বাঙালি
নেতারা কোনোকালেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন না। তা তাঁরা করতে পারেন
না কখনো তাঁদের কপালের দোষে, বেশির ভাগ সময় স্বভাবদোষে। রাষ্ট্রের মতো একটা
প্রকাণ্ড জিনিস পরিচালনার দায়িত্ব বঙ্গোপসাগরের এই বদ্বীপ গঠিত হওয়ার পর
থেকে বাঙালির ভাগ্যে জোটেনি। বাঙালি মুসলমানের ইউনিয়ন বোর্ড, কখনো জেলা
বোর্ডে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। ১৯৩৭ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক পরাধীন
বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে একটি প্রদেশ পরিচালনার সুযোগ পান। জাতির ইতিহাসে
প্রথম নির্বাচিত পার্লামেন্টারি সরকার। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ছিলেন
না। তাঁর সরকার ছিল মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার। রাজ্যের সবচেয়ে বড়
দল কংগ্রেস তাঁকে পদে পদে বিড়ম্বনায় ফেলতে চেয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের
ঐতিহ্য গড়ার যে সুযোগটি বাঙালি পেয়েছিল, তা কাজে লাগানো গেল না।
দ্বিতীয়বার সুযোগটি এসেছিল ১৯৪৭ সালে। এ সুযোগটি আরেকটু ভালো। ওই সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যায়। সেটা কপালের দোষ, স্বভাবেরও দোষ।
তিন হাজার বছরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সুযোগটি আসে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। মাথার ওপরে আর কেউ রইল না। ব্রিটিশও না, পাঞ্জাবিও না। নিজেদের ভাগ্য নিজেদের গড়ার সুযোগ পাওয়া গেল। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে, কোটি কোটি মানুষের কপাল দুই-একজন লোক ভাঙতে পারে, কিন্তু গড়তে গেলে অনেক লোকের দরকার। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি শত্রু ও তাদের সহযোগীদের পরাজিত করলাম, কিন্তু ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে শোচনীয়ভাবে হলাম ব্যর্থ। গেল সুবর্ণ সুযোগ হারিয়ে।
বহু বছর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এবং রক্ত ঝরিয়ে ১৯৯১ সালে সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আরেকটি সুযোগ পেলেন। সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়েরই নেতাদের জনগণের আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। জনগণের কাছে দেওয়া তাঁদের অঙ্গীকারও ছিল। কিন্তু তাঁরা তা অবলীলায় ভুলে গেলেন। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগটি নষ্ট হয়ে গেল। জনগণ যা চায়নি, পেল তা-ই—নির্বাচিত সরকারি দলের গণতন্ত্র, বহুদলীয় গণতন্ত্র নয়।
গণতন্ত্রের সঙ্গে নির্বাচন অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বহু পুরোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিশন নেই। সরকারি প্রশাসনই নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দায়িত্ব পালন করে। ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন কোনো নির্বাচন কমিশন করেনি, জেলা প্রশাসকরা করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচন পরিচালনা করেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুস সাত্তার।
সত্তরের নির্বাচনের সময় কেন্দ্রে ও প্রদেশে ছিল সামরিক সরকার। সামরিক বাহিনী ছিল নিরপেক্ষ। নির্বাচন কমিশন ছিল নিরপেক্ষ ও স্বাধীন। সামরিক বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ না থাকলে নির্বাচনের ফলাফল এদিক-ওদিক হতে পারত। প্রশাসক হিসেবে বিচারপতি সাত্তার ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ ও দক্ষ। ব্রিটিশ আমল থেকে কাজ করেছেন শেরেবাংলার সঙ্গে। তিনি ছিলেন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও নির্দ্বিধায় বলা যায়, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে যত সরকারপ্রধান ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিচারপতি সাত্তারের প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হলো এখানে কারও কোনো অবদান স্বীকার না করা। দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সত্তরের নির্বাচন পরিচালনা করার স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুই তাঁকে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে তিনি ছিলেন পাকিস্তানে। ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতি সাত্তারকে বাংলাদেশ জীবন বীমা করপোরেশনের পরিচালকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান এবং তার কিছুদিন পরে বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের বেতন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। অবশ্য পরে তিনি জিয়াউর রহমানের রজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁর কাছ থেকেই জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন ২৪ মার্চ ১৯৮২, ভোররাতে।
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধানে বলা হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত বহাল আছে: ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যে রূপ নির্দেশ করিবেন, সেই রূপসংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন। একাধিক নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া নির্বাচন কমিশন গঠিত হইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাহার সভাপতিরূপে কার্য করিবেন।’
গত ৪০ বছরে নির্বাচন কমিশন-সংক্রান্ত কোনো আইনের বিধান প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি বাংলাদেশের কোনো সরকার। আমাদের সংবিধান বলে দেয়নি, কত জন কমিশনার থাকবেন ‘নির্বাচন কমিশনে’। একজন তো প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে থাকবেনই, নির্বাচন কমিশনার একাধিক থাকতে পারেন। নির্দিষ্ট করে সংখ্যা না বলায় এবং যথাযথ আইন না থাকায়, জোট সরকার তাদের খুশিমতো প্রায় আধাডজনের কাছাকাছি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আজিজ সাহেব থেকে শুরু করে কোনো কমিশনার সাহেবের অভিধানেই ‘নিরপেক্ষতা’ শব্দটি ছিল না। কোনো সরকার যদি রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করে, তা কিছুমাত্র অসাংবিধানিক হবে না।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন উদ্দিনদের সময় গঠিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে হালচাল, দলীয়পনার যে ভয়াবহ অবস্থা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট সাহস, নিরপেক্ষতা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। দুই বিবদমান শিবিরের, বিশেষ করে বিএনপির বিষাক্ত তির মাঝেমধ্যেই ড. এ টি এম শামসুল হুদা, ছহুল হোসাইন ও সাখাওয়াত হোসেনের গায়ে লেগেছে। তাঁরা আহত হলেও অবিচলভাবে তাঁদের কাজ করে গেছেন। এতটা ঐক্যবদ্ধ ও পরস্পরের প্রতি সদ্ভাবপূর্ণ টিম পাওয়া আমাদের সমাজে কঠিনই বটে। তাঁদের অধীন সহকর্মীরাও খুবই একতাবদ্ধ ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন।
গত পাঁচ বছরে তাঁরা অনেক বড় কাজ করেছেন। ভুয়া ভোটারসংবলিত আগের আবর্জনা ফেলে দিয়ে তাঁরা একটি ভালো ভোটার তালিকা তৈরি করেছেন। সিভিল সোসাইটি থেকে আমরা তেমনটিই চেয়েছিলাম। সংসদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এবং অন্যান্য স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে তিন নির্বাচন কমিশনার ও তাঁদের সহকর্মীরা প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। তাঁদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ তাঁদের কথা অনেক দিন মনে রাখবে। তাঁরা বিভিন্ন সময় বিতর্কিত বিষয়ে আমাদের নাগরিক সমাজের লোকদের পরামর্শ চেয়েছেন। আমার মতো অভাজনকেও বহুবার ডেকেছেন। কোনো প্রশ্নে হয়তো শক্তভাবে দ্বিমত করেছি। কিন্তু তাঁরা মনোক্ষুণ্ন হননি। ভালো পরামর্শ হলে হাসিমুখে গ্রহণ করেছেন। আমি তাঁদের অগ্রিম বিদায়ী ধন্যবাদ জানাই।
দীর্ঘকালের জড়তা ও অবসাদের ফলে আমাদের সমাজে অভিনন্দনমূলক কাজ খুব কমই হয়ে থাকে এবং হিংসা-প্রতিহিংসায় পরিপূর্ণ সমাজে কারও কোনো গঠনমূলক কাজ প্রশংসা পায় না। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগের প্রশ্নে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করেছেন। তাঁকে দিয়ে সংলাপের উদ্যোগটি সরকার নেওয়ালেও রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত আন্তরিকতা ও ভূমিকাকেও খাটো করে দেখার উপায় নেই। এই সংলাপ একটি অত্যন্ত ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি। সেটা তাঁর সাংবিধানিক অবস্থান। তাঁর ব্যক্তিসত্তা বলেও একটি জিনিস রয়েছে। জনাব জিল্লুর রহমান একজন বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ছাত্রজীবনে তাঁর রাজনীতিতে হাতে খড়ি। ভাষা-আন্দোলন থেকে উদ্দীপনায় অনাচার পর্যন্ত অব্যাহতভাবে তিনি রাজনীতিতে আছেন। তিনি একজন অতিসজ্জন ও সরল মানুষ। তাঁকে আমি চিনি ষাটের দশকের শুরু থেকে, বিশেষ করে আইভি আপার সূত্রে। তাঁর শ্বশুর অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমদ ছিলেন আমাদের শিক্ষক। ষাটের দশক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপসহীন ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের একজন। প্রবাসী সরকারের প্রচার-প্রকাশনা প্রভৃতিতে অসামান্য ভূমিকা রাখেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী। স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, যখন বঙ্গবন্ধু সভাপতি। বাকশালের অন্যতম সম্পাদক। এলাকায় জনপ্রিয় নেতা হিসেবে বারবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন এবং তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই নিপীড়িত হয়েছেন। ২০০৭-০৮ সালের স্বৈরাচারী জরুরি অবস্থার সময় শুধু শেখ হাসিনার পক্ষে নয়, সাংবিধানিক রাজনীতির পক্ষে তাঁর অনমনীয় অবস্থানের কথা আমি তখন বহু আলোচনা সমাবেশে বলেছি। তাঁর সাংবিধানিক পদের বাইরে তিনি আমাদের একজন মুরব্বিস্থানীয় ব্যক্তি।
রাষ্ট্রপতি সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর পর আমি ভয় পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, বিএনপি বুঝি বিগড়ে বসে। নানা রকম বর্জনমূলক ব্যাপারে তারা অভ্যস্ত। ‘আমরা যাব না’ বা ‘রাষ্ট্রপতির সংলাপ বয়কট করলাম’ বলে বসলে কারও করার কিছু ছিল না। তাতে লাভ-লোকসান কিছু নয়, রাষ্ট্রপতিকে অসম্মান করা হতো। কিন্তু তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধি দেখা দেয়। স্বয়ং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপে যোগ দেয়।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানির মতো কালো ও দূষিত হয়ে গেছে কত আগে, তা বলা কঠিন। সংসদ থেকে শুরু করে গোটা রাজনীতির অঙ্গন অসুন্দর দৃশ্যে পরিপূর্ণ। দেরিতে নয়, যথাসময়ের ১৫ মিনিট আগেই বেগম জিয়া বঙ্গভবনে পৌঁছেন। রাষ্ট্রপতি তাঁকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান। তাঁরা সৌজন্য ও আন্তরিকতার সঙ্গে পরস্পরের হাত ধরে কুশল বিনিময় করেন। গত ২৫ বছরে এটি ছিল আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর রাজনৈতিক দৃশ্য।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে গিয়ে বিএনপি নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়ার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। বেগম জিয়ার আহ্বানে রাষ্ট্রপতি তাঁর সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা জানান। তবে তাঁদের এই দাবির বিষয়টি সরকারকে অবহিত করবেন বলে বিএনপির প্রতিনিধিদলকে আশ্বস্ত করেন। বিএনপির দাবির সমালোচনা করে চলেছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও মন্ত্রী। বিজ্ঞ নেতাদের ওই সমালোচনার অর্থ আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের কাছে স্পষ্ট নয়। এই মুহূর্তে এই প্রশ্নে তাঁরা নীরব থাকলেও পারতেন। তাঁদের মতামত তো তাঁরা রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেনই—প্রকাশ্যে ও গোপনে। বর্তমান বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তিন তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়ার বিষয় নয়।
তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন শুধু বিএনপির দাবি নয়, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া আর প্রায় সব দলের দাবি। ১৯৮৮ সালের মতো একটি নির্বাচনের স্বপ্ন জেনারেল এরশাদ দেখতে পারেন। শ-খানেক আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও তাঁর গোপন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ শুধু নয়, দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বিদেশি বন্ধুদের কথাবার্তা থেকে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
কোনো প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট অনেকের বুদ্ধি-পরামর্শ নিলে বহু সমস্যার সমাধান বেরিয়ে যায়। রাষ্ট্রপতির সংলাপের ইতিবাচক দিক হলো, নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ব্যাপারে বর্তমানে যে কোনো আইন নেই, সে বিষয়টিও উঠে এসেছে কোনো কোনো নেতার কথায়। এখন দায়িত্ব চলে গেছে সংসদের কাঁধে। আপাতত নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে। তাঁরা দশ কার্যদিবসের মধ্যে তাঁদের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবেন। তবে সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, তা বলা যাবে না।
বিবদমান পক্ষগুলোর মতপার্থক্য কমিয়ে আনতেই হবে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে ও গণতন্ত্রের স্বার্থে। রাষ্ট্রপতি যদি তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নেও সংলাপের আহ্বান করেন, তাকেও জনগণ স্বাগত জানাবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
দ্বিতীয়বার সুযোগটি এসেছিল ১৯৪৭ সালে। এ সুযোগটি আরেকটু ভালো। ওই সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যায়। সেটা কপালের দোষ, স্বভাবেরও দোষ।
তিন হাজার বছরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সুযোগটি আসে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। মাথার ওপরে আর কেউ রইল না। ব্রিটিশও না, পাঞ্জাবিও না। নিজেদের ভাগ্য নিজেদের গড়ার সুযোগ পাওয়া গেল। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে, কোটি কোটি মানুষের কপাল দুই-একজন লোক ভাঙতে পারে, কিন্তু গড়তে গেলে অনেক লোকের দরকার। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানি শত্রু ও তাদের সহযোগীদের পরাজিত করলাম, কিন্তু ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে শোচনীয়ভাবে হলাম ব্যর্থ। গেল সুবর্ণ সুযোগ হারিয়ে।
বহু বছর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এবং রক্ত ঝরিয়ে ১৯৯১ সালে সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আরেকটি সুযোগ পেলেন। সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয়েরই নেতাদের জনগণের আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। জনগণের কাছে দেওয়া তাঁদের অঙ্গীকারও ছিল। কিন্তু তাঁরা তা অবলীলায় ভুলে গেলেন। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগটি নষ্ট হয়ে গেল। জনগণ যা চায়নি, পেল তা-ই—নির্বাচিত সরকারি দলের গণতন্ত্র, বহুদলীয় গণতন্ত্র নয়।
গণতন্ত্রের সঙ্গে নির্বাচন অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বহু পুরোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন কমিশন নেই। সরকারি প্রশাসনই নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দায়িত্ব পালন করে। ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন কোনো নির্বাচন কমিশন করেনি, জেলা প্রশাসকরা করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচন পরিচালনা করেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুস সাত্তার।
সত্তরের নির্বাচনের সময় কেন্দ্রে ও প্রদেশে ছিল সামরিক সরকার। সামরিক বাহিনী ছিল নিরপেক্ষ। নির্বাচন কমিশন ছিল নিরপেক্ষ ও স্বাধীন। সামরিক বাহিনী ও নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ না থাকলে নির্বাচনের ফলাফল এদিক-ওদিক হতে পারত। প্রশাসক হিসেবে বিচারপতি সাত্তার ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ ও দক্ষ। ব্রিটিশ আমল থেকে কাজ করেছেন শেরেবাংলার সঙ্গে। তিনি ছিলেন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও নির্দ্বিধায় বলা যায়, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে যত সরকারপ্রধান ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিচারপতি সাত্তারের প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হলো এখানে কারও কোনো অবদান স্বীকার না করা। দক্ষতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে সত্তরের নির্বাচন পরিচালনা করার স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুই তাঁকে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে তিনি ছিলেন পাকিস্তানে। ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতি সাত্তারকে বাংলাদেশ জীবন বীমা করপোরেশনের পরিচালকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান এবং তার কিছুদিন পরে বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের বেতন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। অবশ্য পরে তিনি জিয়াউর রহমানের রজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁর কাছ থেকেই জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন ২৪ মার্চ ১৯৮২, ভোররাতে।
নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধানে বলা হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত বহাল আছে: ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যে রূপ নির্দেশ করিবেন, সেই রূপসংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন। একাধিক নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া নির্বাচন কমিশন গঠিত হইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাহার সভাপতিরূপে কার্য করিবেন।’
গত ৪০ বছরে নির্বাচন কমিশন-সংক্রান্ত কোনো আইনের বিধান প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি বাংলাদেশের কোনো সরকার। আমাদের সংবিধান বলে দেয়নি, কত জন কমিশনার থাকবেন ‘নির্বাচন কমিশনে’। একজন তো প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে থাকবেনই, নির্বাচন কমিশনার একাধিক থাকতে পারেন। নির্দিষ্ট করে সংখ্যা না বলায় এবং যথাযথ আইন না থাকায়, জোট সরকার তাদের খুশিমতো প্রায় আধাডজনের কাছাকাছি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আজিজ সাহেব থেকে শুরু করে কোনো কমিশনার সাহেবের অভিধানেই ‘নিরপেক্ষতা’ শব্দটি ছিল না। কোনো সরকার যদি রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশন গঠন করে, তা কিছুমাত্র অসাংবিধানিক হবে না।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন উদ্দিনদের সময় গঠিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে হালচাল, দলীয়পনার যে ভয়াবহ অবস্থা, সেই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট সাহস, নিরপেক্ষতা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। দুই বিবদমান শিবিরের, বিশেষ করে বিএনপির বিষাক্ত তির মাঝেমধ্যেই ড. এ টি এম শামসুল হুদা, ছহুল হোসাইন ও সাখাওয়াত হোসেনের গায়ে লেগেছে। তাঁরা আহত হলেও অবিচলভাবে তাঁদের কাজ করে গেছেন। এতটা ঐক্যবদ্ধ ও পরস্পরের প্রতি সদ্ভাবপূর্ণ টিম পাওয়া আমাদের সমাজে কঠিনই বটে। তাঁদের অধীন সহকর্মীরাও খুবই একতাবদ্ধ ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন।
গত পাঁচ বছরে তাঁরা অনেক বড় কাজ করেছেন। ভুয়া ভোটারসংবলিত আগের আবর্জনা ফেলে দিয়ে তাঁরা একটি ভালো ভোটার তালিকা তৈরি করেছেন। সিভিল সোসাইটি থেকে আমরা তেমনটিই চেয়েছিলাম। সংসদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এবং অন্যান্য স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে তিন নির্বাচন কমিশনার ও তাঁদের সহকর্মীরা প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। তাঁদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ তাঁদের কথা অনেক দিন মনে রাখবে। তাঁরা বিভিন্ন সময় বিতর্কিত বিষয়ে আমাদের নাগরিক সমাজের লোকদের পরামর্শ চেয়েছেন। আমার মতো অভাজনকেও বহুবার ডেকেছেন। কোনো প্রশ্নে হয়তো শক্তভাবে দ্বিমত করেছি। কিন্তু তাঁরা মনোক্ষুণ্ন হননি। ভালো পরামর্শ হলে হাসিমুখে গ্রহণ করেছেন। আমি তাঁদের অগ্রিম বিদায়ী ধন্যবাদ জানাই।
দীর্ঘকালের জড়তা ও অবসাদের ফলে আমাদের সমাজে অভিনন্দনমূলক কাজ খুব কমই হয়ে থাকে এবং হিংসা-প্রতিহিংসায় পরিপূর্ণ সমাজে কারও কোনো গঠনমূলক কাজ প্রশংসা পায় না। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগের প্রশ্নে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সংলাপ করেছেন। তাঁকে দিয়ে সংলাপের উদ্যোগটি সরকার নেওয়ালেও রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত আন্তরিকতা ও ভূমিকাকেও খাটো করে দেখার উপায় নেই। এই সংলাপ একটি অত্যন্ত ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি। সেটা তাঁর সাংবিধানিক অবস্থান। তাঁর ব্যক্তিসত্তা বলেও একটি জিনিস রয়েছে। জনাব জিল্লুর রহমান একজন বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ছাত্রজীবনে তাঁর রাজনীতিতে হাতে খড়ি। ভাষা-আন্দোলন থেকে উদ্দীপনায় অনাচার পর্যন্ত অব্যাহতভাবে তিনি রাজনীতিতে আছেন। তিনি একজন অতিসজ্জন ও সরল মানুষ। তাঁকে আমি চিনি ষাটের দশকের শুরু থেকে, বিশেষ করে আইভি আপার সূত্রে। তাঁর শ্বশুর অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমদ ছিলেন আমাদের শিক্ষক। ষাটের দশক থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপসহীন ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের একজন। প্রবাসী সরকারের প্রচার-প্রকাশনা প্রভৃতিতে অসামান্য ভূমিকা রাখেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী। স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, যখন বঙ্গবন্ধু সভাপতি। বাকশালের অন্যতম সম্পাদক। এলাকায় জনপ্রিয় নেতা হিসেবে বারবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে ছিলেন এবং তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই নিপীড়িত হয়েছেন। ২০০৭-০৮ সালের স্বৈরাচারী জরুরি অবস্থার সময় শুধু শেখ হাসিনার পক্ষে নয়, সাংবিধানিক রাজনীতির পক্ষে তাঁর অনমনীয় অবস্থানের কথা আমি তখন বহু আলোচনা সমাবেশে বলেছি। তাঁর সাংবিধানিক পদের বাইরে তিনি আমাদের একজন মুরব্বিস্থানীয় ব্যক্তি।
রাষ্ট্রপতি সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর পর আমি ভয় পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, বিএনপি বুঝি বিগড়ে বসে। নানা রকম বর্জনমূলক ব্যাপারে তারা অভ্যস্ত। ‘আমরা যাব না’ বা ‘রাষ্ট্রপতির সংলাপ বয়কট করলাম’ বলে বসলে কারও করার কিছু ছিল না। তাতে লাভ-লোকসান কিছু নয়, রাষ্ট্রপতিকে অসম্মান করা হতো। কিন্তু তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধি দেখা দেয়। স্বয়ং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপে যোগ দেয়।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর পানির মতো কালো ও দূষিত হয়ে গেছে কত আগে, তা বলা কঠিন। সংসদ থেকে শুরু করে গোটা রাজনীতির অঙ্গন অসুন্দর দৃশ্যে পরিপূর্ণ। দেরিতে নয়, যথাসময়ের ১৫ মিনিট আগেই বেগম জিয়া বঙ্গভবনে পৌঁছেন। রাষ্ট্রপতি তাঁকে আন্তরিকতার সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান। তাঁরা সৌজন্য ও আন্তরিকতার সঙ্গে পরস্পরের হাত ধরে কুশল বিনিময় করেন। গত ২৫ বছরে এটি ছিল আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর রাজনৈতিক দৃশ্য।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে গিয়ে বিএনপি নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়ার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি জানিয়েছে। বেগম জিয়ার আহ্বানে রাষ্ট্রপতি তাঁর সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার কথা জানান। তবে তাঁদের এই দাবির বিষয়টি সরকারকে অবহিত করবেন বলে বিএনপির প্রতিনিধিদলকে আশ্বস্ত করেন। বিএনপির দাবির সমালোচনা করে চলেছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ও মন্ত্রী। বিজ্ঞ নেতাদের ওই সমালোচনার অর্থ আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের কাছে স্পষ্ট নয়। এই মুহূর্তে এই প্রশ্নে তাঁরা নীরব থাকলেও পারতেন। তাঁদের মতামত তো তাঁরা রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছেনই—প্রকাশ্যে ও গোপনে। বর্তমান বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তিন তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়ার বিষয় নয়।
তত্ত্বাবধায়ক-ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন শুধু বিএনপির দাবি নয়, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া আর প্রায় সব দলের দাবি। ১৯৮৮ সালের মতো একটি নির্বাচনের স্বপ্ন জেনারেল এরশাদ দেখতে পারেন। শ-খানেক আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও তাঁর গোপন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ শুধু নয়, দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বিদেশি বন্ধুদের কথাবার্তা থেকে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
কোনো প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট অনেকের বুদ্ধি-পরামর্শ নিলে বহু সমস্যার সমাধান বেরিয়ে যায়। রাষ্ট্রপতির সংলাপের ইতিবাচক দিক হলো, নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ব্যাপারে বর্তমানে যে কোনো আইন নেই, সে বিষয়টিও উঠে এসেছে কোনো কোনো নেতার কথায়। এখন দায়িত্ব চলে গেছে সংসদের কাঁধে। আপাতত নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়েছে। তাঁরা দশ কার্যদিবসের মধ্যে তাঁদের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবেন। তবে সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, তা বলা যাবে না।
বিবদমান পক্ষগুলোর মতপার্থক্য কমিয়ে আনতেই হবে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে ও গণতন্ত্রের স্বার্থে। রাষ্ট্রপতি যদি তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নেও সংলাপের আহ্বান করেন, তাকেও জনগণ স্বাগত জানাবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন