মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

কাঁদো কবি কাঁদো


সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ১৯-০৬-২০১২




সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অতুলনীয় উপন্যাসটির নাম কাঁদো নদী কাঁদো। বাংলার মানুষের চেতনাপ্রবাহ রীতিতে উপন্যাস লেখার ক্ষমতা থাকলে তারা লিখত ‘কাঁদো কবি কাঁদো’।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে ছোটখাটো কবি ছিলেন না। সুখ-দুঃখের বহু রকমের কবিতাই লিখেছেন। চোখের সামনে একের পর এক প্রিয়জন চলে গেছে। দুঃখের গানও লিখেছেন অনেক। মহর্ষিপুত্র নিজের কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন অন্যকে। অন্যরাও তাঁর পদ্য আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন তাঁকে। কিন্তু তিনি তাঁর কবিতা ও গান শুনে কাঁদেননি। যদি একবার কোনো রকমে কাঁদতেন, তা হলেই হয়েছিল! সেই কান্নার পটভূমি, কবার রুমালে চোখ মুছেছেন এবং সেই কান্নার তাৎপর্য বাঙালির জীবনে কতটা—প্রভৃতি নিয়ে হতো গবেষণা। এবং নির্দ্বিধায় বলা যায়, তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশে যে ২৫০টির মতো বই বেরিয়েছে সেখানে যোগ হতো আর একখানা, যার শিরোনাম হতো: ‘রবীন্দ্রকান্নার বহুমাত্রিকতা’ অথবা ‘রবীন্দ্রনাথের কান্না ও বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা’। কিন্তু দূরদর্শী কবি কাঁদেননি, তাই ওই বিষয়ে বই পড়ার বিড়ম্বনা থেকে বাঙালি বেঁচে গেছে।
কিন্তু যা কখনো আগে হয়নি, বাঙালির জীবনে তা এই কলি কালে ঘটবে না, বাঙালি তেমন জাতিই নয়, চর্যাপদের পর থেকে হাজার বছরের বাংলা কাব্যের ইতিহাসে গত বুধবারই প্রথম কোনো কবি নিজের কবিতা আবৃত্তি শুনে কাঁদলেন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘অনুষ্ঠানে কারাবাসের ঘটনা নিয়ে লেখা কবিতা আবৃত্তির সিডি বাজানোর একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন এরশাদ। চোখ মুছে বক্তব্য দিতে আসেন মঞ্চে। তিনি বলেন, ছয় বছর কারাবাসের পর নিজের বাড়ির পেয়ারাগাছের নিচে বসে কবিতাটি লিখেছেন।’ আম, আতাফল বা বরইগাছ নয়; ওই কবির পেয়ারাগাছের নিচে বসে কবিতা লেখা খুবই অর্থবহ।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে ছাতিমগাছের তলায় বসে কিছু গান-টান লিখেছেন। কাজী ফকির আহমদের পাগল ছেলেটির মাথার ওপর কোনো গাছপালার ছায়া ছিল না। রাস্তাঘাটে যেখানেই বসেছেন, সেখানেই লিখে ফেলেছেন কবিতা, আর হো হো করে হেসেছেন। আমাদের কবির মতো কাজীপুত্রও কারাগারে গেছেন এবং লিখেছেন: ‘কারার ওই লৌহকপাট/ ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট...’। তাঁর কবিতা শুনে তিনি নিজে বা অন্য কেউ কাঁদেনি। কিন্তু তাদের রক্তে আগুন লেগে গেছে।
যে কবি নিজের কবিতা শুনে কাঁদেন, তিনি চাট্টিখানি কবি নন। বিরাট কবি বাল্মীকি কাঁদেননি। মহাকবি কালিদাস তাঁর নিজের কবিতা শুনে কাঁদেননি। মহাকবি ফেরদৌসির শাহনামায় কাঁদার মতো কাহিনি বহু আছে। তা পাঠ করে চোখের পানি ফেলেছেন কেউ কেউ। কবি নিজে কাঁদেননি।
কাঁদো নদী কাঁদোর কাহিনি গড়ে উঠেছে বাঁকাল নদী ও কুমুরডাঙ্গাকে কেন্দ্র করে। ‘বাঁকাল নদীতে চড়া পড়ার জন্যে আর স্টিমার আসবে না।’ চড়ার কথাটা প্রথমে শহরের প্রভাবশালী উকিল কফিলউদ্দিনও বিশ্বাস করে না, তার প্রশ্ন: ‘কোথায় চড়া পড়েছে, কেই বা বলেছে চড়া পড়েছে?’ আসলে কি গল্প-উপন্যাসে, কি বাস্তব জীবনে নেতৃত্বস্থানীয়রা কোনো অমঙ্গলের কথাই বিশ্বাস করেন না।
এর মধ্যে বিপত্তি ঘটায় মোক্তার মোসলেহউদ্দিনের মেয়ে সখিনা। সে ‘একটি বিচিত্র কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়’ নদীর ভেতর থেকে। কুমুরডাঙ্গা সম্পর্কে ওয়ালীউল্লাহর কথাই হুবহু উদ্ধৃতি করি: ‘কুমুরডাঙ্গার লোকেরা এমনই হিংসুটে এবং নীচমনা যে নিজের নাক কেটেও পরের ক্ষতি করতে তারা সদা প্রস্তুত। অবশ্য কুমুরডাঙ্গার আর্থিক অবস্থাটা ভালো নয়,...রাহাজানি, খুনখারাবী, নারী ধর্ষণ এসবের মতো দারিদ্র্যও নৈতিক অবনতির একটি লক্ষণ। [শহরবাসী ভাবে]...ভয়ঙ্কর বিপদ গুটিগুটিপায়ে কুমুরডাঙ্গার দিকে এগিয়ে আসছে, এমন কোনো মহামারী যা সমগ্র শহর উজাড় করে দেবে? বা কোনো মহাপ্লাবন যা দুরন্তবেগে ছুটে এসে মানুষের ঘরবাড়ি গোলাঘর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে? অথবা কোনো প্রচণ্ড ভূমিকম্প যা নিমিষের মধ্যে পায়ের নিচের শক্ত জমিকে বিশালকায় কোনো জন্তুর মুখগহ্বরে পরিণত করবে?’
বাঁকাল নদী আর কুমুরডাঙ্গা আজকের বাংলাদেশের প্রতীক। বাংলার বুক থেকে মধ্যরাতে একটি কান্নার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। কুমুরডাঙ্গার মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষের মনেও অজানা আশঙ্কা। কখন কী ঘটে! চেতনার নদীতে চড়া। জনজীবনে নীরব কান্নার আওয়াজ। সখিনার মতো হতভাগিনীরা সে কান্না শোনে। নেতারা বিশ্বাস করেন না। কারণ, তাঁরা নিজের কানে কোনো কান্নার আওয়াজ শোনেননি। কবি ও রাষ্ট্রপতি কাঁদেন নিজের মনের দুঃখে। দেশের দুঃখে চোখে পানি আসে না।
ওই কবিতাপাঠের আসরে শেষ কথা কান্না নয়। খুশির কথাও ছিল। সেটি পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম নয়, দ্বিতীয় ঘটনা। অমন ঘটনা প্রথম ঘটে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের জীবনে। তাঁর প্রিয় পুত্র হুমায়ুন মৃত্যুশয্যায়। তিনি তাঁর শয্যার চতুর্দিকে পায়চারি করতেন আর প্রার্থনা করতেন: হে খোদা, আমাকে তুমি নিয়ে যাও, আমার অবশিষ্ট আয়ু হুমায়ুনকে দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে তোলো। শিগগিরই বাবর শয্যা গ্রহণ করেন এবং মারা যান। হুমায়ুন সুস্থ হয়ে মোগল সাম্রাজ্যের পরমায়ু ৩৩১ বছর পর্যন্ত দীর্ঘ করেন।
সেদিনের কবিতাপাঠের আসরে জাতীয় পার্টির মহাসচিব কবিতা শুনে নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়ে প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের সবার কাছ থেকে আয়ু নিয়ে আমার নেতার আয়ু বাড়িয়ে দাও।’
ওই মোনাজাতের পরে আসুন আমরা সবাই বলি: আমিন।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

বাঙালি চরিতামৃত

সৈয়দ আবুল মকসুদ

লক্ষ্মণ সেন ও বখতিয়ার খিলজির পরবর্তী হাজার বছরের বাংলার ইতিহাসে গত হপ্তায় প্রথম হয়ে গেল কফিন র‌্যালি। বাংলার মাটিতে একবার কেউ কোনো কিছু শুরু করলে তা আর থামে না। চলতে থাকে অপ্রতিহত গতিতে। অবিলম্বে কফিন র‌্যালির কারণে যানজট বেঁধে যাবে প্রেসক্লাব, মৎস্য ভবন, মওলানা ভাসানী এভিনিউ থেকে জাদুঘর পর্যন্ত। শুধু ঢাকায় নয়, জেলা ও উপজেলা সদরেও হবে। নানা দাবি আদায়ে হবে কফিন র‌্যালি। কেউ করবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে, কেউ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে, কেউ ইসলামি শরিয়া বাস্তবায়নের দাবিতে, কেউ অতি দ্রুত পদ্মা সেতু নির্মাণের দাবিতে, কেউ টিপাইমুখ ও তিস্তা চুক্তির ইস্যুতে, কেউ বিদ্যুতের দাবিতে, কেউ সপ্তম নৌবহর ‘দ্বিতীয় বাংলাদেশে’ এসে নোঙর ফেলতে না পারে সে দাবিতে, কেউবা কালোটাকা সাদা করার দাবিতে।
আমি প্রথম শিরোনাম দেখে মনে করেছিলাম, নতুন বাজেটে কফিনের ওপর ভ্যাট নামক কর আরোপের প্রতিবাদে কফিন মিছিল ও সমাবেশ। কারণ, এমন বিষয় নেই যার ওপর মাননীয় অর্থমন্ত্রী ভ্যাট আরোপ করেননি। বিস্ময়ের ব্যাপার, কফিনের ওপরই তিনি ভ্যাট আরোপ করেননি। হয়তো মনে পড়েনি ওই বস্তুটির কথা, কফিন মিছিল হয়েছে ‘নিরাপদে হাঁটার পরিবেশের দাবিতে’।
‘পথচারীবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাজেট বরাদ্দ করে নগরে নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটার জন্য যান্ত্রিক যানের গতি নিয়ন্ত্রণ’-এর দাবিসহ বিভিন্ন দাবিতে কফিন র‌্যালি হয়। র‌্যালির যাঁরা আয়োজন করেন, তাঁরা কেউই পাবনার হেমায়েতপুর থেকে ছাড়া পাওয়া মানুষ নন। ওখান থেকে ছাড়া পেলেই ঢাকা দক্ষিণে এসে তাঁরা কফিন র‌্যালি করবেন, অত পাগল তাঁরা কেউ নন। কফিন র‌্যালির আয়োজন করে একটি নয়, দুটি নয়—১১টি বেসরকারি সংগঠন।
কফিন র‌্যালি অতিদূরদর্শী ও খুবই বাস্তব চিন্তাপ্রসূত কর্মসূচি। তার পেছনে রয়েছে গভীর ফিলোসফি। দুঃখবাদী জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার আজ বেঁচে থাকলে খুশি হতেন। আড়াই শ বছর পরে তাঁর দর্শনের বাস্তবায়ন হলো বাংলার মাটিতে। উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙালি প্রবীণ আর কফিনের সম্পর্ক আজ ঘনিষ্ঠ। তাঁরা থাকেন ঢাকায় একা চাকরদের নিয়ে। ছেলেরা থাকে আমেরিকায়। বড় মেয়ে স্বামীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায়, ছোট মেয়ে একগাদা বাচ্চা নিয়ে কানাডায়। শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর গরম পানি ও বরইপাতা দিয়ে গোসল দিয়েই দাফন হবে, তা সম্ভব নয়। হাসপাতালে নার্সদের হাতের মধ্যে দমটা তো বেরোল। তারপর প্রাণহীন শরীরটা না হয় আত্মীয়স্বজন টানাটানি করল। ছোট মেয়ের আবার বাচ্চা হবে। স্ত্রী গেছে ওই অজুহাতে কানাডা বেড়াতে। সারাজীবন জ্বালাতন করলেও শেষ দেখাটা দেখতে চান। তাঁর আসতে লাগবে তিন দিন। ছেলেদের একজন তো আসবেই না। যে ছেলে আসবে বাবার লাশ দেখতে, তারও তিন দিনের আগে পৌঁছা সম্ভব নয়। আরেক মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে স্বার্থপরের মতো চলে গেলেও এখন জন্মদাতার মরা মুখ দেখতে অনর্থক অস্ট্রেলিয়া থেকে আসবে। অত টাকা খরচ করে তার জামাইয়ের আসার একেবারেই ইচ্ছা নেই। অথচ বউকে খুশি করতে না এসে উপায়ও নেই। কয়েকটি এয়ারলাইনস ঘুরেছে সস্তায় টিকিটের জন্য। শেষ পর্যন্ত কনসেশনে একটা কোম্পানিতে পাওয়া গেছে। তার ফ্লাইট ছয় দিন পরে। মনে মনে গজগজ করতে করতে বাসায় ফিরে বউকে বলবে, ‘আব্বা আমাকে এত আদর করতেন। তাঁর চেহারাটা আমার চোখে ভাসতেছে দুদিন যাবৎ। অনেক কষ্টে টিকিট পাইলাম। আমার নিজের বাবা মারা গেলেও যাইতাম না। মঙ্গলবার সকালে ফ্লাইট। রেডি হয়ে নাও।’
এসব কারণে বাংলার মধ্যবিত্ত প্রবীণেরা একটা সময় কফিনের কথা না ভেবে পারেন না। কারণ, ওই বাক্সের ভেতরে তাঁকে বারডেমের হিমঘরে কাটাতে হবে পুরো একটি সপ্তাহ। মৃত্যুর পরবর্তী প্রথম একটি ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ওই সময়টুকুতেই প্রিয়জনেরা কান্নাকাটি করে। মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে যারা এসে জড়ো হবে, তাদের মধ্যে শোকের লেশমাত্র থাকবে না।
তা ছাড়া উচ্চমধ্যবিত্তের নানা রকমের ফ্যাকরা আছে। পাকিস্তান আমলে মারা গেলে ঠাঁই হতো সোজা আজিমপুর। কিন্তু স্বাধীনতার পরে দেখা গেল, ওটা সেকেলে হয়ে গেছে। ওখানে বেওয়ারিশ, গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্তরা থাকুক। শুরু হলো বনানীতে ভিড়। ওখানে দাফন হওয়া একটা স্ট্যাটাসের ব্যাপার। আশির দশকে শুরু হলো আরেক নতুন চালাকি। জীবনকালে মুক্তিযুদ্ধের ধারেকাছে ছিলেন না, মনপ্রাণ দিয়ে একাত্তরের টিক্কা খাঁর অবৈধ প্রশাসনকে সহায়তা করেছেন। তিনবার ঘুরে এসেছেন পশ্চিম পাকিস্তান। অক্টোবর, নভেম্বরেও লাহোরে করেছেন প্রচুর কেনাকাটা। গেছেন ল্যান্ডিকোটলি। ছেলেমেয়েরা সব জানে। কিন্তু তারা প্রমোশনের প্রয়োজনে ও অন্যান্য সুবিধা নিতে বুকে আঙুল ঠুকে বলে, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। হাসপাতালে ডাক্তার মুখ গম্ভীর করে বারান্দায় এসে কঠিন সংবাদটা দিতেই ছেলেমেয়েরা সিদ্ধান্ত নেয়, মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা গোরস্তানে ব্যবস্থা করতে। লোকে যখন জিজ্ঞেস করবে, ‘হাওলাদার সাহেবকে কোথায় দিলেন?’ তখন যাতে বলা যায়, ‘মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা কবরস্থানে।’ ওই কথাতে লোকে ধরে নেবে, বাবা বারো আনা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। শুধু ১০ হাজার টাকা খরচ করে সার্টিফিকেটটা জোগাড় করার প্রয়োজন মনে করেননি।
বাঙালি মধ্যবিত্তের মাথায় বুদ্ধি অতি বেশি, তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কফিন র‌্যালি কোনো সাধারণ প্রতিবাদ কর্মসূচি ছিল না। তাতে প্রকাশ পেয়েছে একালের বাঙালির প্রজ্ঞা, পরিমিতিবোধ, দ্রোহ, দূরদৃষ্টি ও সংগ্রামী চেতনা। এ ধরনের বুদ্ধি তিতুমীর, সূর্য সেন বা সুভাষ বসুর থাকলে তিরিশের দশকেই উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশরা বিতাড়িত হতো, সাতচল্লিশ পর্যন্ত বসে থাকতে হতো না।
এমন কর্মসূচি ভাসানী-মুজিব পালন করলে পঞ্চাশের দশকেই বাংলাদেশ স্বাধীন হতো। দিন সাতেকের মধ্যে দাবি আদায়ের এমন কৌশল ইরাকিদের জানা থাকলে মার্কিন সেনারা অনেক আগেই বাগদাদ থেকে পালাত। জায়গা থাক বা না থাক, ফুটপাতে হেলেদুলে অথবা হন হন করে হাঁটার জন্য তা ১০ হাত চওড়া করতে হবে। মোটরগাড়ি, বাস-ট্রাক চলাচলের জন্য মূল রাস্তা যদি গলির মতো সরু হয়, তাতে ক্ষতি নেই। বরং তাতে লাভ এই যে, গাড়ি কম চলবে। তাতে দুর্ঘটনা কমবে। পরিবেশদূষণ হবে না। জ্বালানির খরচ কমবে। মানুষ হেঁটে যাতায়াত করবে। তাতে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। কফিন বানানোর কাঠের প্রয়োজন হবে কম। বাঁচবে বনের গাছ। বাংলাদেশ হবে সুখী ও সমৃদ্ধ।
কফিন মিছিল আরেকটি বার্তা পৌঁছে দেয় সরকারকে। ফুটপাত ১০-১২ হাত চওড়া না করলে নিরাপদে হাঁটা যাবে না। না হাঁটলে শরীরে চর্বি জমবে। হূদরোগ, ডায়াবেটিসে মানুষ মারা যাবে। সুতরাং ফুটপাত চওড়া করতে বাজেটে টাকা বরাদ্দ চাই। তা না দিলে তিতুমীর, সূর্য সেনের মতো লড়াই করে জীবন উৎসর্গ করব। উৎসর্গ মানে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে মারা যাব। তখন কফিনই হবে শেষ আশ্রয়। এই কর্মসূচির মধ্যে সরকারকে ভয় ধরিয়ে দেওয়া।
যুগে যুগে, দেশে দেশে বড় বড় অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে প্রতীকী কর্মসূচি পালিত হয়। কিন্তু বাংলার মানুষকে দেখেছি, লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে সন্ধ্যায় কোত্থেকে কয়েকটি জোনাকি পোকা ধরে এনে ‘জোনাকি মিছিল’ করতে। আরেকটু মোটা বুদ্ধি যাঁদের, তাঁরা করেন হারিকেন ও কুপি মিছিল। ঝাড়ু ও জুতা মিছিল আজ দেদার হচ্ছে। যেকোনো দাবিতে তা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে ভর্তির দাবিতে হতে পারে। সর্বোচ্চ দরপত্রকে টেন্ডার দেওয়ার দাবিতে হতে পারে। বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে হতে পারে ঝাড়ু মিছিল। পানির দাবিতে বাংলার নারীকে কলস, হাঁড়ি-পাতিল ও বদনা নিয়ে মিছিল করতে দেখেছি দক্ষিণ রাজধানীতে। কোথাও একদিন হয়ে গেল থুতু ফেলা কর্মসূচি। দ্রোহ ও বুদ্ধির অপূর্ব মিশ্রণে প্রতিবাদ করতে পারে একমাত্র বাঙালি।
তবে বাঙালির কাছে সুন্দর জীবনের চেয়ে মৃত্যুর নীরবতা অনেক বেশি মূল্যবান। তাই সুন্দর জীবনের প্রতীক নিয়ে কোনো র‌্যালি নয়, মিছিল ও পাঁচ ঘণ্টার আমরণ অনশন হয় কাফনের কাপড় পরে। মিছিল হয় কফিন কাঁধে নিয়ে। অবশ্য বাঙালি অত বোকা নয় যে, শুধু পারলৌকিক জীবন নিয়ে ভাববে। ইহজগতের বুঝটাও সে বোঝে ভালো। গুণীজন সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান এখন মহামারির আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন যে কতজনকে দেওয়া হচ্ছে পদক-পুরস্কার, তার খবর জানে শুধু দক্ষিণ রাজধানীর বোবা দেয়ালগুলো। আজীবন সম্মাননা, স্বর্ণপদক, রৌপ্যপদক, ব্রোঞ্জপদক; বিভিন্ন ধাতুর যা দাম তাতে হয়তো শিগগিরিই প্রবর্তিত হবে অ্যালুমিনিয়াম ও লৌহপদকও। তবে সবচেয়ে ভালো হবে পঞ্চধাতুর মিশ্রণে এমন এক নতুন পদক চালু করা, যার নাম হবে ‘পঞ্চধাতুর পদক’। তাতে কারও ক্ষোভ থাকবে না, তাতে সোনা থাকবে এক অণুুপরিমাণ আর তামা ও লোহা থাকবে পুরোটা। পদকের সঙ্গে টাকাও বিতরিত হচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো।
তবে আজীবন সম্মাননা ও পদক পুরস্কারের সঙ্গে বিশুদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যোগ করেছেন গত চার বছর যাবৎ আরেকটি নতুন উপাদান। ক্রেস্ট, চেক ও সার্টিফিকেট গুণীজনকে দেওয়া হয় হাতে। গলা ও কাঁধ বলে, আমাকে কিছু দিলেন না। তাদের জন্য ওই উপহার। বিশুদ্ধ বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিতে নতুন সংযোজন। উত্তরীয়। ওড়না নয়, চাদর নয়, গামছা নয়, মাফলারও নয়—অথচ ওই সবগুলোর সংমিশ্রণে তৈরি এক খণ্ড বস্ত্র। বছর দশেক আগে পশ্চিমবঙ্গীয় কায়দায় চাদর ভাঁজ করে হাতে অথবা কাঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। উদ্দীনীয় সরকারের সময় যোগ হয় চাদরের সঙ্গে উত্তরীয়। উত্তরীয় শোভিত ছবি বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জসীমউদ্দিন, বিভূতি, মানিক, বুদ্ধদেবদের দেখিনি। 
চিরকালের বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতিও আজ বিশুদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের কাছে যথেষ্ট নয়। তাঁরা দক্ষিণ ভারতীয় অবাঙালি হিন্দুদের সংস্কৃতিকে মনে করছেন অতি আধুনিক বাঙালিয়ানার প্রতীক। মৌলবাদীরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করছেন আরব্য-সংস্কৃতি। অতি বাঙালিরা অত দূর যাননি। তাঁরা গেছেন দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত। আবরীয় সংস্কৃতি দ্রুত গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতি রাজধানী উত্তর ও রাজধানী দক্ষিণে ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক আখ্যায়িত হয়ে গাল খাওয়ার ভয়ে মুখে এ নিয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। আমাদের অনুকরণপ্রিয় মানুষ। একবার কিছু চালু হলে তা থামানো কঠিন। এক সময় এমন অবস্থা হবে, এই জিনিস গলায় না ঝুলিয়ে কেউ শ্বশুরবাড়িও যাবে না। দেহে অন্য বস্ত্র থাকুক আর না থাকুক, গলায় উত্তরীয় শোভা পাবে বঙ্গসন্তানদের। বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে তা ভারত থেকে আমদানি করতে হবে। অথবা শাড়ি, গরু ও গরম মসলার মতো আসবে চোরাচালানের মাধ্যমে।
নীতিবিদ্যা, নন্দনতত্ত্ব দর্শনশাস্ত্রেরই শাখা। জাতীয়তাবাদী চেতনারও একটি দার্শনিক তাৎপর্য রয়েছে। প্রতিবাদের নামে কুরুচিপূর্ণ কাজ করা অনৈতিক। স্বকীয়তা মানুষের অমূল্য সম্পদ। আমাদের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ‘জাতীয়তাবাদ’। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো জাতীয়তাবাদও মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। কুরুচিপূর্ণ কাজ ও বিজাতীয় সংস্কৃতির অপচর্চা থেকে মানুষকে বিরত রাখেন এমন নেতৃত্ব কোথায়?
শ্রেষ্ঠদের নিয়ে জাতি গর্ব করে। কিন্তু কোনো জাতির স্বভাব-চরিত্রের পরিচয় তার শ্রেষ্ঠদের পরিচয়ে নয়, সাধারণদের পরিচয়ে। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, স্বামী বিবেকানন্দ, নজরুলকে দিয়ে বাঙালি জাতির স্বভাব-চরিত্র, মেধা, নৈতিকতা, মননশীলতা, সৃষ্টিশীলতা ও রুচির পরিমাপ করা যাবে না। রহিম-করিম, রাম-শ্যাম, যদু-মধু, ছলিমুদ্দি-কৈমুদ্দিরাই বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করে। আমাদের আজকের অসাধারণ-সাধারণ কারও কাজই জাতি গঠনমূলক নয়, আত্মঘাতী। এ অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে আমাদের স্বাধীন অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে পড়বে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

নিরাপদ দূরত্ব-তত্ত্ব


সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ০৫-০৬-২০১২

এ মাটির মানুষের এমনই নিয়তি যে রাস্তায় বেরোলে গাড়িচাপা পড়ে মরে। গাড়ির যাত্রী হলে গাড়িসহ খাদের মধ্যে গিয়ে পড়ে মরে। আমরা বললাম, চালকদের একটু ভালোমতো যোগ্যতা পরীক্ষা করে লাইসেন্স দিন। চালকদের অকৃত্রিম সুহূদ সে অনুরোধ খারিজ করে দিয়ে মন্ত্রী উপস্থিত করলেন তাঁর ‘গরু-ছাগল চেনা তত্ত্ব’।
রাস্তাঘাট, কোর্টকাচারিতে সাংবাদিকেরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে পোশাক পরা জনগণের বন্ধুরা তাদের বেদম মারধর করেন। আরজি করা হলো: মারধর ভালো লাগে না, তাদের একটু সামলান। প্রত্যুত্তরে তাদের মালিক উপহার দিলেন ‘নিরাপদ দূরত্ব থিওরি’।
সব চালক মানুষ মারেন না। সব পুলিশও সাংবাদিক ও শিক্ষকদের মারেন না। যাঁরা সড়কে দুর্ঘটনা ঘটান ও সংবাদমাধ্যম কর্মীদের মারেন, শিক্ষকদের পেটান, আমরা শুধু তাদেরই সামলাতে বলেছিলাম। পরিণামে জাতি উপহার পেয়েছে দুই তত্ত্ব: গরু-ছাগল চেনা তত্ত্ব এবং নিরাপদ দূরত্ব-তত্ত্ব। নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব, আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের মতো এ দুই তত্ত্বও মানুষ মনে রাখবে বহুকাল।
মাননীয় ঠিকই বলেছেন, দূরত্বটা হতে হবে নিরাপদ। যে দূরত্বে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তার চেয়ে বেশ দূরে। তবে সেই নিরাপদ দূরত্ব গজ-ফিতার হিসাবে কতটা, তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। এক শ গজ না আড়াই শ গজ—তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। মাপজোখ করে কোনো অধিবেশনে হয়তো আইন পাস হবে: ‘সংবাদমাধ্যমের লোকদের জনগণের বন্ধুদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা আইন ২০১২’।
নিরাপদ দূরত্ব রক্ষার উপদেশ দেওয়া হয়েছে দুটি কারণে। এক. তাতে সংবাদমাধ্যম কর্মীরা শারীরিকভাবে অক্ষত থাকবেন। হাড্ডি গুঁড়া হবে না। পায়ের মাংসপেশি থেঁতলে যাবে না। ঊরুর হাড় লাথিতে ভাঙবে না। ঘুষিতে ফাটবে না নাক। চড়থাপ্পড়ে মুখমণ্ডল ফুলে হবে না মিষ্টি কুমড়ার মতো গোল।
দুই. জনগণের বন্ধুদের থেকে সংবাদকর্মীরা যত দূরে থাকবেন তত তাঁরা কম দেখবেন। আসল ঘটনা কম জানবেন, ফলে জনগণও কম জানবে। নিরাপদ দূরত্বে থেকে ছবি তোলায় প্রকৃত ঘটনা ক্যামেরায় ধরা পড়বে না। জনগণ যত কম জানবে ও দেখবে, তত তারা দূরে থাকবে সত্য থেকে। সত্য থেকে জনগণকে দূরে রাখাই নিরাপদ দূরত্বের মর্মবাণী।
সংবাদকর্মীরা জনগণের বন্ধুদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকলে কোনো পৌরাণিক মহাকাব্য অশুদ্ধ হবে না। কিন্তু কোনো নারীর (বিশেষ করে থুত্থুরে বুড়ি না হয়ে যদি যুবতী হন) বন্ধুদের থেকে দূরত্বটা শুধু নিরাপদ হলে হবে না—তাকে থাকতে হবে নিরাপদতম দূরত্বে। কোনো বিপদে পড়ে যদি তার পুলিশের ও আইনের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তা হলে তাকে আদালতে আরজি পেশ করতে হবে আধা কিলোমিটার দূর থেকে। মাইকযোগে তাকে জানাতে হবে কে তার শ্লীলতাহানি করেছে বা করার আয়োজন করেছিল। পুলিশের কাছে এসে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার শ্লীলতাহানির ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকাই বুদ্ধিমতীর কাজ।
একজন পুরুষের পক্ষে কোনো নারীর শ্লীলতাহানির যন্ত্রণা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু আরেকজন নারীর পক্ষে উপলব্ধি করা সহজ। সে নারী পর্বতারোহী বা সাংবাদিক বা মন্ত্রী হোন। যদি আদর করেও টেনেহিঁচড়ে কোনো মেয়েকে তার বাপ-মার সামনে তাদের ক্লাবে নেয়, নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বা নির্যাতন করে, কোনো কোনো রাষ্ট্রে তা বড় অপরাধমূলক কাজ না হতে পারে, কিন্তু কাজটা যে জঘন্য তা কোনো নারী মন্ত্রীর পক্ষে না বোঝার কথা নয়। ঘটনাটির কথা তাঁর কানে যাওয়া মাত্র তাঁর বারুদের মতো জ্বলে ওঠার কথা। একটি মেয়ের ইজ্জতের চেয়ে একটি পুলিশের চাকরির মায়া বেশি! বর্বর যুগেও নারীর ওপর নির্যাতন কোনো সমাজই সহ্য করত না।
যে রাষ্ট্রে আদালত প্রাঙ্গণে বিচার চাইতে গিয়ে নারীকে সম্ভ্রম হারাতে হয়, সে রাষ্ট্র আইয়ামে জাহেলিয়াতের চেয়ে জঘন্য। তারপর ইজ্জত হারানোর প্রতিকার তো দূরের কথা, নির্যাতিতা যদি প্রভুদের মৌখিক সান্ত্বনাটুকুও না পায়, তারচেয়ে নিষ্ঠুরতা আর হতে পারে না। এ ধরনের অপরাধীর বিচার হওয়া উচিত তাৎক্ষণিক, যেমন হরতালের দিনে মোবাইল কোর্টে হয়। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী অল্পসংখ্যক চালক। সাংবাদিক, শিক্ষক ও নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত অল্প কয়েকজন জনগণের বন্ধু। সেই ঘাতক চালক ও নির্যাতক পুলিশের পক্ষে অবস্থান নিলে দক্ষ ও ভালো চালক এবং দক্ষ ও সজ্জন পুলিশকেই অপমান করা হয়।
এ মাটিতে অযোগ্য, অদক্ষ ও অসাধু পান উচ্চাসন। সভা-সমাবেশ-গোলটেবিলে বাচাল ও বেসৎ মানুষের কথা দেশবাসী আড়িপেতে শোনে। এক প্রসিদ্ধ মন্ত্রী বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীকে পদত্যাগ করতে। কারণ তিনি ব্যর্থ। কিন্তু মাননীয় তো খুব ভালো জানেন, বাংলার মাটিতে পদত্যাগ করলেও তা গৃহীত হয় না। সাংসদের পদত্যাগ গৃহীত হয় না। প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয় না। মন্ত্রীরটা হয় না। বিরোধীদলীয় নেত্রী যদি পদত্যাগ করেনও তা গৃহীত হবে না। তাঁর বেতন-ভাতা-বাড়িভাড়া জমা হবে ব্যাংকে। সংসদ সচিবালয় থেকে বলা হবে: পদত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে করা হলো দপ্তরবিহীন বিরোধীদলীয় নেত্রী।
উঁচু আসনে বসা ব্যক্তিদের কথাবার্তা হুঁশ করে বলা ভালো। নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ ঘটে তেমন বক্তব্য না দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

মঙ্গল-আলোকে আলোকিত হোক জাতি

সৈয়দ আবুল মকসুদ
গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথের কাঁটাগুলো অপসারণের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। পৃথিবীর বহু দেশেই বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বিচিত্র বাধা ছিল। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই। কোনো একটি মত কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, নানা মতাদর্শের সমন্বয়ের ভেতর দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা কমিয়ে আনা মোটেই কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা

অনেক দুঃখের তিমিরের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বিশ্ববাসী অনেকের আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে পারবে না। কারণ তার ভূমি কম, প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত এবং জনসংখ্যা ঘনবসতিপূর্ণ; কিন্তু তাদের আশঙ্কা বা অনুমান অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান থেকে সরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্টই ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বড় পাকিস্তানের অবস্থাই আজ শোচনীয়। কিন্তু বাংলাদেশ আরও ভালো থাকতে পারত, যদি এখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন অব্যাহত থাকত। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে শুরুতেই পুঁতে রাখা ছিল কিছু কাঁটা। দিন দিন কাঁটার সংখ্যা বেড়েছে। সেই কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে জনগণের পা; কিন্তু সেই কাঁটা থেকে সুবিধা নিয়েছেন একশ্রেণীর জনবিরোধী রাজনীতিক, জনবিচ্ছিন্ন আমলা আর সামরিক শাসক ও তাদের দোসররা।

বাংলাদেশের চলি্লশ বছরের ইতিহাস নির্বাচিত সরকারের স্বৈরশাসন, অসাংবিধানিক সামরিক সরকারের স্বৈরাচার এবং গণতান্ত্রিক সরকারের অনাচারে ভরপুর। সরকারি দল ও বিরোধী দলের অসহযোগিতামূলক ও সংঘাতপূর্ণ অবস্থান বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে একটি অন্ধকারময় অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আইনের শাসনের অভাবে জনগণের জীবনে নেমে এসেছে প্রায় অসহনীয়
দুর্দশার অবস্থা।
বাংলাদেশ হাজার বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমন্বিত সাংস্কৃতিক দেশ। বাংলাদেশের সমাজ পরমতসহিষ্ণুতার সমাজ। সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় এক সময় ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদিতা হলো অন্ধকারের জিনিস। সেই অন্ধকার দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ এবং এ ক্ষেত্রে তার সফল না হয়ে উপায় নেই।
অপরাজনীতির ভেতরেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে গেছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। এ ক্ষেত্রে সরকারের চেয়ে বেশি কৃতিত্ব বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। অনেক বাধার ভেতর দিয়ে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের কাজ করতে হয়। তারপরও আজ দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ এক বিকাশমান অর্থনীতি। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে এবং গণতান্ত্রিক সুশাসন থাকলে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাবে, সে সম্ভাবনার কথা বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে যে বাধা তা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধের মারাত্মক অভাব। অথচ বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা অপরিহার্য। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সংসদে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা না করে তা নিয়ে রাজপথে সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। তাতে সমস্যা থেকেই যায়, সমাধান হয় না। এ বিষয়টিই আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট।
গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথের কাঁটাগুলো অপসারণের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। পৃথিবীর বহু দেশেই বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বিচিত্র বাধা ছিল। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই। কোনো একটি মত কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, নানা মতাদর্শের সমন্বয়ের ভেতর দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা কমিয়ে আনা মোটেই কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা।
অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কোনো লাভ হবে না। তাতে শুধু হবে শক্তিক্ষয়। বাড়বে তিক্ততা। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি আলোকিত বাংলাদেশ গড়তে হলে সব দলের নেতাদেরই কিছু ছাড় দিতে হবে। ভিন্নমতের সঙ্গে বৈরিতা না করে সহযোগিতার সঙ্গে কাজ করার মনোভাব না থাকলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ধর্মান্ধতার অন্ধকার আপনাআপনি দূর হবে, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রের অস্থিরতাও কমে আসবে।
পৃথিবীর যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বড় ভূমিকা রাখছে। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া আজ খুবই বিকশিত। সব দলের মতামতই মুহূর্তের মধ্যে জনগণের কাছে পেঁৗছে যাচ্ছে। তা ছাড়া দলীয় রাজনীতির বাইরে বিভিন্ন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও তাদের চিন্তা-ভাবনার কথা প্রকাশ করছেন। তাতে জনগণের চেতনার মান বাড়ছে। সব মতামত বিবেচনা করে তারা নিজেরা একটি স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। ফলে রাজনীতিকরা মানুষকে দীর্ঘ সময় বোকা বানিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটতে পারবে না। জনগণ যখন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় তখন নেতারা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে না। বহু সংগ্রাম করে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতা নষ্ট রাজনীতির স্বার্থে নয়, ব্যবহৃত হবে জনগণের স্বার্থে এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। এটাই বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের দাবি।
স্বাধীনতা অর্জনের আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধে যে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, হারিয়েছেন সহায়-সম্পদ এবং নারীসহ সাধারণ মানুষ সহ্য করেছেন অকল্পনীয় নির্যাতন, সেসব মানুষের স্বপ্ন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। শাসকশ্রেণী সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। সংবিধান কাটাছেঁড়ার ফলে আজ পরস্পরবিরোধিতায় পরিপূর্ণ। মূলনীতি হিসেবে মূল সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপিত হয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও আছে, বিসমিল্লাহও আছে। তাতে আধুনিক গণতান্ত্রিক সংবিধানের চরিত্রটি থাকল না।
তারপরও সংবিধান জনগণকে যে অধিকার দিয়েছে তাও আজ রক্ষিত হচ্ছে না। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষের মৌলিক অধিকারকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। রাষ্ট্রে আজ কিছু নতুন উপদ্রব দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে মহামারীর মতো। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা শোচনীয়। প্রশাসনে দক্ষতার অভাব, দলীয়করণ সর্বত্র। এসবই মানুষের সৃষ্টি। সুতরাং তার সমাধান সম্ভব।
পৃথিবীর অনেক দেশই আজ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি জটিল সমস্যায় জর্জরিত। সেদিক থেকে আমাদের অবস্থান অনেক ভালো। কিন্তু প্রত্যাশিত রকম ভালো নয়। ভালো না থাকার পথে যেসব বাধা তা শনাক্ত করার দায়িত্ব যে কোনো সচেতন মানুষের; কিন্তু তার সমাধান করতে পারেন শুধু নেতারাই। সব রকম অন্ধকারমূলক অবস্থাকে হটিয়ে সবার অংশগ্রহণে মঙ্গল-আলোকে আলোকিত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে_ এ আমাদের প্রত্যাশা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ :লেখক ও গবেষক

সোমবার, ২৮ মে, ২০১২

সরকারি দল, বিরোধী দল ও পাবলিক


রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে পাবলিকের, অর্থাৎ ভোটারদের কোনোরকম কুটুম্বিতা নেই। ভোটারদের সবারই বাপ-মা আছেন। অনেকের আছেন শ্বশুর-শাশুড়ি। কারও সৎ শ্বশুর-শাশুড়ি, কারও চাচা-মামা, ফুফা-খালু। কারও বেয়াই, ভায়রা, জেটেস ও শালা-শালী। ভোটারদের সঙ্গে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সে রকম কোনো আত্মীয়তা বা কুটুম্বিতার সম্পর্ক নেই। যখন যাকে উপযুক্ত ও যোগ্য মনে করেন, তখন ভোটাররা তাঁকে ভোট দেন। অনন্তকালের জন্য তাঁরা কাউকে নির্বাচিত করেন না। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেন তাঁরা। তবে আবার এবং বারবার পুনর্নির্বাচনের সুযোগও থাকে।
ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনে মানুষ সামনের দিনগুলোতে কী করবে, তার নানা রকম ছক কাটে। যার ঘরে সেয়ানা মেয়ে আছে, সে চায় আগামী বছর তাকে একটি রোজগেরে ছেলের হাতে তুলে দিতে। যার নিজস্ব বাড়িঘর নেই, সে চায় তার সাধ্যমতো একটি বাড়ি বানাতে। কেউ ভূমিহীনদের কোটায় কাঠা দুই খাস জমির বরাদ্দ চায়। কেউ গুলশান, বারিধারা, উত্তরা বা তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বরাদ্দ চেয়ে সফল হয়। কেউ অন্য কোনো জরুরি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নেয়। যেসব দেশে গণতন্ত্র আছে, সেখানে পাবলিক একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ভাবতে থাকে একটি নতুন নির্বাচনের কথা। যে সরকার তারা আগেরবার নির্বাচিত করেছিল, তাকেও তারা পুনর্বার নির্বাচন করে রেখে দিতে পারে, তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকেও সরকার গঠনের সুযোগ দিতে পারে। সেটা একেবারেই পাবলিকের ব্যাপার। সরকারি দল ও বিরোধী দলের হাত নেই। তারা দুটি পক্ষ মাত্র। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রে পক্ষ তিনটি: সরকারি দল, বিরোধী দল ও পাবলিক। 
পাবলিক বা জনগণের একটি সামষ্টিক সত্তা রয়েছে। একটি সমষ্টিগত মন রয়েছে। সেই মনের আছে ইচ্ছা-অনিচ্ছা। একবার তারা চায় এই দল ক্ষমতায় যাক, কখনো চায় এই দল ক্ষমতা থেকে সরে যাক। অন্য কেউ ক্ষমতায় আসুক। সে যে-ই হোক। সে রকমই তারা চেয়েছিল ১৯৫৪-তে, সত্তরে, একানব্বইয়ে, ছিয়ানব্বইতে, ২০০১-এ এবং হালে ২০০৮-এ। ২০১৪ সালের জন্য নিশ্চয়ই ভোটাররা মন ঠিক করে ফেলেছেন। কিন্তু পাবলিক বড় চাপা স্বভাবের। মুখ খুলে আগে কিছু বলে না।
এ পর্যন্ত বাংলার মাটিতে যাঁরা ক্ষমতায় গেছেন গণরায় নিয়ে, তাঁরা মনে করেন নির্বাচন জিনিসটা হলো সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার একটি কায়দা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন হয় সরকারে যাওয়ার জন্য যেমন, তেমনি সরকার থেকে সরে যাওয়ার জন্যও। যদিও সেটা বড়ই বেদনাদায়ক ব্যাপার। সত্যিকারের গণতন্ত্রে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যতই কাকুতিমিনতি কর কেউ বলুক, অথবা আবদার করুক ‘আর একটা টার্ম’ থাকতে দাও; পাবলিক তা শোনে না। জোর করে, ষড়যন্ত্র করে, ‘আর একটা টার্ম’ থাকার চেষ্টা যে সরকারই করেছে তারা আর গণতন্ত্রী থাকেনি। পাবলিকের ইচ্ছা পূরণের নাম গণতন্ত্র, ক্ষমতাসীনদের খায়েশ পূরণকে গণতন্ত্র বলে না। তার নাম স্বৈরতন্ত্র।
ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল নয়, পাবলিকও জানে, ২০১৪-এর জানুয়ারিতে সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। নতুন সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন করতে হবে। সরকার বলছে, কেন নির্বাচন করব না, এক শ বার করব। এবং সংবিধান অনুযায়ী করব। সংবিধানে যা লেখা আছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে নির্বাচন করব। বিরোধী দল তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। পাবলিক সরকারি দল ও বিরোধী দলের মতো টেলিভিশনে কথা বলতে পারে না, তাই তাদের বয়ানটা জানা যাচ্ছে না। তবে তাদের চোখ-মুখ দেখে আঁচ করা যায়। 
সরকার সংবিধানের বাইরে এক চুলও নড়াচড়া করতে চায় না। সেই নড়ন-চড়ন হবে নাকি ‘অসাংবিধানিক’। তাদের সেই যুক্তিও শিরোধার্য। আসলেই তো সংবিধানের বাইরে এক চুল যাওয়াও ঘোরতর অপরাধ। যে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু সাবালক হয়ে ওঠেনি এমন কোনো কিশোর বা কিশোরী যদি সরকারকে প্রশ্ন করে: ২০০৮ সালে আপনারা যে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেন তা কীভাবে করলেন? কোন সংবিধানের অধীনে করেছেন? সেটা যদি বর্তমান সংবিধান না হয়ে থাকে, তা হলে সেই নির্বাচনের বৈধতা কোথায়? কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাও মৃত্যুশয্যা থেকেও প্রশ্ন তুলতে পারেন; সরকার মহোদয় বলুন, যে সংবিধান আপনাকে অস্তিত্ব দান করেছে, সেই সংবিধানকে আপনি অসম্মান করতে পারেন না। তাতে আপনি নিজেকেই অসম্মান করছেন। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসংবলিত সংবিধান থেকে আপনি সুবিধা নিয়েছেন। এখন ওই সংবিধানকে আপনি খিস্তিখেউড় করছেন। এ কোন ধরনের নৈতিক অবস্থান? যাকে গ্রামের লোকে বলে: গাঙ পার হইলে মাঝি হয় হালা (শালা অর্থাৎ স্ত্রীর ছোট ভাই)।
টিভির পর্দা থেকে শোনা গেছে, আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই হবে। এই কথা শুনে পাবলিকের পিলে চমকে উঠলেও, এই ঘোষণায় বিন্দুমাত্র দোষ নেই। একেবারে খাঁটি সংবিধানসম্মত কথা। এবং এই ঘোষণার পর পাবলিক সেই অনাগত নির্বাচনের ফলাফলটাও পুরোপুরি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশনের বরাত ছাড়াই যদি কল্পনা করে, তা হলে তা সংক্ষেপে হবে এ রকম: ১৪ দলীয় মহাজোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮২ আসন এবং ১৮ দলীয় পাতিজোট ১৭ এবং স্বতন্ত্র একজন। 
ব্যক্তির বা কলাম লেখকদের অনুমানের মতোই পাবলিকের সব অনুমান যে নির্ভুল তা নয়। কিন্তু পাবলিকের পিলে চমকানোর কারণ কী? কারণ তাদের ইম্পিরিক্যাল মাইন্ড বা বাস্তব অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মন। তারা গত তিন বছরে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা তিনশ বছরের অভিজ্ঞতার সমান। তাদের কোনো পুঁথিগত ও পত্রিকাগত বিদ্যার পুঁজি নেই, যা আছে তা সবই তাদের নিজের অভিজ্ঞতা। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কী বলল, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কী কী লিখল, দ্য ইকোনমিস্ট কী বিশ্লেষণ ও পরামর্শ দিল, তার কোনো মূল্য নেই বাংলার পাবলিকের কাছে। কোথায় কোন মতলবে কে কী করছে তা তারা জানে, কে কী করতে পারে, তাও তারা জানে। 
বাংলাদেশের পাবলিকের কাছে এই দেশ তাদের অতি প্রিয় মাতৃভূমি। কিন্তু অনেকের কাছেই বাংলাদেশ একটি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ে বেশি কিছু নয়। ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো যদি আগামী নির্বাচনের আগে আগে বাংলাদেশেও ওই একই দশা হয়, তা ঠেকায় কার বাবার সাধ্য? যদি দৈববাণীর মতো ঘোষিত হয়: নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকাল বর্তমান সরকারই ক্ষমতায় থাকব, সেটাই বা ঠেকাবে কে? রাজধানীর ব্যাপারে যা করা হয়েছে, রাষ্ট্রের ব্যাপারে যে তা হবে না তার নিশ্চয়তা কী?
সেই পরিস্থিতি হওয়ার আগে একটি নিখুঁত সাংবিধানিক পথ খোলা আছে। বিরোধী দলের সব বড়-মাঝারিকে জামাই আদরে কাশিমপুর প্রাসাদে রাখার পর, খালেদা জিয়াকে এতিমের টাকা মারার ‘অপরাধে’ সাজা হিসেবে মাইনাস করে দিয়ে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন বা অগ্রিম নির্বাচন দেওয়া যায়। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আগাম নির্বাচন দেওয়া দোষের নয়। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর কেবিনেট সহকর্মীরা পদত্যাগ করবেন এবং বশংবদ একদল লোক বা ভাঁড়দের নিয়ে গঠিত হবে একটি অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকার করবে অতি নিরপেক্ষ নির্বাচন। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন তো আছেই। এ ব্যাপারে প্রধান ডিপ্লোম্যাট ও ডিপুটি প্রধান ডিপ্লোম্যাটদের পটাতে পারলেই হলো। দেশে একটি ‘নির্বাচিত’ সরকার থাকলেই হলো। হামিদ কারজাই রয়েছেন, নুরি আল মালিকিও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। ক্ষতি কী? 
সরকার যদি অতি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বলে, তোমরা নির্বাচন নির্বাচন করে চেঁচাচ্ছ, এই নাও, দিয়ে দিলাম একেবারে আগাম নির্বাচন। বিরোধীদের সবাই কাশিমপুর প্রাসাদে থাকার ফলে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে এ কথা বলারও কেউ থাকবে না যে: তোমরা বরং আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাক। আমাদের প্রস্তুতি নেই। দাঁড়া করানোর মতো প্রার্থীও নেই। তোমরাই থাক ক্ষমতায়, এত তাড়াহুড়োর কী আছে! 
কষ্ট করে এখন আর কোনো ব্যারিস্টারকে দিয়ে বিএনপিকে ভাঙার দরকার নেই। কোনো দল ভাঙার চেয়ে দলের মেরুদণ্ড ভাঙা বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। একদিকে সব নেতা কারাগারে, অন্যদিকে এক ব্যারিস্টার বাইরে। কার মনে কী আছে তা ৫ তারিখের পর বোঝা যাবে। বিএনপির যাঁরা কাশিমপুর ফটকে ঢুকতে রাজি হবেন না, তাঁদের যদি কিছু আশ্বাস ও উপহার দিয়ে ঠান্ডা রাখা যায়, তার চেয়ে সহজ উপায় আর হতে পারে না। যদি কাউকে কাউকে বলা হয়, তোমাদের অমুক অমুককে নির্বাচন করিয়ে সংসদে আনব এবং মতৈক্যের সরকার করে দুটো মন্ত্রিত্বও দেব, তাতে গররাজি হবেন এমন মানুষ বাংলার মাটিতে একুশ শতকে বিরল। জোটের এক নেতা মাইনাস ওয়ানের কথা মুখ ফসকে বলেননি। তিনি জেনেশুনেই বলেছেন।
যুগে যুগে পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলায়, কিন্তু একটি জনগোষ্ঠীর মন বদলায় না হাজার বছরেও। কিছুটা হতাশা ও না-পাওয়ার ব্যথায় বিমর্ষ কিছু ছদ্মবাম বা কমিউনিস্ট তাদের নেতাদের মাঠে নামিয়ে, তাঁদের কয়েকটি আসন দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে, একটি বহুদলীয় নির্বাচন করার চেষ্টাও যে সফল হবে তা মনে হয় না। মাঝখান থেকে তাঁরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ট্যুর করে কোমরের ব্যথা বাধাবেন। পাবলিক ছদ্মবামদের মতো চালাক নয় বটে, কিন্তু তারা গোঁজামিল জিনিসটা বোঝে। এবং দেশের সঙ্গে ও গণতন্ত্রের সঙ্গে যাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেন তাঁদের খুব সহজেই চিনে ফেলেন।
পরীক্ষায় যেমন প্রশ্নপত্রে কয়েকটি বিকল্প থাকে, তেমনি সরকারের পরিকল্পনারও কয়েকটি বিকল্প আছে বলে পাবলিক মনে করছে। সবগুলো বিকল্পের মধ্যে সবচেয়ে সহজ পথটিই পাবলিক পছন্দ করে। সেই সহজ পথটি হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। কথাটা নির্মম মনে হলেও এবং তা সাহস করে বলাও মুশকিল, তা হলো, আগামী অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি পরাজিতও হয় তা হবে দলের জন্য গৌরবের। তাতে প্রমাণিত হবে আওয়ামী লীগ সাচ্চা গণতন্ত্রী দল। আন্তর্জাতিক প্ররোচনায় তেলেসমাতির নির্বাচনে, যেমন নির্বাচন করেছিলেন একাত্তরে টিক্কা এবং ১৯৮৮ সালে এরশাদ, আওয়ামী লীগ যদি ২২০ আসন পায় তা হবে দলের জন্য আত্মঘাতী। একেবারে রীতিমতো বিষপানে আত্মহত্যা।
বিএনপি যদি মনে করে যে বাংলাদেশের সব লোক তাদের লেজ ধরেই বসে থাকবে—তা এক বড় নির্বুদ্ধিতা। আওয়ামী লীগকে জনগণ ক্ষমতা থেকে সরালে তাদেরই যে পাবলিক ক্ষমতায় বসাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? কোন অবস্থায় কারা কখন সামনে চলে আসেন, রাজনীতিতে সে সম্পর্কে আগাম বলা সম্ভব নয়। পাবলিকের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। সুতরাং একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশে একটি পালাবদল ঘটবে। বাংলাদেশের পাবলিক কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের খাস তালুকের প্রজা নয়। তারা কারও গোলামি করা পছন্দ করে না। তারা প্রত্যেকেই মাত্র একবার বিশ্বাস করে—দুবার নয়। কিন্তু কিছুটা দয়াপরবশ বা নিরুপায় হয়ে তারা দুই দলকে দুবার বিশ্বাস করেছিল। আর করবে না।
শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা শুধু বিধাতাই বলতে পারেন। আমাদের মতো পাবলিক আশা করে, যা কিছুই হোক, ভালোয় ভালোয় হোক। লগি, বৈঠা ও কাটা রাইফেলের এস্তেমাল চাই না। বাস ও গাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলুক, তা দেখতে চাই না। রাস্তার মধ্যে পেটের দায়ে দলীয় কর্মীর প্রক্সি দেওয়া তরুণের লাশ পড়ে থাকুক তাও কাম্য নয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কী বলল, তার চেয়ে বেশি জরুরি আমাদের পাবলিক কী বলে এবং আমাদের বিচার-বিবেচনা ও বুদ্ধি-বিবেক কী বলে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

শুক্রবার, ২৫ মে, ২০১২

মোজাফ্ফর আহমদ ও নাগরিক আন্দোলন

সৈ য় দ আ বু ল ম ক সু দ
শিল্প-সাহিত্য ও শি¶া-সংস্কৃতি ¶েত্রে আমাদের কেউ মারা গেলে, তার মৃত্যুতে ‘জাতির অপূরণীয় ¶তি হল’ অথবা তার চলে যাওয়ায় ‘যে শূন্যতার সৃষ্টি হল তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়’Ñ বলা যেন আমাদের একটি অর্থহীন অভ্যাস বা প্রথায় পরিণত হয়েছে। শীর্ষ সরকারি নেতারাও এ ভাষাতেই শোকবাণী দেন। অথচ যিনি মারা যান, তার কোন গুর“ত্বপূর্ণ কাজ দেখতে পায়নি দেশের মানুষ ৩০ বছরেও। দেশের মানুষের জন্য তার ত্যাগ নেই এক ছটাক। পুঁজি শুধু কোন এক সময়ে কিছু কাজ করার খ্যাতিটুকু। আমাদের আবেগতাড়িত, যুক্তিবিবর্জিত ও কর্মবিমুখ সমাজে এখনও এমন মানুষ কেউ কেউ আছেন, যাদের মৃত্যুতে আ¶রিক অর্থেই অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তারা অপ্রতিকল্পনীয়। যাদের পরিবর্তে আর একজন খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদেরই একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
কর্মজীবনে অর্থাৎ চাকরি-বাকরিতে মোজাফফর আহমদ কী কী প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন, তা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। ওসব পদে বহু মানুষই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পরী¶া দিয়েই হরগঙ্গা কলেজে শি¶কতা শুর“ করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। শি¶কতা ছেড়ে দিয়ে ষাটের দশকে একটি বেসরকারি ব্যাংক এবং পূর্ব পাকি¯—ান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনে কাজ করেন। শি¶ায়তনিক ও তাত্তি¡ক জ্ঞানের সঙ্গে ওই দুই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ফলে তিনি ব্যাংকিং ও শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
¯^াধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে তিনি যোগ দেন। ১৯৭৪ সালে পরিকল্পনা কমিশন থেকে পদত্যাগ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইন্সটিটিউটে (আইবিএ) অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ও তার কয়েকজন সুযোগ্য সহকর্মীর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের একটি শীর্ষ শি¶া প্রতিষ্ঠান হিসেবে ¯^ীকৃতি পায় আইবিএ। এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম আজও অ¶ুণœ। বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে যে বহু দ¶ প্রশাসনিক কর্মকর্তা তৈরি হয়েছেন গত ৪৫ বছরে, তার কৃতিত্ব আইবিএ’র। সে¶েত্রে মোজাফফর আহমদের অবদান রয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ¶ প্রশাসকদের অনেকেই তার প্রত্য¶ ছাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি করেন ১৯৬৫ সালে। সেখানে তার শি¶কদের কয়েকজন ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তার সহপাঠী বব লুকাস অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। তার প্রাতিষ্ঠানিক শি¶ার মান তার সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এবং তার অনেক সহকর্মীর চেয়ে উঁচু ছিল বলে তার ঘনিষ্ঠদের অভিমত।
উচ্চশি¶া প্রতিষ্ঠানে জীবিকার জন্য শি¶কতার চাকরি করা নয়, মোজাফফর আহমদ ছিলেন একজন আদর্শ শি¶াবিদ। ছাত্রদের তিনি উপযুক্ত শি¶া দান করতেন। তার নিজের শি¶ার ভিত্তিও ছিল খুব মজবুত। তার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের কাছে শুনেছি, সেখানে ৪০-এর শেষ ও ৫০-এর শুর“তে তার সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে সব সময় কিছু বই থাকত। শুধু ঘরে নয়, বাইরেও সময় পেলে তিনি পড়তেন। তা নিয়ে তার বন্ধুরা হাসি-ঠাট্টা করতেন। তবে সবাই ¯^ীকার করেন যে তিনি বা¯—বিকই খুব পড়-য়া ছিলেন। দেশে ও দেশের বাইরে তিনি আদর্শ শি¶কদের কাছে পাঠ নিয়েছেন, নিজে হওয়ার চেষ্টা করেছেন আদর্শ শি¶ক।
তার অগণিত অনুরাগীর অনেকেই জানেন না, মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন একটি ঐতিহ্যবাহী শি¶িত মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। তিনি প্রথম জেনারেশন আধুনিক শি¶িত ছিলেন না। তার গ্রামের বাড়ি আর আমাদের গ্রামের বাড়ির দূরত্ব ছিল মাইল পাঁচেক। আমাদের দুই গ্রামই ছিল পদ্মা নদীর পাড়ে। দুটিই আজ নদীগর্ভে। উনিশ শতক থেকেই আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তার বাবা-চাচারা এবং তাদের বাবা-চাচারা ছিলেন উনিশ শতক থেকেই আধুনিক ইংরেজি শি¶ায় শি¶িত। তার দাদার ভাই মবিনউদ্দিন আহমদ গত শতাব্দীর প্রথম দিকে একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সারা বাংলায় পরিচিত ছিলেন। তখন বাংলায় উচ্চপদস্থ বাঙালি মুসলিম সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন হাতেগোনা।
কাস্টমস ও আবগারি বিভাগের ক্যাডার সার্ভিসের পদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও, মবিনউদ্দিন আহমদ একজন লেখক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। তার লেখনী নাম ছিল মবিনউদ্দিন আহমদ জাহাঙ্গীরনগরী। আগের দিনে ঢাকা জেলার অনেকে তাদের নামের শেষে জাহাঙ্গীরনগরী লিখতেন। তিনি ছিলেন আমার দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মবিনউদ্দিন আহমদের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থটি ছিল ‘কোরআনতত্ত¡’। এই ইসলামী ধর্মতত্তে¡র বইটি ছিল তিন খÊে। সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে লেখা। তিনটি খÊই আমার আব্বার সংগ্রহে ছিল। দুটি খÊ তিনি মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের পীড়াপীড়িতে তাকে দেন। আর ফেরত পাওয়া যায়নি। একটি খÊ জীর্ণ হয়ে গেলেও আমার কাছে আছে। এ ধরনের বই পুনর্মুদ্রিত হওয়া দরকার। ইসলামী দর্শনের ওপর তার আরও রচনা রয়েছে।
অধ্যাপক মোজাফফরের অর্থনীতি বিষয়ে মূল্যবান রচনা রয়েছে। শেষ জীবনে তার ইচ্ছা ছিল মহানবী (সা.) ও ইসলামী দর্শন বিষয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে তার একটি দিনও অবসর ছিল না। আইনের শাসন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, পরিবেশের বিপর্যয় রোধ প্রভৃতি বিষয়ে আন্দোলন ও অনুষ্ঠানে তাকে প্রতিদিন অংশগ্রহণ করতে হতো। দুর্র্নীতির বির“দ্ধে তার নেতৃত্বাধীন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) যে প্রচারাভিযান চালায় তার তুলনা নেই। তিনি বাংলাদেশে আধুনিক নাগরিক আন্দোলনের জনক।
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), টিআইবি এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক মোজাফফর। তার দেখাদেখি বাংলাদেশে সামাজিক আন্দোলনে আরও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেন। কিভাবে আমিও তার সংগঠনগুলোর কর্মকাÊে জড়িয়ে পড়ি, তা আমার মনে নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু সামাজিক কাজ করি বহুদিন ধরে। কোন সংগঠনের সদস্যপদ বা পদ আমার পছন্দ নয়। তাতে ¯^াধীনভাবে কথা বলা যায় না। আমার নিজের মতো আমি অন্যায়-অবিচারের সাধ্যমতো প্রতিবাদ করাই পছন্দ করি। শ্রদ্ধেয় স্যার ও আমার বন্ধু অত্যš— পরিশ্রমী ও নিবেদিতকর্মী ড. বদিউল আলম মজুমদার তাদের অবাধ-নিরপে¶ নির্বাচনের ল¶্যে গঠিত সংগঠনের সঙ্গে আমাকে সম্পৃক্ত করেন। ১০ বছর ধরে আমি তার একজন অযোগ্য সহকর্মী হিসেবে তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি।
রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সুষ্ঠু ও নিরপে¶ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ও ¯^াধীন করা দরকার। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিক সমাজও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বড় ভ‚মিকা পালন করে। আমাদের রাজনীতি দুর্বৃত্তায়িত ও কলুষিত। এসব অনাচার থেকে মুক্ত হয়ে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তনের ল¶্যে প্রচার চালাতে এবং সৎ, যোগ্য প্রার্থীদের প¶ে জনমত তৈরির ল¶্যে ২০০২ সালে ‘সিটিজেনস ফর ইলেকশন’ নামে নাগরিকদের সংগঠন আÍপ্রকাশ করে মোজাফ্ফর স্যারের নেতৃত্বে। যা পরে নামকরণ হয় সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন। জনমত তৈরির জন্য গত ১০ বছরে কত যে সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল, মানববন্ধন প্রভৃতি করা হয়েছে সারা দেশেÑ প্রতিটি জেলা উপজেলায়Ñ তার হিসাব বদিউল আলম মজুমদার দিতে পারবেন। কারণ তিনিই সংগঠনের মূল চালিকাশক্তি। তবে স্যার শিখÊীর মতো মাথার উপরে থাকেননি, অকল্পনীয় শারীরিক শ্রমও দিয়েছেন। রোদের ভেতরে সমাবেশ করতে গিয়ে স্যার মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। সোজা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। ভেবেছি, তিনি আর কোন অনুষ্ঠানে যাবেন না। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে ঠিকই এসেছেন। এসব কাজে তার বিন্দুমাত্র ব্যক্তিগত ¯^ার্থ ছিল না। এক পয়সা আর্থিক ¯^ার্থের তো প্রশ্নই আসে না।
আমাদের সমাজে বহুকাল থেকেই ¯ে^চ্ছাসমাজসেবক ছিলেন। আশির দশক থেকে বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও কার্যক্রম শুর“ হয়। বিদেশ থেকে আসতে থাকে রাশি রাশি টাকা। ভলান্টারি সমাজসেবা বলে আর কিছু থাকল না। যুবসমাজ মজুরি বা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে এনজিওতে কাজ করতে লেগে যায়। শি¶িত বেকারের দেশে সেটা খুবই ¯^াভাবিক। টিআইবি একটি আš—র্জাতিক গবেষণাধর্মী এনজিও, তাছাড়া বাপা বা সুজন নাগরিক সংগঠন, যেখানে প্রয়োজনে সদস্যদের চাঁদা দিয়ে হলেও কাজ করতে হয়। মোজাফফর স্যার সারাদেশে কিছু ¯ে^চ্ছাসেবক পেয়েছিলেন, যারা নিঃ¯^ার্থভাবে তার নেতৃত্বে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন।
কোন্ প্রে¶িতে বাংলাদেশে মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে নাগরিক আন্দোলনের সূচনা তা ভেবে দেখতে হবে। গত শতাব্দীর শেষ দশকটি ছিল বাংলাদেশে ছদ্ম গণতন্ত্রের অনাচারের দশক। দুটি বড় দল এবং সেই দুই দলের দুই জনপ্রিয় নেত্রী পাঁচ বছর করে ভাগ করে দেশ শাসন করেন। দুটি সরকারই অধিকাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে ¶মতায় আসে। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পরে তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল গণতান্ত্রিক সুশাসন। আশির দশকে সামরিক ¯ৈ^রাচারের বির“দ্ধে দুই নেত্রীই বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করেন। তারা তখন অব্যাহতভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। কিন্তু ¶মতা লাভের পর দুটি সরকারই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে নির্লজ্জ দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, আমলারা দুর্নীতিতে ডুবে যান। আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ভ‚লুণ্ঠিত হয়। প্রাধান্য পায় পেশিশক্তি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ হতে থাকে অবাধে লুণ্ঠন। সংসদকে করে রাখা হয় অকার্যকর। বিচার বিভাগও হয় দলীয়করণ। সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে অসহায় ও অবর“দ্ধ। প্রতিবাদকারীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন।
শতাব্দীর শেষ সরকারের ক্যাডার বাহিনীর অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। টিআইবির জরিপে বাংলাদেশ হয় পৃথিবীতে এক নম্বর। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি দিয়ে ২০০১-এ চারদলীয় সরকার ¶মতায় যায়। তাদের তখন ছিল বিপুল জনসমর্থন। কিন্তু নির্বাচনী অঙ্গীকার ভুলে গিয়ে তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর অকারণে নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। ¶মতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সব জর“রি কাজ ফেলে রেখে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডার বাহিনী প্রতিহিংসায় উš§ত্ত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর, যাদের অনেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের, হামলা চালায়। তাদের বাড়িঘর তছনছ করে। তাদের থেকে জোর করে চাঁদা তোলে। মারধর করে। নারীর ওপর পর্যš— চালায় নির্যাতন। আমি তখন এক মাসে ১৪টি জেলায় নিজে ঘুরে দেখেছি কী ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল গ্রামগঞ্জে।
সেই পরিপ্রে¶িতে মোজাফফর স্যারের নেতৃত্বে নির্দলীয় নাগরিক আন্দোলনের সূচনা। স্যার নিজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ছিলেন অবিচল। যেসব সংগঠনে অথবা ফোরামে স্যারের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, সেখানে তার বা সেই সংগঠনের নীতির সঙ্গে আমি অনেক সময় ভিন্নমত পোষণ করেছি। কখনও তার মতের সম্পূর্ণ বিপরীত কথায় তিনি প্রকাশ্যে বিব্রত হয়েছেন, কিন্তু বিরক্ত বা ¶ুব্ধ হননি। সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নে আমার অবস্থানকে তিনি সহ্য করেছেন। সব মতাদর্শের শাšি—পূর্ণ সহ-অবস্থানকে তিনি মূল্য দিতেন। আমার ভোগবাদবিরোধী দর্শনকে তিনি পছন্দ করতেন, কারণ তিনি নিজে ছিলেন ভোগবাদের ঘোরবিরোধী। যেসব প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেছেন, যেমন রাজনীতি, গণতন্ত্র, অর্থনীতি, সমাজ পরিবর্তন, দুর্নীতির কারণ ও তার প্রতিকার প্রভৃতি, সেসব ব্যাপারে তার অত্যš— পরিষ্কার ধারণা ছিল। ভাসাভাসা জেনে তিনি কিছু বলতেন না। যা বলতেন বা করতেন, তা বিশ্বাস ও প্রত্যয় থেকে করতেন।
গত কয়েক বছর আমি তার সফরসঙ্গী হয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার ঘুরেছি সারা দেশ। তিনি ছিলেন অত্যš— ধর্মপরায়ণ। ধর্ম ছিল তার ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়। কোন রকম গোঁড়ামির লেশমাত্র ছিল না তার মধ্যে। নামাজ আদায় করতেন ও রোজা রাখতেন নিয়মিত। নামাজের সময় হলে গাড়ির মধ্যেই আমাদের পাশে বসে ১০ মিনিটে নামাজ পড়ে নিতেন। অনেকের মতো গাড়ি থামিয়ে মসজিদ খুঁজতে যেতেন না।
যেসব বিষয় আমাদের সমাজকে বিভক্ত করে ফেলেছে, সেসব ব্যাপারে আমি তার মধ্যে একটি যুক্তিবাদী ও সমš^য়ী অবস্থান দেখেছি। জিয়াউর রহমানের সরকারের উপদেষ্টা বা মন্ত্রী ছিলেন কিছুকাল। তাতে খুব ¯^াভাবিকভাবেই কেউ ধারণা করতে পারেন তিনি একজন বিএনপিপন্থী এবং আওয়ামী লীগের ঘোরবিরোধী। দীর্ঘ সময় আমি তার সঙ্গে একাšে— কাটিয়েছি। আমার মনে হয়নি তিনি আওয়ামীবিরোধী বা বিএনপিপন্থী। তিনি অকপটে আওয়ামী লীগের ভুলগুলোর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। তবে তার ভুলগুলো গোপন করতেন না। কী কী করলে তিনি আরও ভালো করতেন সে কথাও বলতেন।
অযৌক্তিক ভারতবিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা অনেকেই গোপন রাখতে পারেন না। ভারত-বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে, যৌথ নদী নিয়ে সীমাš— হত্যা নিয়ে, যখন তিনি কথা বলতেন, তখন তিনি ইস্যুটি নিয়ে কথা বলতেন, দেশটি নিয়ে নয়। সেই দেশের রাজনীতি নিয়ে নয়। বাংলাদেশে কারণে-অকারণে ভারতবিরোধী মানুষের সংখ্যা বিখ্যাতদের মধ্যে বহু। মোজাফফর স্যার বিন্দুমাত্র ভারতবিরোধী ছিলেন না। সাম্প্রদায়িকতা তার মধ্যে ছিল না। ভারতবর্ষের মহান সভ্যতা, ভারতের সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনীতির ঐতিহ্য, ভারতের অনর্ঘ্য সংস্কৃতির তিনি ছিলেন অবিচল অনুরাগী। কিন্তু পানির ন্যায্য হিস্যার প্রশ্নে, সীমাš— হত্যা প্রশ্নে, টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে তার অবস্থান ছিল স্পষ্ট ও আপসহীন।
আমাদের সমাজে নাগরিক সমাজের নেতারা বড় বড় দেশের দূতাবাসে ঘুর ঘুর করেন। ক‚টনীতিকদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে ধন্য হন। বিদেশ সফরে যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোন দূতাবাস ও ক‚টনীতিকের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক বা যোগাযোগ ছিল না।
সরল জীবনযাপনের একটি ক্লাসিক উদাহরণ ছিলেন মোজাফফর আহমদ। সমাজে তিন পয়সা দাম নেই, এমন মানুষও আমাদের সমাজে নাক উঁচু করে চলেন। টেলিফোনটা নিজে ধরেন না। স্যার সব ফোন নিজে ধরতেন। যে কেউ অনায়াসে কোন সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারতেন তার সঙ্গে। যে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। কোন অহংকার ছিল না।
কর্ম¶েত্র ও আনুষ্ঠানিক সভা-সমাবেশের বাইরে একজন মানুষের যে দৈনন্দিন জীবনযাপন তাতেই মানুষ হিসেবে তার সত্যিকারের পরিচয় পাওয়া যায়। তার প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ধারা এতই সাদাসিধা ছিল যে, তা না দেখলে একালের মধ্যবিত্ত ও উঠতি উচ্চমধ্যবিত্তদের বোঝানো যাবে না। অপচয় ও অপব্যয় অপছন্দ করতেন। নিজে করতেন না, অন্যকেও করতে নির“ৎসাহিত করতেন। তিনি ছিলেন অকপট, সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ ও স্পষ্টভাষী। হঠাৎ তার চলে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিন্তু জাতির ঠিক এই মুহূর্তে তার আর কিছুকাল বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল।
গণতন্ত্র সংহত করা, নাগরিক অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একুশ শতকের প্রথম দশকে বাংলাদেশে যে নাগরিক আন্দোলনের সূচনা মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য ভবিষ্যৎ প্রজšে§র মানুষ মূল্যায়ন করবেন। এবং সেই মূল্যায়নই হবে যথার্থ মূল্যায়ন। আমরা যারা তার সঙ্গে একত্রে কাজ করেছি, তাদের সে সম্পর্কে কিছু না বলাই শোভন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক

সোমবার, ২১ মে, ২০১২

বাটি-বৃত্তান্ত

প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নপ্রস্তর যুগের পাথরের তৈরি অস্ত্রফলক পাওয়া গেছে। মাটি খুঁড়ে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা নবপ্রস্তর যুগের মৃৎপাত্রের সন্ধান পান। সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা এবং হরপ্পা সভ্যতার তৈজসপত্রের যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তার মধ্যে পাথর ও ধাতুর বাটি ছিল। আদিম মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাতে যেসব পাত্র বানাতে শেখে, সেগুলোর মধ্যে বাটি অন্যতম।
প্রথম দিকে এবং তারপর হাজার হাজার বছর তরল খাদ্য ও পানীয় পরিবেশনে বাটি ব্যবহূত হতো। ধীরে ধীরে বাড়ে তার বহুমাত্রিক ব্যবহার। ব্যাবিলন ও হরপ্পা থেকে বাটি যখন বাংলার মাটি পর্যন্ত আসে, তখন তার ব্যবহারের পরিধি আরও বেড়ে যায়। বুদ্ধিমান ও প্রতিশোধকামী বাঙালি বাটির ব্যবহার শুধু ঘন দুধের পায়েস খাওয়ার মধ্যেই সীমিত রাখেনি। পায়েস খাওয়া থেকে চোর ধরা পর্যন্ত বিচিত্র কাজে ব্যবহূত হতে থাকে বাটি।
আজ ঘটেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় অগ্রগতি। এখনই আবার দেশজ সনাতনবিদ্যার পুনর্ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক দেশে। প্রাচ্যের বহু দেশে দেখা যাচ্ছে, দেশজ পদ্ধতিতে গাছগাছড়া-লতাগুল্মের চিকিৎসাপ্রথার প্রয়োগ। যেসব দেশ মাত্র তিন বছরেই ষোলোআনা ডিজিটাল হয়ে গেছে, সেখানকার মধ্যযুগীয় মানসিকতাসম্পন্ন মানুষও বাটি চালানোর সনাতন প্রথা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় যে অপরাধীকে ধরা সম্ভব নয়, তাকে পাকড়াও করার অব্যর্থ অস্ত্র বাটি চালান।
বাটি চালান কোনো রূপকথা নয়। একসময় তা ছিল গ্রামবাংলার বাস্তবতা। ১৯৫০-৫২ সালের দিকে আমি দুটি বাটি চালানের ঘটনা দেখেছি। আমাদের এক আত্মীয়ার একটি সোনার চেন চুরি গিয়েছিল। গেঁয়ো বাটপার ধরনের একদল লোক বাটি চালান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাটি ঠেলার জন্য খুঁজে বের করা হয় কথিত তুলা রাশির এক লোককে, যে আবার আরেক বাটপার। যার চেন খোয়া গিয়েছিল, তার পায়ের কাছ থেকে বাটি ছুটল। ছুটল মানে তুলা রাশিওয়ালা ঠেলতে লাগল। সে বাটি সারা গ্রাম এদিক-ওদিক ঘুরল। আমরাও বাটিওয়ালার পিছে পিছে ছুটলাম। একপর্যায়ে সে বাটি গ্রামের প্রান্তে খেতের মধ্যে কাজ করছিল এমন এক লোকের পায়ের কাছে গিয়ে থেমে গেল। কাউকে আর বলে দিতে হলো না, চেনের চোরটি কে। লোকটি ছিল নিরীহ গোছের। প্রতিবাদ করল না, তবে চেনও ফেরত দিল না। দুদিন পরে তার লাশ ঝুলতে দেখা গেল তার বাড়ির আমগাছে। তার দুদিন পর চেনটি পাওয়া গেল আসল চোরের কাছে।
সামন্ত যুগে চিহ্নিত চোর ধরতে ব্যবহূত হতো বাটি। আজ গণতন্ত্রের যুগ। আজ প্রতিপক্ষকে পাকড়াও করতে চালান দেওয়া হবে বাটি। বাটি চালান একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী পদ্ধতি। ডিজিটাল বাংলাদেশও থাকবে, বাটি চালানের বাংলাদেশও থাকবে পাশাপাশি। বাংলাদেশ-মার্কা গণতন্ত্রকে আমরা বলতে পারি ‘বাটি চালান গণতন্ত্র’।
বিরোধী দল ক্ষমতায় না যাওয়ার দুঃখে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার দুরাশায় হইচই করে। যেসব নেতা হইচই করেন, পুলিশ তাঁদের পাকড়াও করে লোহার খাঁচায় পুরেছে। তাঁদের ছাড়াতে যাঁরা হইচই করবেন, তাঁদের সম্পর্কেও নাশকতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। লোকালয়ে থাকলে তাঁদের খুঁজে বের করবে পুলিশ। ভয়ে তাঁরা বন-বাদাড়ে গিয়ে আত্মগোপন করতে পারেন। সে অবস্থায় প্রধান প্রতিমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, ‘আন্দোলনের জন্য ১৮ দলীয় সব নেতাকে বাটি চালান দিয়েও পাওয়া যাবে না।’
বাটি চালানপদ্ধতি চালু হলে রাষ্ট্রের ব্যয় অনেক কমে যাবে। পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকায়ন না করলেও চলবে। গোয়েন্দাদের খাটনি কমে যাবে পনেরো আনা, যা করার বাটিই করে দেবে। বাটিই বলে দেবে, এক বাস পোড়াতে আর এক ককটেল ফাটাতে একবাক্যে হুকুম দিয়েছিলেন ৪৪ নেতা। যদিও হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা মারার হুকুমদাতা দুজনের বেশি নন।
আইয়ুব খানের জামানায় বাটি চালান দিয়ে নেতাদের ধরতে দেখেছি মোনায়েম খানকে। এবং একপর্যায়ে জেলগুলো ভরে যাওয়ার পর বাটি চালান দিয়েও আমেনা বেগম ও মিজান চৌধুরী ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু দুই বছর না যেতেই বাটি চালান দিয়েও খানসাহেবদের লীগের একজনকেও খুঁজে পাওয়া গেল না সত্তরের নির্বাচনের দিন রাত বারোটায়। সারা দেশের লোক দেখতে লাগল অন্য লীগের লোকদের।
বঙ্গীয় বাটি দুই প্রকার: একটি দৃশ্যমান, আরেকটি অদৃশ্য। বাংলাদেশে অদৃশ্য বাটি চালান চলছে বহুদিন থেকে। জোট সরকারের প্রধান প্রতিমন্ত্রী ছিলেন বাবর সাহেব। ১০ ট্রাক অস্ত্রের মামলাই হোক বা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাই হোক, গোয়েন্দাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিয়ে নিজেই বাটি চালান দিলেন। বাটি গিয়ে খপ্ করে অপরাধীদের ধরে ফেলল। পরিণাম হলো এই যে এখন তিনি নিজে এবং শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা রাজ অতিথি।
বাংলাদেশে বাটির বহুমুখী ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের উচিত যখন বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা আসবেন, তাঁদের একটি বাটি উপহার দিয়ে বলা: চোর চোর বলছেন, এইটা চালান দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের প্রয়োজন এখন একটি বাটি। তদন্ত করে কাঁঠালের বস্তায় যখন কোনো দুর্নীতির প্রমাণ মিলবে না, তখন চালান দেবেন বাটি। সব দেখা হয়ে গেছে। বাটিই এখন একমাত্র ভরসা। জয় বাংলা। জয় বাংলার বাটি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সোমবার, ১৪ মে, ২০১২

অতিথি নারায়ণদের কথা


কোনো কোনো উপলক্ষ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এবং তা বিশেষভাবে বিচার্য। সব উপলক্ষ নয়। কোনো দেশে বিদেশি অতিথি সফর করলেই তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমনকি অতিথিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেও সফরটি গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে। সব কুটুম্ব বড় কুটুম্ব নয়। এই উপমহাদেশে অতিথিকে বলা হয় নারায়ণ। কিন্তু সব অতিথি নারায়ণ নন—কোনো কোনো অতিথি নির্ভেজাল নারায়ণ। নারায়ণ সন্তুষ্ট থাকলে তাঁর বদৌলতে ভাগ্য খুলে যাবে। নারায়ণ নাখোশ হলে কপাল পোড়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। 
ঘটনাক্রমে তিন গুরুত্বপূর্ণ দেশের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি এক হপ্তার মধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁদের আগমনের কথা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই মিডিয়া বলতে থাকে তাঁদের সফল এক ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা। আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যেমন আজকাল ১৫ দিন আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন: অনাগত হরতালে ‘নাশকতা হবে’, ‘দূর থেকে মিছিলে গুলি হবে’, তেমনি মিডিয়ার মানুষ অতিথি আগমনের আগেই রায় দিয়ে দেন: এ সফর ‘সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য।’
শুধু সাংবাদিকদেরও দোষ দেওয়া যাবে না। তাঁরা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই রিপোর্ট করেন। পেশাদার কূটনীতিক, প্রবীণ আমলা এবং টিভি চ্যানেলে প্রাত্যহিক জ্ঞানদানকারীদের মতামত ও বিশ্লেষণের মূল্য খুব বেশি। কিন্তু সাধারণ লোকজন যত নাদানই হোক, তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি না থাকুক—যেকোনো পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের একটা নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন আছে। তাদের সেই মূল্যায়নের মূল্য স্বনামধন্য কলাম লেখকদের সারগর্ভ বিশ্লেষণের চেয়ে কম নয়। 
তিন অতিথি কাছাকাছি সময়ে বা প্রায় একসঙ্গে এসেছেন—সেটাকেও বলা হয়েছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’। আসলে তাঁদের একই হপ্তায় আসাটা পরিকল্পিত নয়—কাকতালীয়। যেকোনো কারণেই হোক একসঙ্গে ঘটে গেছে। এমন নয় যে বেগম ক্লিনটন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও ভারতের অর্থমন্ত্রীকে ফোন করে বলেছেন, ‘ভাইসাব, চলেন আমরা এক লগে বাংলাদেশে যাই।’ 
জাপানি নেতা এসেছেন, তাঁরা আমাদের রাস্তাঘাট, ব্রিজ প্রভৃতি বানানোর জন্য টাকা ধারকর্জ দেন। শুনেছেন সেই টাকা এধার-ওধার হয়। তাঁদের ট্যাক্সের কষ্টের টাকা। তা যে কাজের জন্য দেন, তা না করে ভাগাভাগি হলে তাঁদের কষ্ট হয়। সেই কথাটা বলতে তিনি এসেছিলেন: ও সব চলবে না। বকাঝকা খাওয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সাফল্য কম নয়!
কূটনৈতিক সাফল্য যেটুকু দেখানোর তা আমাদের সাবেক রাষ্ট্রদূত টোকিওতে দেখিয়ে এসেছেন। তাঁর সাফল্যের কথা জাপানি পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্তাদের চেয়ে ঢের বেশি জানেন সে দেশের এক বা একাধিক নারী। কী সুন্দর দেশ। কী অপরূপ চেরি ফুল। ওই অপরূপ পরিবেশে হাতের নাগালে যে যুবতীকে পাওয়া যায় তার গায়ে হাত দেওয়ার সাধ কার না হয়? ওই যে কবি বলেছেন: ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো। 
লম্পট প্রকৃতির দুলাভাই নির্জন পুকুরের পাড়ে বা ঝোপঝাড়ের আড়ালে শালীকে হাতটা ধরে বলতে পারে, ‘তোমার বুবুর চেয়ে তুমি সুন্দর। কাছে আসো।’ ডাগর শ্যালিকা তার বাবার কাছে নালিশ নাও করতে পারে চক্ষুলজ্জায়। শুধু বোনকে সাবধান করে দেবে, ‘বুবু, তোমার জামাই কেমন জানি। চোখে চোখে রাখবা।’ কিন্তু বিদেশি যুবতীকে কোনো কূটনীতিক অশোভন প্রস্তাব দিলে তিনি নীরবে হজম করবেন না। এসব ক্ষেত্রে দুনিয়ার মানুষ দেখতে চায়, দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
যে দেশে খুনখারাবি, অপহরণের শাস্তি হয় না, সেখানে অর্থ আত্মসাৎ বা লুচ্চামি তো নস্যি। রাষ্ট্রযন্ত্র মানুষ না, কিন্তু তারও একটি নৈতিক মান থাকতে হয়। জোট সরকারের আমলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছিল জঙ্গি মৌলবাদের কারণে। এখন ভাবমূর্তি চূর্ণ হচ্ছে দুর্নীতি ও লাম্পট্যের ঘটনায়। কাঠমান্ডু থেকে টোকিও পর্যন্ত বাংলাদেশের বদনাম। টোকিওতে অনেক দিন থেকে কোনো রাষ্ট্রদূত নেই। 
টোকিওর মেহমান যাওয়ার বেলায় যা বলে গেছেন, তাতে দেশের মানুষ মনে করে তাঁর না আসাই ভালো ছিল। কর্তাদের দুর্নীতির খাসলত না বদলালে তাঁরা কোনো অনুদান ও ঋণ দেবেন না। বলেছেন আগে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ফয়সালা না হলে তাঁরা পদ্মা সেতুতে একটি পয়সাও দেবেন না। 
ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম বর্ষের দুই দেশের যৌথ অনুষ্ঠানমালার সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মানিত অতিথি হয়ে। তাঁর আসার দিনক্ষণ ১৫১ বছর আগেই রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা ঠিক করে দেন, শুধু কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতাটুকু করেছেন আমাদের পররাষ্ট্র ও ভারতের বিদেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে তিনি যে উপলক্ষেই আসুন না কেন, তাকে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপারেও কাজে লাগিয়েছেন। তিনি উপলক্ষকে কাজে লাগাবেন তাঁর দেশের স্বার্থে। বাংলাদেশের নেতারা যদি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারতেন, সেটাই হতো তাঁদের ‘কূটনৈতিক সাফল্য’।
পশ্চিমবঙ্গের কাগজগুলোর ভাষায়, প্রণব মুখার্জি ‘শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু’। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক অন্তরঙ্গ। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক যদি দুই দেশের জনগণের স্বার্থে ও কল্যাণে ব্যবহার করা যায়, তা হলে তার মূল্য খুব বেশি। যদি বন্ধুত্বটা শুধু পারিবারিক ও ব্যক্তিপর্যায়েই গভীর থাকে, তাহলে তাতে দেশের মানুষের কিছু আসে-যায় না।
প্রণববাবু প্রাজ্ঞ মানুষ। রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ। তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে জানি অনেক দিন থেকে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও প্রাজ্ঞ। তিনি রাজনীতি থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সমান দক্ষ। তাঁর খালি গায়ে মন্দিরে বসে চণ্ডীপাঠের দৃশ্য আমি মিডিয়ায় দেখেছি। তাঁর বাবা কামদাকিঙ্কর মুখার্জি গান্ধীজির অসহযোগের সময় থেকে কংগ্রেসের রাজনীতি করেছেন। তাঁর পুত্রও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এসেছেন।
প্রণব মুখার্জি শুরুতে কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। বহু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সাফল্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ভারতের মতো একটি বৃহৎ উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে তিনি প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানও ছিলেন। তিনি একজন লেখকও। কংগ্রেস দলের বহু ইতিহাস আমার ঘরে রয়েছে, কিন্তু যখনই অবিভক্ত ভারতের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ইতিহাসের কোনো তথ্যের প্রয়োজন হয় আমি তাঁর সাগা অব স্ট্রাগল অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস দেখে থাকি। ভারতীয় অর্থনীতির বহুমাত্রিকতা জানতে তাঁর বিয়ন্ড সারভাইভ্যাল অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত সহজ ভাষায় তিনি প্রকাশ করতে পারেন। এ ধরনের বিদগ্ধ ও অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পূর্বপ্রস্তুতি থাকা দরকার।
অকৃতজ্ঞ কেউ যেমন অতি নিম্নশ্রেণীর মানুষ, তেমনি উপকারীর কোনো উপকারকে অব্যাহত বলতে থাকলে ব্যক্তিত্বহীনতার প্রকাশ ঘটে। এবং তা করলে উপকারী ও উপকৃতের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় না। আমাদের নেতারা অনবরত ভারতের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের কথা বলে থাকেন। সবার জানা একটি ঐতিহাসিক সত্যকে অব্যাহত বলা হীনম্মন্যতার পরিচয়। ‘শ্রী’ কথাটি ভারতের জাতীয় সম্বোধন। এবং একটি ‘শ্রী’তেই কাজ চলে। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমুখ বারবার ‘শ্রীশ্রী প্রণব মুখার্জি’ বলতে থাকলে কানে ভালো শোনাল না। বাংলাদেশের কারও নামের আগে জনাব বা শ্রী কোনোটাই না বলায় কেমন খালি খালি ঠেকল। অবশ্য রামেন্দু মজুমদার জনাব সম্বোধন করেছেন।
যে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রীরা ‘শ্রীশ্রী’ বললেন, সেই রবীন্দ্রনাথকে মুসলমানপ্রধান এলাকায় ‘জনাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ সম্বোধন করা হয়েছে। ‘জনাব জওহরলাল নেহরু’ বলেও সম্বোধন করা হয়েছে। তাতে তাঁদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগেনি। তাঁরাও অন্যদের জনাব সম্বোধন করেছেন। ড. মনমোহন সিংকেও আমাদের মন্ত্রীদের জনাব সম্বোধন করতে আমি নিজে শুনেছি। সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জির ভাষণটি ছিল সুলিখিত ও সংযত। আমাদের বক্তাদের মধ্যে একটা বিগলিত তোষামোদীর ভাব প্রকাশ পেয়েছে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ—প্রদেশ নয়। স্বকীয় সংস্কৃতি ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে, সে সবের সুরাহা সংক্রান্ত কোনো সুখবর জানা না গেলেও, কলকাতার সংবাদপত্র থেকে জানা গেল:
‘বরাবরই তিনি স্বল্পভোজী। বিদেশে গেলে তো আরও। কিন্তু সেই নিয়ম ভাঙতে হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “শাসনে”। এত ব্যস্ততার মধ্যেও রোববার ঢাকায় নিজ হাতে পায়েস রান্না করেছিলেন পুরোনো পারিবারিক বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্য। দুই বাটি খেয়েছেন প্রণব। কিন্তু মিষ্টি খেতে তো তিনি ভালোই বাসেন। তদুপরি চার রকমের মাছ খেতে হয়েছে তাঁকে। রুই মাছের কালিয়া, তেল কই, চিতল মাছের বিরাট পেটি, চুনোমাছের ঝাল আর গলদা চিংড়ি। একসঙ্গে এত কী করে সামলালেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী? তাঁর ভাষায়, ‘কী করব! সামনে রীতিমতো ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তো হাসিনা। না খেয়ে উঠতে দিলেন না।’...রোববার রবীন্দ্রসদনে [ভুল] বক্তৃতা দিতে উঠে অন্তত দুবার প্রণববাবুকে ‘বাংলাদেশের পরম বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন শেখ হাসিনা। ...দিল্লি থেকে আমসহ বিভিন্ন উপহার নিয়ে গিয়েছেন প্রণব। তাঁর হাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর জন্য উপহার পাঠিয়েছেন শেখ হাসিনা। ওই উপহারের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বিখ্যাত বিপণির শাড়িও।’
মুখার্জি মহাশয় বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। সফরসূচি তৈরিতে শুধু বাংলাদেশ সরকারের হাত থাকলে নিশ্চয়ই এই সাক্ষাৎ হতো না। খালেদার সঙ্গে মুখার্জির পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব না থাকলেও তাঁদের সঙ্গে জানাশোনা বহুদিনের। বিরোধীদলীয় নেত্রী ভারতীয় অতিথিকে বগুড়ার দই বা নাটোরের কাঁচাগোল্লা দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন কি না জানা যায়নি। এমনও হতে পারে, শেখ হাসিনার বাড়িতে অত গুরুপাক খাদ্যে অতিভোজনের পর তাঁর আর কিছু মুখে দেওয়া সম্ভব ছিল না। সেটা বিবেচনা করেই বেগম জিয়া টোস্ট বিস্কুট অথবা পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ সরষে তেল দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে চা দিয়ে খাতির করে থাকবেন।
তবে কি খেলেন বা পেলেন, তারচেয়ে বড় কথা তাঁরা খোলামেলা আলোচনা করেছেন মাতৃভাষায়। ভারতের নেতা বলেছেন, কোনো একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় ভারত। খালেদা বলেছেন, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ওবাড়িতে দুই বাটি পায়েস, চিতলের পেটি, গলদা, রুই প্রভৃতি থালায় নিয়ে যে বিরক্তিকর প্রসঙ্গ ওঠেনি, এবাড়িতে সেই তিস্তা ও টিপাই নিয়ে কথা হয়েছে। দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক খুবই চমৎকার। তবে ভারত-বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তা যদি দুটি দেশের মধ্যে হতো, তা হলে এ দেশের হতভাগ্য জনগণ হতে পারত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মা একই সময় ঢাকায় ছিলেন। তাঁকে কী কী বঙ্গীয় খাদ্যে ভূরিভোজ করানো হয়েছে সে খবর আমেরিকার কাগজে বের হয়নি। বিশ্ববিধাতা কোটি কোটি বছর ছিলেন একজন। ১৯৯০ থেকে দুইজন। একজন আকাশে—আর একজন মাটিতে। মাটির বিশ্ববিধাতার নিজস্ব পাটিগণিত আছে। যাদববাবুর পাটিগণিতের সঙ্গে তাঁর পাটিগণিতের মিল নেই। তাঁর পাটিগণিতের অঙ্কের হিসাব আলাদা। তাঁর পাটিগণিত তাঁর পলিসি। তাঁদের গ্রহটির প্রতি বর্গইঞ্চি জায়গায় কোন মুহূর্তে কী হচ্ছে তা তাঁদের নখদর্পণে। এবং তাঁদের স্বার্থে কী হতে হবে, তার নীলনকশা তাঁদের নোটবইয়ে টোকা আছে। তাদের আকাঙ্ক্ষাই মুখ্য। কোন ভূখণ্ডের জনগণ কী চায় তা গৌণ। গৌণ বললে ঠিক হবে না, তার কোনো মূল্যই নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মা বলে গেছেন, ‘বাংলাদেশ অনেক পথ পাড়ি দেবে, সঙ্গী হবে যুক্তরাষ্ট্র।’ সেই পথটা যদি চীন, ভেনেজুয়েলা বা কিউবা পর্যন্ত হয়, তা হলে এক কথা। যদি আফগানিস্তান, ইরাক বা লিবিয়ায় তার পিছে পিছে পাড়ি দিতে হয়, তা হলে অন্য কথা। বড় মার মুখের ম্লান হাসির অর্থ বাংলার মানুষ কিছুটা বোঝে।
অভাগিনী বাংলা মায়ের সামান্য ধন, কিন্তু তার কাছে বড় মা ও বড়দাদের দাবি কত? তবু বলব, অতিথি নারায়ণ।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সোমবার, ৭ মে, ২০১২

প্রেমিকের দাঁত

প্রেম-বন্ধুত্ব কোনো স্বার্থনিরপেক্ষ চিরস্থায়ী বিষয় নয়। তা সে বন্ধুত্ব নর-নারীর মধ্যেই হোক বা এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের হোক বা জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের হোক। বন্ধুত্ব বিষয়টিই এ রকম যে—যদি তুমি আমার সঙ্গে থাকো তো তোমাকে আমি আমার কোলে তুলে নেব। যদি না থাকো, বিরুদ্ধে যাও অথবা এর-ওর সঙ্গে মাখামাখি করো, তাহলে তোমার সবগুলো দাঁত তুলে নেব।
এ ব্যাপারে একেবারে ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পোল্যান্ডের এক নারী গত হপ্তায়। তাঁর বাড়তি সুবিধা ছিল এই যে তিনি একজন দাঁতের ডাক্তার। অর্থাৎ প্রতারক বন্ধুকে শায়েস্তা করার অস্ত্র—দাঁত তোলার অস্ত্রপাতি—তাঁর নিজেরই ছিল। অন্য কোনো ডেন্টিস্টকে অতিরিক্ত ফি দিয়ে নিয়োগ করতে হয়নি।
বাঙালি রেগে গেলে বলে, ‘এক থাপ্পড়ে তোর বত্রিশ পাটি দাঁত ফেলে দেব।’ পোল্যান্ডের প্রেমিকা থাপড় দিয়ে ফেলেননি, প্রেমিককে অজ্ঞান করে যন্ত্র দিয়ে টেনে তুলেছেন তাঁর ৩২টি দাঁত। 
দন্ত চিকিৎসক আন্না বন্ধুত্ব বা ভালোবাসাবাসি করেছিলেন ওলসেঙ্কির সঙ্গে। তলে তলে ওলসেঙ্কি আরেক নারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতান। সেটা টের পান আন্না। এর মধ্যে দাঁতের সমস্যা নিয়ে আন্নার চেম্বারেই যান ওলসেঙ্কি। আন্না মনে মনে বলেন, এবার পেয়েছি তোমাকে। আরেক মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করার মজা দেখাচ্ছি। বললেন, শুয়ে পড়ো চেয়ারে। টোকাটুকি করে দাঁত পরীক্ষা করতে করতেই প্রয়োগ করেন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন চেতনানাশক ইনজেকশন। তারপর তিনি নির্বিঘ্নে বন্ধুর ৩২টি দাঁতই তুলে ফেলেন। 
ঘোর কাটার পর ওলসেঙ্কি বুঝতে পারেন, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। মুখের ভেতরটা খালি খালি লাগে। ওপরে ব্যান্ডেজ। তাকে সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে না। সে ভালো ডাক্তার। কিন্তু হায় আল্লাহ, সে এমন নিষ্ঠুরতা করতে পারল!
ব্যাপারটা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অপরাধ প্রমাণিত হয়। আন্না আদালতের কাঠগড়ায় বলেন, জানি কাজটি ঠিক হয়নি। কিন্তু লোকটা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তাই নিজেকে সামাল দিতে পারিনি। সবগুলো দাঁত তুলে ফেলেছি। এবার নতুন বন্ধুর সঙ্গে দাঁত কেলিয়ে হাসাহসি করুক।
দাঁত তোলা ডাক্তারনীর তিন বছরের জেল হয়েছে। কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো, ওলসেঙ্কির নতুন মেয়েবন্ধুটিও তাকে ছেড়ে পালিয়েছে। দাঁতও গেল, নতুন বন্ধুও গেল। খবরটি ডেইলি মেইল-এর।
প্রতারণা এমন এক প্রবৃত্তি যা থেকে প্রতিহিংসার জন্ম। প্রতিহিংসায় কোনো পক্ষই লাভবান হয় না। ব্যক্তিগত জীবনেও নয়, রাজনীতিতেও নয়।
কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে তা হিসাব করে করা ভালো। বিচার-বিবেচনা করে সততার সঙ্গে করা ভালো। স্বার্থের জন্য বন্ধুত্বের অভিনয় করলে তার পরিণাম শুভ হয় না। তা সাধারণ নর-নারীর জন্য যেমন প্রযোজ্য, রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। বন্ধুত্বের নামে, পার্টনারশিপ বা অংশীদারির নামে এক বন্ধু যদি অপর বন্ধুর পনের আনা সম্পদের অংশের ভাগ চায় এবং তা না দিলেই দন্ত উৎপাটন করে, তা কোনো বন্ধুত্ব নয়।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা স্বার্থের কারণে কখনো একজন নিজেকে উজাড় করে দিতে পারে। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের মালিকানা যৌথভাবে জনগণের। বন্ধুত্বের নামে, ব্যক্তিস্বার্থে অর্থাৎ ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সবকিছু উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা হলে জনগণ মনে করে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। 
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বহু দেশ আমেরিকা ও পশ্চিমী পুঁজিবাদী দেশগুলোর সহায়তায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। একপর্যায়ে কোনো কোনো দেশের নেতা সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়েন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে। তা ছিল প্রতারণা। আফ্রিকার অনেক দেশে এমন হয়েছে। আমাদের অঞ্চলেও ঘটেছে। 
রাজনীতি এক ভয়ংকর খেলা। নেতাদের উচিত সবার সঙ্গেই খুব সাবধানে প্রেম ও পার্টনারশিপ করা। প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা না থাকলে সবগুলো দাঁত রক্ষা করা কঠিন।
গণতন্ত্র একধরনের বন্ধুত্ব। জনগণের সঙ্গে জনপ্রিয় নেতাদের বন্ধুত্ব। তা নর-নারীর প্রণয়ের মতোই আবেগী ব্যাপার। প্রেমিকের সব দাঁত তুলে ফেলা মানে তার মুখের সৌন্দর্য হারানো। রাজনীতিতে নেতাদের দাঁত তোলা মানে ক্ষমতা হারানো। যদি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে তাহলে দাঁত তোলার কাজটা তারা করে ভোটের সময়। যদি সে সুযোগ না থাকে, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন না করা যায়, তাহলে আরব বসন্ত। স্বৈরাচারী শাসকের দাঁত ওভাবেই জনগণ তোলে। 
জনগণ যদি দেখে তাদের বন্ধু তাদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের সঙ্গে মাখামাখি করছে, তখন তারা মনে করে তারা প্রতারিত হয়েছে। ফলে জনগণ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়। তারা নেতাদের সব দাঁত তুলে ফেলতে দ্বিধা করে না। 
ব্যক্তিগত জীবনে ও রাজনীতিতে সবচেয়ে নিরাপদ ও উত্তম পন্থা হলো কারও সঙ্গেই অতিরিক্ত প্রেমে জড়িয়ে না পড়া এবং প্রতারণা না করা। বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গেও নয়, দেশের বন্ধু অর্থাৎ জনগণের সঙ্গেও নয়। প্রতারণার পরিণাম পাঁচ-সাতটি নয়—সবগুলো দাঁত খোয়ানো।

সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১২

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব

রাজনীতি একটি পেশা। তবে রাজনীতিকের পেশাটি একজন তাঁতির পেশার মতো নয়, কর্মকারের পেশার মতো নয়, সুতার-মিস্ত্রি বা ডাক্তার-কবিরাজের পেশার মতো নয়। শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার পেশার মতোও নয় রাজনীতি। একজন তাঁতিকে উপার্জনের জন্য বসে বসে কাপড় বুনতে হয়। কর্মকারকে হাপরে লোহা গলিয়ে দা-বঁটি-খোন্তা-কুড়াল তৈরি করতে হয়। মিস্ত্রি দরজা-জানালা-আসবাবপত্র বানান। ডাক্তার-কবিরাজ রোগীর রোগ নির্ণয় করে ওষুধ দিয়ে তাকে আরোগ্য করেন। এসব কাজের জন্য তাঁরা মজুরি বা ফি পান। 
রাজনীতি একটি অন্য রকম পেশা। পেশা বটে, কিন্তু জীবিকা নয়। রাজনীতি সেবামূলক পেশা। কামার-কুমার-জেলে-তাঁতি যেমন প্রতিদিন জীবিকার জন্য কামাই করেন, রাজনীতির সঙ্গে জীবিকা অর্জনের সম্পর্ক নেই। একসময় তাই ছিল। এখন অবশ্য রাজনীতি শুধু জীবিকা নয়, জীবিকার বাবা। উপার্জনের দিক থেকে আজ একজন মধ্যমশ্রেণীর রাজনীতিকের কাছে একজন মাঝারি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী কিছুই না। শিল্পপতির লোকসানের ভয় আছে, রাজনীতিকের সে শঙ্কা লেশমাত্র নেই। 
প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক যুগের নেতৃত্ব থেকে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেতারা বিদেশি শাসকদের কাছে চাইতেন কিছুটা ক্ষমতার ভাগ; আর জনগণের কাছে চাইতেন আনুগত্য। ওই ব্যবস্থায় জনগণ নেতাদের আনুগত্য প্রদর্শন করে নিজেদের ধন্য মনে করত, অন্যদিকে আনুগত্য প্রদর্শন না করেও উপায় ছিল না। নেতাদের অনেকের লক্ষ্য ছিল বড় লাটের কাউন্সিলে মেম্বার বা মন্ত্রিত্ব-জাতীয় কিছু পাওয়া—অর্থ উপার্জন নয়। বরং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্মান-মর্যাদা অর্জন করতে ‘তাঁরা’ অকাতরে নিজের অর্থ ব্যয় করতেন। 
কংগ্রেসের প্রথম দিকের নেতারা সামন্ততান্ত্রিক নেতা ছিলেন। দাদাভাই নওরোজি, গোপালকৃষ্ণ গোখেল, বদরুদ্দিন তাইয়েবজি, ফিরোজশাহ্ মেহ্তা, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, রহিমতুল্লাহ সয়ানি, আনন্দমোহন বসু, মদনমোহন মালব্য, নবাব বাহাদুর সৈয়দ মোহাম্মদ, হাসান ইমাম, মতিলাল নেহরু প্রমুখ ছিলেন সামন্ত-পরিবারের মানুষ। কেউ বিরাট ধনী, কেউ বিখ্যাত ব্যারিস্টার, কেউ জমিদার-জায়গিরদার, কেউ পত্রিকার মালিক, বড় ব্যবসায়ী অথবা অভিজাত পরিবারের মানুষ। তাঁদের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সামান্য, শাসকদের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠতর। মহাত্মা হওয়ার আগে গান্ধীজির মতো মানবাধিকার আইনজীবীকে ফিরোজশাহ মেহ্তার সঙ্গেও দেখা করতে বেগ পেতে হয়েছে। তারপরও কংগ্রেসের ভেতরে ভিন্নমত প্রকাশের একটা পরিবেশ ছিল।
মুসলিম লিগের নেতৃত্বও ছিল একই রকম সামন্ততান্ত্রিক। কেউ নবাব বাহাদুর, কেউ সামন্তভূস্বামী, কেউ বা বড় আইনজীবী-শিল্পপতি। তবে লিগে ভিন্নমত নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আলোচনার সুযোগ ছিল না। নেতার মতই শিরোধার্য।
সেকালের রাজনৈতিক নেতারা জেলা বোর্ড বা মিউনিসিপ্যালিটিতে নির্বাচন করা দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু করতেন। তারপর কেউ যেতেন কাউন্সিলে, কেউ হতেন মন্ত্রী।
পরাধীন দেশের নেতাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশকে ধীরে ধীরে স্বশাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া। বড় জোর মন্ত্রী পর্যন্ত হওয়া যাবে, কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। সেকালে মন্ত্রিত্ব ছিল জনসেবামূলক চাকরির মতো। তবে নেতারা জনগণের কিছু দাবিদাওয়া সরকারকে দিয়ে পূরণ করাতে চেষ্টা করতেন।
সব রাজনৈতিক নেতা জননেতা নন, কিন্তু সব জননেতাই রাজনৈতিক নেতাও। জননেতারা মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধী ভারতীয়দের অধিকার আদায়ের জন্য অহিংস সত্যাগ্রহ বা সংগ্রাম করেছেন। মওলানা ভাসানী আসামে লাইন প্রথার বিরুদ্ধে এবং বাঙাল-খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে জননেতায় পরিণত হন। বিদেশি শাসকদের বিতাড়িত করার আন্দোলন করে সুভাষচন্দ্র বসু নেতাজি হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কিংবদন্তিতে পরিণত হন। ক্ষমতায় বসা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। মার্টিন লুথার কিং কালোদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জননায়কে পরিণত হন এবং জীবন উৎসর্গ করেন। নিজে ক্ষমতায় যেতে চাননি, কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় বারাক হোসেইন ওবামার মাধ্যমে। মিয়ানমারে সু চি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সে কারণে তিনি জননেতা। আপস করলে অনেক আগে মন্ত্রী হতেন। 
সামরিক শাসন সাংবিধানিক শাসন নয়—কয়েকজন সেনাপতির খেয়ালখুশির শাসন। কিন্তু রাষ্ট্রে যদি গণতন্ত্র থাকে, তা হলে যেকোনো পেশার মানুষ জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে পারে। অবসর নিয়ে কোনো সেনাকর্মকর্তাও নির্বাচিত হতে পারেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো দুটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সে দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার ছিলেন জনপ্রিয় মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের একজন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল ছিলেন অতি জনপ্রিয় ও সম্মানিত। আইয়ুব খানসহ কোনো সামরিক একনায়কই যত দক্ষ শাসনকর্তাই হোন, জননেতা হতে পারেননি।
গণতন্ত্রের সুবিধা ব্যবহার করে লিগ নেতারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সামন্ত নেতৃত্ব মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেন। অ-সামন্তবাদী গণতন্ত্রপন্থী নেতারা লিগ থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে ১৯৫০-এ জমিদারি প্রথাও বাতিল হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটলেও, কৃষক জমির মালিকানা পেলেও, তাঁর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হলেও, সমাজব্যবস্থা থেকে যায় আধা সামন্ততান্ত্রিক। যাঁর ক্ষমতা বেশি ও যাঁর বিত্ত বেশি, তাঁর কাছে নতজানু হওয়া সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য।
জনগণের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো। জনগণের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখা দিল। কিন্তু সম্ভাবনাটি ফলপ্রসূ হলো না। গণতন্ত্রের বিরতিহীন চর্চা ছাড়া, নানা মতাদর্শের সমন্বয় ও সহ-অবস্থান ছাড়া জনগণের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে নতুন নেতৃত্ব তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু উগ্র পন্থা গ্রহণ করায় তাঁরা সে সুযোগ নস্যাৎ করে দেন। বেসামরিক সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব থেকে দেশ সামরিক একনায়কী নেতৃত্বে চলে যায়।
চতুর্থ সংশোধনীর পর গণতন্ত্র চর্চার পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তারও আগে ১৯৭৩- দেশের ছোট-মাঝারি দলের নেতারা উপলব্ধি করেন, নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো দন তাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। তখন তাঁদের সামনে খোলা ছিল তিনটি পথের যেকোনো একটি: বাকশালে যোগ দেওয়া, রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া এবং কোনো অনাগত অসাংবিধানিক সরকারকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া। সবচেয়ে সুবিধাজনক বলে তাঁরা শেষটি বেছে নেন।
তাঁরা মোশতাক-জিয়া সরকারকে সঙ্গে সঙ্গেই সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৭৯-তে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল তাঁদের গণতান্ত্রিক উপায়ে আকাঙ্ক্ষা পূরণের শেষ ধাপ। ওই নির্বাচনে সদ্যজাত বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। দ্বিতীয় স্থানে আওয়ামী লীগ পায় ৩৯, মুসলিম লীগ—যা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল—পায় ১২টি, জাসদ আটটি, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (যা ছদ্মবেশী জামায়াত) পায় আটটি, সাম্যবাদী দল, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), একতা পার্টি প্রভৃতি দলের নেতারাও নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক জিয়া তাঁদের এই সুযোগটা দেন, আওয়ামী লীগ থেকে তাঁরা যা কোনো দিন পেতেন না। জিয়ার কাছ থেকে ওই করুণাটুকু পাওয়ার ফলে অনেকেই সরকারে গেলেন কিন্তু জনগণের নেতা হওয়ার সুযোগটা হারালেন।
শুধু ছোট দলের নেতাদের দোষ দেওয়া যাবে না। বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী প্রথিতযশারা সামরিক একনায়ককে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এক লেখায় ঠিকই বলেছেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার সামরিক পরিচয় ঘুচে গিয়েছিল, জনগণের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ মিলছিল এবং সে কারণে তিনি তাঁকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান। সেখানে তিনি ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে খাল খনন করেন বা মাটি-টাটি কাটেন।
সামরিক একনায়কেরা নানাভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আইয়ুবের মতো জিয়াও শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠী প্রযোজিত সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কোরিয়ায় পাঠাতে প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু অর্থ অনুদান নয়, শিল্পী ও কলাকুশলীদের বিমানে ফ্রি টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকটি তিনি নিজে বেইলি রোডে গিয়ে উপভোগ করেন। তাতে তিনি সংস্কৃতিসেবীদের কৃতজ্ঞতাভাজন হন। প্রেসিডেন্ট এরশাদও শিল্পী-সাহিত্যিকদের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
এসবের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ কণ্টকাকীর্ণ হয়। সামন্ততান্ত্রিক ধরনের নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্যতা পায়। ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের ভার এখন দুই পরিবারের হাতে চলে গেছে। গত ১৬-১৭ মার্চ দিল্লিতে ইন্ডিয়া টুডে আয়োজিত একান্ত বৈঠকে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা সজীব ওয়াজেদ জয় যথার্থই বলেছেন: ‘উই হ্যাভ টু পলিটিক্যাল ডায়নেস্টিজ ইন আওয়ার কান্ট্রি। ওয়ান ইজ মাই ফ্যামিলি। দ্য আদার ওয়াজ ফাউন্ডেড বাই আওয়ার ফার্স্ট মিলিটারি ডিকটেটর।’ জনাব তারেকও সম্ভবত একই কথা বলবেন।
পারিবারিক বংশপরম্পরার শাসন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। পারিবারিক সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব যত যোগ্যই হোক, মানবকল্যাণে মাদার তেরেসার মতো ব্রতী হোক, তাঁকে জনগণের নেতা বলা যাবে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দলের নেতারা শীর্ষনেতার সহকর্মী। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্বে তাঁরা সহকর্মী নন, অধীনস্ত কর্মচারী বা হুকুমবর্দার।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারায় দল নয়, ডায়নেস্টি প্রধান। প্রবীণ নেতা আবদুল জলিলসহ অনেকেই এখন প্রকাশ্যে বলছেন, দলের ভেতরে কথা বললে বিপদ। তবে অসাবধানতাবশত একটি কথা তিনি স্বীকার করেছেন, একক সর্বময় নেতৃত্ব সৃষ্টিতে তাঁরা কয়েকজন সংস্কারপন্থীই প্রধান ভূমিকা পালন করেন। শুধু তাঁরা নন, কিছু প্রথিতযশা বিভিন্নজীবী ও নীতিবিদদের ভূমিকা আরও বেশি। 
গণতন্ত্র একটি ডিসকোর্স বা বিতর্ক ও চিন্তাশীল বিচার-বিশ্লেষণের বিষয়—ওপর থেকে কারও চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস নয়। কোনো প্রশ্নে ভিন্নমত পোষণ করে বিরোধিতা করা আর শ্রদ্ধাহীনতা এক কথা নয়। নেতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আনুগত্য রেখেও ভিন্নমত দেওয়া যায়। 
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাবে জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তা-ই বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারেন জননেতারা—প্রচলিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়। 
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভার শুধু নির্বাচন কমিশনের নয়। তার কাজ এক দিনেই শেষ। গণতন্ত্র শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন নয়, শুধু নেতার শাসন নয়, সবার শাসন। ছোট-বড় সব দলের অনির্বাচিত নেতাদের মতামতের মূল্য দিতে হয়। দক্ষ ও মেধাবী আমলা ও কূটনীতিকদের ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুযোগ্য ও সৎ সামরিক কর্মকর্তাদের কাজে লাগাতে হয়। সব পেশাজীবী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী, শিল্পপতির পরামর্শ ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। অতি অল্পসংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতার দাবিও গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হয়। সেসব সমন্বয় করতে পারেন শুধু একজন জননেতা—সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্বের পক্ষে তা সম্ভব নয়। 
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।