মাসিক সওগাত প্রকাশের পর থেকে ঈদ নিয়ে লেখালেখি শুরু হয়। গত ৯০ বছরে বিখ্যাত বাঙালি লেখক ও কবি ঈদ নিয়ে যত প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও কবিতা লিখেছেন, সারা পৃথিবীতে গত নয় শ বছরে তত লেখা প্রকাশিত হয়নি। ঈদের বিশেষ সংখ্যা বহুকাল থেকেই প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে সমৃদ্ধ বিশেষ ঈদসংখ্যা বের করছে দৈনিক ও সাপ্তাহিকগুলো। সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নতির ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা ভালো।
বাংলা ভাষায় ঈদ বিষয়ে যত কবিতা-গান রচিত হয়েছে, তার মধ্যে নজরুল ইসলামের রচনাই সব লেখার কাজি। দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। এখানে সবার জীবনে ঈদ আসে না। নজরুলকে দিয়ে শেষ করি:
ইসলাম বলে, সকলের তরে মোরা সবাই,
সুখ-দুঃখ সম-ভাগ করে নেব সকলে ভাই,
নাই অধিকার সঞ্চয়ের!
কারো আঁখিজলে কারো ঝাড়ে কি রে জ্বলিবে দীপ?
দু’জনার হবে বুলন্দ্-নসিব, লাখে লাখে হবে বদনসিব?
এ নহে বিধান ইসলামের।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সংবাদপত্র: জাতীয় চেতনা ও চ্যালেঞ্জ

প্রথম আলো আজ চৌদ্দতে পড়ল। একটি দৈনিক পত্রিকার জন্য এটি কম বয়স নয়। পত্রিকারও মানুষের মতো জন্ম-মৃত্যু আছে। চিরকাল কোনো কাগজ প্রকাশিত হয় না। জন্মের পর একটি পত্রিকার প্রথম ১০-১৫ বছরই গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠা না ঘটলে অথবা চারিত্র দাঁড়িয়ে না গেলে, পাঠকের মন জয় করতে না পারলে, দীর্ঘকাল টিকে থেকেও তা সমাজে কোনো অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে না। উপমহাদেশে বহু দীর্ঘজীবী পত্রিকার ক্ষেত্রে তা দেখা গেছে। আবার কোনো কোনো কাগজ দীর্ঘায়ু শুধু নয়, টিকে আছে স্বমহিমায়। ঘটেছে তার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি, পালন করছে বৃহত্তর ভূমিকা। কলকাতা ও চেন্নাই থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা ও দ্য হিন্দুর কথা বলতে পারি।
কোনো কাজের পেছনে যদি কোনো এষণা না থাকে, তাহলে কাজটি সর্বাঙ্গসুন্দর হলেও তা একঘেয়ে ও প্রাণহীন হতে বাধ্য। উজ্জ্বলতা আসে সৃষ্টিশীলতায়, গতানুগতিকতায় নয়। সংবাদপত্র একটি পণ্য। সংবাদপত্র প্রকাশ একটি ব্যবসা বটে এবং সংবাদপত্র আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। কিন্তু সংবাদ তৈরি ও সংবাদপত্র সম্পাদনা একটি সম্পূর্ণ সৃষ্টিশীল কাজ। যে কাগজের সৃষ্টিশীলতা কম, পাঠকের কাছে তার আবেদন ও কদর কম। প্রথম আলোর সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে এই কাগজে যাঁরা কাজ করেন এবং এখানে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা নন, সঠিক রায়টি দিতে পারবেন পাঠকেরাই।
প্রথম আলোর বদলে দেওয়ার অঙ্গীকার অথবা স্বপ্নের স্বদেশ গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা, তা মনে হতে পারে স্রেফ স্লোগান। কিন্তু তার ১৩ বছরের ভূমিকা রক্ষণশীল দৃষ্টিতে দেখলেও বোঝা যাবে, ওগুলোই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সমাজের প্রতি তার একটি দায়বদ্ধতা রয়েছে। একই সঙ্গে সামাজিক দায়িত্ব পালন করা এবং পাঠকের রুচি নির্মাণ খুবই কঠিন কাজ। প্রথম আলো তা করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
একটি সময়ে বড় বড় কাগজকেও অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হয়েছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগে আজ সে সংকট নেই। কিন্তু সংবাদপত্রের আজকের সংকট অতীতের অর্থনৈতিক সংকটের চেয়েও কঠিন। প্রকাশক, সম্পাদক ও তাঁর সাংবাদিক সহকর্মীদের অপ্রকাশ্য-প্রকাশ্য মারাত্মক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়। সে চাপ শুধু স্বৈরতান্ত্রিক সরকার থেকে চাপ নয়, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোর চাপ আরও কুৎসিত ও ভয়ংকর।
যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই বা নামমাত্র আছে, পার্লামেন্ট অকার্যকর, সরকারের দায়বদ্ধতা বলে কিছু নেই, প্রশাসনে সীমাহীন দুর্নীতি, রাজনীতি কলুষিত ও দুর্বৃত্তায়িত, দুর্বল ও নারীর প্রতি সহিংসতাসহ সামাজিক অনাচারের কোনো শেষ নেই, সেখানে সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের কর্মীদের বিপদ প্রতিমুহূর্তে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনবহুল দেশগুলোর সংবাদপত্রের প্রকাশক, সম্পাদক ও তাঁর সাংবাদিক সহকর্মীদের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। আয়ারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ডের একজন সম্পাদক ও সাংবাদিক যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন, বাংলাদেশ, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার সাংবাদিকদের সে সৌভাগ্য নেই।
প্রতিটি দেশের সংবাদপত্র তার আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। প্রতিটি যুগের সংবাদপত্র সেই যুগেরই সৃষ্টি এবং যুগকেই ধারণ করে। প্রতিটি প্রগতিশীল সংবাদপত্র তার যুগকে বদলে দেওয়ারও চেষ্টা করে। জাতির অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের অঙ্গীকার তার। ইংরেজ আমলে দেশপ্রেমিক সংবাদপত্রগুলোর মূল লড়াইয়ের জায়গাটা ছিল সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশিক সরকার। লক্ষ্য ছিল, তা থেকে জনগণের মুক্তি। পাকিস্তানি যুগের গণমাধ্যমের প্রধান লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রের অবাঙালি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জনগণের আবেগকে তুলে ধরা। স্বাধীনতার পরে আমাদের গণমাধ্যমের ঘাড়ে যে দায়িত্ব বর্তায় তা আরও শক্ত: গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও দেশ গঠন। বাংলাদেশের মানুষের নিয়তি সামরিক স্বৈরশাসন অথবা নির্বাচিত স্বৈরাচার। ফলে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকে প্রবল চাপ ও ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়।
বিষয়ভিত্তিক সংবাদ সাময়িকীর একরকম কাজ। কিন্তু একালের মূলধারার সংবাদপত্র মূলত পলিটিক্যাল জার্নালিজম—রাজনৈতিক সাংবাদিকতা। রাজনীতির সঙ্গে রাজনৈতিক অর্থনীতিও যুক্ত। রাজনৈতিক সাংবাদিকদের রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের কঠোর নজরদারির মধ্যে কাজ করতে হয়। যেখানে উদার গণতন্ত্র নেই, রাজনীতি প্রতিহিংসাপরায়ণ ও সংঘাতময়, সেখানে সংবিধান ও আইনের যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ ঘটা খুব স্বাভাবিক। বাংলাদেশে সে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের সাংবাদিকদের রয়েছে। এখনো বাংলাদেশের বহু পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও তাঁদের সহকর্মী সাংবাদিকদের নামে বহু মামলা ঝুলছে। তাঁদের দৌড়ুতে হচ্ছে এক জেলা থেকে আরেক জেলার আদালতে। বাদী অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকার নয়, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। উন্নত বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এমনটি হয় না। যদিও দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো সাংবাদিকই পলিটিক্যাল মিশন নিয়ে কাজ করেন না। তাঁরা জনস্বার্থের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে স্বেচ্ছায় বিপদ ডেকে আনেন।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে পৃথিবীর উন্নত ও অনুন্নত সব দেশেই রাজনীতি এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সাংবাদিকতাও চ্যালেঞ্জ থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট, ভয়াবহ বেকারত্ব, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অকল্পনীয় দূরত্ব, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, আধিপত্যবাদী চাপ প্রভৃতি সমস্যার মধ্যে রাজনীতি ও রাজনৈতিক সাংবাদিকতা কঠিন পরীক্ষায় পড়েছে। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপায় বা পথটি তাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির সমস্যা সংবাদমাধ্যমেরও সমস্যা। বিশ্বব্যাপী আজ যে উত্তেজনা, তা থেকে উত্তরণে রাজনীতিকদের গণমাধ্যমের সহযোগিতা নিতে হবে। যদি তাঁরা তা না নেন, তাহলে আরও বড় বিপর্যয় ঘটবে। সে পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যম নয়—ভেসে যাবে প্রথাগত রাজনীতিও। সে জন্য রাজনীতি ও রাজনৈতিক সাংবাদিকতার মধ্যে সমন্বয়মূলক সম্পর্ক সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বর্তমান অবস্থা টিকিয়ে রাখতে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে চরম বৈরী আচরণ করছে। সাংবাদিকদের হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধার উদ্দেশ্যে তাদের ছলচাতুরীর অভাব হচ্ছে না। রচনা করা হচ্ছে, নতুন নতুন কালাকানুন ও অসভ্য বিধিবিধান।
আমরা আমাদের বাংলাদেশের কথাই যদি বলি, তাহলে দেখব, ৫০ বছর আগের চেয়ে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের পরিধি আজ অনেক বেশি বিস্তৃত শুধু নয়, জটিলও বটে। এ অবস্থায় সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যমের দায়দায়িত্ব হাজার গুণ বেড়ে গেছে। রাষ্ট্র হয়ে উঠছে এক দানবীয় শক্তি। সংবাদপত্র রাষ্ট্রেরও পক্ষে, জনগণেরও পক্ষে। তবে কথাটা খুব ঔদ্ধত্যপূর্ণ শোনালেও বলতে হচ্ছে, যেখানে সরকারের স্বার্থের সঙ্গে জনগণের স্বার্থের সংঘাত ঘটবে, সেখানে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম জনগণেরই পাশে থাকবে। নিপীড়নকারী অন্যায় রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করা সংবাদপত্রের ধর্ম। বহু আগে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের পঞ্চম প্রধান শক্তি সংবাদপত্র।’ এখন আমরা তাঁর সেই বক্তব্যকে সংশোধন করে বলব, রাষ্ট্রের প্রধান শক্তি হিসেবে সংবাদপত্রের রোল নম্বর পাঁচ থেকে আরও নিচে নেমে এসেছে। গণতন্ত্র ছাড়া রাষ্ট্র চলে, গণমাধ্যম ছাড়া চলে না।
নিন্দুকও বলতে বাধ্য, প্রথম আলো সাংবাদিকতায় নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে। সম্পাদনার ক্ষেত্রে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। তৈরি করছে উন্নত রুচি। নারী ও যুবসমাজকেও সে গভীরভাবে সম্পৃক্ত করছে। তবে শুধু প্রথম আলো নয়, বাংলাদেশে আজ বহু আধুনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যম আছে বলেই আজও আমাদের সমাজে দুর্বলেরা বসবাস করতে পারছে। প্রশাসনের ওপর মানুষের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই, শেষ আশ্রয়স্থল আদালতের ওপরও মানুষের বিশ্বাস নড়ে গেছে, এই অবস্থায় সংবাদমাধ্যমই মানুষের শেষ ভরসা।
অনেক দিন আগে জার্মানির হামবুর্গে এক আলোচনায় উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। সেখানে একজন খ্যাতনামা সম্পাদক তাঁর বক্তৃতাপত্রে বলেছিলেন: কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে একুশ শতকে বহু সংবাদপত্রকে—অর্থাৎ প্রকাশক, সম্পাদক ও সাংবাদিককে তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এখনকার চেয়ে অনেক বেশি সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই দেখতে পাচ্ছি, কথাটি ষোলোআনা সত্য।
প্রথম আলো সার্বিক যুগের চৈতন্য ও জাতীয় চেতনাকে আরও বেশি করে ধারণ করবে—আজকের শুভলগ্নে সেই প্রত্যাশা করি।
l সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

তিন অমঙ্গল ও অকার্যকর রাষ্ট্র

দুর্নীতি, অদক্ষতা ও কর্তব্যে অবহেলা এবং অপচয়—এই তিন অমঙ্গল একটি রাষ্ট্রকে করে দেয় অকার্যকর, কোনো দেশের গণতন্ত্রের চর্চাকে শুধু ব্যাহত নয়, করে তোলে অসম্ভব। এই তিন অমঙ্গল যেখানে প্রাধান্য পায়, সে জাতির সব আশা-আকাঙ্ক্ষা শেষ হয়ে যেতে পারে। তার বর্তমান যেমন হতাশাজনক, তেমনি তার ভবিষ্যৎও অন্ধকারাচ্ছন্ন।
একটি রক্তাক্ত মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। একটি ন্যায়ভিত্তিক শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। একদিকে তা ছিল প্রতিরোধযুদ্ধ: পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার ও নারকীয়তাকে প্রতিহত করা। অন্যদিকে ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করে, একটি উন্নত সমাজ গঠন—যে সমাজ ও রাষ্ট্র হবে পাকিস্তানি শাসনের চেয়ে ভালো। যদি এমন হতো, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ ইয়াহিয়া-টিক্কা-নিয়াজি-ফরমানের পরিবর্তে কম অত্যাচারী অন্য কোনো পাকিস্তানিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়, সেটা হতো ভিন্ন ব্যাপার। তা তো নয়। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ চেয়েছে স্বশাসন এবং সেই স্বশাসিত রাষ্ট্রটি হবে গণতান্ত্রিক, ন্যায়বিচারভিত্তিক ও অপেক্ষাকৃত বৈষম্যহীন।
সর্বশেষ যিনি ছিলেন, তিনি বাংলাদেশকে তাঁর সাধ্য ও পরিকল্পনামতো সেবা দিয়ে স্বদেশে ফিরে গেছেন। বাংলাদেশকে একটি সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের আনুষ্ঠানিকতায় পৌরোহিত্য করে তিনি চলে যান। তাঁর পদে বাংলাদেশে নতুন মার্কিন প্রধান অতিথি হিসেবে আসছেন মি. ড্যান ডব্লিউ মোজেনা। ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কমিটিতে এক শুনানিতে তিনি বলেন, ‘দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, দুই মেরুতে বিভক্ত রাজনৈতিক দল, দুর্নীতি এবং নাগরিক সমাজের প্রতি সরকারের অস্পষ্ট অবস্থানই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা।’ তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশ একটি ‘মধ্যপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ’।
মান্যবর মোজেনা যখন তাঁর পর্যবেক্ষণ সিনেট কমিটিতে প্রকাশ করেন, তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। বাংলাদেশের সমস্যা যে দুর্নীতি—এই অভিযোগ যে রাবিশ ও বোগাস, সে কথা প্রবীণ অর্থমন্ত্রী সেখানে সাংবাদিকদের বলেছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে মি. মোজেনা আগন্তুক নন। শুধু সরকারি কাগজপত্র থেকে নয়, তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশ সম্পর্কে। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে কর্মকর্তা ছিলেন।
বিশ্বব্যাংকের বড় কর্ত্রী কিছুদিন আগে বাংলাদেশে পদধূলি দিয়েছিলেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ সরেজমিনে দেখতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কোনো রকম করাপশন টলারেট বা দুর্নীতিকে বরদাশত করা হবে না। কথাটি বলেন তিনি ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে। তাঁর বলার ভঙ্গিটি টিভিতে দেখে আমার ভালো লাগেনি। পরদিন আবার টিভিতে দেখি, তিনি তাঁর তর্জনী নাচিয়ে বলছেন, ‘নো করাপশন, নো করাপশন, নো করাপশন’। আমাদের সরকারের কেউ কোনো প্রতিবাদ করেননি। ওই দিনই রাতে এটিএন বাংলা আমাকে টক শোতে ডাকে। সেখানে আমি বিশ্বব্যাংক-কর্ত্রীর মুখনিঃসৃত বাণীর বিষয়বস্তু ও বলার ঢং—দুটোরই তীব্র প্রতিবাদ করি।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের দুর্নীতি নিয়ে পত্রপত্রিকায় অব্যাহত লেখালেখি হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রামাণ্য প্রতিবেদন হচ্ছে। কিছুদিন ধরে আমরা নাগরিক সমাজ থেকেও জোরালো প্রতিবাদ করছি। তাতে সরকার বিরক্ত। নেতারা আমাদের আক্রমণ করে সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সরকারের নেতাদের সুর দেখে মনে হয়, তাঁরা এ কথা স্বীকার করতে অনিচ্ছুক যে রাষ্ট্রে দুর্নীতি আছে। এবং দুর্নীতির প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। দুর্নীতি যে একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেম, তার জন্য কোনো এক বা কয়েকজন ব্যক্তি দায়ী নন, তা উপলব্ধির প্রয়োজন বোধ করেন না আমাদের নেতারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য করে বলেছেন, শুধু দুর্নীতি দুর্নীতি বললেই হবে না, কোথায়, কোন খাতে, কতটা দুর্নীতি হচ্ছে শুধু অভিযোগ করলেই হবে না, তথ্যপ্রমাণ উপস্থিত করতে হবে।
বাংলাদেশের কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে, তার তথ্যপ্রমাণ দাখিল করার কথা শুনলে বড়ই অসহায় ও বিপন্ন বোধ করি। কেউ যদি আমাকে বলেন যে বাংলাদেশে অক্সিজেন নামে যে কোনো পদার্থ আছে, তার প্রমাণ দাও। আমি দিতে পারব না। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গায় দুর্নীতির চিহ্ন রয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি কি ও কত প্রকার, তা এই দেশের সেই ব্যক্তিই জানে যে টিঅ্যান্ডটির একটি টেলিফোনের গ্রাহক, সারা জীবনের সঞ্চয়, বউয়ের অলংকার ও ঘটি-বাটি বিক্রি করে ঢাকার কোনো প্রান্তে কাঠা দেড়েক জমি কিনে কোনোমতে একটি ঘর তুলেছে, সেই ঘরে বিদ্যুৎ নিয়েছে, লাকড়ির চুলার বদলে তিতাস গ্যাসের লাইন নিয়েছে, যার একটি ভাঙাচোরা গাড়ি আছে, যেকোনো দিন একটি পাসপোর্ট করেছে, যে তার নিষ্কণ্টক জমি বিক্রি করতে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে একবার গেছে অথবা সম্পূর্ণ কষ্টার্জিত টাকায় কিনতে গেছে এক খণ্ড জমি। গত ৫০ বছরে আমি নিজে অন্তত ১৫ বার কাউকে না কাউকে ঘুষ দিয়েছি। ঘুষ নেওয়ার মতো দেওয়াও অন্যায়, তা জেনেও দিয়েছি। মাত্র এক বাসা থেকে আরেক বাসায় টেলিফোন শিফট করব, দূরত্ব মাত্র ২০০ গজ, কিছু ‘বকশিশ’ ছাড়া আড়াই মাসেও কাজ হয়নি।
এই উপমহাদেশে দুর্নীতি নতুন বিষয় নয়। ব্রিটিশ আমলে এর শুরু। তবে তখন খুব কম জায়গায় ঘুষ-দুর্নীতি ছিল। পুলিশের নিচের দিকে দারোগাদের কেউ ঘুষ খেতেন, কোনো এসপি ঘুষ খেয়েছেন, তেমন নজির অতি নগণ্য। সেকালে পদমর্যাদাই কাউকে বাধা দিত দুর্নীতি করতে। পঞ্চাশের দশকে আমার এক বন্ধুর বাবা রেলের টিটি ছিলেন। আমরা জানতাম, তিনি টিকিটবিহীন যাত্রীদের থেকে কিছু ‘খান’। কোনো কোনো দিন দু-তিন টাকা তাঁর ভাগ্যে জুটত। তাতেই তাঁর বদনাম হয়েছিল যে ঘুষখোর। তিনি এমনই দুর্নীতিবাজ ছিলেন যে মৃত্যুকালে কোনো সঞ্চয় রেখে যাননি। আমার বন্ধু আইএ পাস করেই চাকরিতে ঢোকে।
আজ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ছোট পুলিশ কর্মকর্তা নন, আইজির গ্রামের বাড়িতে প্রাসাদ ওঠে, তাঁর স্থাবর সম্পত্তিতে ভরে যায় শহর ও গ্রামের এলাকা। কেউ জিজ্ঞাসা করে না: এ টাকা তুমি কোথায় পেলে? বরং তাকে কূটনীতিকের চাকরি দিয়ে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি ও আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনো চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। বহু বাড়িঘর, জমি, দামি গাড়ি ও দোকানপাটের মালিক। রাষ্ট্র প্রশ্ন করে না: এসবের উৎস কী? এর নাম সিস্টেম।
স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দুর্নীতির উৎস ও তার কারণ অনুসন্ধানে একটি গবেষণাধর্মী কমিশন গঠন করেছিলেন। সেই কমিশনের রিপোর্টের অংশবিশেষ দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তার শুরুতেই ছিল হোয়াট ইজ করাপশন বা দুর্নীতি জিনিসটি কী? তারপর হোয়াট ইজ দ্য কজেজ অব দ্য করাপশন? অর্থাৎ দুর্নীতির কারণ কী? খুব বড় বড় নীতিমান পণ্ডিত ব্যক্তি ওই কমিশনে ছিলেন। দুর্নীতির সংজ্ঞা তাঁরা যা দিয়েছিলেন, আজ তাকে খুব সংকীর্ণ মনে হয়। দুর্নীতির পরিধি ও গভীরতা আজ আরও ব্যাপক পণ্ডিত নেহরুর দেশে ও বাংলাদেশে। তবে নেহরুর দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তফাতটা এখানে যে তাঁর দেশের নেতারা দুর্নীতির কথা স্বীকার করেন, বাংলাদেশের নেতারা তা অস্বীকার করেন বা চেপে যান।
কোনো মন্ত্রণালয়ের শীর্ষে যিনি আছেন, তিনি নিজে সৎ হলেই যে তাঁর মন্ত্রণালয় দুর্নীতিমুক্ত হবে, তা নয়। এক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তুলতে গিয়ে আমার স্ত্রী ৩০ টাকা ঘুষ দিয়ে এসেছেন। তিনি একা নন, তাঁর মতো অগণিত। জাতীয় সঞ্চয়পত্র কোন মন্ত্রণালয়ে? আয়কর বিভাগ কোন মন্ত্রণালয়ে? স্থানীয় সরকারে দুর্নীতি, গম আত্মসাৎ প্রভৃতি আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের সময় শুরু হয়েছে, এখন তার পরিমাণ কতটা, তা গাঁওগেরামের যে কেউ জানে। সার, ডিজেল নিয়ে কী হয়, তা কাগজে কিছু আসে, তার জন্য কৃষিমন্ত্রীকে দায়ী করা যাবে না—দায়ী সিস্টেম। কিন্তু দায়িত্ব বর্তায় মন্ত্রীর ওপর।
বাংলাদেশের বনভূমির প্রতিটি গাছ জানে, দুর্নীতি কোন পর্যায় থেকে কোন পর্যায়ে হয়। বৃক্ষের যদি মানুষের মতো ভাষা থাকত, সে চিৎকার করে সব বলে দিত: তার গোড়ায় মধ্যরাতের নৈঃশব্দ্যে করাত চালায় কে অথবা ব্যাগে কোটি কোটি টাকা নিয়ে প্রধান বনরক্ষক হওয়ার জন্য কে কোথায় ছোটেন। শিক্ষা বিভাগে কী হয়, শিক্ষামন্ত্রী তা খুব ভালো জানেন। ওই বিভাগের কথা শোনার জন্য প্রাথমিক স্কুলের কোনো হতভাগ্য শিক্ষক, যাঁর পাঞ্জাবি ঘাড়ের কাছে ছিঁড়ে গেছে, অথবা কোনো কলেজের অধ্যাপকের জবানবন্দি নেওয়ার দরকার নেই। হাইকোর্ট ও কার্জন হলের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকের ভবনটির দিকে তাকালেই যে-কারও নিঃশ্বাস দুর্নীতির গন্ধে বন্ধ হয়ে আসে।
খুব বেশি আগের কাগজ ঘাঁটাঘাঁটির দরকার নেই। রোববারের দুটি দৈনিকের দুটি সংবাদের দিকে তাকাতে চাই। ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম আর দুর্নীতির তদন্তে ভাটা’ শিরোনামে যুগান্তর লিখেছে: ‘দেশের ২৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জোট সরকারের আমলে সংঘটিত নামা অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তের উদ্যোগ ভেস্তে গেছে।... মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিবাজদের বহুমুখী তৎপরতার কারণেই ওই তদন্তকার্য সম্পন্ন হয়নি।’ জোট সরকারের সময় এক সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অতিথি সৎকারের বিল পরিশোধ করেই ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফতুর হয়ে যায়। এক মোরগের বিল তিনি ৭০০ টাকা পর্যন্ত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় তাঁর ভোজনবিলাসিতার কথা ও আনুুষঙ্গিক দুর্নীতির সম্পর্কে আমি লিখেছিলাম।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টাকার অভাব, তা জানা গেল প্রথম আলোর ‘তিন বিশ্ববিদ্যালয়কে টাকা দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় রাজি নয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাজেটের বেশির ভাগ অর্থ দেয় সরকার। কিন্তু আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা আছে।’ অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ উপচে পড়ছে।
অযোগ্য ও অসৎ লোকেরা আত্মরক্ষার বা আত্ম-উন্নতির জন্য বিচিত্র উপায় উদ্ভাবন করে। তার মধ্যে একটি স্তাবকতা। একালের ছেলেমেয়েরা একটি চমৎকার শব্দ বের করেছে: চামচামি। ভালো ভালো কাজ করে সরকারপ্রধানকে খুশি করার চেয়ে স্তাবকতা করে চাকরি টিকিয়ে রাখা জরুরি। ফলে কার সাধ্য তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ তোলে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কৃত হওয়ার অর্থ গোটা দেশবাসীর পুরস্কৃত হওয়া। আলাদা করে কোনো বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আনন্দের ব্যাপার নয়। ‘বিশ্ব মহিলা’ ও শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নে ‘সাউথ সাউথ’ পুরস্কার পাওয়ায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের উপাচার্য প্রফেসর ড. হক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ‘অকৃত্রিম অভিনন্দন’ জানিয়েছেন। বিজ্ঞাপনে মুদ্রিত হয়েছে দুটি ছবি: ডান দিকে প্রধানমন্ত্রীর, বাম দিকে উপাচার্যের। ছবি ও নাম দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ায় ধারণা হয় বিজ্ঞাপনের দেড়-দুই লাখ টাকা তাঁর নিজের। যদি তা না হয়ে থাকে, তা হলে তা হবে অনৈতিক ও অরুচিকর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যথাক্রমে প্রফেসর ড. আখন্দ ও প্রফেসর ড. আলমও ‘আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন’ জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাখ লাখ টাকা বিজ্ঞাপনে ব্যয় হলো।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোনো এক গভর্নিং বডির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রকাণ্ড ছবিসহ লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সমকাল-এর সোমবারের এক প্রতিবেদনে জানা গেল, পঞ্চগড়ের স্বাস্থ্য সহকারী নওয়াবউদ্দিন অবসর নেন ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর, মারা যান ’৭৯ সালে, তাঁর বিধবা স্ত্রী স্বামীর পেনশনের টাকা আজও পাননি। এ কি রাষ্ট্রীয় অপরাধ নয়?
যে তিন অমঙ্গলের কারণে একটি রাষ্ট্র অকার্যকর হয়, তার সবগুলোই বাংলাদেশে বর্তমান। এখন থেকে নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই। ইথিওপিয়া, জায়ার, গিনি, ঘানা, জাম্বিয়া, সোমালিয়া ও কেনিয়ার সম্মিলিত লোকসংখ্যার দেড় গুণ লোকসংখ্যা বাংলাদেশের। এই দেশে শুধু দুর্নীতিবাজ নয়, কৃষক-শ্রমিক সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে এখনো সৎ ও ভালো মানুষ কোটি কোটি। বিশেষ করে রয়েছে অভিভাবকহীন। অথচ অপার সম্ভাবনাময় যুবসম্প্রদায়। তারা রাষ্ট্রকে অকার্যকর ও ব্যর্থ হতে দিতে পারে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

রবীন্দ্রনাথ—সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতে

আড়াই হাজার বছরের সভ্য ও সংস্কৃতিমান বাঙালি জাতির যা কিছু মূল্যবান, তাকে আজ ঢেকে দিয়েছে আমাদের অস্বাভাবিক কলুষিত রাজনীতি। রাজনীতি ছাড়া আজ আমাদের জীবনে যেন আর কিছুই নেই। রাজনীতির নোংরায় নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের সুকুমারবৃত্তিসমূহ। বাঙালির সাহিত্য, শিল্পকলা, দর্শন, বাঙালির ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবন রাজনীতির চড়ায় আটকে গেছে। সকাল থেকে মধ্যরাতে ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত অপ্রীতিকর রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ অধিকার করে আছে রাজনীতি। এর সঙ্গে সংস্কৃতির নামে যে জিনিস দেখা যায়, তা চিরকালের বাঙালি সংস্কৃতি নয়; সংস্কৃতির নামে এক বিকৃত বস্তু, যাকে অনেকে নাম দিয়েছেন অপসংস্কৃতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি সংস্কৃতির সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত। তাঁর মধ্যেই প্রকাশ ঘটেছে একই সঙ্গে বাঙালির সৌন্দর্যবোধ ও মননশীলতার উপাদানসমূহ, সর্বাধিক পরিমাণে। বাংলা সাহিত্যের তিনি সর্বকালের সবচেয়ে বড় প্রতিভা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান প্রভৃতি শুধু নয়; সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই, যা তিনি স্পর্শ করেননি। গুণগত ও পরিমাণগত উভয় দিকেই তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অনতিক্রম্য। বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনিই এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। শুধু শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়, রাজনৈতিক-সামাজিক ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা বিরাট। এবং তাঁর গঠনমূলক ও সাংগঠনিক কাজের পরিমাণও বিশাল। যে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তা তাঁকে একজন মহান কর্মযোগীর মর্যাদায় ভূষিত করেছে। আগামী পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মজয়ন্তী।
গত ৮ মে থেকে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতে। বছরব্যাপী এই কার্যক্রম চলবে। আগামী পঁচিশে বৈশাখ এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটবে।
রবীন্দ্রনাথ সব দেশের, সব অঞ্চলের বাঙালির অভিন্ন সম্পদ। বাংলাদেশ ও উপমহাদেশ রাজনৈতিকভাবে ভাগাভাগি হওয়ার আগেই তিনি পরলোক গমন করেন। তিনি ভারতের, না বাংলাদেশের—এই প্রশ্ন তোলা মূর্খতার নামান্তর। গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ঘোষিত যৌথ ইশতেহারে বলা হয় যে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালন করবে। এটি ছিল গত ৩৯ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের সবচেয়ে সুন্দর সিদ্ধান্ত।
যৌথ ইশতেহারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বশীল। এতে রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, নাট্যশিল্পী, শিক্ষাবিদ প্রভৃতি। এতে আছেন সাবেক সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এমপি এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী (বেগম খালেদা জিয়া)। আমার মতো অভাজনকেও কমিটিতে রাখা হয়েছে। এরশাদ সাহেবের রোল নম্বর দুই, বিরোধীদলীয় নেত্রীর ক্রমিক নম্বর ১১ এবং আমার রোল নম্বর ১৪৭। তবে সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী যে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে তাঁর অমূল্য সময় কিছুটা খরচ করতে পারবেন সে আশা দুরাশা। তবু তাঁকে রাখা হয়েছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত বাংলাদেশের চেয়ে ২৩ গুণ বড়। সে দেশে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে বহু গুণ বেশি। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর সংখ্যা আরও বেশি। ভারতের কমিটি আমাদের কমিটির চেয়ে অনেক ছোট—সদস্যের সংখ্যা চার ভাগের এক ভাগ, মাত্র ৩৬। কমিটিতে লোকের সংখ্যা প্রচুর হলেই কাজের পরিমাণ হবে বিপুল, তা নয়। বরং আমার ধারণা, যেখানে লোক যত বেশি, সেখানে দেখা যাবে কাজের সময় লোক পাওয়া যাবে তত কম। হাজার খানেক অকাজের লোক থাকার চেয়ে, কাজের মানুষ দশজনই যথেষ্ট। আমার মতো অকম্মাকে কমিটিতে না রাখলেও, সরকার রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে ডাকলে আমি আনন্দের সঙ্গে খাটাখাটনি করে দিতাম। এ কথা আমি উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম। তাঁরা বললেন, কমিটিতে নাম না রাখলে অনেকে মন খারাপ করেন, কেউ কেউ রাগও করেন। আমি বললাম, তা বটে। বাংলাদেশে কাজ করার চেয়ে মন খারাপ করা সহজ, রাগ করা আরও সহজ।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালিকে শুধু গান শেখাননি, তিনি শিখিয়েছেন রুচিজ্ঞান ও পরিমিতিবোধ। তবে তিনি শেখালেই যে শিখব, তেমন জাতি আমরা নই। তাই দেখছি, রবীন্দ্রনাথ শিখিয়ে গেলেও আমাদের রুচিজ্ঞান ও রসবোধ উন্নত হয়নি, মাত্রাজ্ঞান সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
জাতীয় কমিটি গঠন করার সময় এর কাজের পরিধি সম্পর্কে বলা হয়েছিল: ক. নীতিনির্ধারণ ও যথাযথ মর্যাদাসহ সার্ধশত জন্মবার্ষিকী পালনসংক্রান্ত যথোচিত নির্দেশনা প্রদান এবং খ. জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন-সংক্রান্ত সময় ও কর্মসূচিসংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান।
পরামর্শ বা উপদেশ দেওয়ার চেয়ে সহজতম জিনিস আদম-হাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই গ্রহে দ্বিতীয়টি ছিল না। সুতরাং সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার মওকা যখন একবার পাওয়া গেছে, তার সদ্ব্যবহার ১৫৫ জনের বিপুল অধিকাংশই যে করবেন, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। পরামর্শের প্রবলতায় শেষ পর্যন্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নাভিশ্বাস ওঠে কি না বলা যায় না।
এর মধ্যেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক ‘কার্যপত্রে’ দেখেছি যে ‘সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ১৩৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে আরও সদস্য অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জাতীয় কমিটির সভার পরে তা চূড়ান্ত করা হবে।’ জাতীয় কমিটির সভার আগেই সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীর সভাপতিত্বে ২০ এপ্রিল ও ১৩ জুন দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অন্তত ৩১টি প্রস্তাব ‘জাতীয় কমিটির সভায় বিবেচনার জন্য’ উত্থাপিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ব্যুরোক্রেসিকে ভয় করতেন, তাঁর আত্মা সম্ভবত ভয় করে আরও বেশি।
ওই যে ‘আরও সদস্য অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়টি’র কথা বলা হয়েছে, সেটাই বিপদের আশঙ্কার বড় কারণ। প্রধানমন্ত্রী নিজেই একটি চমৎকার প্রস্তাব করেছেন। কবির সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি ‘মৈত্রী ট্রেন’ চালু হবে। কমিটির সদস্যসংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে মৈত্রী ট্রেনের উদ্বোধনী যাত্রায় কমিটির বাইরের সাধারণ যাত্রীদের অনেকে তাঁদের স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়ে কালোবাজারে টিকিট কেটেও কলকাতায় যেতে পারবেন, সে ভরসা নেই। এমনকি কমিটির সদস্যদের মধ্যে বুড়োগোছের অনেকে ট্রেনের বগির হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে জয়দেবপুর পর্যন্ত যেতে পারেন কি না সন্দেহ। টানাটানি, ধাক্কাধাক্কিতে হয়তো বহু সদস্য ট্রেনেই উঠতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর কাঁধের শান্তিনিকেতনি ঝোলাটি ট্রেনে অন্য কারও সঙ্গে চলে যাবে শিয়ালদহ স্টেশনে।
কমিটির প্রথম সভাটি হয়েছে ৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তাঁর কার্যালয়ে। অধিকাংশ সদস্যই উপস্থিত ছিলেন এবং পরামর্শ দেওয়ার সুযোগটি হাতছাড়া করেননি অনেকেই। সবার পরামর্শ যদি সরকার বাস্তবায়ন করতে চায়, তাহলে বর্তমান অর্থবছরে আর কোনো কাজ করতে পারবে না। সভার শুরুতে ‘প্রস্তাবাবলিসহ গৃহীতব্য কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা উপস্থাপন’ করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব। তিনি ‘যৌথ কার্যক্রমের জন্য প্রাপ্ত প্রস্তাবসমূহ’ উপস্থাপন করেন। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে:
‘যৌথ/যুগপৎ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন, উদ্বোধনী দিনে উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় উচ্চপর্যায়ের নেতাদের উপস্থিতি, বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ক্রোড়পত্র প্রকাশ, বিশ্বকবির গবেষণা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত গুণীজন সংবর্ধনা, সম্মাননা ও পদক প্রদান এবং বিভিন্ন ধরনের যৌথ কার্যক্রম (সংগীত, নৃত্য, নৃত্যনাট্য, নাটক, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রপ্রদর্শনী, আলোচনা, সেমিনার, নাট্য কর্মশালা, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রস্তাবিত যৌথ অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রবীন্দ্র-চেয়ার প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ-ভারতের বাইরে তৃতীয় দেশের জন্য রবীন্দ্র বৃত্তি প্রদান, যৌথ প্রকাশনা, স্যুভেনির প্রকাশ, ছবি, ভিডিওচিত্র, দুই দেশের শিল্পীদের রবীন্দ্রসংগীতের যৌথ সিডি রেকর্ডিং ও প্রকাশ, সাংস্কৃতিক দল বিনিময়, কবিগুরুর গবেষণা ও অন্যান্য বিষয়ে সম্পৃক্ত ১০০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্য ভিসা সহজীকরণ, ভ্রাম্যমাণ রেল জাদুঘরের আয়োজন, পদ্মাবোটের অনুকরণে বোট নির্মাণ ও শুভেচ্ছা উপহার হিসেবে একটি বোট বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান। এ ছাড়া যৌথ ও বহুপক্ষীয় কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে ভারত ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বিষয়সমূহ নির্ধারণ করার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
[জাতীয় কমিটির প্রথম সভার কার্যবিবরণী, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়]
প্রধানমন্ত্রী সভার শুরুতে কিছু বলেন কবি সম্পর্কে। তারপর তিনি আমাদের মতামত আহ্বান করেন। ড. সন্জীদা খাতুন বলেন, প্রস্তাবিত রবীন্দ্র-চেয়ার প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে এবং পরে তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। ড. আনিসুজ্জামান বলেন, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন দুই দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে হওয়ায় ক্ষতি নেই, বরং তাতে উভয় দেশে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হবে এবং উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উভয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন। সেলিনা হোসেন বলেন, রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী এবং নজরুলের ১১২তম জন্মবার্ষিকীও বাংলাদেশ-ভারত কর্তৃক যৌথভাবে উদ্যাপিত হতে পারে। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান জানান, এ বছর ‘রবীন্দ্র পদক’ প্রবর্তন করেছে একাডেমী। প্রথমবার দুজন গুণী ব্যক্তিকে এই পদক দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বারবার সবাইকে বসে বসেই পরামর্শ দেওয়ার জন্য বলছিলেন। সরকারের বহু নির্দেশ যেমন পালন করার প্রয়োজন মনে করেন না অনেকেই, সেদিন অবশ্য সৌজন্যতাবশত সরকারপ্রধানের ওই নির্দেশ না মানাই সমীচীন মনে করেন কমিটির সদস্যরা। সৈয়দ শামসুল হকের প্রস্তাব ছিল একটু ব্যতিক্রমী। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে প্রস্তাব করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনটি ‘গণতন্ত্র চেতনা দিবস’ হিসেবে পালন করার ব্যবস্থা করা হোক। পিনপতন নীরবতার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীই তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘না-না-না, কোনো দরকার নাই।’ তারপর সৈয়দ হক প্রস্তাব করেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানও যেন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নানা রকম প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক পরামর্শ উত্থাপিত হতে থাকে। হাসিমুখে ধৈর্যসহকারে প্রধানমন্ত্রী সব শোনেন প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী। অসীম সাহা বলেন, শুধু রবীন্দ্রগবেষকই নন, সব শ্রেণীর সংস্কৃতিকর্মীর জন্য ভারত কর্তৃক ভিসা সহজীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা সমীচীন হবে। নির্মলেন্দু গুণ ঢাকার একটি বড় রাস্তার নাম রবীন্দ্রনাথের নামে করার প্রস্তাব করেন এবং বাংলাদেশি টাকায় কবির ছবি মুদ্রণের দাবিও করেন।
সভাপ্রধানের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উত্থাপিত মতামত যত দূর সম্ভব গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। তিনি নিজে একটি চমৎকার প্রস্তাব করেন। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করছেন এমন শিক্ষার্থীদের জন্য ‘বাংলাদেশ ভবন’ নামে একটি ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে মৈত্রী ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার নাম ‘সোনার তরী’।
আমি যে দুটি প্রস্তাব করার প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম, তা আগেই উত্থাপিত হওয়ায় বেঁচে যাই। আমি বলতে চেয়েছিলাম, শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশের একটি ভবন থাকা দরকার, যেখানে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা হবে এবং কবির নামে ঢাকার একটি প্রধান সড়কের নামকরণ। আমি যতটা জানি তা হলো, প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা যখন ডিগ্রি নিতে বিশ্বভারতীতে যান, তখন তিনি এ ধরনের একটি ভবন নির্মাণের মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মধ্যাহ্নভোজের সময় আমার দাবি দুটিও প্রধানমন্ত্রীকে নিবেদন করি। আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি আমার কথা শুনলেন এবং বাস্তবায়নে সব চেষ্টা করা হবে বলে আশ্বাস দিলেন।
রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মজয়ন্তী ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে উদ্যাপন করবে বলে ঘোষিত হলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। ভারত কাজ শুরু করেছে এবং এগিয়ে গেছে অনেক দূর। শান্তিনিকেতনকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণার জন্য ইউনেসকোর কাছে আবেদন করেছে ভারত সরকার। বাংলাদেশ শিলাইদহের কুঠিবাড়ির জন্য আবেদন করতে পারত। করেছে কি না, তা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে ফোন করে আমি জানতে পারিনি। ভারতীয় রেলওয়ে পাঁচ কামরার একটি ট্রেনে বিশেষ রবীন্দ্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘সংস্কৃতিযাত্রা’। পাঁচটি বগির যাত্রীদের বসার আসন সরিয়ে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম ও স্মৃতিস্মারকে সজ্জিত করা হয়েছে। পাঁচটি কোচের নাম দেওয়া হয়েছে ‘জীবনস্মৃতি’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘মুক্তধারা’, ‘চিত্ররেখা’ ও ‘শেষকথা’। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বগিগুলোর বহিরঙ্গ সজ্জা ও ডিজাইন করেছেন শিল্পী যোগেন চৌধুরী।
আমরা হাজারো কাজ করব বলে পরিকল্পনা করে কোনো কাজই সুন্দরভাবে করতে পারছি না। শেষ মুহূর্তে তিন তুড়িতে কাজ করতে গিয়ে টাকার শ্রাদ্ধ হবে, কাজটিও ঠিকমতো করা হবে না।
আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অন্য সমস্যাও আছে। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেননি, তবে তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তাঁর নির্দলীয় রাজনীতি ছিল শুভবুদ্ধির রাজনীতি। কিন্তু বারবার তিনি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের রাজনীতির শিকার হয়েছেন। তা হয়েছেন জীবনকালে ও মৃত্যুর পরও।
রবীন্দ্রনাথ মারা যান অখণ্ড ভারতে, কিন্তু পাকিস্তান তাঁকে নিজের কবি বলে স্বীকার করেনি। পাকিস্তানে তিনি ছিলেন পথভোলা এক পথিক, শাসকেরা তাঁকে চিনতেন না। তাঁর জন্মশতবর্ষ তাঁরা যথাযথ মর্যাদায় পালন করেননি। তবে সরকারের অবহেলা পুষিয়ে দিয়েছেন বাঙালি সংস্কৃতিসেবীরা। পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটতে বাঙালি ভালোবাসে। এবারও ঘাঁটা শুরু হয়েছে। কারণ বাঙালির কাছে বর্তমান ও ভবিষ্যতের চেয়ে অতীত প্রিয়। এবারও আইয়ুব খানকে আসামি বানিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে স্বস্তি পাবে না বাঙালি।
একটি উচ্চতর সংস্কৃতির নাম রবীন্দ্রনাথ। রুচিশীলতা ও যুক্তিশীলতার নাম রবীন্দ্রনাথ। অবস্থা দেখে মনে হয়, দুই বাংলার একশ্রেণীর রবীন্দ্রপ্রেমিক মনে করেন, লম্বা পাঞ্জাবি, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ঝোলা, কৃত্রিম ভঙ্গিতে হাঁটাচলার নাম রবীন্দ্রসংস্কৃতি। একটি শ্রেণী ফুল-চন্দনখচিত একটি ঘরে কবিকে আটকে রাখার পক্ষপাতী। সার্ধশত জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে কলকাতার একটি চ্যানেল গানের ওপারে নামে একটি ধারাবাহিক করছে গত বৈশাখ থেকে। আমার স্ত্রী ও মেয়ে প্রতিদিন সেটা দেখে। কখনো আমিও একটু দেখি। মূল চরিত্রটি একজন রবীন্দ্রগবেষক। সিরিয়ালটিতে দেখাতে চাইছেন রবীন্দ্রনাথকে ঠাকুর বানিয়ে কেউ পূজা করছেন, কেউ তাঁকে নিয়ে করছেন ব্যবসা।
আরেক সমস্যা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নয়, রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে। রক্ষণশীলেরা মনে করেন, রবীন্দ্রসংগীত যক্ষের ধন। তা শুধু হারমোনিয়াম, তানপুরা ও তবলার চাঁটিসহ গীত হবে। কিন্তু মানুষ বেশি দিন একঘেয়ে জিনিস পছন্দ করে না। ওই ধারাবাহিকটির বক্তব্য হলো, রবীন্দ্রসংগীতকেও যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বদলাতে হবে। তা না হলে তা সেকেলে হয়ে যাবে। কেউ যদি গিটার বাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান গায়, তাতে ক্ষতি কী? রবীন্দ্রনাথকে সবাই ধারণ করুক।
জাতির মহত্তম সৃষ্টিশীল প্রতিভার শতবর্ষ বা সার্ধশতবর্ষ একবার করেই আসে। জাতি যদি উপযুক্ত হয়, তাহলে উপলক্ষটিকে ষোলআনা কাজে লাগাতে পারে। জাতি যদি অযোগ্য হয়, তাহলে উপলক্ষটা তার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে। অগোছালোভাবে ও দায়সারা গোছে কাজ করা রবীন্দ্রনাথ অপছন্দ করতেন। তাঁর ১৫০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমরা যদি তা-ই করি, তা হবে কবির প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের নামান্তর। আর যদি রুচি ও নৈপুণ্যের প্রকাশ ঘটে, সেটাই হবে উপলক্ষটির জন্য উপযুক্ত।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

উদ্ধারকাজ: খালের ও খনির

দুটি উদ্ধারকাজ দেখলাম গত কয়েক দিনে। একটি বাংলার মাটিতে। মাটিতে বললে ভুল হবে—বাংলার পানিতে। আরেকটি চিলিতে। চিলির মাটিতেও নয়—মাটির নিচে। সোনা ও তামার খনিতে। একেবারে পাতালে। মাটির ওপর থেকে আধা কিলোমিটারেরও বেশি নিচে।
বাংলার মাটির উদ্ধারকাজটি আমাদের চ্যানেলগুলোয় দেখেছি। চিলির পাতালে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারকাজ দেখেছি বিবিসিতে। তারা সরাসরি সম্প্রচার করেছে।
সালেহপুর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তুরাগ নদ। শীর্ণ তুরাগও নয়, তুরাগের একটি শাখাবিশেষ। কিন্তু টিভি চ্যানেলের সংবাদকর্মীদের সামনে মুখে খইফোটা আমাদের কর্মকর্তাদের বাচনে জানা গেল, তুরাগের শাখাটিই পৃথিবীর সবচেয়ে খরস্রোতা নদী। উত্তাল তার স্রোত। তুরাগের তুফানের কাছে আমাজান, আমু দরিয়া, হোয়াংহো তুচ্ছ। তুরাগের তরঙ্গের সামনে ম্লান হয়ে গেল আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার ব্রিগেড, র‌্যাব, পুলিশ প্রভৃতি বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রতিভা। একটি হতভাগ্য বাস এবং হতভাগ্যতর প্রাণহীন যাত্রীদের দেহ পড়ে রইল পানিতে, ডাঙায় দাঁড়িয়ে শুধু পানির দিকে তাকিয়ে রইল হাজার হাজার কৌতূহলী মানুষ। যাঁদের মধ্যে ছিলেন হতভাগ্যদের প্রিয়জনেরাও।
সালেহপুর সেতুতে যা ঘটেছে, তা কোনো দুর্ঘটনা নয়—একটি রোমাঞ্চকর দুঃসাহসিক অভিযান। কোনো রকমে আমরা বাসের বডি বানাতে শিখেছি, ইঞ্জিন বানাতে পারি না। পারলে এমন শক্তিসম্পন্ন ইঞ্জিন বানাতাম, যার গতি হতো ঘণ্টায় ৫০০ কিলোমিটার। আমরা বীরের জাতি। তাই কম গতির বাস চালকের পছন্দ নয়। অন্যের পেছনে যাওয়াও কোনো বীরের জাতির পক্ষে সম্ভব নয়। সামনের চাকা পাংচার হলো তো কী! তবুও আরেক বাসকে অতিক্রম করতে হবে। তা করতে গিয়ে ব্রিজের ওপর থেকে যদি চালককে ৫০ জন যাত্রী নিয়ে বাসটিসহ ৪০ ফুট পানিতে লাফিয়ে পড়তে হয়, তাতে দোষ কী?
তাই সালেহপুরের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আমাদের মেয়ে মনোয়ারা খাতুন তারা বাসের ভেতর থেকে নিজের শক্তিতে বেরিয়ে এসেও বাঁচতে পারল না। হয়তো সে ওই বাসের যাত্রী না হলেও এই সমাজে বাঁচতে পারত না। কোনো লম্পটের লালসার শিকার হয়ে একদিন ওকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হতো। পানিতে হোক, ডাঙায় হোক—এ সমাজে নারী ও দুর্বল বাঁচতে পারে না।
অন্যদিকে বাঁচার অদম্য আকাঙ্ক্ষা দেখেছি চিলির মানুষের মধ্যে। অবশ্য সালেহপুর খাল থেকে সান হোসে খনি অনেক দূর। সান হোসে খনিতে ৩৩ জন শ্রমিক ৭০ দিন ধরে আটকে ছিলেন—শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনা। বিশ্বব্যাপী মানুষ উদ্বেগে। আমাদের বড়পুকুরিয়ায় হলে অনেক আগেই হতভাগ্যদের চেহলাম অথবা আদ্যশ্রাদ্ধ করে ফেলতে হতো। জ্বালানিমন্ত্রী ও উপদেষ্টা শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়ে বাণী দিতেন। ৩৩ জনের বিনা খরচায় শেষকৃত্য হয়ে যেত।
প্রশান্ত মহাসাগরের কোলে লাঠির মতো লম্বা দেশ চিলি। কোনো সাংঘাতিক উন্নত দেশ নয়। তার অতীত ও বর্তমান রাজনৈতিক ইতিহাস আমাদের মতোই বেদনাদায়ক। বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের কাছে পাবলো নেরুদার দেশ বলেই পরিচিত চিলি। চিলির সংবাদ সংস্থার সাবেক সম্পাদক ইউজেনিও অবলিতাজ আমার বন্ধু। হামবুর্গ ও বার্লিনে আমরা পাশাপাশি কামরায় অনেক দিন ছিলাম। তখন মার্কসবাদী সালভাদর আলেন্দেকে সরিয়ে অগাস্টো পিনোশে ক্ষমতা দখল করেছেন। অবলিতাজ ছিলেন পিনোশের মানুষ। ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝতাম, নানা রকম গাভির একই রকম দুধ, জগৎ ঘুরে দেখা যাবে সব দেশের মধ্যশ্রেণীই একই রকম সুবিধাবাদী। তা সত্ত্বেও স্প্যানিশভাষী চিলির মানুষ স্বাজাত্যবোধে বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে অগ্রসর।
আমি যখন লেখাটি লিখছি, আমার সামনে টেলিভিশন খোলা। দেখছি শ্বাসরুদ্ধকর উদ্ধারকাজ। উদ্ধারকর্মীদের নৈপুণ্য ও দক্ষতা। বহুদিন ধরে তৈরি করা ৬২৫ মিটার দৈর্ঘ্যের সুড়ঙ্গ দিয়ে ২১ বর্গ ইঞ্চি একটি ক্যাপসুল চলে যাচ্ছে আটকে পড়া শ্রমিকদের কাছে। ঝুঁকিপূর্ণ লিফটে চড়ে প্রথম যিনি উঠে এলেন, তাঁর নাম ফ্লোরেনসিও আভাতোজ। বয়স ৩১। ৭০ দিন পর দুনিয়ার আলো দেখলেন। সুড়ঙ্গের মুখের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর ছয়-সাত বছরের ছেলে ও স্ত্রী মনিকা। এত দিন পর বাবাকে দেখে ছেলেটি ভীষণভাবে কাঁদতে লাগল। পৃথিবীর যেকোনো নারীর মতো মনিকার আবেগও একই রকম। দ্বিতীয় যে শ্রমিককে তোলা হলো, তাঁর নাম মারিও সেপালভেদা।
৩৩ জনের মধ্যে একজন বলিভিয়ার নাগরিক। সে জন্য উদ্ধারকাজ দেখতে ছুটে এসেছেন বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস। আভাতোজ উঠে আসার পর সংযত ভাষণ দিলেন চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা। নিজের কৃতিত্বের জন্য বড়াই করেননি। কথা বললেন বহুবচনে: ‘আমরা’।
চিলির চেয়ে আমরা চৌদ্দ গুণ বেশি মানুষ। উত্তাল তুফানের কারণে কচুরিপানা ভাসা খালের মধ্যে একটি বাস শনাক্ত করে তুলতে লাগল ৫৪ ঘণ্টা। ৩৯ বছরে সরকারি কোনো ক্ষেত্রে আমরা দক্ষ জনশক্তি ও বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে পারিনি। অথচ সব বিভাগে মানুষ গিজ গিজ করছে। বেতনভাতা দিয়ে পোষা হচ্ছে। মানি আমাদের কোনো প্রবলেম নয়। চাপিয়ে দেওয়া বৈদেশিক ঋণের টাকা বারোআনা খেয়ে ফেলেছি। বাকিটুকু দিয়ে কিনেছি অদরকারি ভোগ্যপণ্য, চেয়ার-টেবিল প্রভৃতি। কর্তাদের বিশাল চেয়ারখানির পেছনে বড় তোয়ালে মেলে দিয়েছি। চেয়ারের পেছনেই কোট-টাই ঝুলিয়ে রাখার স্ট্যান্ড বা আলনা দিয়েছি। মাথার চুল ঘন ঘন আঁচড়ানের জন্য দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছি আয়না। লাঞ্চ করার জন্য পার্টিশন দিয়ে ঘের দিয়েছি। দুপুরের পরে ভাতঘুমের জন্য কোনো কোনো আমলার ঘরে আছে বিশাল ইজি চেয়ার। ২০০১ থেকে অজুর বদনাও প্রত্যেকের ঘরে দেওয়া হয়েছে। বদনা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পোয়াবারো। বাড়ি এবং গাড়ির কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। একটি মাঝারি দুর্ঘটনার উদ্ধারকাজ চালানোর যন্ত্র আমাদের নেই।
সালেহপুরের হতভাগ্যদের জন্য শোক প্রকাশ করা ছাড়া করার কিছুই নেই। চিলির সান হোসের খনির পাতাল থেকে উদ্ধার করা শ্রমিকদের জন্য আমাদের গভীর আনন্দ। সুদক্ষ উদ্ধারকারীদের জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন। চিলির সরকারকেও আমাদের অভিনন্দন।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।