বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

মঙ্গল-আলোকে আলোকিত হোক জাতি

সৈয়দ আবুল মকসুদ
গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথের কাঁটাগুলো অপসারণের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। পৃথিবীর বহু দেশেই বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বিচিত্র বাধা ছিল। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই। কোনো একটি মত কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, নানা মতাদর্শের সমন্বয়ের ভেতর দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা কমিয়ে আনা মোটেই কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা

অনেক দুঃখের তিমিরের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বিশ্ববাসী অনেকের আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে পারবে না। কারণ তার ভূমি কম, প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত এবং জনসংখ্যা ঘনবসতিপূর্ণ; কিন্তু তাদের আশঙ্কা বা অনুমান অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান থেকে সরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্টই ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বড় পাকিস্তানের অবস্থাই আজ শোচনীয়। কিন্তু বাংলাদেশ আরও ভালো থাকতে পারত, যদি এখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন অব্যাহত থাকত। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে শুরুতেই পুঁতে রাখা ছিল কিছু কাঁটা। দিন দিন কাঁটার সংখ্যা বেড়েছে। সেই কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে জনগণের পা; কিন্তু সেই কাঁটা থেকে সুবিধা নিয়েছেন একশ্রেণীর জনবিরোধী রাজনীতিক, জনবিচ্ছিন্ন আমলা আর সামরিক শাসক ও তাদের দোসররা।

বাংলাদেশের চলি্লশ বছরের ইতিহাস নির্বাচিত সরকারের স্বৈরশাসন, অসাংবিধানিক সামরিক সরকারের স্বৈরাচার এবং গণতান্ত্রিক সরকারের অনাচারে ভরপুর। সরকারি দল ও বিরোধী দলের অসহযোগিতামূলক ও সংঘাতপূর্ণ অবস্থান বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে একটি অন্ধকারময় অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আইনের শাসনের অভাবে জনগণের জীবনে নেমে এসেছে প্রায় অসহনীয়
দুর্দশার অবস্থা।
বাংলাদেশ হাজার বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমন্বিত সাংস্কৃতিক দেশ। বাংলাদেশের সমাজ পরমতসহিষ্ণুতার সমাজ। সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় এক সময় ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদিতা হলো অন্ধকারের জিনিস। সেই অন্ধকার দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ এবং এ ক্ষেত্রে তার সফল না হয়ে উপায় নেই।
অপরাজনীতির ভেতরেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে গেছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। এ ক্ষেত্রে সরকারের চেয়ে বেশি কৃতিত্ব বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। অনেক বাধার ভেতর দিয়ে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের কাজ করতে হয়। তারপরও আজ দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ এক বিকাশমান অর্থনীতি। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে এবং গণতান্ত্রিক সুশাসন থাকলে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাবে, সে সম্ভাবনার কথা বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে যে বাধা তা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধের মারাত্মক অভাব। অথচ বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা অপরিহার্য। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সংসদে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা না করে তা নিয়ে রাজপথে সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। তাতে সমস্যা থেকেই যায়, সমাধান হয় না। এ বিষয়টিই আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট।
গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথের কাঁটাগুলো অপসারণের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। পৃথিবীর বহু দেশেই বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বিচিত্র বাধা ছিল। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই। কোনো একটি মত কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, নানা মতাদর্শের সমন্বয়ের ভেতর দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা কমিয়ে আনা মোটেই কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা।
অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কোনো লাভ হবে না। তাতে শুধু হবে শক্তিক্ষয়। বাড়বে তিক্ততা। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি আলোকিত বাংলাদেশ গড়তে হলে সব দলের নেতাদেরই কিছু ছাড় দিতে হবে। ভিন্নমতের সঙ্গে বৈরিতা না করে সহযোগিতার সঙ্গে কাজ করার মনোভাব না থাকলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ধর্মান্ধতার অন্ধকার আপনাআপনি দূর হবে, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রের অস্থিরতাও কমে আসবে।
পৃথিবীর যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বড় ভূমিকা রাখছে। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া আজ খুবই বিকশিত। সব দলের মতামতই মুহূর্তের মধ্যে জনগণের কাছে পেঁৗছে যাচ্ছে। তা ছাড়া দলীয় রাজনীতির বাইরে বিভিন্ন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও তাদের চিন্তা-ভাবনার কথা প্রকাশ করছেন। তাতে জনগণের চেতনার মান বাড়ছে। সব মতামত বিবেচনা করে তারা নিজেরা একটি স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। ফলে রাজনীতিকরা মানুষকে দীর্ঘ সময় বোকা বানিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটতে পারবে না। জনগণ যখন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় তখন নেতারা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে না। বহু সংগ্রাম করে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতা নষ্ট রাজনীতির স্বার্থে নয়, ব্যবহৃত হবে জনগণের স্বার্থে এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। এটাই বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের দাবি।
স্বাধীনতা অর্জনের আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধে যে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, হারিয়েছেন সহায়-সম্পদ এবং নারীসহ সাধারণ মানুষ সহ্য করেছেন অকল্পনীয় নির্যাতন, সেসব মানুষের স্বপ্ন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। শাসকশ্রেণী সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। সংবিধান কাটাছেঁড়ার ফলে আজ পরস্পরবিরোধিতায় পরিপূর্ণ। মূলনীতি হিসেবে মূল সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপিত হয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও আছে, বিসমিল্লাহও আছে। তাতে আধুনিক গণতান্ত্রিক সংবিধানের চরিত্রটি থাকল না।
তারপরও সংবিধান জনগণকে যে অধিকার দিয়েছে তাও আজ রক্ষিত হচ্ছে না। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষের মৌলিক অধিকারকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। রাষ্ট্রে আজ কিছু নতুন উপদ্রব দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে মহামারীর মতো। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা শোচনীয়। প্রশাসনে দক্ষতার অভাব, দলীয়করণ সর্বত্র। এসবই মানুষের সৃষ্টি। সুতরাং তার সমাধান সম্ভব।
পৃথিবীর অনেক দেশই আজ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি জটিল সমস্যায় জর্জরিত। সেদিক থেকে আমাদের অবস্থান অনেক ভালো। কিন্তু প্রত্যাশিত রকম ভালো নয়। ভালো না থাকার পথে যেসব বাধা তা শনাক্ত করার দায়িত্ব যে কোনো সচেতন মানুষের; কিন্তু তার সমাধান করতে পারেন শুধু নেতারাই। সব রকম অন্ধকারমূলক অবস্থাকে হটিয়ে সবার অংশগ্রহণে মঙ্গল-আলোকে আলোকিত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে_ এ আমাদের প্রত্যাশা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ :লেখক ও গবেষক

সোমবার, ২৮ মে, ২০১২

সরকারি দল, বিরোধী দল ও পাবলিক


রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে পাবলিকের, অর্থাৎ ভোটারদের কোনোরকম কুটুম্বিতা নেই। ভোটারদের সবারই বাপ-মা আছেন। অনেকের আছেন শ্বশুর-শাশুড়ি। কারও সৎ শ্বশুর-শাশুড়ি, কারও চাচা-মামা, ফুফা-খালু। কারও বেয়াই, ভায়রা, জেটেস ও শালা-শালী। ভোটারদের সঙ্গে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সে রকম কোনো আত্মীয়তা বা কুটুম্বিতার সম্পর্ক নেই। যখন যাকে উপযুক্ত ও যোগ্য মনে করেন, তখন ভোটাররা তাঁকে ভোট দেন। অনন্তকালের জন্য তাঁরা কাউকে নির্বাচিত করেন না। একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেন তাঁরা। তবে আবার এবং বারবার পুনর্নির্বাচনের সুযোগও থাকে।
ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনে মানুষ সামনের দিনগুলোতে কী করবে, তার নানা রকম ছক কাটে। যার ঘরে সেয়ানা মেয়ে আছে, সে চায় আগামী বছর তাকে একটি রোজগেরে ছেলের হাতে তুলে দিতে। যার নিজস্ব বাড়িঘর নেই, সে চায় তার সাধ্যমতো একটি বাড়ি বানাতে। কেউ ভূমিহীনদের কোটায় কাঠা দুই খাস জমির বরাদ্দ চায়। কেউ গুলশান, বারিধারা, উত্তরা বা তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বরাদ্দ চেয়ে সফল হয়। কেউ অন্য কোনো জরুরি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুতি নেয়। যেসব দেশে গণতন্ত্র আছে, সেখানে পাবলিক একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ভাবতে থাকে একটি নতুন নির্বাচনের কথা। যে সরকার তারা আগেরবার নির্বাচিত করেছিল, তাকেও তারা পুনর্বার নির্বাচন করে রেখে দিতে পারে, তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকেও সরকার গঠনের সুযোগ দিতে পারে। সেটা একেবারেই পাবলিকের ব্যাপার। সরকারি দল ও বিরোধী দলের হাত নেই। তারা দুটি পক্ষ মাত্র। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রে পক্ষ তিনটি: সরকারি দল, বিরোধী দল ও পাবলিক। 
পাবলিক বা জনগণের একটি সামষ্টিক সত্তা রয়েছে। একটি সমষ্টিগত মন রয়েছে। সেই মনের আছে ইচ্ছা-অনিচ্ছা। একবার তারা চায় এই দল ক্ষমতায় যাক, কখনো চায় এই দল ক্ষমতা থেকে সরে যাক। অন্য কেউ ক্ষমতায় আসুক। সে যে-ই হোক। সে রকমই তারা চেয়েছিল ১৯৫৪-তে, সত্তরে, একানব্বইয়ে, ছিয়ানব্বইতে, ২০০১-এ এবং হালে ২০০৮-এ। ২০১৪ সালের জন্য নিশ্চয়ই ভোটাররা মন ঠিক করে ফেলেছেন। কিন্তু পাবলিক বড় চাপা স্বভাবের। মুখ খুলে আগে কিছু বলে না।
এ পর্যন্ত বাংলার মাটিতে যাঁরা ক্ষমতায় গেছেন গণরায় নিয়ে, তাঁরা মনে করেন নির্বাচন জিনিসটা হলো সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার একটি কায়দা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন হয় সরকারে যাওয়ার জন্য যেমন, তেমনি সরকার থেকে সরে যাওয়ার জন্যও। যদিও সেটা বড়ই বেদনাদায়ক ব্যাপার। সত্যিকারের গণতন্ত্রে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। যতই কাকুতিমিনতি কর কেউ বলুক, অথবা আবদার করুক ‘আর একটা টার্ম’ থাকতে দাও; পাবলিক তা শোনে না। জোর করে, ষড়যন্ত্র করে, ‘আর একটা টার্ম’ থাকার চেষ্টা যে সরকারই করেছে তারা আর গণতন্ত্রী থাকেনি। পাবলিকের ইচ্ছা পূরণের নাম গণতন্ত্র, ক্ষমতাসীনদের খায়েশ পূরণকে গণতন্ত্র বলে না। তার নাম স্বৈরতন্ত্র।
ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল নয়, পাবলিকও জানে, ২০১৪-এর জানুয়ারিতে সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। নতুন সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন করতে হবে। সরকার বলছে, কেন নির্বাচন করব না, এক শ বার করব। এবং সংবিধান অনুযায়ী করব। সংবিধানে যা লেখা আছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে নির্বাচন করব। বিরোধী দল তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। পাবলিক সরকারি দল ও বিরোধী দলের মতো টেলিভিশনে কথা বলতে পারে না, তাই তাদের বয়ানটা জানা যাচ্ছে না। তবে তাদের চোখ-মুখ দেখে আঁচ করা যায়। 
সরকার সংবিধানের বাইরে এক চুলও নড়াচড়া করতে চায় না। সেই নড়ন-চড়ন হবে নাকি ‘অসাংবিধানিক’। তাদের সেই যুক্তিও শিরোধার্য। আসলেই তো সংবিধানের বাইরে এক চুল যাওয়াও ঘোরতর অপরাধ। যে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু সাবালক হয়ে ওঠেনি এমন কোনো কিশোর বা কিশোরী যদি সরকারকে প্রশ্ন করে: ২০০৮ সালে আপনারা যে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলেন তা কীভাবে করলেন? কোন সংবিধানের অধীনে করেছেন? সেটা যদি বর্তমান সংবিধান না হয়ে থাকে, তা হলে সেই নির্বাচনের বৈধতা কোথায়? কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাও মৃত্যুশয্যা থেকেও প্রশ্ন তুলতে পারেন; সরকার মহোদয় বলুন, যে সংবিধান আপনাকে অস্তিত্ব দান করেছে, সেই সংবিধানকে আপনি অসম্মান করতে পারেন না। তাতে আপনি নিজেকেই অসম্মান করছেন। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসংবলিত সংবিধান থেকে আপনি সুবিধা নিয়েছেন। এখন ওই সংবিধানকে আপনি খিস্তিখেউড় করছেন। এ কোন ধরনের নৈতিক অবস্থান? যাকে গ্রামের লোকে বলে: গাঙ পার হইলে মাঝি হয় হালা (শালা অর্থাৎ স্ত্রীর ছোট ভাই)।
টিভির পর্দা থেকে শোনা গেছে, আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই হবে। এই কথা শুনে পাবলিকের পিলে চমকে উঠলেও, এই ঘোষণায় বিন্দুমাত্র দোষ নেই। একেবারে খাঁটি সংবিধানসম্মত কথা। এবং এই ঘোষণার পর পাবলিক সেই অনাগত নির্বাচনের ফলাফলটাও পুরোপুরি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচন কমিশনের বরাত ছাড়াই যদি কল্পনা করে, তা হলে তা সংক্ষেপে হবে এ রকম: ১৪ দলীয় মহাজোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮২ আসন এবং ১৮ দলীয় পাতিজোট ১৭ এবং স্বতন্ত্র একজন। 
ব্যক্তির বা কলাম লেখকদের অনুমানের মতোই পাবলিকের সব অনুমান যে নির্ভুল তা নয়। কিন্তু পাবলিকের পিলে চমকানোর কারণ কী? কারণ তাদের ইম্পিরিক্যাল মাইন্ড বা বাস্তব অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মন। তারা গত তিন বছরে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা তিনশ বছরের অভিজ্ঞতার সমান। তাদের কোনো পুঁথিগত ও পত্রিকাগত বিদ্যার পুঁজি নেই, যা আছে তা সবই তাদের নিজের অভিজ্ঞতা। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কী বলল, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কী কী লিখল, দ্য ইকোনমিস্ট কী বিশ্লেষণ ও পরামর্শ দিল, তার কোনো মূল্য নেই বাংলার পাবলিকের কাছে। কোথায় কোন মতলবে কে কী করছে তা তারা জানে, কে কী করতে পারে, তাও তারা জানে। 
বাংলাদেশের পাবলিকের কাছে এই দেশ তাদের অতি প্রিয় মাতৃভূমি। কিন্তু অনেকের কাছেই বাংলাদেশ একটি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ে বেশি কিছু নয়। ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মতো যদি আগামী নির্বাচনের আগে আগে বাংলাদেশেও ওই একই দশা হয়, তা ঠেকায় কার বাবার সাধ্য? যদি দৈববাণীর মতো ঘোষিত হয়: নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকাল বর্তমান সরকারই ক্ষমতায় থাকব, সেটাই বা ঠেকাবে কে? রাজধানীর ব্যাপারে যা করা হয়েছে, রাষ্ট্রের ব্যাপারে যে তা হবে না তার নিশ্চয়তা কী?
সেই পরিস্থিতি হওয়ার আগে একটি নিখুঁত সাংবিধানিক পথ খোলা আছে। বিরোধী দলের সব বড়-মাঝারিকে জামাই আদরে কাশিমপুর প্রাসাদে রাখার পর, খালেদা জিয়াকে এতিমের টাকা মারার ‘অপরাধে’ সাজা হিসেবে মাইনাস করে দিয়ে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন বা অগ্রিম নির্বাচন দেওয়া যায়। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আগাম নির্বাচন দেওয়া দোষের নয়। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর কেবিনেট সহকর্মীরা পদত্যাগ করবেন এবং বশংবদ একদল লোক বা ভাঁড়দের নিয়ে গঠিত হবে একটি অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সরকার করবে অতি নিরপেক্ষ নির্বাচন। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন তো আছেই। এ ব্যাপারে প্রধান ডিপ্লোম্যাট ও ডিপুটি প্রধান ডিপ্লোম্যাটদের পটাতে পারলেই হলো। দেশে একটি ‘নির্বাচিত’ সরকার থাকলেই হলো। হামিদ কারজাই রয়েছেন, নুরি আল মালিকিও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। ক্ষতি কী? 
সরকার যদি অতি সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বলে, তোমরা নির্বাচন নির্বাচন করে চেঁচাচ্ছ, এই নাও, দিয়ে দিলাম একেবারে আগাম নির্বাচন। বিরোধীদের সবাই কাশিমপুর প্রাসাদে থাকার ফলে প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে এ কথা বলারও কেউ থাকবে না যে: তোমরা বরং আরও কিছুদিন ক্ষমতায় থাক। আমাদের প্রস্তুতি নেই। দাঁড়া করানোর মতো প্রার্থীও নেই। তোমরাই থাক ক্ষমতায়, এত তাড়াহুড়োর কী আছে! 
কষ্ট করে এখন আর কোনো ব্যারিস্টারকে দিয়ে বিএনপিকে ভাঙার দরকার নেই। কোনো দল ভাঙার চেয়ে দলের মেরুদণ্ড ভাঙা বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। একদিকে সব নেতা কারাগারে, অন্যদিকে এক ব্যারিস্টার বাইরে। কার মনে কী আছে তা ৫ তারিখের পর বোঝা যাবে। বিএনপির যাঁরা কাশিমপুর ফটকে ঢুকতে রাজি হবেন না, তাঁদের যদি কিছু আশ্বাস ও উপহার দিয়ে ঠান্ডা রাখা যায়, তার চেয়ে সহজ উপায় আর হতে পারে না। যদি কাউকে কাউকে বলা হয়, তোমাদের অমুক অমুককে নির্বাচন করিয়ে সংসদে আনব এবং মতৈক্যের সরকার করে দুটো মন্ত্রিত্বও দেব, তাতে গররাজি হবেন এমন মানুষ বাংলার মাটিতে একুশ শতকে বিরল। জোটের এক নেতা মাইনাস ওয়ানের কথা মুখ ফসকে বলেননি। তিনি জেনেশুনেই বলেছেন।
যুগে যুগে পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলায়, কিন্তু একটি জনগোষ্ঠীর মন বদলায় না হাজার বছরেও। কিছুটা হতাশা ও না-পাওয়ার ব্যথায় বিমর্ষ কিছু ছদ্মবাম বা কমিউনিস্ট তাদের নেতাদের মাঠে নামিয়ে, তাঁদের কয়েকটি আসন দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে, একটি বহুদলীয় নির্বাচন করার চেষ্টাও যে সফল হবে তা মনে হয় না। মাঝখান থেকে তাঁরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ট্যুর করে কোমরের ব্যথা বাধাবেন। পাবলিক ছদ্মবামদের মতো চালাক নয় বটে, কিন্তু তারা গোঁজামিল জিনিসটা বোঝে। এবং দেশের সঙ্গে ও গণতন্ত্রের সঙ্গে যাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করেন তাঁদের খুব সহজেই চিনে ফেলেন।
পরীক্ষায় যেমন প্রশ্নপত্রে কয়েকটি বিকল্প থাকে, তেমনি সরকারের পরিকল্পনারও কয়েকটি বিকল্প আছে বলে পাবলিক মনে করছে। সবগুলো বিকল্পের মধ্যে সবচেয়ে সহজ পথটিই পাবলিক পছন্দ করে। সেই সহজ পথটি হলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া। কথাটা নির্মম মনে হলেও এবং তা সাহস করে বলাও মুশকিল, তা হলো, আগামী অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি পরাজিতও হয় তা হবে দলের জন্য গৌরবের। তাতে প্রমাণিত হবে আওয়ামী লীগ সাচ্চা গণতন্ত্রী দল। আন্তর্জাতিক প্ররোচনায় তেলেসমাতির নির্বাচনে, যেমন নির্বাচন করেছিলেন একাত্তরে টিক্কা এবং ১৯৮৮ সালে এরশাদ, আওয়ামী লীগ যদি ২২০ আসন পায় তা হবে দলের জন্য আত্মঘাতী। একেবারে রীতিমতো বিষপানে আত্মহত্যা।
বিএনপি যদি মনে করে যে বাংলাদেশের সব লোক তাদের লেজ ধরেই বসে থাকবে—তা এক বড় নির্বুদ্ধিতা। আওয়ামী লীগকে জনগণ ক্ষমতা থেকে সরালে তাদেরই যে পাবলিক ক্ষমতায় বসাবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? কোন অবস্থায় কারা কখন সামনে চলে আসেন, রাজনীতিতে সে সম্পর্কে আগাম বলা সম্ভব নয়। পাবলিকের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। সুতরাং একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশে একটি পালাবদল ঘটবে। বাংলাদেশের পাবলিক কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের খাস তালুকের প্রজা নয়। তারা কারও গোলামি করা পছন্দ করে না। তারা প্রত্যেকেই মাত্র একবার বিশ্বাস করে—দুবার নয়। কিন্তু কিছুটা দয়াপরবশ বা নিরুপায় হয়ে তারা দুই দলকে দুবার বিশ্বাস করেছিল। আর করবে না।
শেষ পর্যন্ত কী হবে, তা শুধু বিধাতাই বলতে পারেন। আমাদের মতো পাবলিক আশা করে, যা কিছুই হোক, ভালোয় ভালোয় হোক। লগি, বৈঠা ও কাটা রাইফেলের এস্তেমাল চাই না। বাস ও গাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলুক, তা দেখতে চাই না। রাস্তার মধ্যে পেটের দায়ে দলীয় কর্মীর প্রক্সি দেওয়া তরুণের লাশ পড়ে থাকুক তাও কাম্য নয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কী বলল, তার চেয়ে বেশি জরুরি আমাদের পাবলিক কী বলে এবং আমাদের বিচার-বিবেচনা ও বুদ্ধি-বিবেক কী বলে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

শুক্রবার, ২৫ মে, ২০১২

মোজাফ্ফর আহমদ ও নাগরিক আন্দোলন

সৈ য় দ আ বু ল ম ক সু দ
শিল্প-সাহিত্য ও শি¶া-সংস্কৃতি ¶েত্রে আমাদের কেউ মারা গেলে, তার মৃত্যুতে ‘জাতির অপূরণীয় ¶তি হল’ অথবা তার চলে যাওয়ায় ‘যে শূন্যতার সৃষ্টি হল তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়’Ñ বলা যেন আমাদের একটি অর্থহীন অভ্যাস বা প্রথায় পরিণত হয়েছে। শীর্ষ সরকারি নেতারাও এ ভাষাতেই শোকবাণী দেন। অথচ যিনি মারা যান, তার কোন গুর“ত্বপূর্ণ কাজ দেখতে পায়নি দেশের মানুষ ৩০ বছরেও। দেশের মানুষের জন্য তার ত্যাগ নেই এক ছটাক। পুঁজি শুধু কোন এক সময়ে কিছু কাজ করার খ্যাতিটুকু। আমাদের আবেগতাড়িত, যুক্তিবিবর্জিত ও কর্মবিমুখ সমাজে এখনও এমন মানুষ কেউ কেউ আছেন, যাদের মৃত্যুতে আ¶রিক অর্থেই অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তারা অপ্রতিকল্পনীয়। যাদের পরিবর্তে আর একজন খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদেরই একজন ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
কর্মজীবনে অর্থাৎ চাকরি-বাকরিতে মোজাফফর আহমদ কী কী প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব পালন করেন, তা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। ওসব পদে বহু মানুষই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পরী¶া দিয়েই হরগঙ্গা কলেজে শি¶কতা শুর“ করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। শি¶কতা ছেড়ে দিয়ে ষাটের দশকে একটি বেসরকারি ব্যাংক এবং পূর্ব পাকি¯—ান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনে কাজ করেন। শি¶ায়তনিক ও তাত্তি¡ক জ্ঞানের সঙ্গে ওই দুই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ফলে তিনি ব্যাংকিং ও শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
¯^াধীনতার পর ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে তিনি যোগ দেন। ১৯৭৪ সালে পরিকল্পনা কমিশন থেকে পদত্যাগ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইন্সটিটিউটে (আইবিএ) অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ও তার কয়েকজন সুযোগ্য সহকর্মীর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের একটি শীর্ষ শি¶া প্রতিষ্ঠান হিসেবে ¯^ীকৃতি পায় আইবিএ। এই প্রতিষ্ঠানের সুনাম আজও অ¶ুণœ। বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে যে বহু দ¶ প্রশাসনিক কর্মকর্তা তৈরি হয়েছেন গত ৪৫ বছরে, তার কৃতিত্ব আইবিএ’র। সে¶েত্রে মোজাফফর আহমদের অবদান রয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দ¶ প্রশাসকদের অনেকেই তার প্রত্য¶ ছাত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি করেন ১৯৬৫ সালে। সেখানে তার শি¶কদের কয়েকজন ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তার সহপাঠী বব লুকাস অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। তার প্রাতিষ্ঠানিক শি¶ার মান তার সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এবং তার অনেক সহকর্মীর চেয়ে উঁচু ছিল বলে তার ঘনিষ্ঠদের অভিমত।
উচ্চশি¶া প্রতিষ্ঠানে জীবিকার জন্য শি¶কতার চাকরি করা নয়, মোজাফফর আহমদ ছিলেন একজন আদর্শ শি¶াবিদ। ছাত্রদের তিনি উপযুক্ত শি¶া দান করতেন। তার নিজের শি¶ার ভিত্তিও ছিল খুব মজবুত। তার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের কাছে শুনেছি, সেখানে ৪০-এর শেষ ও ৫০-এর শুর“তে তার সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ারে সব সময় কিছু বই থাকত। শুধু ঘরে নয়, বাইরেও সময় পেলে তিনি পড়তেন। তা নিয়ে তার বন্ধুরা হাসি-ঠাট্টা করতেন। তবে সবাই ¯^ীকার করেন যে তিনি বা¯—বিকই খুব পড়-য়া ছিলেন। দেশে ও দেশের বাইরে তিনি আদর্শ শি¶কদের কাছে পাঠ নিয়েছেন, নিজে হওয়ার চেষ্টা করেছেন আদর্শ শি¶ক।
তার অগণিত অনুরাগীর অনেকেই জানেন না, মোজাফ্ফর আহমদ ছিলেন একটি ঐতিহ্যবাহী শি¶িত মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। তিনি প্রথম জেনারেশন আধুনিক শি¶িত ছিলেন না। তার গ্রামের বাড়ি আর আমাদের গ্রামের বাড়ির দূরত্ব ছিল মাইল পাঁচেক। আমাদের দুই গ্রামই ছিল পদ্মা নদীর পাড়ে। দুটিই আজ নদীগর্ভে। উনিশ শতক থেকেই আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তার বাবা-চাচারা এবং তাদের বাবা-চাচারা ছিলেন উনিশ শতক থেকেই আধুনিক ইংরেজি শি¶ায় শি¶িত। তার দাদার ভাই মবিনউদ্দিন আহমদ গত শতাব্দীর প্রথম দিকে একজন সৎ ও ন্যায়পরায়ণ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সারা বাংলায় পরিচিত ছিলেন। তখন বাংলায় উচ্চপদস্থ বাঙালি মুসলিম সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন হাতেগোনা।
কাস্টমস ও আবগারি বিভাগের ক্যাডার সার্ভিসের পদস্থ কর্মকর্তা ছাড়াও, মবিনউদ্দিন আহমদ একজন লেখক হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। তার লেখনী নাম ছিল মবিনউদ্দিন আহমদ জাহাঙ্গীরনগরী। আগের দিনে ঢাকা জেলার অনেকে তাদের নামের শেষে জাহাঙ্গীরনগরী লিখতেন। তিনি ছিলেন আমার দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মবিনউদ্দিন আহমদের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থটি ছিল ‘কোরআনতত্ত¡’। এই ইসলামী ধর্মতত্তে¡র বইটি ছিল তিন খÊে। সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে লেখা। তিনটি খÊই আমার আব্বার সংগ্রহে ছিল। দুটি খÊ তিনি মুহম্মদ মনসুরউদ্দিনের পীড়াপীড়িতে তাকে দেন। আর ফেরত পাওয়া যায়নি। একটি খÊ জীর্ণ হয়ে গেলেও আমার কাছে আছে। এ ধরনের বই পুনর্মুদ্রিত হওয়া দরকার। ইসলামী দর্শনের ওপর তার আরও রচনা রয়েছে।
অধ্যাপক মোজাফফরের অর্থনীতি বিষয়ে মূল্যবান রচনা রয়েছে। শেষ জীবনে তার ইচ্ছা ছিল মহানবী (সা.) ও ইসলামী দর্শন বিষয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু গত ১০ বছর ধরে তার একটি দিনও অবসর ছিল না। আইনের শাসন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা, পরিবেশের বিপর্যয় রোধ প্রভৃতি বিষয়ে আন্দোলন ও অনুষ্ঠানে তাকে প্রতিদিন অংশগ্রহণ করতে হতো। দুর্র্নীতির বির“দ্ধে তার নেতৃত্বাধীন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) যে প্রচারাভিযান চালায় তার তুলনা নেই। তিনি বাংলাদেশে আধুনিক নাগরিক আন্দোলনের জনক।
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), টিআইবি এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন অধ্যাপক মোজাফফর। তার দেখাদেখি বাংলাদেশে সামাজিক আন্দোলনে আরও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেন। কিভাবে আমিও তার সংগঠনগুলোর কর্মকাÊে জড়িয়ে পড়ি, তা আমার মনে নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু সামাজিক কাজ করি বহুদিন ধরে। কোন সংগঠনের সদস্যপদ বা পদ আমার পছন্দ নয়। তাতে ¯^াধীনভাবে কথা বলা যায় না। আমার নিজের মতো আমি অন্যায়-অবিচারের সাধ্যমতো প্রতিবাদ করাই পছন্দ করি। শ্রদ্ধেয় স্যার ও আমার বন্ধু অত্যš— পরিশ্রমী ও নিবেদিতকর্মী ড. বদিউল আলম মজুমদার তাদের অবাধ-নিরপে¶ নির্বাচনের ল¶্যে গঠিত সংগঠনের সঙ্গে আমাকে সম্পৃক্ত করেন। ১০ বছর ধরে আমি তার একজন অযোগ্য সহকর্মী হিসেবে তাকে খুব কাছে থেকে দেখেছি।
রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে এবং গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সুষ্ঠু ও নিরপে¶ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী ও ¯^াধীন করা দরকার। শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিক সমাজও গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বড় ভ‚মিকা পালন করে। আমাদের রাজনীতি দুর্বৃত্তায়িত ও কলুষিত। এসব অনাচার থেকে মুক্ত হয়ে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তনের ল¶্যে প্রচার চালাতে এবং সৎ, যোগ্য প্রার্থীদের প¶ে জনমত তৈরির ল¶্যে ২০০২ সালে ‘সিটিজেনস ফর ইলেকশন’ নামে নাগরিকদের সংগঠন আÍপ্রকাশ করে মোজাফ্ফর স্যারের নেতৃত্বে। যা পরে নামকরণ হয় সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন। জনমত তৈরির জন্য গত ১০ বছরে কত যে সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল, মানববন্ধন প্রভৃতি করা হয়েছে সারা দেশেÑ প্রতিটি জেলা উপজেলায়Ñ তার হিসাব বদিউল আলম মজুমদার দিতে পারবেন। কারণ তিনিই সংগঠনের মূল চালিকাশক্তি। তবে স্যার শিখÊীর মতো মাথার উপরে থাকেননি, অকল্পনীয় শারীরিক শ্রমও দিয়েছেন। রোদের ভেতরে সমাবেশ করতে গিয়ে স্যার মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। সোজা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। ভেবেছি, তিনি আর কোন অনুষ্ঠানে যাবেন না। কিন্তু এক সপ্তাহ পরে ঠিকই এসেছেন। এসব কাজে তার বিন্দুমাত্র ব্যক্তিগত ¯^ার্থ ছিল না। এক পয়সা আর্থিক ¯^ার্থের তো প্রশ্নই আসে না।
আমাদের সমাজে বহুকাল থেকেই ¯ে^চ্ছাসমাজসেবক ছিলেন। আশির দশক থেকে বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও কার্যক্রম শুর“ হয়। বিদেশ থেকে আসতে থাকে রাশি রাশি টাকা। ভলান্টারি সমাজসেবা বলে আর কিছু থাকল না। যুবসমাজ মজুরি বা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে এনজিওতে কাজ করতে লেগে যায়। শি¶িত বেকারের দেশে সেটা খুবই ¯^াভাবিক। টিআইবি একটি আš—র্জাতিক গবেষণাধর্মী এনজিও, তাছাড়া বাপা বা সুজন নাগরিক সংগঠন, যেখানে প্রয়োজনে সদস্যদের চাঁদা দিয়ে হলেও কাজ করতে হয়। মোজাফফর স্যার সারাদেশে কিছু ¯ে^চ্ছাসেবক পেয়েছিলেন, যারা নিঃ¯^ার্থভাবে তার নেতৃত্বে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন।
কোন্ প্রে¶িতে বাংলাদেশে মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে নাগরিক আন্দোলনের সূচনা তা ভেবে দেখতে হবে। গত শতাব্দীর শেষ দশকটি ছিল বাংলাদেশে ছদ্ম গণতন্ত্রের অনাচারের দশক। দুটি বড় দল এবং সেই দুই দলের দুই জনপ্রিয় নেত্রী পাঁচ বছর করে ভাগ করে দেশ শাসন করেন। দুটি সরকারই অধিকাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে ¶মতায় আসে। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পরে তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল গণতান্ত্রিক সুশাসন। আশির দশকে সামরিক ¯ৈ^রাচারের বির“দ্ধে দুই নেত্রীই বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করেন। তারা তখন অব্যাহতভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন। কিন্তু ¶মতা লাভের পর দুটি সরকারই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে নির্লজ্জ দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হয়। রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, আমলারা দুর্নীতিতে ডুবে যান। আইনের শাসন, নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ভ‚লুণ্ঠিত হয়। প্রাধান্য পায় পেশিশক্তি। রাষ্ট্রীয় সম্পদ হতে থাকে অবাধে লুণ্ঠন। সংসদকে করে রাখা হয় অকার্যকর। বিচার বিভাগও হয় দলীয়করণ। সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ে অসহায় ও অবর“দ্ধ। প্রতিবাদকারীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন।
শতাব্দীর শেষ সরকারের ক্যাডার বাহিনীর অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। টিআইবির জরিপে বাংলাদেশ হয় পৃথিবীতে এক নম্বর। দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি দিয়ে ২০০১-এ চারদলীয় সরকার ¶মতায় যায়। তাদের তখন ছিল বিপুল জনসমর্থন। কিন্তু নির্বাচনী অঙ্গীকার ভুলে গিয়ে তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর অকারণে নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। ¶মতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সব জর“রি কাজ ফেলে রেখে বিএনপি-জামায়াত ক্যাডার বাহিনী প্রতিহিংসায় উš§ত্ত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর, যাদের অনেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের, হামলা চালায়। তাদের বাড়িঘর তছনছ করে। তাদের থেকে জোর করে চাঁদা তোলে। মারধর করে। নারীর ওপর পর্যš— চালায় নির্যাতন। আমি তখন এক মাসে ১৪টি জেলায় নিজে ঘুরে দেখেছি কী ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল গ্রামগঞ্জে।
সেই পরিপ্রে¶িতে মোজাফফর স্যারের নেতৃত্বে নির্দলীয় নাগরিক আন্দোলনের সূচনা। স্যার নিজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ছিলেন অবিচল। যেসব সংগঠনে অথবা ফোরামে স্যারের সঙ্গে আমি কাজ করেছি, সেখানে তার বা সেই সংগঠনের নীতির সঙ্গে আমি অনেক সময় ভিন্নমত পোষণ করেছি। কখনও তার মতের সম্পূর্ণ বিপরীত কথায় তিনি প্রকাশ্যে বিব্রত হয়েছেন, কিন্তু বিরক্ত বা ¶ুব্ধ হননি। সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্নে আমার অবস্থানকে তিনি সহ্য করেছেন। সব মতাদর্শের শাšি—পূর্ণ সহ-অবস্থানকে তিনি মূল্য দিতেন। আমার ভোগবাদবিরোধী দর্শনকে তিনি পছন্দ করতেন, কারণ তিনি নিজে ছিলেন ভোগবাদের ঘোরবিরোধী। যেসব প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেছেন, যেমন রাজনীতি, গণতন্ত্র, অর্থনীতি, সমাজ পরিবর্তন, দুর্নীতির কারণ ও তার প্রতিকার প্রভৃতি, সেসব ব্যাপারে তার অত্যš— পরিষ্কার ধারণা ছিল। ভাসাভাসা জেনে তিনি কিছু বলতেন না। যা বলতেন বা করতেন, তা বিশ্বাস ও প্রত্যয় থেকে করতেন।
গত কয়েক বছর আমি তার সফরসঙ্গী হয়ে হাজার হাজার কিলোমিটার ঘুরেছি সারা দেশ। তিনি ছিলেন অত্যš— ধর্মপরায়ণ। ধর্ম ছিল তার ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়। কোন রকম গোঁড়ামির লেশমাত্র ছিল না তার মধ্যে। নামাজ আদায় করতেন ও রোজা রাখতেন নিয়মিত। নামাজের সময় হলে গাড়ির মধ্যেই আমাদের পাশে বসে ১০ মিনিটে নামাজ পড়ে নিতেন। অনেকের মতো গাড়ি থামিয়ে মসজিদ খুঁজতে যেতেন না।
যেসব বিষয় আমাদের সমাজকে বিভক্ত করে ফেলেছে, সেসব ব্যাপারে আমি তার মধ্যে একটি যুক্তিবাদী ও সমš^য়ী অবস্থান দেখেছি। জিয়াউর রহমানের সরকারের উপদেষ্টা বা মন্ত্রী ছিলেন কিছুকাল। তাতে খুব ¯^াভাবিকভাবেই কেউ ধারণা করতে পারেন তিনি একজন বিএনপিপন্থী এবং আওয়ামী লীগের ঘোরবিরোধী। দীর্ঘ সময় আমি তার সঙ্গে একাšে— কাটিয়েছি। আমার মনে হয়নি তিনি আওয়ামীবিরোধী বা বিএনপিপন্থী। তিনি অকপটে আওয়ামী লীগের ভুলগুলোর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল তার গভীর শ্রদ্ধা। তবে তার ভুলগুলো গোপন করতেন না। কী কী করলে তিনি আরও ভালো করতেন সে কথাও বলতেন।
অযৌক্তিক ভারতবিরোধিতা ও সাম্প্রদায়িকতা অনেকেই গোপন রাখতে পারেন না। ভারত-বাংলাদেশের পরিবেশ নিয়ে, যৌথ নদী নিয়ে সীমাš— হত্যা নিয়ে, যখন তিনি কথা বলতেন, তখন তিনি ইস্যুটি নিয়ে কথা বলতেন, দেশটি নিয়ে নয়। সেই দেশের রাজনীতি নিয়ে নয়। বাংলাদেশে কারণে-অকারণে ভারতবিরোধী মানুষের সংখ্যা বিখ্যাতদের মধ্যে বহু। মোজাফফর স্যার বিন্দুমাত্র ভারতবিরোধী ছিলেন না। সাম্প্রদায়িকতা তার মধ্যে ছিল না। ভারতবর্ষের মহান সভ্যতা, ভারতের সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক রাজনীতির ঐতিহ্য, ভারতের অনর্ঘ্য সংস্কৃতির তিনি ছিলেন অবিচল অনুরাগী। কিন্তু পানির ন্যায্য হিস্যার প্রশ্নে, সীমাš— হত্যা প্রশ্নে, টিপাইমুখ বাঁধ প্রশ্নে তার অবস্থান ছিল স্পষ্ট ও আপসহীন।
আমাদের সমাজে নাগরিক সমাজের নেতারা বড় বড় দেশের দূতাবাসে ঘুর ঘুর করেন। ক‚টনীতিকদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে ধন্য হন। বিদেশ সফরে যাওয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোন দূতাবাস ও ক‚টনীতিকের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক বা যোগাযোগ ছিল না।
সরল জীবনযাপনের একটি ক্লাসিক উদাহরণ ছিলেন মোজাফফর আহমদ। সমাজে তিন পয়সা দাম নেই, এমন মানুষও আমাদের সমাজে নাক উঁচু করে চলেন। টেলিফোনটা নিজে ধরেন না। স্যার সব ফোন নিজে ধরতেন। যে কেউ অনায়াসে কোন সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারতেন তার সঙ্গে। যে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারতেন। কোন অহংকার ছিল না।
কর্ম¶েত্র ও আনুষ্ঠানিক সভা-সমাবেশের বাইরে একজন মানুষের যে দৈনন্দিন জীবনযাপন তাতেই মানুষ হিসেবে তার সত্যিকারের পরিচয় পাওয়া যায়। তার প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ধারা এতই সাদাসিধা ছিল যে, তা না দেখলে একালের মধ্যবিত্ত ও উঠতি উচ্চমধ্যবিত্তদের বোঝানো যাবে না। অপচয় ও অপব্যয় অপছন্দ করতেন। নিজে করতেন না, অন্যকেও করতে নির“ৎসাহিত করতেন। তিনি ছিলেন অকপট, সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ ও স্পষ্টভাষী। হঠাৎ তার চলে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিন্তু জাতির ঠিক এই মুহূর্তে তার আর কিছুকাল বেঁচে থাকার প্রয়োজন ছিল।
গণতন্ত্র সংহত করা, নাগরিক অধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একুশ শতকের প্রথম দশকে বাংলাদেশে যে নাগরিক আন্দোলনের সূচনা মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য ভবিষ্যৎ প্রজšে§র মানুষ মূল্যায়ন করবেন। এবং সেই মূল্যায়নই হবে যথার্থ মূল্যায়ন। আমরা যারা তার সঙ্গে একত্রে কাজ করেছি, তাদের সে সম্পর্কে কিছু না বলাই শোভন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক

সোমবার, ২১ মে, ২০১২

বাটি-বৃত্তান্ত

প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নপ্রস্তর যুগের পাথরের তৈরি অস্ত্রফলক পাওয়া গেছে। মাটি খুঁড়ে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা নবপ্রস্তর যুগের মৃৎপাত্রের সন্ধান পান। সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা এবং হরপ্পা সভ্যতার তৈজসপত্রের যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তার মধ্যে পাথর ও ধাতুর বাটি ছিল। আদিম মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাতে যেসব পাত্র বানাতে শেখে, সেগুলোর মধ্যে বাটি অন্যতম।
প্রথম দিকে এবং তারপর হাজার হাজার বছর তরল খাদ্য ও পানীয় পরিবেশনে বাটি ব্যবহূত হতো। ধীরে ধীরে বাড়ে তার বহুমাত্রিক ব্যবহার। ব্যাবিলন ও হরপ্পা থেকে বাটি যখন বাংলার মাটি পর্যন্ত আসে, তখন তার ব্যবহারের পরিধি আরও বেড়ে যায়। বুদ্ধিমান ও প্রতিশোধকামী বাঙালি বাটির ব্যবহার শুধু ঘন দুধের পায়েস খাওয়ার মধ্যেই সীমিত রাখেনি। পায়েস খাওয়া থেকে চোর ধরা পর্যন্ত বিচিত্র কাজে ব্যবহূত হতে থাকে বাটি।
আজ ঘটেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অকল্পনীয় অগ্রগতি। এখনই আবার দেশজ সনাতনবিদ্যার পুনর্ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক দেশে। প্রাচ্যের বহু দেশে দেখা যাচ্ছে, দেশজ পদ্ধতিতে গাছগাছড়া-লতাগুল্মের চিকিৎসাপ্রথার প্রয়োগ। যেসব দেশ মাত্র তিন বছরেই ষোলোআনা ডিজিটাল হয়ে গেছে, সেখানকার মধ্যযুগীয় মানসিকতাসম্পন্ন মানুষও বাটি চালানোর সনাতন প্রথা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় যে অপরাধীকে ধরা সম্ভব নয়, তাকে পাকড়াও করার অব্যর্থ অস্ত্র বাটি চালান।
বাটি চালান কোনো রূপকথা নয়। একসময় তা ছিল গ্রামবাংলার বাস্তবতা। ১৯৫০-৫২ সালের দিকে আমি দুটি বাটি চালানের ঘটনা দেখেছি। আমাদের এক আত্মীয়ার একটি সোনার চেন চুরি গিয়েছিল। গেঁয়ো বাটপার ধরনের একদল লোক বাটি চালান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাটি ঠেলার জন্য খুঁজে বের করা হয় কথিত তুলা রাশির এক লোককে, যে আবার আরেক বাটপার। যার চেন খোয়া গিয়েছিল, তার পায়ের কাছ থেকে বাটি ছুটল। ছুটল মানে তুলা রাশিওয়ালা ঠেলতে লাগল। সে বাটি সারা গ্রাম এদিক-ওদিক ঘুরল। আমরাও বাটিওয়ালার পিছে পিছে ছুটলাম। একপর্যায়ে সে বাটি গ্রামের প্রান্তে খেতের মধ্যে কাজ করছিল এমন এক লোকের পায়ের কাছে গিয়ে থেমে গেল। কাউকে আর বলে দিতে হলো না, চেনের চোরটি কে। লোকটি ছিল নিরীহ গোছের। প্রতিবাদ করল না, তবে চেনও ফেরত দিল না। দুদিন পরে তার লাশ ঝুলতে দেখা গেল তার বাড়ির আমগাছে। তার দুদিন পর চেনটি পাওয়া গেল আসল চোরের কাছে।
সামন্ত যুগে চিহ্নিত চোর ধরতে ব্যবহূত হতো বাটি। আজ গণতন্ত্রের যুগ। আজ প্রতিপক্ষকে পাকড়াও করতে চালান দেওয়া হবে বাটি। বাটি চালান একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদী পদ্ধতি। ডিজিটাল বাংলাদেশও থাকবে, বাটি চালানের বাংলাদেশও থাকবে পাশাপাশি। বাংলাদেশ-মার্কা গণতন্ত্রকে আমরা বলতে পারি ‘বাটি চালান গণতন্ত্র’।
বিরোধী দল ক্ষমতায় না যাওয়ার দুঃখে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার দুরাশায় হইচই করে। যেসব নেতা হইচই করেন, পুলিশ তাঁদের পাকড়াও করে লোহার খাঁচায় পুরেছে। তাঁদের ছাড়াতে যাঁরা হইচই করবেন, তাঁদের সম্পর্কেও নাশকতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। লোকালয়ে থাকলে তাঁদের খুঁজে বের করবে পুলিশ। ভয়ে তাঁরা বন-বাদাড়ে গিয়ে আত্মগোপন করতে পারেন। সে অবস্থায় প্রধান প্রতিমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন, ‘আন্দোলনের জন্য ১৮ দলীয় সব নেতাকে বাটি চালান দিয়েও পাওয়া যাবে না।’
বাটি চালানপদ্ধতি চালু হলে রাষ্ট্রের ব্যয় অনেক কমে যাবে। পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকায়ন না করলেও চলবে। গোয়েন্দাদের খাটনি কমে যাবে পনেরো আনা, যা করার বাটিই করে দেবে। বাটিই বলে দেবে, এক বাস পোড়াতে আর এক ককটেল ফাটাতে একবাক্যে হুকুম দিয়েছিলেন ৪৪ নেতা। যদিও হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা মারার হুকুমদাতা দুজনের বেশি নন।
আইয়ুব খানের জামানায় বাটি চালান দিয়ে নেতাদের ধরতে দেখেছি মোনায়েম খানকে। এবং একপর্যায়ে জেলগুলো ভরে যাওয়ার পর বাটি চালান দিয়েও আমেনা বেগম ও মিজান চৌধুরী ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু দুই বছর না যেতেই বাটি চালান দিয়েও খানসাহেবদের লীগের একজনকেও খুঁজে পাওয়া গেল না সত্তরের নির্বাচনের দিন রাত বারোটায়। সারা দেশের লোক দেখতে লাগল অন্য লীগের লোকদের।
বঙ্গীয় বাটি দুই প্রকার: একটি দৃশ্যমান, আরেকটি অদৃশ্য। বাংলাদেশে অদৃশ্য বাটি চালান চলছে বহুদিন থেকে। জোট সরকারের প্রধান প্রতিমন্ত্রী ছিলেন বাবর সাহেব। ১০ ট্রাক অস্ত্রের মামলাই হোক বা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাই হোক, গোয়েন্দাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিয়ে নিজেই বাটি চালান দিলেন। বাটি গিয়ে খপ্ করে অপরাধীদের ধরে ফেলল। পরিণাম হলো এই যে এখন তিনি নিজে এবং শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা রাজ অতিথি।
বাংলাদেশে বাটির বহুমুখী ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের উচিত যখন বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা আসবেন, তাঁদের একটি বাটি উপহার দিয়ে বলা: চোর চোর বলছেন, এইটা চালান দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের প্রয়োজন এখন একটি বাটি। তদন্ত করে কাঁঠালের বস্তায় যখন কোনো দুর্নীতির প্রমাণ মিলবে না, তখন চালান দেবেন বাটি। সব দেখা হয়ে গেছে। বাটিই এখন একমাত্র ভরসা। জয় বাংলা। জয় বাংলার বাটি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সোমবার, ১৪ মে, ২০১২

অতিথি নারায়ণদের কথা


কোনো কোনো উপলক্ষ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এবং তা বিশেষভাবে বিচার্য। সব উপলক্ষ নয়। কোনো দেশে বিদেশি অতিথি সফর করলেই তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমনকি অতিথিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেও সফরটি গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে। সব কুটুম্ব বড় কুটুম্ব নয়। এই উপমহাদেশে অতিথিকে বলা হয় নারায়ণ। কিন্তু সব অতিথি নারায়ণ নন—কোনো কোনো অতিথি নির্ভেজাল নারায়ণ। নারায়ণ সন্তুষ্ট থাকলে তাঁর বদৌলতে ভাগ্য খুলে যাবে। নারায়ণ নাখোশ হলে কপাল পোড়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। 
ঘটনাক্রমে তিন গুরুত্বপূর্ণ দেশের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি এক হপ্তার মধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসেন। তাঁদের আগমনের কথা ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই মিডিয়া বলতে থাকে তাঁদের সফল এক ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনা। আমাদের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যেমন আজকাল ১৫ দিন আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন: অনাগত হরতালে ‘নাশকতা হবে’, ‘দূর থেকে মিছিলে গুলি হবে’, তেমনি মিডিয়ার মানুষ অতিথি আগমনের আগেই রায় দিয়ে দেন: এ সফর ‘সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য।’
শুধু সাংবাদিকদেরও দোষ দেওয়া যাবে না। তাঁরা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই রিপোর্ট করেন। পেশাদার কূটনীতিক, প্রবীণ আমলা এবং টিভি চ্যানেলে প্রাত্যহিক জ্ঞানদানকারীদের মতামত ও বিশ্লেষণের মূল্য খুব বেশি। কিন্তু সাধারণ লোকজন যত নাদানই হোক, তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি না থাকুক—যেকোনো পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের একটা নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন আছে। তাদের সেই মূল্যায়নের মূল্য স্বনামধন্য কলাম লেখকদের সারগর্ভ বিশ্লেষণের চেয়ে কম নয়। 
তিন অতিথি কাছাকাছি সময়ে বা প্রায় একসঙ্গে এসেছেন—সেটাকেও বলা হয়েছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’। আসলে তাঁদের একই হপ্তায় আসাটা পরিকল্পিত নয়—কাকতালীয়। যেকোনো কারণেই হোক একসঙ্গে ঘটে গেছে। এমন নয় যে বেগম ক্লিনটন জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও ভারতের অর্থমন্ত্রীকে ফোন করে বলেছেন, ‘ভাইসাব, চলেন আমরা এক লগে বাংলাদেশে যাই।’ 
জাপানি নেতা এসেছেন, তাঁরা আমাদের রাস্তাঘাট, ব্রিজ প্রভৃতি বানানোর জন্য টাকা ধারকর্জ দেন। শুনেছেন সেই টাকা এধার-ওধার হয়। তাঁদের ট্যাক্সের কষ্টের টাকা। তা যে কাজের জন্য দেন, তা না করে ভাগাভাগি হলে তাঁদের কষ্ট হয়। সেই কথাটা বলতে তিনি এসেছিলেন: ও সব চলবে না। বকাঝকা খাওয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সাফল্য কম নয়!
কূটনৈতিক সাফল্য যেটুকু দেখানোর তা আমাদের সাবেক রাষ্ট্রদূত টোকিওতে দেখিয়ে এসেছেন। তাঁর সাফল্যের কথা জাপানি পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্তাদের চেয়ে ঢের বেশি জানেন সে দেশের এক বা একাধিক নারী। কী সুন্দর দেশ। কী অপরূপ চেরি ফুল। ওই অপরূপ পরিবেশে হাতের নাগালে যে যুবতীকে পাওয়া যায় তার গায়ে হাত দেওয়ার সাধ কার না হয়? ওই যে কবি বলেছেন: ফুলের বনে যার পাশে যায় তারেই লাগে ভালো। 
লম্পট প্রকৃতির দুলাভাই নির্জন পুকুরের পাড়ে বা ঝোপঝাড়ের আড়ালে শালীকে হাতটা ধরে বলতে পারে, ‘তোমার বুবুর চেয়ে তুমি সুন্দর। কাছে আসো।’ ডাগর শ্যালিকা তার বাবার কাছে নালিশ নাও করতে পারে চক্ষুলজ্জায়। শুধু বোনকে সাবধান করে দেবে, ‘বুবু, তোমার জামাই কেমন জানি। চোখে চোখে রাখবা।’ কিন্তু বিদেশি যুবতীকে কোনো কূটনীতিক অশোভন প্রস্তাব দিলে তিনি নীরবে হজম করবেন না। এসব ক্ষেত্রে দুনিয়ার মানুষ দেখতে চায়, দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
যে দেশে খুনখারাবি, অপহরণের শাস্তি হয় না, সেখানে অর্থ আত্মসাৎ বা লুচ্চামি তো নস্যি। রাষ্ট্রযন্ত্র মানুষ না, কিন্তু তারও একটি নৈতিক মান থাকতে হয়। জোট সরকারের আমলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছিল জঙ্গি মৌলবাদের কারণে। এখন ভাবমূর্তি চূর্ণ হচ্ছে দুর্নীতি ও লাম্পট্যের ঘটনায়। কাঠমান্ডু থেকে টোকিও পর্যন্ত বাংলাদেশের বদনাম। টোকিওতে অনেক দিন থেকে কোনো রাষ্ট্রদূত নেই। 
টোকিওর মেহমান যাওয়ার বেলায় যা বলে গেছেন, তাতে দেশের মানুষ মনে করে তাঁর না আসাই ভালো ছিল। কর্তাদের দুর্নীতির খাসলত না বদলালে তাঁরা কোনো অনুদান ও ঋণ দেবেন না। বলেছেন আগে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ফয়সালা না হলে তাঁরা পদ্মা সেতুতে একটি পয়সাও দেবেন না। 
ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম বর্ষের দুই দেশের যৌথ অনুষ্ঠানমালার সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ সম্মানিত অতিথি হয়ে। তাঁর আসার দিনক্ষণ ১৫১ বছর আগেই রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতা ঠিক করে দেন, শুধু কাগজপত্রের আনুষ্ঠানিকতাটুকু করেছেন আমাদের পররাষ্ট্র ও ভারতের বিদেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তবে তিনি যে উপলক্ষেই আসুন না কেন, তাকে তিনি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপারেও কাজে লাগিয়েছেন। তিনি উপলক্ষকে কাজে লাগাবেন তাঁর দেশের স্বার্থে। বাংলাদেশের নেতারা যদি বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারতেন, সেটাই হতো তাঁদের ‘কূটনৈতিক সাফল্য’।
পশ্চিমবঙ্গের কাগজগুলোর ভাষায়, প্রণব মুখার্জি ‘শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু’। শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক অন্তরঙ্গ। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক যদি দুই দেশের জনগণের স্বার্থে ও কল্যাণে ব্যবহার করা যায়, তা হলে তার মূল্য খুব বেশি। যদি বন্ধুত্বটা শুধু পারিবারিক ও ব্যক্তিপর্যায়েই গভীর থাকে, তাহলে তাতে দেশের মানুষের কিছু আসে-যায় না।
প্রণববাবু প্রাজ্ঞ মানুষ। রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ। তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে জানি অনেক দিন থেকে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও প্রাজ্ঞ। তিনি রাজনীতি থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সমান দক্ষ। তাঁর খালি গায়ে মন্দিরে বসে চণ্ডীপাঠের দৃশ্য আমি মিডিয়ায় দেখেছি। তাঁর বাবা কামদাকিঙ্কর মুখার্জি গান্ধীজির অসহযোগের সময় থেকে কংগ্রেসের রাজনীতি করেছেন। তাঁর পুত্রও পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এসেছেন।
প্রণব মুখার্জি শুরুতে কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন। বহু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সাফল্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ভারতের মতো একটি বৃহৎ উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশে তিনি প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানও ছিলেন। তিনি একজন লেখকও। কংগ্রেস দলের বহু ইতিহাস আমার ঘরে রয়েছে, কিন্তু যখনই অবিভক্ত ভারতের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ইতিহাসের কোনো তথ্যের প্রয়োজন হয় আমি তাঁর সাগা অব স্ট্রাগল অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস দেখে থাকি। ভারতীয় অর্থনীতির বহুমাত্রিকতা জানতে তাঁর বিয়ন্ড সারভাইভ্যাল অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত সহজ ভাষায় তিনি প্রকাশ করতে পারেন। এ ধরনের বিদগ্ধ ও অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে পূর্বপ্রস্তুতি থাকা দরকার।
অকৃতজ্ঞ কেউ যেমন অতি নিম্নশ্রেণীর মানুষ, তেমনি উপকারীর কোনো উপকারকে অব্যাহত বলতে থাকলে ব্যক্তিত্বহীনতার প্রকাশ ঘটে। এবং তা করলে উপকারী ও উপকৃতের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয় না। আমাদের নেতারা অনবরত ভারতের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের কথা বলে থাকেন। সবার জানা একটি ঐতিহাসিক সত্যকে অব্যাহত বলা হীনম্মন্যতার পরিচয়। ‘শ্রী’ কথাটি ভারতের জাতীয় সম্বোধন। এবং একটি ‘শ্রী’তেই কাজ চলে। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী প্রমুখ বারবার ‘শ্রীশ্রী প্রণব মুখার্জি’ বলতে থাকলে কানে ভালো শোনাল না। বাংলাদেশের কারও নামের আগে জনাব বা শ্রী কোনোটাই না বলায় কেমন খালি খালি ঠেকল। অবশ্য রামেন্দু মজুমদার জনাব সম্বোধন করেছেন।
যে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবর্ষে আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রীরা ‘শ্রীশ্রী’ বললেন, সেই রবীন্দ্রনাথকে মুসলমানপ্রধান এলাকায় ‘জনাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ সম্বোধন করা হয়েছে। ‘জনাব জওহরলাল নেহরু’ বলেও সম্বোধন করা হয়েছে। তাতে তাঁদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগেনি। তাঁরাও অন্যদের জনাব সম্বোধন করেছেন। ড. মনমোহন সিংকেও আমাদের মন্ত্রীদের জনাব সম্বোধন করতে আমি নিজে শুনেছি। সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রণব মুখার্জির ভাষণটি ছিল সুলিখিত ও সংযত। আমাদের বক্তাদের মধ্যে একটা বিগলিত তোষামোদীর ভাব প্রকাশ পেয়েছে। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ—প্রদেশ নয়। স্বকীয় সংস্কৃতি ছাড়া স্বাধীনতা অর্থহীন।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে, সে সবের সুরাহা সংক্রান্ত কোনো সুখবর জানা না গেলেও, কলকাতার সংবাদপত্র থেকে জানা গেল:
‘বরাবরই তিনি স্বল্পভোজী। বিদেশে গেলে তো আরও। কিন্তু সেই নিয়ম ভাঙতে হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “শাসনে”। এত ব্যস্ততার মধ্যেও রোববার ঢাকায় নিজ হাতে পায়েস রান্না করেছিলেন পুরোনো পারিবারিক বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্য। দুই বাটি খেয়েছেন প্রণব। কিন্তু মিষ্টি খেতে তো তিনি ভালোই বাসেন। তদুপরি চার রকমের মাছ খেতে হয়েছে তাঁকে। রুই মাছের কালিয়া, তেল কই, চিতল মাছের বিরাট পেটি, চুনোমাছের ঝাল আর গলদা চিংড়ি। একসঙ্গে এত কী করে সামলালেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী? তাঁর ভাষায়, ‘কী করব! সামনে রীতিমতো ছড়ি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তো হাসিনা। না খেয়ে উঠতে দিলেন না।’...রোববার রবীন্দ্রসদনে [ভুল] বক্তৃতা দিতে উঠে অন্তত দুবার প্রণববাবুকে ‘বাংলাদেশের পরম বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন শেখ হাসিনা। ...দিল্লি থেকে আমসহ বিভিন্ন উপহার নিয়ে গিয়েছেন প্রণব। তাঁর হাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর জন্য উপহার পাঠিয়েছেন শেখ হাসিনা। ওই উপহারের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের বিখ্যাত বিপণির শাড়িও।’
মুখার্জি মহাশয় বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন। সফরসূচি তৈরিতে শুধু বাংলাদেশ সরকারের হাত থাকলে নিশ্চয়ই এই সাক্ষাৎ হতো না। খালেদার সঙ্গে মুখার্জির পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব না থাকলেও তাঁদের সঙ্গে জানাশোনা বহুদিনের। বিরোধীদলীয় নেত্রী ভারতীয় অতিথিকে বগুড়ার দই বা নাটোরের কাঁচাগোল্লা দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন কি না জানা যায়নি। এমনও হতে পারে, শেখ হাসিনার বাড়িতে অত গুরুপাক খাদ্যে অতিভোজনের পর তাঁর আর কিছু মুখে দেওয়া সম্ভব ছিল না। সেটা বিবেচনা করেই বেগম জিয়া টোস্ট বিস্কুট অথবা পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ সরষে তেল দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে চা দিয়ে খাতির করে থাকবেন।
তবে কি খেলেন বা পেলেন, তারচেয়ে বড় কথা তাঁরা খোলামেলা আলোচনা করেছেন মাতৃভাষায়। ভারতের নেতা বলেছেন, কোনো একটি বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায় ভারত। খালেদা বলেছেন, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ওবাড়িতে দুই বাটি পায়েস, চিতলের পেটি, গলদা, রুই প্রভৃতি থালায় নিয়ে যে বিরক্তিকর প্রসঙ্গ ওঠেনি, এবাড়িতে সেই তিস্তা ও টিপাই নিয়ে কথা হয়েছে। দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক খুবই চমৎকার। তবে ভারত-বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মধ্যে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, তা যদি দুটি দেশের মধ্যে হতো, তা হলে এ দেশের হতভাগ্য জনগণ হতে পারত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মা একই সময় ঢাকায় ছিলেন। তাঁকে কী কী বঙ্গীয় খাদ্যে ভূরিভোজ করানো হয়েছে সে খবর আমেরিকার কাগজে বের হয়নি। বিশ্ববিধাতা কোটি কোটি বছর ছিলেন একজন। ১৯৯০ থেকে দুইজন। একজন আকাশে—আর একজন মাটিতে। মাটির বিশ্ববিধাতার নিজস্ব পাটিগণিত আছে। যাদববাবুর পাটিগণিতের সঙ্গে তাঁর পাটিগণিতের মিল নেই। তাঁর পাটিগণিতের অঙ্কের হিসাব আলাদা। তাঁর পাটিগণিত তাঁর পলিসি। তাঁদের গ্রহটির প্রতি বর্গইঞ্চি জায়গায় কোন মুহূর্তে কী হচ্ছে তা তাঁদের নখদর্পণে। এবং তাঁদের স্বার্থে কী হতে হবে, তার নীলনকশা তাঁদের নোটবইয়ে টোকা আছে। তাদের আকাঙ্ক্ষাই মুখ্য। কোন ভূখণ্ডের জনগণ কী চায় তা গৌণ। গৌণ বললে ঠিক হবে না, তার কোনো মূল্যই নেই।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মা বলে গেছেন, ‘বাংলাদেশ অনেক পথ পাড়ি দেবে, সঙ্গী হবে যুক্তরাষ্ট্র।’ সেই পথটা যদি চীন, ভেনেজুয়েলা বা কিউবা পর্যন্ত হয়, তা হলে এক কথা। যদি আফগানিস্তান, ইরাক বা লিবিয়ায় তার পিছে পিছে পাড়ি দিতে হয়, তা হলে অন্য কথা। বড় মার মুখের ম্লান হাসির অর্থ বাংলার মানুষ কিছুটা বোঝে।
অভাগিনী বাংলা মায়ের সামান্য ধন, কিন্তু তার কাছে বড় মা ও বড়দাদের দাবি কত? তবু বলব, অতিথি নারায়ণ।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

সোমবার, ৭ মে, ২০১২

প্রেমিকের দাঁত

প্রেম-বন্ধুত্ব কোনো স্বার্থনিরপেক্ষ চিরস্থায়ী বিষয় নয়। তা সে বন্ধুত্ব নর-নারীর মধ্যেই হোক বা এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের হোক বা জনগণের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের হোক। বন্ধুত্ব বিষয়টিই এ রকম যে—যদি তুমি আমার সঙ্গে থাকো তো তোমাকে আমি আমার কোলে তুলে নেব। যদি না থাকো, বিরুদ্ধে যাও অথবা এর-ওর সঙ্গে মাখামাখি করো, তাহলে তোমার সবগুলো দাঁত তুলে নেব।
এ ব্যাপারে একেবারে ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পোল্যান্ডের এক নারী গত হপ্তায়। তাঁর বাড়তি সুবিধা ছিল এই যে তিনি একজন দাঁতের ডাক্তার। অর্থাৎ প্রতারক বন্ধুকে শায়েস্তা করার অস্ত্র—দাঁত তোলার অস্ত্রপাতি—তাঁর নিজেরই ছিল। অন্য কোনো ডেন্টিস্টকে অতিরিক্ত ফি দিয়ে নিয়োগ করতে হয়নি।
বাঙালি রেগে গেলে বলে, ‘এক থাপ্পড়ে তোর বত্রিশ পাটি দাঁত ফেলে দেব।’ পোল্যান্ডের প্রেমিকা থাপড় দিয়ে ফেলেননি, প্রেমিককে অজ্ঞান করে যন্ত্র দিয়ে টেনে তুলেছেন তাঁর ৩২টি দাঁত। 
দন্ত চিকিৎসক আন্না বন্ধুত্ব বা ভালোবাসাবাসি করেছিলেন ওলসেঙ্কির সঙ্গে। তলে তলে ওলসেঙ্কি আরেক নারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতান। সেটা টের পান আন্না। এর মধ্যে দাঁতের সমস্যা নিয়ে আন্নার চেম্বারেই যান ওলসেঙ্কি। আন্না মনে মনে বলেন, এবার পেয়েছি তোমাকে। আরেক মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করার মজা দেখাচ্ছি। বললেন, শুয়ে পড়ো চেয়ারে। টোকাটুকি করে দাঁত পরীক্ষা করতে করতেই প্রয়োগ করেন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন চেতনানাশক ইনজেকশন। তারপর তিনি নির্বিঘ্নে বন্ধুর ৩২টি দাঁতই তুলে ফেলেন। 
ঘোর কাটার পর ওলসেঙ্কি বুঝতে পারেন, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। মুখের ভেতরটা খালি খালি লাগে। ওপরে ব্যান্ডেজ। তাকে সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে না। সে ভালো ডাক্তার। কিন্তু হায় আল্লাহ, সে এমন নিষ্ঠুরতা করতে পারল!
ব্যাপারটা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অপরাধ প্রমাণিত হয়। আন্না আদালতের কাঠগড়ায় বলেন, জানি কাজটি ঠিক হয়নি। কিন্তু লোকটা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তাই নিজেকে সামাল দিতে পারিনি। সবগুলো দাঁত তুলে ফেলেছি। এবার নতুন বন্ধুর সঙ্গে দাঁত কেলিয়ে হাসাহসি করুক।
দাঁত তোলা ডাক্তারনীর তিন বছরের জেল হয়েছে। কিন্তু ট্র্যাজেডি হলো, ওলসেঙ্কির নতুন মেয়েবন্ধুটিও তাকে ছেড়ে পালিয়েছে। দাঁতও গেল, নতুন বন্ধুও গেল। খবরটি ডেইলি মেইল-এর।
প্রতারণা এমন এক প্রবৃত্তি যা থেকে প্রতিহিংসার জন্ম। প্রতিহিংসায় কোনো পক্ষই লাভবান হয় না। ব্যক্তিগত জীবনেও নয়, রাজনীতিতেও নয়।
কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে তা হিসাব করে করা ভালো। বিচার-বিবেচনা করে সততার সঙ্গে করা ভালো। স্বার্থের জন্য বন্ধুত্বের অভিনয় করলে তার পরিণাম শুভ হয় না। তা সাধারণ নর-নারীর জন্য যেমন প্রযোজ্য, রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রযোজ্য। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। বন্ধুত্বের নামে, পার্টনারশিপ বা অংশীদারির নামে এক বন্ধু যদি অপর বন্ধুর পনের আনা সম্পদের অংশের ভাগ চায় এবং তা না দিলেই দন্ত উৎপাটন করে, তা কোনো বন্ধুত্ব নয়।
ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা স্বার্থের কারণে কখনো একজন নিজেকে উজাড় করে দিতে পারে। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের মালিকানা যৌথভাবে জনগণের। বন্ধুত্বের নামে, ব্যক্তিস্বার্থে অর্থাৎ ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সবকিছু উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা হলে জনগণ মনে করে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। 
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বহু দেশ আমেরিকা ও পশ্চিমী পুঁজিবাদী দেশগুলোর সহায়তায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে। একপর্যায়ে কোনো কোনো দেশের নেতা সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়েন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে। তা ছিল প্রতারণা। আফ্রিকার অনেক দেশে এমন হয়েছে। আমাদের অঞ্চলেও ঘটেছে। 
রাজনীতি এক ভয়ংকর খেলা। নেতাদের উচিত সবার সঙ্গেই খুব সাবধানে প্রেম ও পার্টনারশিপ করা। প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা না থাকলে সবগুলো দাঁত রক্ষা করা কঠিন।
গণতন্ত্র একধরনের বন্ধুত্ব। জনগণের সঙ্গে জনপ্রিয় নেতাদের বন্ধুত্ব। তা নর-নারীর প্রণয়ের মতোই আবেগী ব্যাপার। প্রেমিকের সব দাঁত তুলে ফেলা মানে তার মুখের সৌন্দর্য হারানো। রাজনীতিতে নেতাদের দাঁত তোলা মানে ক্ষমতা হারানো। যদি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে তাহলে দাঁত তোলার কাজটা তারা করে ভোটের সময়। যদি সে সুযোগ না থাকে, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন না করা যায়, তাহলে আরব বসন্ত। স্বৈরাচারী শাসকের দাঁত ওভাবেই জনগণ তোলে। 
জনগণ যদি দেখে তাদের বন্ধু তাদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের সঙ্গে মাখামাখি করছে, তখন তারা মনে করে তারা প্রতারিত হয়েছে। ফলে জনগণ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়। তারা নেতাদের সব দাঁত তুলে ফেলতে দ্বিধা করে না। 
ব্যক্তিগত জীবনে ও রাজনীতিতে সবচেয়ে নিরাপদ ও উত্তম পন্থা হলো কারও সঙ্গেই অতিরিক্ত প্রেমে জড়িয়ে না পড়া এবং প্রতারণা না করা। বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গেও নয়, দেশের বন্ধু অর্থাৎ জনগণের সঙ্গেও নয়। প্রতারণার পরিণাম পাঁচ-সাতটি নয়—সবগুলো দাঁত খোয়ানো।

সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।