সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

কবিতা ও মোরগের ডিম

ফেব্রুয়ারি বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির মাস। তাই রচনার বিষয়বস্তু সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ভালো।
কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের ৭৬তম জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কবিতাপাঠ, আড্ডা ও সংগীতায়োজনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি (এবং কবি) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, ‘রাজনীতি আমার দেহ আর কবিতা আমার আত্মা।...আমার দীর্ঘ জীবনে কবিতা একটি বিশেষ অধ্যায়, যা আমার একান্ত উচ্চারণ এবং নিভৃত বাসনা।’ [ডেসটিনি, ৮ ফেব্রুয়ারি]
বাংলা সাহিত্য খুবই সমৃদ্ধ। কবিতা সাহিত্যের একটি শাখা। বাংলা কাব্যের দীর্ঘ ইতিহাসে কোনো কবিই তাঁর দেহ ও তাঁর কবিতাকে ভাগাভাগি করার প্রয়োজন বোধ করেননি। বৈষ্ণব কবিরাও নন, রবিবাবুও নন, কাজী সাহেবও নন। কবিতা লেখার ক্ষমতা অনেকেরই না থাকতে পারে, কিন্তু কবিতা লেখার অধিকার সবাই রাখেন। এমনকি কোনো কোনো একনায়কের কবিতাচর্চার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার কোনো অধিকার নেই স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের। কবিতার যদি নারীর শরীরের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে, রাজনীতির সঙ্গে থাকবে না কেন?
বাংলাদেশে বহু রাজনীতিক কবিতার চর্চাও করেছেন। চিত্তরঞ্জন দাশের মালঞ্চ, সাগরসঙ্গীত প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ শৈশবে পাঠ করেছি। অরবিন্দ ঘোষ ঋষি হওয়ার আগে ছিলেন কবি ও বিপ্লবী-রাজনীতিক। বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা বাকেরগঞ্জের অশ্বিনীকুমার দত্তের একটি কবিতা বা গানের বই আমাদের বাড়িতে দেখেছি। তাঁরা রাজনীতিও করতেন, কবিতাও লিখতেন, কিন্তু শরীর, বস্তু, আত্মা প্রভৃতি আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে ভাবার ফুরসত পাননি। দেশের মানুষের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তাঁদের হাতে ছিল দেদার কাজ।
কোনো কোনো সৈনিকও ছাউনি থেকে চলে এসে কবিতা, গান লিখেছেন। বলেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য’। [বিদ্রোহী] কবি হলেন সত্য, সুন্দর; বিশেষ করে নারী, ফুল প্রভৃতির পূজারি। বিশের দশকের কবিও, আশির দশকের কবিও। সত্যিকারের কবি তাঁর নিজের সম্পর্কে সব বলে দেন। চুরুলিয়ার কাজী ফকির আহমেদের পুত্র লিখেছেন, ‘সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে’। [আমার কৈফিয়ত]
এই কলিকালে মোরগ যদি ডিম দিতে পারে, যে কারও পক্ষে কবিতা লেখাও সম্ভব। দ্য ডেইলি মেইল-এর অনলাইনের এক সংবাদে জানা গেছে, চীনের আনহুই প্রদেশের চুমিয়াও গ্রামের এক কৃষকের একটি মোরগ প্রতিদিন একটি করে ডিম দিচ্ছে। অনেক কবির লেখা কবিতা যে সত্য তারই লেখা, তা যেমন বিশ্বাস করতে চায় না মানুষ, কৃষক হুয়াং লির মোরগটিও যে সত্যি সত্যি মোরগ, তা পরীক্ষা করে দেখতে চাইছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাখি বিশেষজ্ঞরা। ওটা মোরগ না মুরগি, তা পরীক্ষা করতে তাঁরা নিয়ে গেছেন।
মানুষের জীবনের প্রেম হোক বা কবিতাই হোক, তার একেকটি অধ্যায় থাকে। বাংলাদেশে আশির দশকটি তেমনি একটি অধ্যায়। রাজনীতি আর কবিতা সেদিন দেহ ও আত্মার মতো একাকার হয়ে গিয়েছিল। আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনতিক্রম্য মেরুকরণ। ২৫ বছর আগে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেরুকরণের আগে কবিতায় মেরুকরণ করা হয়েছিল সেই আশির দশকেই।
রাজনীতিতে মতপার্থক্য ছিল। প্রগতিশীল, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলরা আলাদা আলাদা রাজনীতি করতেন। কিন্তু সহ-অবস্থানও করতেন। আশির দশকে জাতির সংহত চরিত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। সীমাহীন স্বৈরাচার। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান। গণতন্ত্রের জন্য উত্তপ্ত ও রক্তাক্ত রাজপথ। রাষ্ট্রধর্মের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান। প্রতি শুক্রবার মসজিদে বা পীরের আস্তানায় গিয়ে ধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা। এবং একই সঙ্গে প্রবল কাব্য আন্দোলন।
মনে পড়ে, এশীয় কবিতা উৎসবের কথা। উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষককবি বললেন, ‘আমি কবি নই, কবি হওয়ার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করিনি, কিন্তু চারদিকের দারিদ্র্য দেখে স্থির থাকতে পারি না। প্রতিবাদের জন্য হাতে কলম তুলি। চাঁদের আলোকে ফিরিয়ে আনার জন্যে কবিতা লিখি। এশিয়ার কাব্যাকাশকে এক নতুন আভায় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে এই কবিতা উৎসব।’ [দৈনিক বাংলা]
ওসব আসরের গালিচার এক কোণে ঠাঁই হলো না আমাদের মতো হতভাগাদের। আমরা জড়ো হলাম শামসুর রাহমানের পেছনে। জন্ম নিল জাতীয় কবিতা উৎসব। পাঁচতারা হোটেলের জলসাঘরে নয়, আমাদের উৎসব রাজপথে: টিএসসির সড়কদ্বীপের কাছে। অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ও প্রগতিশীল কবিদের সেই উৎসব এখনো হয়। আমাদের জনগণের উৎসবে রাজপথে বসে শেষ ছবি এঁকেছিলেন কামরুল হাসান। তবে আশির দশকের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক কবিতাটি কাগজে নয়, নিজের দেহে লিখেছিলেন নূর হোসেন।
নূর হোসেন বেঁচে থাকলে আজ বলতেন, রাজনীতি আমার দেহ। কবিতা কী আমি জানি না। তবে গণতন্ত্র আমার আত্মা। কিন্তু নূর হোসেনের আত্মা আজ দেখতে পাচ্ছে: গণতন্ত্র নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, কবিতা নিয়ে আজ বাংলার মাটিতে চলছে তামাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সংবাদমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটি

আগের দিনে বহু স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেত হাতে নিয়ে ঘুরতেন। অমনোযোগী অথবা দুষ্টু ছেলেমেয়েদের হাতের নাগালে পেলে সপাং সপাং কয়েক ঘাই বসিয়ে দিতেন। একালের বহু গণতান্ত্রিক দেশের সরকারও সেকালের হেডমাস্টারদের মতো। যখন খুশি সংবাদপত্র ও নাগরিক সমাজকে বেত্রাঘাত করে তাদের আনন্দ। কারও গালাগাল হজম করা যায়, কিন্তু অপবাদ নয়। আমরা গত বুধবার জানতে পারলাম, সংবাদপত্র ও নাগরিক সমাজ দেশের অর্থনীতির সংকটের জন্য দায়ী। অর্থাৎ দেশে আদৌ যদি কোনো অর্থনৈতিক সংকট থেকে থাকে, তা সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সৃষ্টি। অন্য কেউ নয়, সরকার তো নয়ই।
অর্থনীতির বেহাল অবস্থা। কতটা বেহাল তা আমার মতো অর্থ-বিত্তে দুর্বল ও অর্থশাস্ত্রে অজ্ঞ মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এইটুকু বুঝি যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম প্রতি ঘণ্টায় লাফিয়ে বাড়ছে। সরকার অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় তা নিয়ন্ত্রণ করার সময় পাচ্ছে না। টাকার বিনিময়ে ডলারের দাম ৮৫ টাকা। প্রতিদিনই যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামী নির্বাচনের প্রচারাভিযানে আওয়ামী লীগের নেতারা সগর্বে বলতে পারবেন: ‘বাংলার মাটিতে ডলারের দাম আমরাই ১০০ টাকা করেছি।’ এই যে বঙ্গীয় মুদ্রার দাম কমতে কমতে এই পর্যায়ে পৌঁছাল, তার জন্য সংবাদপত্র কি ক্ষতিকর ভূমিকাটা পালন করছে, তা আমার জানা নেই। তারল্যসংকট অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, তার জন্য সংবাদমাধ্যম কীভাবে দায়ী? পুঁজিবাজারের অবস্থার কথা দেশের যেকোনো নিঃস্ব মানুষও জানে। সে ব্যাপারেও দোষারোপ করা হয়েছে সংবাদমাধ্যমকে, কিছুদিন আগেই। সংবাদপত্রের দোষ নেই তা আমরা বলব না। পুঁজিবাজারে গিয়ে ফতুর হয়ে বাংলার মাটিতে আত্মহত্যা করছেন যাঁরা, তাঁদের মর্মবেদনার কথা খবরের কাগজ লিখে থাকে। সেটা না করলে পুঁজিবাজার যদি চাঙা হয়, তাহলে আমরা করজোড়ে সম্পাদকদের অনুরোধ করব: পুঁজিবাজার নিয়ে লেখালেখি বাদ দিন। শেয়ারবাজারে যা খুশি হোক।
আমাদের প্রকাণ্ড পণ্ডিত ও বিদ্বানরা ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে বড় বড় পদে চাকরি করে প্রচুর ডলার কামাই করেন। তাঁদের উপার্জিত ডলার, পাউন্ড, ইউরো তাঁরা খুব কমই দেশে পাঠান। সেখানেই রাখেন। বাড়ি করেন। ব্যবসা করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের লোহার আলমারিতে যত বৈদেশিক মুদ্রা আছে, এর বিরাট অংশ অদক্ষ গরিব শ্রমিকদের অমানুষিক কষ্টে অর্জিত। প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে সরকারের উদাসীনতার কথা আর কেউ না জানলেও পেটের দায়ে যাঁরা বিদেশে গিয়ে জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন, তাঁরা জানেন। বিদেশে আমাদের শ্রমবাজার সম্প্রসারণের জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নাকি ১১ মিলিয়ন ডলার থেকে নেমে নয় মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে খবরের কাগজ ও নাগরিক সমাজের দোষটা কী?
দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে আসামি কবার মাত্র ১৬ ঘণ্টা আগে সংসদ থেকেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ঘোষণা করেন: অর্থনীতিতে কালো ছায়া বিরাজ করছে। ছায়াটা গোলাপি নয়, সবুজ নয়, ফিরোজাও নয়—কালো। কালো রংটি শুভ নয়। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন কালো হরফে লেখা হলেও অর্থনীতির মাথার ওপরে অশুভ কালো ছায়া বিস্তারে তার ভূমিকাটা কী, তা আমাদের জানা নেই।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ কোমর বেঁধে দেশের কী সর্বনাশটা করছে, তা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করলে আমাদের জ্ঞানবৃদ্ধি হতো। আধুনিক গণতন্ত্র গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ ছাড়া অর্থহীন। আমাদের শাসকশ্রেণী মনে করছেন, এই দুটি উপদ্রববিশেষ। তাঁরা সেই গণমাধ্যম চান, যেখানে সরকারের প্রতিটি কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হবে। সরকারি দলের নেতা, কর্মী ও ক্যাডারদের সব কথা ও কাজকে অন্ধের মতো সমর্থন দেওয়া হবে। তাঁদের যাবতীয় অপকর্মকে করা হবে আড়াল। আমাদের নেতারা চান তেমন একটি পোষমানা নাগরিক সমাজ, যাঁর নেতারা সরকারের যেকোনো কাজ দেখে বলবেন: আহা বেশ বেশ!
দুনিয়ার সব মানুষের কথার গুরুত্ব না দিলেও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কথা হিসাবে না-ধরা সুবুদ্ধির কাজ নয়। গোটা বিশ্বের নাড়িনক্ষত্রের খবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নখদর্পণে। বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা অতি ওয়াকিবহাল। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিস্টার ড্যান ডব্লিউ মজিনাকে গত বছর মিস্টার মরিয়ার্টির উত্তরাধিকারী হিসেবে ঢাকায় নিয়োগ দেন। সে দেশের রীতি অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে কোনো দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিলে সেই দেশ সম্পর্কে তাঁর ধারণা কতটা, তার প্রমাণ দিতে হয়। নিয়োগ পাওয়ার পর মি. মজিনাকেও মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতে শুনানি দিতে হয়েছে। সেই শুনানিতে তিনি বলেন, ‘দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, দুই মেরুতে বিভক্ত রাজনৈতিক দল, দুর্নীতি ও সিভিল সোসাইটির প্রতি সরকারের অস্পষ্ট আচরণই বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা।’ (প্রথম আলো, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১)
ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে এবং ঢাকায় পৌঁছেও মি. মজিনা যে বিবৃত্তি দিয়েছেন, তাতে নাগরিক সমাজের প্রতি সরকারের অসন্তুষ্ট মনোভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। গত মাস দুয়েক তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন উপলক্ষে দেখা হয়েছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও তিনি ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে কাজ করেছেন, তখনো তাঁকে চিনতাম। বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা পরিষ্কার। তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির প্রতি, বিশেষ করে ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিক সমাজের নেতাদের প্রতি সরকারের অসহিষ্ণু আচরণকে যুক্তরাষ্ট্র অনুমোদন করে না। তবে আমেরিকা অনুমোদন করুক বা না করুক, নাগরিক সমাজের মতামতের মূল্য না দেওয়ায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যে দুর্বলতর হচ্ছে, তা যেকোনো মানুষই বোঝে। বোঝেন না শুধু সরকারের নেতা ও নীতিনির্ধারকেরা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো নাগরিক সমাজও দুই বা আড়াই শিবিরে বিভক্ত। যেমন—নাগরিক সমাজ (আওয়ামী), নাগরিক সমাজ (বিএনপি-জামায়াত) এবং নাগরিক সমাজ (স্বতন্ত্র)। এক নম্বর ও দুই নম্বর নাগরিক সমাজ দুটি তাদের নিজ নিজ দলের একনিষ্ঠ সেবক ও ক্যাডারের ভূমিকা পালন করছে। তাঁরা তাঁদের দলেরই অংশ, যেমন প্রাণীর শরীরের লোম। মনে হয় আলাদা, আসলে এক। দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থ তাঁদের কাছে বড় নয়। যেমন, এক পক্ষের কাছে ফালানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়, আরেক পক্ষের কাছে ওই লাশটি তাঁদের রাজনীতির জন্য দরকার।
ভারতে গণতন্ত্র একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পেরেছে সেখানকার গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কারণে। পাকিস্তানে শাসকেরা সংবাদপত্রকে শুরু থেকেই টুঁটি চেপে ধরেছিলেন। শক্ত নাগরিক সমাজের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তাই সেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারেনি। ৬৫ বছর যাবৎ সামরিক-বেসামরিক স্বৈরশাসন পাকিস্তানি জনগণকে পদানত করে রেখেছে। কিন্তু ভারতে সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ গণতন্ত্রের ওপর কোনোরকম আঘাত মেনে নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ দীর্ঘায়িত হতে দেয়নি; বরং চরম মূল্য দিতে হয়েছে মিসেস গান্ধীকেই। বাংলাদেশের দশা ভারত ও পাকিস্তানের মাঝামাঝি।
জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরার দায়িত্ব নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের। নাগরিক সমাজের যে গোত্রটি সুবিধাবাদী, তাদের পক্ষে জনগণের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না। আমরা যাঁরা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বলে দাবি করি, তাঁরা কেউ লেখক, কেউ শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কেউ সাংবাদিক, অধ্যাপক, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক আমলা, কেউ এনজিও-কর্তা। নাগরিক নেতাদেরও চাওয়া-পাওয়ার আছে। বড় বড় পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ চাই। ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকারের আনুকূল্য চাই। এনজিও চালালে মোটা অঙ্কের ফান্ড চাই। উত্তরাতে না পাওয়া গেলে পূর্বাচল প্রভৃতি আবাসিক এলাকায় প্লট চাই। সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে খুব বড় বড় স্যুটকেস নিয়ে বিদেশ সফর করতে চাই। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের কোনো রকম সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকি। কারণ, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার প্রভৃতির প্রাপকদের তালিকা থেকে বাদ পড়লে আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখানো সম্ভব হয় না। সুতরাং গা-বাঁচিয়ে সব রকম হিসাব ও যোগ-বিয়োগ করে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হওয়া সবচেয়ে ভালো। তাতে সরকারও স্বস্তিতে থাকে, নাগরিক নেতারাও ভালো থাকেন। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি তা-ই। সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার মধ্যে যে নির্মল আনন্দ রয়েছে তা থেকে কে বঞ্চিত হতে চায়?
কিন্তু তৃতীয় যে নাগরিক সমাজটির কথা বলেছি, সেটিকে নিয়েই সমস্যা। তাঁরা সরকারের ভুলভ্রান্তির সমালোচনা করেন, অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করেন, প্রয়োজনে সাধ্যমতো প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। অর্থাৎ জনগণের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটে তাঁদের তৎপরতায়। এই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের ওপরই সরকারের যত ক্ষোভ। তাঁদের সমালোচনা করা হয় অসৌজন্যমূলক ভাষায়। গণমাধ্যমেরও সেই অংশটির ওপরই সরকার চটা, যা সত্য প্রকাশে দ্বিধাহীন। জনগণ ও জাতীয় স্বার্থের কথা লিখলেই সরকারি নেতারা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী মহোদয়রা অপ্রসন্ন হন। বলেন যে তাঁরা দেশের ক্ষতি করছেন।
জাতীয় অর্থনীতিতে কালো ছায়া নেমে এসেছে কি না জানি না, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি জাতীয় জীবনে নেমে এসেছে এক গভীর কালো ছায়া। দেশপ্রেমের সংজ্ঞা গেছে বদলে। স্বাধীনতার সংজ্ঞাও গেছে বদলে। সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলাই আজ ভারতবিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপকরা দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিলেও কিছু বলা যাবে না। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা চাওয়া দোষ। হাত কচলানো কূটনীতির সমালোচনা করলে অপরাধ। সীমান্ত-হত্যার প্রতিবাদ করলে দোষ। টিপাইমুখ নিয়ে কথা বলা বা প্রতিবাদ করা ভারতবিরোধিতা।
এনএসআইয়ের মতো জাতীয় স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত সংস্থায় সরকারি ছাত্র সংগঠনের বর্তমান ও সাবেক নেতাদের গণহারে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে লিখলে গণমাধ্যমের দোষ। মন্ত্রী-সাংসদের বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি নিয়ে লিখলে দোষ। অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলা হচ্ছে, অথচ মাননীয়রা ১৫ মাসে এনেছেন ২৫৫টি গাড়ি, যার কোনো কোনোটির দাম পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা। দুর্নীতির কথা তো বলাই যাবে না। বললে প্রমাণ দিতে হবে। এ পর্যন্ত পৃথিবীতে লোকজনের সামনে সাক্ষী-প্রমাণ রেখে কেউ দুর্নীতি করেছে বলে শোনা যায় না। সাংসদ ও সরকারি দলের ক্যাডাররা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চড়-থাপড় দিলে সে সম্পর্কে গণমাধ্যম লিখলে অপরাধ। রাষ্ট্রের সম্পত্তি অবলীলায় বেদখল হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে লেখালেখি বা প্রতিবাদ করলে দোষ। বিরোধী দলের কর্মসূচি বানচাল করতে পাল্টা কর্মসূচি পাকিস্তান আমলেও দেখিনি। তা নিয়ে সংবাদপত্র ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কিছু বললে তার নাম সরকারবিরোধিতা।
সরকার বেশ কিছু প্রগতিশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ দূর করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আন্তরিক। কিন্তু গণতন্ত্রকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাইলে এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইলে তা সংবাদমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের নিয়েই করতে হবে। ভিন্নমতের ও সমালোচনার মূল্য দিতেই হবে। সংবাদমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে অসহিষ্ণু আচরণ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।