শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১২

সাইড নিতেই হবে



সৈয়দ আবুল মকসুদ | 
ফরাসি অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জাঁ-পল সার্ত্রে ১৯৮০-তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এক মধ্যরাতে। রাত দেড়টার দিকে। নানা রকম শারীরিক সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন অনেক দিন। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ যখন সংবাদপত্রের অফিসে আসে তখন পত্রিকার শুধু মেকআপ শেষ নয়, ছাপার কাজ চলছিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ও শেষ পাতা নতুন করে মেকআপ করার ব্যবস্থা করা হয়। কালো বর্ডার দেওয়া সব কাগজের প্রথম ও শেষ পাতায় ছিল সার্ত্রের শেষযাত্রার খবর। অন্য কোনো সংবাদ নয়। পরদিন সকালে প্যারিসে কাগজ বের হয় দেরিতে। 
দেরি হওয়ার কারণ এলিসি প্রাসাদের শোকবার্তার জন্য কাগজগুলো অপেক্ষা করছিলেন। প্রেসিডেন্ট ভালেরি জিসকার্ড দ্যে’স্তার শোকবার্তা আসে দেরিতে। বিলম্বের কারণ তিনি ভাবছিলেন শোকবার্তায় কী লিখবেন। প্রথাগত শোকবাণী চলবে না। এসব ক্ষেত্রে অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানদের কোনো সমস্যা হয় না। তাঁরা ঘুমিয়ে থাকেন। তাঁদের উপ বা সহকারী প্রেসকর্মকর্তা শোকবার্তা মিডিয়াকে দিয়ে দেন: তাঁর মৃত্যুতে আমাদের সাহিত্যের যে ক্ষতি হলো তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আমি তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। 
কাঁচা ঘুম থেকে জেগে প্রেসিডেন্ট দ্যে’স্তা কিছুক্ষণ ভাবেন। তাঁর সহকারীকে ডিকটেশান দিতে গিয়ে বলেন, ‘যা বলি লেখো। আজকের শোকবার্তায় কোনো রকম পণ্ডিতি ফলাইতে যেয়ো না।’ তিনি সেদিন বলেছিলেন: ‘সারা জীবন প্রতিষ্ঠান ও প্রথাবিরোধী ছিলেন এই মহান দার্শনিক। প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি তাঁর মৃত্যুতে শোকবাণী দিলে তাঁর নীতি-আদর্শের প্রতি অসম্মান জানানো হবে। এসব আনুষ্ঠানিক সম্মান তিনি কোনো দিন পছন্দ করেননি। তাঁর মৃত্যুতে আমি শোক প্রকাশ করতে পারি শুধু তাঁর একজন ছাত্র ও পাঠক হিসেবে, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শোকবার্তা দেওয়া হবে ঔদ্ধত্যের শামিল।’ দীর্ঘ শোকবার্তার শেষে গিয়ে তিনি বলেন, সার্ত্রে নিরপেক্ষ ছিলেন না, সব সময়ই একটি সাইড (side) বা পক্ষ নিতেন।
সার্ত্রের মতো মানুষেরা কেন পক্ষ নিতেন এবং কার পক্ষই বা নিতেন? জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এবং আন্তরাষ্ট্রীয় প্রশ্নে তিনি সাবলীলভাবেই একটি পক্ষ অবলম্বন করতেন। যখন দেখতেন তাঁর নিজের রাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো রাষ্ট্র অন্যায় করছে—তিনি একটির পক্ষ নিতেন। অন্যায়কারী নিজের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও দ্বিধা করেননি। প্রবলকে দুর্বলের ওপর অবিচার করতে দেখলে প্রবলের বিরোধিতা করেছেন সব শক্তি দিয়ে। মাওবাদী পত্রিকা বিক্রির ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তিনি সেই কাগজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিক্রি করেছেন। 
ফ্রান্স একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। শত শত বছর ধরে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ শাসন ও লুণ্ঠন করেছে। সেসব দেশের সম্পদ এনে গড়ে তুলেছে এক সমৃদ্ধ ও সুন্দর ফরাসি দেশ। একসময় ওই সব পদানত দেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগে। তৎক্ষণাৎ ফরাসি সরকার তাদের দমন করতে চালায় পাশবিক নির্যাতন। রাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে, নিজের দেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে সার্ত্রে ও তাঁর মতো আরও অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবী আলজেরিয়া, মরক্কো প্রভৃতি দেশের স্বাধীনতাকামীদের সমর্থন দিয়েছেন। সে সমর্থন গোলটেবিলের টেবিল চাপড়ে নয়, অতি সক্রিয়ভাবে ও ঝুঁকি নিয়ে। 
ইঙ্গ-ফরাসি সাম্রাজ্যবাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যখন ভিয়েতনামের মুক্তিকামীদের ওপর বছরের পর বছর ধরে চালাতে থাকে বর্বরতা ও গণহত্যা, তার প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন সার্ত্রে ও তাঁর বন্ধুরা। যুদ্ধাপরাধী মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিচারের জন্য গঠন করেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত। স্টকহোমের সেই আদালতের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তাঁর কার্যকলাপে ফরাসি সরকার বিব্রত হয়েছে, কিন্তু তাঁকে অগ্রাহ্য ও অপমান করেনি। 
সব যুগে সব দেশে ভলতেয়ার, সার্ত্রেরা থাকেন না। কিন্তু সব কালে সব দেশেই বিবেকবান নাগরিকেরা তাঁদের অভাব কিছু পূরণ করেন। অন্যায়-অবিচার দেখলে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁরা প্রতিকার চান। প্রতিবাদ করেন। সরকার যেহেতু মানুষেরাই চালান, সুতরাং যেকোনো সরকারেরই ভুল হতে পারে। ভুল ধরিয়ে দিলে তা সংশোধন করা সম্ভব। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চাইলে, ভুল ধরিয়ে দিতে গেলে, একটা সাইড নিতেই হয়। এক পক্ষকে সমর্থন দিলে আরেক পক্ষের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি নিতেই হবে। 
বাংলাদেশ একটি জনবহুল ছোট রাষ্ট্র। অন্তহীন তার মানুষের সমস্যা, অশেষ তার জনগণের দাবি। সেসব সমাধান করা ও পূরণ করা যেকোনো দক্ষ সরকারের পক্ষেও কঠিন। কিন্তু সমাধান করার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা আছে কি না সেটাই বিবেচ্য।
বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য তারা জনপ্রিয় নেতা পেয়েছে। কিন্তু একটি আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দক্ষতাসম্পন্ন প্রশাসক ও রাষ্ট্রনায়ক পায়নি। নেতা হিসেবে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন এক কথা, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টি থাকা আরেক কথা। উনিশ শতকের শেষ ও কুড়ি শতকের প্রথম দিকে বাঙালি হিন্দুসমাজে অত্যন্ত উঁচু মানের শিক্ষিত ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন অসংখ্য। তাঁদের কেউ কেউ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে রাজনীতিতে আসেন। স্বাধীনতার পরে দেশ গঠনের দায়িত্ব পড়ে তাঁদের হাতে। ফলে ভারতে একটি মজবুত গণতান্ত্রিক ও সামাজিক ভিত্তি তৈরি হয়। ওই নেতৃত্ব বহু ত্যাগ স্বীকার করে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিটিও শক্তভাবে গড়ে তোলেন। তারই ফল আজকের সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী ভারত।
পাকিস্তানে সেটা হতে পারেনি। দক্ষ ও মেধাসম্পন্ন উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর হিন্দুরা ভারতে চলে যান। তাঁদের জায়গা দখল করে অযোগ্য-অদক্ষ অল্প শিক্ষিত মুসলমান। গণতন্ত্র কী জিনিস তা তাঁরা জানতেন না। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাঙালির মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক চেতনার জন্ম হয়। ওই গণতান্ত্রিক চেতনার থেকেই বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু অগণতান্ত্রিক পাকিস্তানের পেট থেকেই যেহেতু বাংলাদেশের জন্ম, সেহেতু বাংলাদেশেরও কোনো গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য নেই। স্বৈরশাসনের প্রতিই বাংলাদেশের নেতাদের ঝোঁক। তাঁরা নির্বাচনকেই মনে করেন গণতন্ত্র। নির্বাচন তো গণতন্ত্রের দুটি পা মাত্র। পায়ে হাঁটতে গেলে দরকার গোটা শরীরটার—একেবারে মাথা পর্যন্ত। আমরা গণতন্ত্রের পা দুটি পেয়েছি, কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত নেই। তা না থাকা মানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের লেশমাত্র নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা যে পার্লামেন্ট পেয়েছি, তা একটি সুসজ্জিত সম্মেলনকক্ষ মাত্র। তাতে প্রাণ নেই, তার চেতনা নেই। আমাদের গণতন্ত্রের যদি চেতনা থাকত, পার্লামেন্টের প্রাণ থাকত, তাহলে দেশের মানুষের যে সমস্যা তা নিয়ে সেখানে কথা হতো। দেশের স্বার্থ নিয়ে কথা হতো। প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও সাংসদেরা বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের টাকায় বিদেশ সফর করেন। সেখানে গিয়ে দেশের মানুষের জন্য কী করেন তা সংসদে আলোচনা হয় না। তা যদি হতো তাহলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের প্রধানন্ত্রীর কী কথাবার্তা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কী চুক্তি ইত্যাদি হয়েছে, অন্যান্য দেশ ও বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের কী চুক্তি হয়েছে তা সংসদে উপস্থাপন করা হতো। তা নিয়ে আলোচনা হতো।
সরকারি দল থেকে বলা হচ্ছে, বিরোধী দল সংসদে যায় না, সংসদ প্রাণবন্ত হবে কী করে? বিরোধী দলের সব সদস্য যদি প্রতিদিন সংসদে যান, তাহলে তাঁদের সংখ্যা ৩৫-এর বেশি হবে না। কিন্তু আমরা দেখছি, সরকারি দলের অন্তত ১০৫ জন সদস্য প্রতিদিন অনুপস্থিত থাকেন। অর্থাৎ আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে সংসদে যোগদান গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেশের স্বার্থে কথা বলার সাহস যদি না থাকে, তাহলে সংসদে গিয়েই বা কী করবেন?
টিপাইমুখ নিয়ে বিরোধী দলের নেত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন। বেশ করেছেন। তবে আরও ভালো হতো পথেঘাটে তা নিয়ে পলিটিকস না করে সংসদে গিয়ে তাঁর দলের অবস্থান তুলে ধরলে। ক্ষমতাসীন জোটের আরেক বড় শরিক জাতীয় পার্টির নেতা সংসদে গিয়ে আলোচনা না করে বাইরে ঘোষণা দিয়েছেন, ভারত যদি টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ করে, তাহলে তিনি জীবন দেবেন—যেমন জীবন দিয়েছিলেন গণতন্ত্রের জন্য নূর হোসেন, ডা. মিলনসহ শত শত যুবক। জনগণ এখন আশা করতে পারে, এরশাদ সাহেবকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য হলেও বাঁধ নির্মাণ স্থগিত রাখবে ভারত। 
জনগণ বেআক্কেল নয়। তারা একটি জিনিস বুঝতে পেরেছে, শুধু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নয়, মহাজোটের অন্য শরিকেরাও এমন কোনো অদৃশ্য বন্ধনে আটকে গেছেন যে তাঁরা কোনো ব্যাপারেই ভারতের সঙ্গে আর মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারবেন না। কোনো কোনো বিরোধী দল, উগ্র মুসলিম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ভারতকে যেকোনো ব্যাপারে সমালোচনা করে আত্মতুষ্টি লাভ করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের যেকোনো কাজকে সমর্থন দেওয়ার মতো সংগঠন গত ১০ বছরে বহু সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। টিপাইমুখে বাঁধের কারণে ক্ষতি হলে তা হবে বাংলাদেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, বাঙালি, আদিবাসী সবার। শুধু মুসলমানদের নয়। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ভারতসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাপারে কোনো কথা বলে না। কিন্তু সেক্টর কমান্ডারদের নীরবতা বেদনাদায়ক। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যাঁদের অবদান চিরস্মরণীয়, আজ তাঁরা শুধু একটি এজেন্ডা নিয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়ান। সংগত কারণে বন্ধুর কোনো ভুলের সমালোচনা করলে বন্ধুত্ব নষ্ট হবে কেন? তা যদি হয় তাহলে সে বন্ু্লত্ব মূল্যহীন। 
জাঁ-পল সার্ত্রে, মার্টিন হাইডেগার প্রমুখ দার্শনিকের অস্তিত্ববাদী দর্শনের একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় ফিয়ার বা ভয়। আজ আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব যখন সংকটের মুখে, আমাদের ভবিষ্যৎ যখন অনিশ্চিত, তখন আমাদের অধিপতি শ্রেণীর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক গভীর ভয়। ডান-বাম রাজনৈতিক নেতা, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, লেখক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী প্রভৃতি শ্রেণীর মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে যে টিপাইমুখ, তিস্তার পানি নিয়ে কথা বললে তাঁরা ভারতের নেমন্তন্ন পাবেন না। করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ যাওয়া বন্ধ হয়েছে ৪০ বছর আগে। এখন কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই যাওয়া বন্ধ হলে সব দরজাই বন্ধ হলো। 
বন্ধুত্ব হয় বুকে বুক মিলিয়ে, হাত ধরাধরি করে—হাত কচলে নয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাপারে সমস্যা, মতানৈক্য, বিরোধ দেখা দিতেই পারে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে নদীর পানি বণ্টন নিয়ে প্রবল বিরোধ রয়েছে। সদিচ্ছা থাকলে বসে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। গোঁজামিল দিয়ে কিছুই হয় না। সমস্যা জিইয়ে রাখা হয় এবং বাড়ে। 
একটি বাঁধ নিয়ে, নদীর পানি বণ্টন নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে হাজার হাজার বছরের সম্পর্ক নষ্ট হবে কেন? বন্ধুকেই বন্ধু সমালোচনা করবে, শত্রুর করতে হয় ক্ষতি। যেকোনো কারণেই হোক, ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার সাবলীলভাবে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। তাদের সাহস জোগাতে পারেন শুধু নাগরিক সমাজের নেতারা এবং বাংলাদেশের জনগণ। টিপাইমুখ নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের আগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছে ভারত সরকার। আলোচনা দুরকম হয়। একটি তথ্য-উপাত্ত ও যুক্তি দিয়ে জোরের সঙ্গে, আরেকটি তোতলাতে-তোতলাতে। বিষয়টি রাজনৈতিক, সুতরাং রাজনৈতিক নেতারাই নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু প্রতিনিধিদলে দক্ষ কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের সাহসী মানুষ না থাকলে দিল্লিতে গিয়ে কনট প্লেসে কেনাকাটাই হবে, কাজের কাজ কিছু হবে না। ৪০ বছরে আমরা দক্ষ কর্মকর্তা তৈরি করতে পারিনি। দলীয় ক্যাডার দিয়ে ক্যাডারের কাজ হয়, জনগণ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা হয় না। 
নাগরিক সমাজের অবস্থাও আজ শোচনীয়। যথাসময় ঠিক দিকে সাইড নিতে না পারায় আজ দেশের এই বিপর্যয়কর অবস্থা। সরকারের দিক থেকে যত কথাই বলা হোক, দেশে কী হচ্ছে তা জনগণই ভালো জানে। ভবিষ্যতে কী কী হতে যাচ্ছে, তা জনগণ কিছুটা আঁচ করতে পারে। যে ছেলেটি ক্ষুধা নিয়ে সারা দিন কাগজ কুড়ায়, রাতে রাস্তায় ঘুমায় তার কাছে কিছু আশা করা অন্যায়। কিন্তু যারা রাষ্ট্রের যাবতীয় আনুকূল্য পেয়ে ধন্য তাদের দায়িত্ব রয়েছে। যাদের দ্বারাই দেশের ক্ষতি হবে, জনগণের ভবিষ্যৎ বিবর্ণ হবে, তাদের ক্ষমা নেই। সরকারকে অকল্যাণকর কাজ করা থেকে বিরত করতে না পারলে, জনগণের সাইড না নিলে, নাগরিক সমাজের নেতাদেরও দেশের মানুষ ক্ষমা করবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

একুশে ও বইমেলার একাল-সেকাল

আজ আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে প্রকৃত ঘটনা ও সত্য তথ্য মানুষকে আকর্ষণ করে না। সবাই যেন শুনতে চায় বানানো ও মনগড়া কথা। নিজের চোখে যা দেখেছি, নিজের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে, অভিজ্ঞতা থেকে যা জানি, তাতে অবিশ্বাস করতে বাধ্য করছে এই সমাজ। জীবনের চারদিকে যা ঘটছে, তা দেখে এক ধরনের বিবমিষা বা অভক্তির সৃষ্টি না হয়ে পারে না।
এখানে যে কারও যেকোনো কথাই কোনো রকম প্রশ্ন না করে বিশ্বাস করতে হবে। তথ্যপ্রমাণ দাখিল করার কোনো প্রয়োজন নেই। এমনকি কেউ যদি বলে যে বায়ান্নর ২২ ফেব্রুয়ারি আমি একটি কৃষ্ণচূড়ার গাছে উঠে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলাম—তৎক্ষণাৎ তা বিশ্বাস করবে সাড়ে সাত কোটি মানুষ। যাঁর সমর্থনে জনা ১৫ লোকও পাওয়া যাবে, যাঁদের একজন দাবি করবেন, গাছে উঠতে তলা থেকে তাঁর পেছনে আমিই সজোরে ধাক্কা দিয়েছিলাম। কেউ প্রশ্ন করবে না যে কৃষ্ণচূড়া গাছে আরোহণকারীর বয়স ছিল তখন আট এবং তাকে ঠেলা দিয়ে ওপরে তোলার লোকটির আড়াই। মহৎ কোনো কাজের কৃতিত্ব নেওয়া এবং তাকে পুঁজি করার প্রতিভা বাঙালির সীমাহীন।
এখানে সত্য ঘটনা নয় উপকথা, ঘটনার নায়ক নয় পার্শ্বচরিত্রই গুরুত্বপূর্ণ, সেনাপতির চেয়ে সেপাইয়ের দাপট বেশি। এখানে রাতারাতি ও পক্ষকালের মধ্যেই খ্যাতি ও প্রতিপত্তি রোজগার করা খুবই সহজ। কোনো ব্যাপারে যাঁর ভূমিকা ও কাজ নগণ্য, তিনি সেই ঘটনার নায়ক সেজে মঞ্চ আলোকিত করে বসেন। যাঁদের অবদান অসামান্য, তাঁরা অবহেলিত হয়ে ঘুরে বেড়ান এদিক-ওদিক। যা সত্য নয়, তাকেই সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণপণ চেষ্টা চলে। যা সত্য তাকে দেওয়া হয় মাটিচাপা।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা এবং বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে একুশের বইমেলা নিয়ে কয়েক বছর ধরে যা হচ্ছে, তা দেখেই ওপরের কথাগুলো মনে হয়েছে। সেকালে একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল একটি মহাশোকের দিন। এখন তা এক উৎসব। বইমেলা এখন আর গাম্ভীর্যপূর্ণ কোনো ঘটনা নয়, প্রাণের মেলা। গ্রামীণ মেলা বা গ্রন্থমেলার একটা সংজ্ঞা আছে, কিন্তু প্রাণের মেলার কোনো ডেফিনেশন নেই। প্রাণ যা চায়, তা-ই নির্বিচারে করে যাওয়াই প্রাণের মেলা। কেউ নাম দিয়েছেন মিলনমেলা। কার সঙ্গে কার মিলন, তা বলেন না।
ইউরোপে উৎপাদিত প্রতিটি দ্রব্য আমরা অতি আনন্দে এস্তেমাল করি। ইউরোপের আঠারো শতকের এনলাইটেনমেন্টের যুক্তি ও বুদ্ধির আলোকের ছিটেফোঁটাও আমাদের গায়ে লাগেনি। আমরা শিক্ষা ও দীক্ষা, দুটোই নিয়েছি আমাদের দেশের পীর-ফকিরদের কাছ থেকে। ফেব্রুয়ারিকে আমরা নাম দিয়েছি ভাষার মাস। দুই হাজার বছর পর দ্বিতীয় মাসের এই নতুন নামকরণের কোনো প্রয়োজন ছিল না।
ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫টি পত্রিকায় ৪২০টির মতো রচনা-প্রতিবেদন পাঠ করেছি। পাঠ করে ক্লান্তি বোধ করিনি, হতাশ হয়েছি। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো নতুন স্বপ্ন জাগেনি। স্মৃতিচারণামূলক নিবন্ধ পড়েছি বায়ান্নর ভাষাসেনাদের, যাঁদের সংখ্যা জনসংখ্যার মতোই ক্রমবর্ধমান। পড়েছি প্রকাশকদের ৭৫টির মতো সাক্ষাৎকার ও পরামর্শমূলক বক্তব্য। পাঠ করেছি খ্যাতিমানদের অমূল্য কালজয়ী রচনা। কোনো সন্দেহ নেই, আগামী বছরগুলোয় এ ধরনের স্মৃতিসম্ভারের ঝাঁপি আরও বেশি খোলা হবে এবং কনফুসীয় উপদেশের পরিমাণ বহুগুণ বাড়বে। কারণ, এ দেশে কোনো কিছু শুরু হলে আর থামে না, বাড়ে। যে কাগজ ওসব যত বেশি ছাপবে, সে কাগজ তত বেশি প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক ও ভাষাপ্রেমিক বলে প্রতিপন্ন হবে। 
একদিন যা ছিল শুধু একুশ, আজ তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বই ও বইমেলা। আগের একুশ আর আজকের একুশের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির এক-দেড় মাস পর আমি জীবনে প্রথম ঢাকায় আসি। সেই ঢাকাও আজ নেই, সেই একুশের মহিমাও নেই।
সেকালে আমরা আরিচা (তখন নাম শিবালয়) থেকে ঢাকা আসতাম স্টিমার বা লঞ্চে। সারা বছর নদী থাকত পানিতে টইটম্বুর। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যায় ছিল উত্তাল ঢেউ। বুড়িগঙ্গাও তখন বুড়ি হয়নি। প্রথম দিন ঢাকায় পদার্পণের কথা আমার মনে আছে। সন্ধেবেলা আমাদের স্টিমার যখন ফতুল্লার কাছে এল, তখন দেখতে পেলাম, আকাশের অধিকাংশ নক্ষত্র মাটিতে পড়ে গেছে। আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, অত আলো কিসের? তিনি বললেন, ওটাই তো ঢাকা। ফরাশগঞ্জ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত প্রজ্বলিত বৈদ্যুতিক বাতিগুলোকে দূর থেকে মনে হচ্ছিল একেকটি নক্ষত্র।
বাদামতলী ঘাটে নেমে উঠি রিকশায়। সেদিন রিকশাকেই মনে হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গাড়ি। উঠেছিলাম টিপু সুলতান রোডে, আমাদের এক আত্মীয়র বাড়িতে। আমার বাবার সেবার ঢাকায় আসার উদ্দেশ্য ছিল দুটো: আমার হাড়সর্বস্ব শরীরকে ডাক্তার দিয়ে দেখানো এবং একটি পুস্তিকা ছাপানো। পরদিন র্যাংকিন স্ট্রিটে ডাক্তার এম এন নন্দীর চেম্বারে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আমার নাড়ি দেখেন, হাড়-ওঠা বুকে-পিঠে স্টেথিসকোপ বসিয়ে হূৎপিণ্ডের শব্দ শোনেন, পেট টেপেন, জিভ দেখেন, তারপর মল ও রক্ত পরীক্ষার নির্দেশ দেন। দুটোই আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। মল বোতলজাত করা চরম বিরক্তিকর, রক্তের জন্য সুঁই ফোটানো ভীতিকর।
যে কয়দিন ঢাকায় ছিলাম, যেখানেই গেছি বড়দের আলোচনার বিষয় ছিল একটিই: রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ও একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের কথা। সব মানুষের চোখে-মুখে এক গভীর বেদনা ও বিমর্ষতা। একটি ঘটনা সারা দেশের সব মানুষের চেতনায় কতটা অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে, তা উপলব্ধি করার বয়স আমার ছিল না, কিন্তু মানুষের শোকের মুখচ্ছবি আমার ঠিকই মনে আছে।
শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ ছিলেন আমাদেরই এলাকার মানুষ। তাঁকে নিয়ে পল্লিকবিরা তৎক্ষণাৎ গান বেঁধেছিলেন। হাটবাজারে সে গান গীত হতো। আমার বাবাও তাঁর উদ্দেশে কয়েকটি শোকগাথা লিখেছিলেন। সেগুলো এবং নজরুলের ‘বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও’, গোবিন্দচন্দ্র দাসের ‘স্বদেশ স্বদেশ কর্চ্ছ কারে এ দেশ তোমার নয়’ ও মুকুন্দ দাশের দু-একটি গান নিয়ে তিনি একটি পুস্তিকা ছাপান। ১৫-২০ পৃষ্ঠার মতো পুস্তিকা। পাতলা খান লেনের একটি প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। কীভাবে একটি একটি করে টাইপ সাজিয়ে ট্রেডল মেশিনে কাগজ ছাপা হয়ে বাঁধাই হয়ে বই হয়, তা তখনই দেখি। আশির দশকে আমার বাবা যখন মারা যান, তখনো ভাষাসৈনিক অভিধাটি আবিষ্কার ও চালু হয়নি। তাঁর মৃত্যুসংবাদে ওই খেতাবটি যোগ করার মওকা পাওয়া যায়নি।
পরের বছর তিনি জিন্দাবাহার গলির ভেতর এক বাঁধাইখানা থেকে একটি বই সংগ্রহ করেন। বইটি অন্যান্য বইয়ের সঙ্গে আলমারিতে সাজিয়ে না রেখে শক্ত কাগজ দিয়ে জড়িয়ে একেবারে ঘরের সিলিংয়ে অপ্রয়োজনীয় বইপত্রের মধ্যে রেখে দেন। পঞ্চাশের শেষ দিকে সে বইয়ের রহস্য আমি উদ্ঘাটন করি এবং শিহরিত হই। আশির দশকে বাংলা একাডেমী যখন মোহাম্মদ সুলতান প্রকাশিত ও হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারীর ফ্যাক্সিমিলি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়, তখন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও তার একটি কপি কারও কাছে পাওয়া যায়নি। আমার কাছ থেকে নিয়েই ফটোকপি করা হয়। মূল বইটি আমার কাছে আছে।
স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল এক মহিমান্বিত ও সত্যি সত্যি শোকের দিবস। পঞ্চাশের দশকের কয়েকটি এবং ষাটের দশকের সব একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি ঢাকায় ছিলাম। কেমন ছিল সেসব একুশে ফেব্রুয়ারি পালন? তখন মানুষের মধ্যে চক্ষুলজ্জা ও জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডের ওপর কালো কাপড় সেঁটে দেওয়া হতো। কেউ কেউ দোকানের নাম বাংলায় কাপড়ে লিখে ঝোলাতেন। এ কাজটি অবাঙালিরাও করতেন।
মধ্যরাতের আয়োজন ও উন্মত্ততা সেকালে ছিল না। তবে অন্ধকার থাকতেই সাধারণ মানুষ বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়। হাজার হাজার মানুষ। সবার পা খালি। সম্ভব হলে একটি ফুল, না হলে খালি হাতেই প্রভাতফেরির মানুষজন অতি সুশৃঙ্খলভাবে দুটো লাইন করে আজিমপুর কবরস্থানে যেত শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে। অগণিত মানুষ, কিন্তু একটু শব্দ নেই। চোখ বন্ধ করে রাখলে মনে হতো এই শহরে কোনো মানুষজন নেই। কবরে ফুল দিয়ে আবার লাইন ধরে মানুষ যেত শহীদ মিনারে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। সেখানেও থাকত না কোনো হট্টগোল। একুশে ফেব্রুয়ারিতে কোনো মানুষের পায়ে জুতা-স্যান্ডেল দেখা যেত না। খুব সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলারাও স্যান্ডেল জোড়া কাগজে মুড়ে খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশ নিতেন।
জাতীয়তাবাদী শিল্পীরা শোকসংগীত ও দেশপ্রেমের গান পরিবেশন করতেন। একসময় শুরু হয় পল্টন ময়দানে গণসংগীত ও দেশাত্মবোধক গানের অনুষ্ঠান। প্রায় প্রতিটি শহীদ দিবসে আবদুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমানসহ সেকালের সংগীতশিল্পীরা গান গাইতেন। বাংলা একাডেমীর বটমূলে হতো কবিতা পাঠের আয়োজন। অতি সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল ছিল সেই অনুষ্ঠান। প্রধান কবি শামসুর রাহমান থেকে আমাদের মতো তরুণেরাও তাতে অংশ নিতেন। কবিতা পাঠের আসরে শ্রোতা হিসেবে প্রায় অবধারিতভাবে দেখা যেত ডা. এম এন নন্দী, ধীরেন দত্ত, অজিত গুহদের। ষাটের দশকের মহিলা কবি মেহেরুন্নেসা ছিলেন আমার চেয়ে বয়সে কিছু বড়। তাঁকে ভালো লাগত। তাঁর কবিতাও। তাঁর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রমনার অল্প ফুলওয়ালা কৃষ্ণচূড়ার গাছটিকেও মনে হতো ফুলে ফুলে ভরে গেছে।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন মানেই একুশের সংকলন প্রকাশ। দু-চার টাকা চাঁদা তুলে বা দোকান-প্রতিষ্ঠান থেকে সামান্য বিজ্ঞাপন নিয়ে সেই সংকলন প্রকাশের যে আনন্দ, তা এখনকার ভাগ্যবান তরুণদের বোঝানো যাবে না। সেই সংকলন প্রকাশে প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীরা জড়িত থাকতেন। প্রতিটি সংকলন থেকে বিচ্ছুরিত হতো বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা। চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন:
‘...প্রতি একুশেতে শত শত সংকলন প্রকাশিত হতো লেখা ও আঁকা নিয়ে সারা বাংলাদেশ থেকে। শহীদ মিনারের পাদদেশে, সামনের ফুটপাতে [চাটাই] বিছিয়ে সেই সংকলনগুলো বিক্রি হতো। ...এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমরা জড়িয়ে পড়েছিলাম সমসাময়িক সবাই। নান্দনিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রচ্ছদ, ভেতরের সজ্জা, হরফ নির্বাচন—সবই করে দিতাম একটি সুন্দর সংকলনের জন্য। এই সংকলনগুলো শহীদ মিনারের পাদদেশে বিক্রি হতো। আমার ধারণা, এটাই ছিল একুশের বইমেলার প্রথম বীজ রোপণ।’
[প্রথম আলো, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১১]
এটা শুধু কাইয়ুম চৌধুরীর ধারণা নয়, এটাই বাস্তবতা ও সত্য। তবে এর সঙ্গে আমি আরেকটু যোগ করতে চাই। শুধু একুশের সংকলন নয়, ১৯৬৭-৬৮ থেকে শহীদ মিনারের সামনের রাস্তায় বইও বিক্রি হতো। স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের মালিক রুহুল আমিন নিজামী সোভিয়েত ইউনিয়নের বইপত্রের আমদানিকারক ছিলেন। তখন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বাংলাদেশে তুঙ্গে। সোভিয়েত বইয়ের ছাপা-বাঁধাই ছিল উন্নত, দাম কম, তবু অনেক বই-ই অবিক্রীত থাকত। তা ছাড়া নিজামী সাহেবেরই ঝিনুক প্রকাশনী থেকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের রচনাবলি প্রকাশ করা হয়। সেসব বইয়ের সস্তা সংস্করণও অল্প সময়ে শেষ হতো না। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমদানি করা ও নিজার সাহেবের প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের বই বিক্রির জন্য একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারের সামনের ফুটপাতে দোকান খোলা হতো। ’৬৯-৭০-এ স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স ও ঝিনুক প্রকাশনার সঙ্গে আরও দু-একটি প্রতিষ্ঠান যোগ দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমদানি করা শিশুদের বই ভালোই বিক্রি হতো। ’৭২ থেকে বাংলা একাডেমীর সামনে ঝিনুক, মুক্তধারা প্রভৃতি প্রকাশনা সংস্থাও বই বিক্রি শুরু করে।
মুক্তধারার প্রধান নির্বাহী জহরলাল সাহার ভাষায়, ‘১৯৭২ সালে মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহাই প্রথম একাডেমী চত্বরে সবুজ ঘাসের মধ্যে চট বিছিয়ে বই বিক্রির সূচনা করেন।’ তাঁর ওই লেখায় কিছু ভুল ও কিছু তথ্যবিকৃতি ঘটেছে। তিনি বলেছেন, চিত্তবাবু ‘সৃজনশীল সাহিত্যের অগ্রপথিক’। প্রকৃতপক্ষে তিনি তা নন, তিনি নোটবই প্রকাশের অগ্রপথিক। তিনি ছিলেন আমাদের অগ্রজের মতো ঘনিষ্ঠ, আমার কয়েকটি বইয়েরও প্রকাশক, কিন্তু কোনো দিন এমন দাবি করতেন না।
পূর্ব বাংলায় সৃজনশীল প্রকাশনাশিল্পের সূচনা রবীন্দ্রনাথের জন্মেরও এক বছর আগে: ১৮৬০ সালে। সূচনা করেন কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও হরিশ্চন্দ্র মিত্র। সেটা বাদ দিলেও চল্লিশের দশকেই ঢাকায় গড়ে ওঠে আধুনিক প্রকাশনা ও মুদ্রণশিল্প। ’৪৭-এর পর ঢাকার দুজন আধুনিক প্রকাশক হলেন প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরির অনিল চন্দ্র ঘোষ ও নওরোজ কিতাবিস্তানের মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। অনিল বাবুর বাড়ি ছিল মানিকগঞ্জে। তিনি ছিলেন আমার বাবার বাল্যবন্ধু। চিত্তদা বলতেন, অনিল বাবু আমার গুরু। তিনি ছিলেন স্বাধীনতাসংগ্রামী ও গান্ধীজির অনুসারী। বহুবার জেল খেটেছেন। নিজেও লেখক ছিলেন। রবীন্দ্র শতবর্ষে পূর্ব বাংলা থেকে প্রকাশিত কবির সম্পর্কে প্রথম বই রবীন্দ্রনাথ-এর তিনিই লেখক।
পঞ্চাশের দশকের সাহিত্যের বইয়ের প্রকাশকদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ আমার হয়েছিল। আজ যে আমি বাংলা ভাষার একজন ক্ষুদ্র লেখক হতে পেরেছি, তাতে তাঁদের প্রভাব রয়েছে। তাঁদের প্রকাশিত বই শৈশব-কৈশোরে পড়েছি। সেসব পাঠ করে গল্প-উপন্যাস-কবিতা-প্রবন্ধ লেখার আকাঙ্ক্ষা জেগেছে। পঞ্চাশের দশকেই ঢাকায় প্রাণবন্ত প্রকাশনাশিল্প গড়ে ওঠে। ষাটের দশকে তা বিকশিত হয়।
বাবুপুরা ব্রিজের নিচে একটি উঁচু জায়গায় ছিল মখদুমী অ্যান্ড আহসানুল্লাহ লাইব্রেরি। শাহাদৎ হোসেনের রূপচ্ছন্দা ওখান থেকেই কিনি। আরও বহু সাহিত্যের বই সেখান থেকে প্রকাশিত হয়। ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী, বাংলাবাজার, প্যারীদাস রোড ছিল বইপাড়া। ইসলামপুরের কথা প্রকাশ থেকে কিনেছিলাম আহসান হাবীবের রানীখালের সাঁকো। কোহিনূর লাইব্রেরি ছিল বহু মূল্যবান সাহিত্য বইয়ের প্রকাশক। পাটুয়াটুলীর পাকিস্তান বুক করপোরেশনও তা-ই। নয়াপল্টনে কাজী আফসার উদ্দিন আহমদের ছিল মৃত্তিকা সাহিত্য সদন। শওকত ওসমান, সৈয়দ আলী আহসানদের বই প্রকাশ করেছেন তিনি। শান্তিনগরে মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের হাসি প্রকাশনী, পাটুয়াটুলীতে বোরহানউদ্দিন আহমদের ইস্ট বেঙ্গল বুক সিন্ডিকেট, ইসলামপুরের ইসলামিয়া লাইব্রেরি, ওসমানিয়া বুক ডিপো, আদিল ব্রাদার্স, সোবহানিয়া লাইব্রেরি, লিয়াকত পাবলিশিং হাউস, রশীত পাবলিশিং হাউস, বাংলাবাজারে স্টুডেন্ট ওয়েজ, মাওলা ব্রাদার্স, প্যারাডাইজ লাইব্রেরি, জিন্না (বঙ্গবন্ধু) এভিনিউয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রভৃতি ছিল বড় প্রকাশনী। মর্যাদাসম্পন্ন প্রকাশনীর মধ্যে ছিল আহমদ পাবলিশিং হাউস, পপুলার পাবলিকেশনস, প্রভিন্সিয়াল বুক ডিপো প্রভৃতি।
ইত্তেফাক-এর কাছে শ্রাবণী, ইন্দিরা রোডে কপোতাক্ষী, পাটুয়াটুলীতে লিবার্টি, কাঠের পুল লেনে কথাবিতান, বর্ণমিছিল, নিউমার্কেটে নলেজ হোম, বুক ভিলা প্রভৃতি আধুনিক বইয়ের প্রকাশক। শুধু ঢাকায় নয়, চট্টগ্রামের বইঘর ছিল আধুনিক কবিতা ও কথাসাহিত্যের প্রকাশক। তা ছাড়া কুমিল্লা, বরিশাল, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহেও কিছু সৃজনশীল প্রকাশনী ছিল। আজ যে বাংলাদেশে প্রাণবন্ত প্রকাশনাশিল্প গড়ে উঠেছে, তার পূর্বসূরিদের ভুলে গেলে চলবে না। তাঁরা সংখ্যাকে গুরুত্ব দেননি, মানকে মূল্য দিয়েছেন।
ভাষা আন্দোলন, একুশে, বইমেলা নিয়ে স্বার্থান্বেষী মানুষ নানা রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। বস্তুনিষ্ঠতা থেকে যদি আমরা বিচ্যুত হই, তা জাতির কোনো কল্যাণ করবে না—সর্বনাশই ডেকে আনবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সহজিয়া কড়চা সৈয়দ আবুল মকসুদ আওয়ামী লীগের অগ্নিপরীক্ষা—বিএনপির বিষপরীক্ষা

অনেক মানুষকেই জীবনে কখনো অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। কেউ উতরায়, কেউ হয় অকৃতকার্য। এ তো গেল জীবনের অগ্নিপরীক্ষা। আসল অগ্নিপরীক্ষা কাকে বলে তা অনেকেই জানে না।
বৈদিক যুগে ভারতবর্ষে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হতো যে সে নিরপরাধ। এবং তা প্রমাণ করতে গিয়ে তাকে নানা রকম নৈতিক পরীক্ষার সামনে দাঁড়াতে হতো। সেই নৈতিক পরীক্ষার একটি অগ্নিপরীক্ষা, আরেকটি বিষপরীক্ষা। অগ্নিপরীক্ষায় অভিযুক্তকে আগুনের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে হতো অথবা আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে বলা হতো। যদি তার হাত-পা ও লোম পর্যন্ত না পুড়ত, তা হলে ধরে নেওয়া হতো লোকটি নির্দোষ। আর যদি তার শরীর ঝলসে যেত তা হলে সমাজপতি ও সাধারণ মানুষ রায় দিত: লোকটা দোষী। বিকল্প অগ্নিপরীক্ষাও ছিল। তা হলো: অভিযুক্তের হাতের তালুতে হাঁপরে পোড়া লাল টক টকে এক খণ্ড লোহা রাখা হতো। যদি তার হাত না পুড়ত, তা হলে সে নিরপরাধ। তবে তিন হাজার বছর পরে আমাদের এ কালের মানুষের অভিজ্ঞতা বলে যে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পাপ মানুষটিও যদি আগুনের কুণ্ডলীতে গিয়ে দাঁড়ায় তার শরীর পুড়তে বাধ্য। এবং লাল টকটকে লোহার টুকরো হাতের তালুতে নিলে ওই হাত চিরকালের জন্য অকেজো হয়ে যাবে।
বিষপরীক্ষাটিও ছিল বিপজ্জনক। অভিযুক্তকে এক বাটি বিষ চায়ের মতো ঢক্ ঢক্ করে পান করতে বলা হতো। খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উগলে দেওয়াও চলবে না। ওই বিষ পানের পরেও যদি লোকটি বেঁচে থাকত, তা হলে সে নিরপরাধ। তবে এ ক্ষেত্রেও আমরা বলব, বিষ পানের পরে রোবট বাঁচতে পারে, কোনো পূত-পবিত্র চরিত্রের মানুষও বাঁচবে না। দোষী ও নির্দোষ বাছবিচারের শক্তি বিষের নেই।
সে যা-ই হোক, গত ২৯ ডিসেম্বরের পর থেকে আমার মনে হচ্ছে: আওয়ামী লীগের অগ্নিপরীক্ষা শুরু হলো এবং বিএনপি পড়েছে বিষপরীক্ষায়। এই দুই দলের অগ্নিপরীক্ষা ও বিষপরীক্ষা যে শুধু তাদেরই বাঁচা-মরার প্রশ্ন তাই নয়, বাংলাদেশের মানুষেরও আধা-বাঁচা ও আধা-মরার প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডে ঝলসে যেতে পারে জনগণের শরীর আর বিএনপির বিচার-বিবেচনাবর্জিত কাজের বিষক্রিয়ায় মানুষ না মরলেও অসুস্থ হয়ে পড়তে বাধ্য।
কোনো দল যখন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়, তখন তার অগ্নিপরীক্ষার শুরু। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের বিজয় যেমন একটি মহা আনন্দের বার্তা বয়ে এনেছে তাদের জন্য, তেমনি তারা না জানলেও আমরা মনে করি, তাদের অগ্নিপরীক্ষায় ফেলে দিয়েছে। সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো প্রচেষ্টা পৌনে সাত মাসে আমাদের চোখে ধরা পড়েনি, কোনো কোনো প্রেমময় কলাম লেখক নিজেদের উরুতে থাপ্পর মেরে সরকারকে বাহবা দিয়ে বলতে পারেন: চমত্কার। কিন্তু খুঁতখুঁতে জনগণের চোখকে ফাঁকি দেওয়া কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। জনগণের দুটি চোখ দুটি রাডার, ওতে ধরা পড়ে সব।
সরকারের প্রথম অগ্নিপরীক্ষাটি ছিল সত্যি সত্যি অগ্নিপরীক্ষা—আসলেই আগ্নেয়াস্ত্রের পরীক্ষা। সেটি হলো পিলখানার পাশবিকতা, যার নামকরণ হয়েছে বিডিআর বিদ্রোহ। আমরা ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, তীতুমীরের বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ প্রভৃতি দেখেছি। তার সঙ্গে আমাদের ইতিহাসের বইতে যোগ হলো আরেকটি বিদ্রোহ: পিলখানা বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহের কথা বাংলার বালক-বালিকারা এক শ বছর পরে পাঠ করবে। মারাঠা বিদ্রোহ দমন করতে মুঘল শাসকদের যে বেগ পেতে হয়েছে, পিলখানার বিদ্রোহীদের দমন করতে সরকারকে তার চেয়ে ঢের বেশি মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়েছে।
এ ছিল এক অনন্য বিদ্রোহ। নজরুলের চেয়ে বড় বড় বীরের সেখানে আবির্ভাব ঘটে। তারা সেদিন ফরাসি বিপ্লবের চেয়ে বড় বিপ্লবই প্রায় ঘটিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশে। সেই বিদ্রোহী ও বিপ্লবীরা দল বেঁধে সরকারপ্রধান ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে চা-নাশতা খেলেন ও সহাস্যে গল্পগুজব করলেন। ওদিকে পিলখানায় সেনা অফিসাররা হলেন বর্বরোচিতভাবে নিহত। যে ডজনখানেকের বেশি বিডিআর কর্মকর্তা বা বিদ্রোহী প্রধানমন্ত্রীর অফিসের কর্মকর্তাদের দ্বারা পেলেন অভ্যর্থনা, তাদের সেখানে চা-স্যান্ডউইচ শুধু নয়, আরও ভালো মধ্যাহ্নভোজ দিয়ে আটকে রেখে তাদের দিয়েই পিলখানার ভেতরে যোগাযোগ ঘটালে জানা যেত কারা অপরাধী আর কারা নিরপরাধ। তৌহিদ ও তাঁর সহযোগীরা পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান বিদ্রোহী, তাদের তখন ওখানে আটক করে ফেললে এখন আর আসামিদের টর্চলাইট নিয়ে দেশের আনাচে-কানাচে খুঁজে বেড়াতে হতো না। যাই হোক, পিলখানার অগ্নিপরীক্ষায় সরকার উতরে গেছে বটে, কিন্তু সরকারের হাত-পা পুড়েছে ভালোমতোই এবং দেশেরও শরীরে স্যাঁকা লেগেছে ভালোই। 
পিলখানা বিদ্রোহের কোন আইনে বিচার হবে—শুধু এই কথাটি সাড়ে চার মাসে অন্তত ৯০ বার ৪৫ ভাবে বলা হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় যদি একজন বলেন, সেনা আইনে বিচার হবে; সোমবার সকালে আরেক কর্তা বলেন, প্রচলিত ফৌজদারি আইনে বিচার করা হবে; মঙ্গলবার মধ্যাহ্নে এক মন্ত্রী বলেন, বিডিআর আইনে বিচার হবে। এসব কী? আর বিডিআরের মহাপরিচালক যে কত রকম কথা বলেছেন তার শেষ নেই। তিনি বুঝলেন না এবং আমাদের মিডিয়াও বুঝল না যে বিচার করার বিষয়টি তাঁর এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। ওটার জন্য রাষ্ট্রের অন্য এজেন্সি রয়েছে। প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আদালত রয়েছে। এ রাষ্ট্রে আজ যার যা খুশি তাই করে ও বলে যায়—কেউ প্রশ্ন তোলে না—চ্যালেঞ্জ করা তো দূরের কথা। এই ঘটনাটি বড় লাট মাউন্টব্যাটেনের সময় ঘটলে এ নিয়ে বাগিবতণ্ডা হতো না, যা হতো তা হলো, বিচার করে হয় অভিযুক্তদের খালাস দিত, না হয় মোম দিয়ে মাজা দড়িতে লটকে দিত।
বাংলাদেশের মতো মাথা গরম মানুষের দেশে কোনো সরকারের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এক শক্ত অগ্নিপরীক্ষা। কোনো রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের বাইরে যদি একটি মাত্র মন্ত্রণালয় রাখতে হয় তাহলে সেটি হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। উপ-প্রধানমন্ত্রীরাই সাধারণত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। যেমন ভারতে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল। পাকিস্তানেও তেমনই ছিল। তথ্য মন্ত্রণালয়, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিপিং মন্ত্রণালয় বা পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় না থাকলে বড় সমস্যা হয় না, কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় না থাকলে রাষ্ট্র চলে না। আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন দুই-দুইজন মন্ত্রী। জুনিয়র মন্ত্রী বললেন, অপরাধীদের ধরার জন্য প্রয়োজনে আকাশের যত উপরে এবং সমুদ্রের যত নিচে সম্ভব তাঁরা যাবেন। কিন্তু আকাশ ও সমুদ্রে না গিয়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি গেছেন আমেরিকায়। সিনিয়র মন্ত্রী অসুস্থ হয়ে গেছেন সিঙ্গাপুর। পৃথিবীতে কেউই অপরিহার্য নয়। জীবন চলে। সুতরাং দেশও চলে। সরকার চেপে গেলেও প্রতিমন্ত্রী বিদেশ থেকে ঘোষণা দিয়েছেন: ‘আমি মন্ত্রিসভায় নেই’।
যেদিন আশুলিয়া হা-মীম গ্রুপের পোশাকশিল্প কারখানা দুর্বৃত্তরা ভস্মীভূত করে সেদিন আমি সেই নারকীয়তা দেখতে যাই। যাওয়ার পথে দেখলাম মোহাম্মদপুরে ট্রমা সেন্টার ক্লিনিকের সামনে ও আশপাশে অসংখ্য পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন। গাড়ি থেকে নেমে আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কী হয়েছে এবং তারা কী করছেন। বললেন, হোম মিনিস্টার আছেন ক্লিনিকে। তাঁরা ডিউটি করছেন। বৃষ্টির মধ্যে আশুলিয়া গিয়ে পোশাক কারখানার ছাইভস্ম দেখলাম, কিন্তু কোনো পুলিশ দেখিনি। কুড়িটির মতো কারখানায় আমি গেছি। ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে। কিন্তু কোনো পুলিশ নেই। চৌরাস্তায় একজন পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কী? এত উত্তেজনা। মালিকেরা ভীত-সন্ত্রস্ত। পুলিশ কোথায়? তিনি বললেন, সাদা পোশাকে আমাদের লোক আছে।
কর্তব্যে অবহেলা ইলেকট্রিকের মিস্ত্রি করলেও দোষ, মন্ত্রী করলেও দোষ। অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না। কাজ করতে করতেই অভিজ্ঞতা হয়। যোগ্যতার বিকল্প নেই, কিন্তু আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করারও মূল্য রয়েছে। একটি মাঝারি আকারের শিল্প চালানোর চেয়ে একটি মন্ত্রণালয় চালানো কঠিন নয়। দরকার আগ্রহ ও বিষয় সম্পর্কে ধারণা। মন্ত্রিত্বে থাকার সময় পারিবারিক কাজকর্মে একটু কম ব্যস্ত থাকলেই ভালো। গত সাড়ে ছয় মাস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কীভাবে চলেছে তা বিধাতা জানেন আর জানে অপরাধীরা। অন্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থাও তথৈবচ।
বাংলাদেশ রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. আকবর আলী খান দুই দিন আগে বলেছেন, প্রতি ছয় মাস অন্তর মন্ত্রীদের কাজের মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। আমি দ্বিমত পোষণ করি। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা ছাত্র নন যে ছয় মাসের সেমিস্টার পদ্ধতিতে কাজ করবেন এবং ছয় মাস পর প্রধানমন্ত্রীর কাছে পরীক্ষা দিয়ে তাদের পাস করতে হবে। একজন মন্ত্রীর যোগ্যতা পরীক্ষার জন্য একটি ঘটনাই যথেষ্ট। বহু গণতান্ত্রিক দেশে মাত্র একটি ঘটনার কারণে কোনো মন্ত্রী বরখাস্ত হন বা তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ছয় মাসের সেমিস্টারের জন্য বসে থাকলে প্রশাসনের বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব নয়। মন্ত্রীদের সস্নেহ প্রীতিবশত কম্পার্টমেন্টালে পাস করাতে গেলে সরকার অগ্নিপরীক্ষায় ফেল করবে।
আধুনিক কালে কোনো জাতির রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের অর্থ সব বিষয়ে তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নয়। দু-চারটি কম জনসংখ্যাবিশিষ্ট ছোট দেশ ছাড়া কোনো রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। শুধু নিত্যব্যবহার্য পণ্য আমদানির জন্য নয়, আরও বহু ব্যাপারে একটি রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। তবে চীনের মতো বিশাল দেশ যা পারে কোনো মাঝারি দেশের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। বিপ্লবের পরে চীন আমেরিকাসহ পুঁজিবাদী দেশগুলোর সঙ্গে দূরত্ব রক্ষা করে। প্রথম কয়েক বছর শুধু বন্ধুত্ব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। এক পর্যায়ে সে সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যায়।
দুই সুপার পাওয়ারের তীব্র মতপার্থক্য এবং ভারত ও চীনের বৈরিতার পটভূমিতে ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের অভ্যুদয়। অর্থাত্ এর জন্মের ইতিহাস অন্য রকম। জন্মলগ্নে এর মিত্রদের মধ্যে ছিল বিলুপ্ত ও বিভক্ত হয়ে যাওয়া সোভিয়েত বলয়ের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রথমে মেনে নেয়নি। আমেরিকা মেনে নেয় এখানে তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের স্বার্থে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এক বিশেষ ধরনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। কোনো দল স্বীকার করুক বা না করুক, ভারতের আধিপত্য এখানে থাকবেই—একভাবে হোক বা অন্যভাবে হোক। পাকিস্তান এখন ওপরে ওপরে ভাই ভাই যতই বলুক, ভেতরে ভেতরে শত্রুতা করবেই। সুতরাং বৈদেশিক সম্পর্ক বাংলাদেশের যেকোনো সরকারের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা।
মুজিব-জিয়া-এরশাদ সরকার যতটুকু বৈদেশিক প্রভাব এড়িয়ে চলতে পারত, খালেদা-হাসিনার গণতান্ত্রিক সরকার তা পারছে না। বিশ্বপটভূমি পাল্টে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপ খুব বেশি। তারা বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন সহযোগী’; প্রভাব খাটাতেই পারে। ভারতের চাপ অন্য রকম। পাকিস্তানের দাঁত-নখ না থাকলেও বাংলাদেশকে ইসলামি মৌলবাদী দেশ বানাতে তার অবিরাম চেষ্টা চলছেই। সবকিছুর ওপরে আছে ‘উন্নয়ন সহযোগী’ নয়া ঔপনিবেশিকদের লগ্নি সংস্থা আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার আন্তর্জাতিক আমলারা। এদের অসঙ্গত প্রভাব কাটিয়ে চলার জন্য যে মেধার প্রয়োজন তা বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী-রাজনীতিক ও আমলাদের নেই। যেসব একাডেমিক, অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও কূটনীতিক এবং অর্থনীতিবিদ থিংক ট্যাংকের কাজ করেন তাঁরা বিদেশিদের স্বার্থ রক্ষায়ই বেশি আগ্রহী।
প্রশাসনের অবস্থা জগাখিচুড়ি। ন্যূনতম দক্ষতা নেই। সরকারের নিরপেক্ষতায় আস্থা নেই কোনো কর্মকর্তার। অযোগ্য প্রিয়জনকে দেওয়া হচ্ছে উচ্চাসন ও গুরুদায়িত্ব। কম্পাউন্ডার যত বিশ্বাসীই হোক তাকে দিয়ে দক্ষ সার্জনের কাজ চলে না। প্রশাসনের দুর্নীতিতে ‘উন্নয়ন সহযোগী’রা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। সরকারি দলের ছাত্র-যুব সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের দাপট হালাকু খাঁর সৈন্যদের হার মানায়। প্রকাশ্যে রাস্তার ইট পর্যন্ত লুট হচ্ছে। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন ভাঙচুর হচ্ছে যেন বর্তমান কাঠামো ভেঙে ফেলে ওখানে নতুন বহুতল ভবন বানাবে। অর্থনীতির অবস্থা অক্সিজেন লাগানো রোগীর মতো—নাক থেকে নল খুলে গেলে কী হয় কে জানে। সরকারের জন্য এ সবই অগ্নিপরীক্ষা। এর থেকে উদ্ধারের উপায় হলো উঁচু চিন্তা শক্তিসম্পন্ন ও সত্ মানুষের সমন্বয়ে গঠিত কোনো পরিষদের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
শক্ত বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। বিরোধী দলবিহীন যে গণতন্ত্র তা হয় একদলীয় শাসন, না হয় সামন্তবাদী রাজতন্ত্র বা অন্য কোনো ‘তন্ত্র’। বাংলাদেশের সংসদেও বিরোধী দল আছে। সেই বিরোধী দলের জনসমর্থনও প্রচুর। কিন্তু তারা জানে না তাদের কী কর্তব্য। বর্তমানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের জন্য যা অগ্নিপরীক্ষা, বেগম জিয়ার বিএনপির জন্য তা বিষপরীক্ষা। বিষপরীক্ষার পরে বেঁচে থাকার ওপর নির্ভর করছে বিএনপির ভবিষ্যত্।
গত পৌনে সাত মাসে বিএনপির একটি তত্পরতাই আমাদের চোখে পড়েছে, তা হলো প্রায় প্রতিদিনই দলের ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের জিয়ার কবরে গিয়ে ফাতেহা পাঠ। ১৪৪ বছরে রিপাবলিকান দলের নেতা-কর্মীরা যতবার আব্রাহাম লিংকনের কবরে গিয়েছেন, গত ছয় মাসে বিএনপির নেতা-কর্মীরা তার চেয়ে অনেক বেশিবার পার হয়েছেন ক্রিসেন্ট লেকের সাঁকো। এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে নেতা-কর্মীদের পদভারে ওই সাঁকো টেকে কিনা সন্দেহ।
দীর্ঘ বাজেট অধিবেশনটি গেল, বিএনপি ও তার মিত্র জামায়াত সেখানে অনুপস্থিত। কী এক অদম্য অভিমান যা রাজনীতিতে তাদের বৈরাগ্যসাধনে প্ররোচিত করেছে। বিএনপির অবস্থা এখন বাউল সাধকদের মতো। কোনো টেন্ডারজাতীয় অর্থকড়ির ব্যাপারে অংশগ্রহণ করতে না পেরে তারা রাজনীতির প্রতিই বীতশ্রদ্ধ শুধু নয়, বীতস্পৃহ হয়ে পড়েছেন। তাঁরা বেছে নিয়েছেন অজ্ঞাতবাস— শুধু টিভি চ্যানেলের নাছোড় সংবাদদাতাদের সামনে বসা ছাড়া। তবে তাঁরা সাংসদ হিসেবে যাবতীয় সরকারি সুযোগ বেতন-ভাতা ঠিকই নিচ্ছেন। তাঁদের রাজনৈতিক নিস্পৃহতা দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে এখনো জরুরি অবস্থা রয়ে গেছে। তাঁদের এই নিষ্ক্রিয়তা শেখ হাসিনার জন্য আনন্দদায়ক হলেও দেশের জন্য বিপজ্জনক।
সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ সবাই কামনা করে। কিন্তু একজন জাতীয় নেতার কর্তব্য আত্মপ্রেম ও পুত্রপ্রেমের ওপর দেশপ্রেমকে স্থান দেওয়া; পুত্রদের স্বার্থ ও ভবিষ্যতের চেয়ে দেশের ও জনগণের ভবিষ্যত্ ও স্বার্থ অগ্রাধিকার পাওয়া। গত নির্বাচনে বিফল মনোরথ বিএনপি নেতারা এখন যা করছেন তাতে দেশেরই যে শুধু ক্ষতি হচ্ছে তাই নয়, তাঁদের নেতাদের ও দলের ভবিষ্যতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ২৯ ডিসেম্বর তাঁদের জন্য ছিল বিষপরীক্ষা। সেই বিষক্রিয়া কাটানোর জন্য কোনো কোশেশ না করে তাঁরা যেন সরকারকে বলছে: প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে আরও আরও আরও দাও বিষ। বিএনপির প্রতিপক্ষরা দেশি ও বিদেশি বিষের নানা রকম শিশি হাতে দাঁড়িয়েই আছে। একটির পর একটি নিয়ে শুধু গিললেই হলো।
গণতন্ত্রের স্বার্থে আমরা চাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অগ্নিপরীক্ষায় ও বিষপরীক্ষায় উতরে যাক। ইতিহাসে একজন রাজনৈতিক নেতার স্থান নির্ধারিত হবে তিনি জনগণের জন্য কী করেছেন তার ওপর, তিনি কতদিন ক্ষমতায় ছিলেন বা রইলেন তার ওপর নয়। নেলসন ম্যান্ডেলা ক্ষমতায় ছিলেন অল্প কিছুদিন। ক্ষমতার বাইরেই বহুদিন। সেদিন তাঁর ৯১তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো। জোহানেসবার্গ থেকে নিউইর্য়ক পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করে উত্সবমুখর প্রার্থনা হয়েছে। শেখ হাসিনার কল্যাণে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে করমর্দনের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমার হাতে তিনি যে জোরে চাপ দিলেন তাতে তাঁঁর কব্জির জোরের চেয়ে বুকের উষ্ণতার জোরই বেশি পেলাম। জনগণ তাদের প্রিয় নেতাদের হূদয়ের উষ্ণতার উত্তাপ শুধু চায়—আর কিছু নয়। আমরা আশা করব, নেতারা ক্ষমতায় থাকুন আর ক্ষমতার বাইরেই থাকুন, জনগণকে আর বেশি হতাশ করবেন না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১২

জনসভা ওরফে মহাসমাবেশের উপকথা

১২ মার্চের মহাসমাবেশের দিন রাজপথে মিছিল ও পুলিশ ১২ মার্চের মহাসমাবেশের দিন রাজপথে মিছিল ও পুলিশ
হোসেন শাহি বাংলায় জনসভা হতো না, মহাসমাবেশ তো নয়ই। তবে ধর্মসভাগুলোতে বহু মানুষের সমাগম হতো বলে ধারণা করি। আলিবর্দীর শাসনামলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় মহাসমাবেশের রেওয়াজ ছিল বলে কোনো বইয়ে পাইনি। হোসেন শাহি রাজত্বে ও নবাবি আমলের বাংলায় গণতন্ত্র ছিল না। গণতান্ত্রিক রাজনীতির যেদিন থেকে সূচনা, সেদিন থেকে জনসভা ওরফে মহাসমাবেশেরও জন্ম। কুড়ি শতক পর্যন্ত যা ছিল জনসভা ও সমাবেশ, একুশ শতকে এসে তা প্রমোশন পেয়ে হয় জনসমুদ্র ও মহাসমাবেশ।
আঠারো শতকে মজনু শাহরা, ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়কেরা, হতদরিদ্র কৃষক-তাঁতিদের নিয়ে জনসমাবেশ করেছেন। তাঁদের যে ব্রিটিশ শাসক ও জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, সে কথা তাঁদের ডেকে বুঝিয়েছেন। মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর দরিদ্র কৃষক প্রজাদের নিয়ে সমাবেশ করে থাকবেন। হাজি শরীয়তুল্লাহ খাজনা বন্ধের আগে মুসলমান প্রজাদের নিয়ে সমাবেশ অবশ্যই করেছেন। তবে তিতুমীর ও শরীয়তুল্লাহর সমাবেশের জন্য খুব বড় মঞ্চ, লাখ লাখ চাররঙা পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন অথবা অগণিত মাইকের প্রয়োজন হয়নি।
কংগ্রেসের প্রথম আঠারো বছর জনসভার কোনো বালাই ছিল না। বছরে একবার বার্ষিক অধিবেশন বা সম্মেলন করতেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সারা দেশ থেকে সেজেগুজে আসতেন। সম্মেলন সাধারণত ঘরের মধ্যেই হতো। কখনো বাইরে প্যান্ডেল করে নেতারা ইংরেজিতে বক্তৃতা করতেন। প্রধান দাবি সরকারি চাকরি-বাকরিতে উচ্চশিক্ষিত হিন্দুদের কোটাটা বাড়ানো। নেতাদের কাছে জনগণের সমস্যার কোনো মূল্য ছিল না।
শতাব্দীর শুরুতে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠনের ঘোষণা আসতেই কংগ্রেসের নেতাদের তন্দ্রার ভাবটা কেটে যায়। গা ঝাড়া দেন। সরকারি চাকরি তো দূরের কথা, এবার পূর্ব বাংলার জমিদারিটাও বুঝি হাতছাড়া হয়ে যায়। রাতারাতি নেতারা রাস্তায় নামেন। শুধু নেতাভিত্তিক আন্দোলনে সুবিধা হবে না, সরকারের টনক নড়বে না। হিন্দু প্রজাদেরও সঙ্গে না রাখলে কাজ হবে না। শুরু হলো জনসভার আনুষ্ঠানিক জয়যাত্রা। দেশব্যাপী সভা-সমাবেশ। তবে মহাসমাবেশ নয়। শুধু জনসভার জয়যাত্রা নয়, শুরু হলো নেতা-পূজাও। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি হেঁটে বা ঘোড়ার গাড়িতে নয়, কর্মীদের কাঁধে চড়ে সভাস্থলে যাওয়াটাই পছন্দ করতেন। দ্বিতীয় দশকে গান্ধী রাজনীতিতে প্রবেশ করে মানুষের কাঁধে চড়ার প্রথা বাতিল করলেন। নেতাকে কাঁধে বহনের রেওয়াজ এখনো থাকলে মারাত্মক সমস্যা হতো। কারণ, নেতৃত্ব আর একচেটিয়া পুরুষের হাতে নেই।
মাইক-পূর্ব জনসভায়ও হাজার হাজার মানুষ হতো কুড়ি শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত। কোনো কোনো নেতার কণ্ঠস্বর ছিল বাঘের মতো। বস্তুত, যাঁর গলায় যত জোর, তিনি তত বড় নেতা। তবে খালি গলায় বক্তৃতা যত জ্বালাময়ীই হোক, তা সব শ্রোতার কান পর্যন্ত পৌঁছাত না। তাহলে উপায়? সামনের দিকে যেসব শ্রোতা নেতার কথা শুনেছেন, তাঁরা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের শ্রোতাদের তা বলে দিতেন। এভাবে একেবারে পেছন পর্যন্ত বক্তব্য পৌঁছে যেত।
জনসভা গণতান্ত্রিক রাজনীতির অপরিহার্য অংশ। জনসভা নেই তো তাদের রাজনীতিও নেই। একদিক থেকে ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে বিপ্লবীরা ভালো। জনসভার নাম-গন্ধ তাঁদের অভিধানে নেই। তাঁদের অতি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং তাঁরা করেন ঘরের মধ্যে নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তায়। অথবা কোনো গহিন অরণ্যে, যার পাঁচ মাইলের মধ্যে কোনো মানুষের ছায়াটিও নেই। গোয়েন্দাদের বাবারও সাধ্য নেই যে তাঁদের সভার বিষয়বস্তু নোট করেন। নেতা এক বাক্য বলে চোখ নিমীলিত করেন। তারপর তিন মিনিট নীরবতা। পরবর্তী বাক্যের অর্ধেক বলে মার্ক্স ও মাওয়ের ছবির দিকে তাকান। যেন সেখান থেকে কোনো নির্দেশ আসবে। কিন্তু ছবি কোনো কথা বলে না। এক দিন এক রাত দুই-তিনটি ‘তত্ত্ব’ নিয়ে আলোচনা হয়। শেষটায় একপক্ষ বলে, সোজা সশস্ত্র বিপ্লব। আরেক পক্ষ থিসিস দেয়—বিপ্লবের স্তর আসে নাই। গেল পার্টি ভেঙে। বিপ্লবের রূপরেখা হয়ে গেল। জনগণ কিছুই জানল না।
বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদের নিয়ে সে সমস্যা নেই। দেশের লোককে ডেকে মনের কথা, দলের পরিকল্পনার কথা গলায় যত জোর আছে তা দিয়ে, দুই হাত প্রসারিত করে, জনতাকে জানিয়ে দেন। নেতা করেন দুই হাত প্রসারিত আর জনতা দুই হাত কাছাকাছি এনে মারে সজোরে করতালি। এভাবে নেতা ও জনতায় মিলে দেশ উদ্ধার। মহাসমাবেশ থেকে ঘরে ফিরে আসার আগে মানুষ বুঝতেই পারে না, নিজেদের জন্য ভালো কিছুর ব্যবস্থা করে এল, না কপালে পেরেক ঠুকে দিয়ে এল।
প্রাচীন ঐতিহাসিক নগর ঢাকাতেই বহু ঐতিহাসিক জনসভা হয়েছে গত ১১০ বছরে। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তায় হয়ে গেল সর্বশেষ দুই ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ। ব্রিটিশ যুগে খুব বড় জনসভা হতো করোনেশন পার্কে, বুড়িগঙ্গার তীরে। সদরঘাটের সেই পার্ক এখন উধাও হয়ে গেছে। এখন সেখানে মার্কেট প্রভৃতি। গান্ধীজিও করোনেশনে বক্তৃতা করেছেন। মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলীরাও করেছেন, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বসুও করেছেন। সেকালে কিছু জনসভা হতো ভিক্টোরিয়া পার্ক বা বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বড় জনসভাটি হয় রেসকোর্স ময়দানে, এখন যা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ওই জনসভায়ই পাকিস্তানের ললাটে পেরেক ঠুকে দিয়ে যান। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যও নির্ধারিত হয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে বড় বড় জনসভা হতো আরমানিটোলা মাঠে, গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠে এবং পল্টন ময়দানে। জীবনে প্রথম সবচেয়ে বড় যে জনসভাটিতে আমি উপস্থিত ছিলাম, সেটি ১৯৫৬-তে। ঢাকা স্টেডিয়ামের সেই সভায় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই ভাষণ দেন। মঞ্চে ছিলেন আর দুজন নায়ক—প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
জনসভা করা কোনো ছেলেখেলা নয়। জনসভার আয়োজন করা একধরনের আর্টও বটে। নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করতে যে নৈপুণ্যের দরকার, জনসভা আয়োজন করা তার চেয়ে কম দক্ষতায় সম্ভব নয়। নেতা জনসভার স্থান, তারিখ ও সময় ঘোষণা করেই খালাস। পরের দায়িত্ব অন্য মাঝারি নেতা ও কর্মীদের। দক্ষতার সঙ্গে জনসভার ব্যবস্থা করতে করতেই অনেক পেশিবহুল কর্মী নেতা হয়ে ওঠেন।
প্রথম হলো জনসভার প্রচারের ব্যবস্থা করা। সে জন্য মাইকসহ ঘোষণাকারী ভাড়া করা হয়। জনসভার সপ্তাহ খানেক আগে থেকে পাড়া-মহল্লার মানুষের দুপুরের ঘুম হারাম। বিকট জোরে মাইকে ঘোষিত হতো: ভাই সব, আগামী ২০ মার্চ রোজ মঙ্গলবার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে বি-রা-ট জনসভা। প্রধান অতিথি হিসেবে ওই সভায় গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিবেন বাংলার গণমানুষের নেতা, অমুক আন্দোলনের মহান রূপকার, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের নয়নের মণি, জনগণের অধিকার আদায়ে আপসহীন কণ্ঠ ইত্যাদি ইত্যাদি...জাতীয় নাজাত পার্টির চেয়ারম্যান হিম্মত আলী তালুকদার। বক্তাদের বিশেষণ প্রভৃতি বলা যদি শুরু হতো পুরানা পল্টন থেকে, তাদের নামটি ঘোষিত হতো ফকিরাপুল বাজারে গিয়ে।
বাংলার মাটিতে সবশেষ দুটি মহাসমাবেশে যোগ না দিয়ে ঘরে বসেই উপভোগ করেছি সাত দিন ধরে। গত সপ্তাহের কথা। জীবনের বৃহত্তম জনসভাটিতে যোগ দিই আজ থেকে ৪১ বছর ১৩ দিন আগে। লাখ লাখ মানুষ রেসকোর্স ও তার আশপাশের রাস্তায়। কাউকেই গলায় গামছা দিয়ে বাড়ি থেকে টেনে আনা হয়নি। সেকালে বড় বাসও ছিল না। তাই বাস ভাড়া করার উপায় ছিল না লোক আনতে। চাররঙা পোস্টার ছিল না। ব্যানার-ফেস্টুন ছিল খুবই সামান্য। নানা কথা লেখা গেঞ্জি গায়ে দেওয়া শ্রোতাও ছিল না।
১৫ বছর যাবৎ যত জনসভা/মহাসমাবেশ হচ্ছে, তার প্রতিটি ‘স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভা’। নেতাদের বক্তৃতার ভাষাও অনবদ্য। সংগত কারণে প্রতিপক্ষকে সমালোচনা করা দোষের নয়। খিস্তিখেউড় কত প্রকার, তা জনসভায় গেলে শোনা যায়। অংশবিশেষ শোনা যায় টিভির পর্দায়। একালে নেতারা ভাষণ দেন জেম্স জয়েস, ভার্জিনিয়া উল্ফ বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর চেতনাপ্রবাহ রীতিতে। কী বলছেন তাঁরাও জানেন না, শ্রোতারাও বোঝে না। কেন তাঁরা অমন ভাষা ব্যবহার করেন, তা মনোবিশ্লেষকেরা ভালো বলতে পারবেন।
বাংলার মাটিতে গত ১২ মার্চের মহাসমাবেশটি ছিল মানবেতিহাসের এক অভূতপূর্ণ সমাবেশ। মহাসমাবেশে কী ঘটবে তা রাষ্ট্রের মহাব্যবস্থাপকেরা অলৌকিকভাবে মাস দেড়েক আগেই জেনে যান। আমাদের সরকারি দলগুলোর নেতারা, পুলিশ-গোয়েন্দারা ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তা সবই জানেন। যা ঘটে যায়, সে সম্পর্কে তাঁরা নীরব। তারস্বরে বলা হতে লাগল, ওই দিন অঘটন ঘটবে, নাশকতা হবে। তাই মানুষের ‘জানমাল’ বাঁচাতে মহাসমাবেশের দুই-তিন দিন আগেই বন্ধ রইল ঢাকামুখী কিছু ট্রেন। কারণ, ট্রেন চললে নাশকতাপন্থীরা উড়িয়ে দিতে পারে। বন্ধ রাখা হলো বাসসহ সড়ক পরিবহন। বাস চললে তা পুড়িয়ে দিতে পারে। সদরঘাটের ত্রিসীমানায় আসতে পারল না লঞ্চ-স্টিমার। ‘ওরা’ ডুবিয়ে দিতে পারে। যাঁরা কোনো রকমে দক্ষিণ বাংলা থেকে এসেছিলেন, তাঁরা আটকে রইলেন বুড়িগঙ্গার পচা পানিতে। যাঁরা নৌকায় নামার চেষ্টা করলেন, তাঁদের অনেকের পিঠে পড়ল লাঠির বাড়ি। পুলিশকে সহযোগিতার জন্য ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে ও নদীর মধ্যে ছিলেন সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক।
মহাজোট সরকার রবিঠাকুরের অতি ভক্ত। তাই সরকার ও গোয়েন্দারা জনগণের উদ্দেশে বললেন: ‘ওগো আজ তোরা যাসেন ঘরের বাহিরে।’ মানুষের যাতায়াতের সব পথ বন্ধ রইল। কিন্তু তার পরও দেখা গেল মহাসমাবেশের দিন নয়াপল্টনে ‘তিল ঠাঁই আর নাই রে’।
প্রজাতন্ত্রের ম্যানেজাররা বুঝতে চেষ্টা করলেন না, রাজধানীতে মানুষ সুষ্ঠু জনসভায় যোগ দিতে আসে না। এখানে জীবিকাপ্রত্যাশী চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসেন, ব্যবসার জন্য আসেন, চিকিৎসার জন্য আসেন, মরণাপন্ন রোগীকে দেখতে আসেন, প্রেমপিরিত করতেও আসেন। তাঁদের যাতায়াতে বাধা দেওয়া মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সমাবেশকে টিভি চ্যানেলে প্রচার করতে বাধা দেওয়া মতপ্রকাশের অধিকারে হস্তক্ষেপ শুধু নয়, সংবিধানের ৩৬, ৩৭ এবং ৩৯ অনুচ্ছেদকে অস্বীকার করা।
১৪ মার্চের সমাবেশটি ছিল ১২ তারিখের সমাবেশের জবাব। ঢাকায় আসার সব দরজা খুলে দেওয়া হলো। শুধু ঢাকার অল্প মানুষে কুলাবে না বলে শত শত বাসে বাইরে থেকে আনা হলো লোক। সরকারি অফিসগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেওয়া হলো সভা-সমাবেশে যোগ দেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা। সম্ভব হলে সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের রোগীদেরও অ্যাম্বুলেন্স ও স্ট্রেচারে করে আনা হতো বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে।
জনসভাকে মনে হয় রাজনৈতিক বিষয়। আমাদের দেশে এখন তা অর্থনীতির বিষয়ও। জনসভা রাখছে মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে সচল। মহাসমাবেশ নিয়েও একদিন গবেষণা হবে। বাংলা বিভাগ করবে ‘বাংলা কবিতায় জনসভা প্রসঙ্গ’ অথবা ‘জনসভা বাঙালি নেতাদের ভাষা প্রয়োগ: একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’। ইতিহাস বিভাগ বসে থাকবে না। তারা করবে ‘বাঙালির অধঃপতনের জনসভার ভূমিকা’। অর্থনীতি বিভাগকে করতে হবে বহু গবেষণা। মাইক ভাড়ায় কত টাকা আয়-ব্যয়। মঞ্চ বানাতে বাঁশ, তক্তা, কাপড়, পেরেক, গজাল, দড়ি প্রভৃতি কেনাকাটা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, পরিবহন সেক্টরে মহাসভার প্রভাব। ক্লিনিকের মালিকদের কথাও আসবে। তাঁদের এক-একটি সমাবেশের আগে-পরে কেমন আয় হয়। রুম ভাড়া, ডাক্তারের ফি, ব্যান্ডেজ, কটন, ওষুধ প্রভৃতিতে টাকার লেনদেন অর্থনীতিতে অবদান রাখে।
ছাপাখানার আয় তো সীমাহীন। চাররঙা পোস্টার বিদেশি কাগজে ছাপা। পোস্টার সাঁটাতে শত শত শ্রমিক নিয়োগ। এ কালের জনসভায় বাঁশের ভূমিকাই বেশি। মঞ্চ বানানো থেকে স্বেচ্ছাসেবকদের সদ্ব্যবহারের জন্য উজাড় হয় বাঁশঝাড়। তবে প্রধান বিষয় হলো মহাসমাবেশ উপলক্ষে চাঁদা সংগ্রহ। সমাবেশ করতে যদি ব্যয় ধরা হয় ৩০ লাখ, চাঁদা ওঠে পাঁচ কোটি।
মহাসমাবেশ নিয়ে উপাখ্যান লেখা যায়, কড়ি দিয়ে কিনলাম-এর মতো উপন্যাস লেখা যায়, গবেষণা করা যায়; কিন্তু এ কথাও কবুল করতে হবে, অর্থপূর্ণ একটি জনসভাই একটি জাতির ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে। সে দৃষ্টান্ত বাঙালির ইতিহাসে আছে। অন্যদিকে অর্থহীন মহাসমাবেশ জনগণের জীবনে নিয়ে আসে মহা দুর্দশা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।