সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১২

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব

রাজনীতি একটি পেশা। তবে রাজনীতিকের পেশাটি একজন তাঁতির পেশার মতো নয়, কর্মকারের পেশার মতো নয়, সুতার-মিস্ত্রি বা ডাক্তার-কবিরাজের পেশার মতো নয়। শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার পেশার মতোও নয় রাজনীতি। একজন তাঁতিকে উপার্জনের জন্য বসে বসে কাপড় বুনতে হয়। কর্মকারকে হাপরে লোহা গলিয়ে দা-বঁটি-খোন্তা-কুড়াল তৈরি করতে হয়। মিস্ত্রি দরজা-জানালা-আসবাবপত্র বানান। ডাক্তার-কবিরাজ রোগীর রোগ নির্ণয় করে ওষুধ দিয়ে তাকে আরোগ্য করেন। এসব কাজের জন্য তাঁরা মজুরি বা ফি পান। 
রাজনীতি একটি অন্য রকম পেশা। পেশা বটে, কিন্তু জীবিকা নয়। রাজনীতি সেবামূলক পেশা। কামার-কুমার-জেলে-তাঁতি যেমন প্রতিদিন জীবিকার জন্য কামাই করেন, রাজনীতির সঙ্গে জীবিকা অর্জনের সম্পর্ক নেই। একসময় তাই ছিল। এখন অবশ্য রাজনীতি শুধু জীবিকা নয়, জীবিকার বাবা। উপার্জনের দিক থেকে আজ একজন মধ্যমশ্রেণীর রাজনীতিকের কাছে একজন মাঝারি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী কিছুই না। শিল্পপতির লোকসানের ভয় আছে, রাজনীতিকের সে শঙ্কা লেশমাত্র নেই। 
প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক যুগের নেতৃত্ব থেকে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেতারা বিদেশি শাসকদের কাছে চাইতেন কিছুটা ক্ষমতার ভাগ; আর জনগণের কাছে চাইতেন আনুগত্য। ওই ব্যবস্থায় জনগণ নেতাদের আনুগত্য প্রদর্শন করে নিজেদের ধন্য মনে করত, অন্যদিকে আনুগত্য প্রদর্শন না করেও উপায় ছিল না। নেতাদের অনেকের লক্ষ্য ছিল বড় লাটের কাউন্সিলে মেম্বার বা মন্ত্রিত্ব-জাতীয় কিছু পাওয়া—অর্থ উপার্জন নয়। বরং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্মান-মর্যাদা অর্জন করতে ‘তাঁরা’ অকাতরে নিজের অর্থ ব্যয় করতেন। 
কংগ্রেসের প্রথম দিকের নেতারা সামন্ততান্ত্রিক নেতা ছিলেন। দাদাভাই নওরোজি, গোপালকৃষ্ণ গোখেল, বদরুদ্দিন তাইয়েবজি, ফিরোজশাহ্ মেহ্তা, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, রহিমতুল্লাহ সয়ানি, আনন্দমোহন বসু, মদনমোহন মালব্য, নবাব বাহাদুর সৈয়দ মোহাম্মদ, হাসান ইমাম, মতিলাল নেহরু প্রমুখ ছিলেন সামন্ত-পরিবারের মানুষ। কেউ বিরাট ধনী, কেউ বিখ্যাত ব্যারিস্টার, কেউ জমিদার-জায়গিরদার, কেউ পত্রিকার মালিক, বড় ব্যবসায়ী অথবা অভিজাত পরিবারের মানুষ। তাঁদের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সামান্য, শাসকদের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠতর। মহাত্মা হওয়ার আগে গান্ধীজির মতো মানবাধিকার আইনজীবীকে ফিরোজশাহ মেহ্তার সঙ্গেও দেখা করতে বেগ পেতে হয়েছে। তারপরও কংগ্রেসের ভেতরে ভিন্নমত প্রকাশের একটা পরিবেশ ছিল।
মুসলিম লিগের নেতৃত্বও ছিল একই রকম সামন্ততান্ত্রিক। কেউ নবাব বাহাদুর, কেউ সামন্তভূস্বামী, কেউ বা বড় আইনজীবী-শিল্পপতি। তবে লিগে ভিন্নমত নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আলোচনার সুযোগ ছিল না। নেতার মতই শিরোধার্য।
সেকালের রাজনৈতিক নেতারা জেলা বোর্ড বা মিউনিসিপ্যালিটিতে নির্বাচন করা দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু করতেন। তারপর কেউ যেতেন কাউন্সিলে, কেউ হতেন মন্ত্রী।
পরাধীন দেশের নেতাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশকে ধীরে ধীরে স্বশাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া। বড় জোর মন্ত্রী পর্যন্ত হওয়া যাবে, কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। সেকালে মন্ত্রিত্ব ছিল জনসেবামূলক চাকরির মতো। তবে নেতারা জনগণের কিছু দাবিদাওয়া সরকারকে দিয়ে পূরণ করাতে চেষ্টা করতেন।
সব রাজনৈতিক নেতা জননেতা নন, কিন্তু সব জননেতাই রাজনৈতিক নেতাও। জননেতারা মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধী ভারতীয়দের অধিকার আদায়ের জন্য অহিংস সত্যাগ্রহ বা সংগ্রাম করেছেন। মওলানা ভাসানী আসামে লাইন প্রথার বিরুদ্ধে এবং বাঙাল-খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে জননেতায় পরিণত হন। বিদেশি শাসকদের বিতাড়িত করার আন্দোলন করে সুভাষচন্দ্র বসু নেতাজি হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে কিংবদন্তিতে পরিণত হন। ক্ষমতায় বসা তাঁর লক্ষ্য ছিল না। মার্টিন লুথার কিং কালোদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জননায়কে পরিণত হন এবং জীবন উৎসর্গ করেন। নিজে ক্ষমতায় যেতে চাননি, কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয় বারাক হোসেইন ওবামার মাধ্যমে। মিয়ানমারে সু চি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। সে কারণে তিনি জননেতা। আপস করলে অনেক আগে মন্ত্রী হতেন। 
সামরিক শাসন সাংবিধানিক শাসন নয়—কয়েকজন সেনাপতির খেয়ালখুশির শাসন। কিন্তু রাষ্ট্রে যদি গণতন্ত্র থাকে, তা হলে যেকোনো পেশার মানুষ জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে পারে। অবসর নিয়ে কোনো সেনাকর্মকর্তাও নির্বাচিত হতে পারেন। পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো দুটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সে দৃষ্টান্ত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার ছিলেন জনপ্রিয় মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের একজন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গল ছিলেন অতি জনপ্রিয় ও সম্মানিত। আইয়ুব খানসহ কোনো সামরিক একনায়কই যত দক্ষ শাসনকর্তাই হোন, জননেতা হতে পারেননি।
গণতন্ত্রের সুবিধা ব্যবহার করে লিগ নেতারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সামন্ত নেতৃত্ব মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেন। অ-সামন্তবাদী গণতন্ত্রপন্থী নেতারা লিগ থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে ১৯৫০-এ জমিদারি প্রথাও বাতিল হয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটলেও, কৃষক জমির মালিকানা পেলেও, তাঁর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা হলেও, সমাজব্যবস্থা থেকে যায় আধা সামন্ততান্ত্রিক। যাঁর ক্ষমতা বেশি ও যাঁর বিত্ত বেশি, তাঁর কাছে নতজানু হওয়া সামন্ততান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য।
জনগণের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলো। জনগণের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখা দিল। কিন্তু সম্ভাবনাটি ফলপ্রসূ হলো না। গণতন্ত্রের বিরতিহীন চর্চা ছাড়া, নানা মতাদর্শের সমন্বয় ও সহ-অবস্থান ছাড়া জনগণের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে নতুন নেতৃত্ব তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু উগ্র পন্থা গ্রহণ করায় তাঁরা সে সুযোগ নস্যাৎ করে দেন। বেসামরিক সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব থেকে দেশ সামরিক একনায়কী নেতৃত্বে চলে যায়।
চতুর্থ সংশোধনীর পর গণতন্ত্র চর্চার পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তারও আগে ১৯৭৩- দেশের ছোট-মাঝারি দলের নেতারা উপলব্ধি করেন, নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো দন তাঁরা ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। তখন তাঁদের সামনে খোলা ছিল তিনটি পথের যেকোনো একটি: বাকশালে যোগ দেওয়া, রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া এবং কোনো অনাগত অসাংবিধানিক সরকারকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া। সবচেয়ে সুবিধাজনক বলে তাঁরা শেষটি বেছে নেন।
তাঁরা মোশতাক-জিয়া সরকারকে সঙ্গে সঙ্গেই সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৭৯-তে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল তাঁদের গণতান্ত্রিক উপায়ে আকাঙ্ক্ষা পূরণের শেষ ধাপ। ওই নির্বাচনে সদ্যজাত বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। দ্বিতীয় স্থানে আওয়ামী লীগ পায় ৩৯, মুসলিম লীগ—যা বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল—পায় ১২টি, জাসদ আটটি, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (যা ছদ্মবেশী জামায়াত) পায় আটটি, সাম্যবাদী দল, ন্যাপ (মোজাফ্ফর), একতা পার্টি প্রভৃতি দলের নেতারাও নির্বাচিত হন। সামরিক শাসক জিয়া তাঁদের এই সুযোগটা দেন, আওয়ামী লীগ থেকে তাঁরা যা কোনো দিন পেতেন না। জিয়ার কাছ থেকে ওই করুণাটুকু পাওয়ার ফলে অনেকেই সরকারে গেলেন কিন্তু জনগণের নেতা হওয়ার সুযোগটা হারালেন।
শুধু ছোট দলের নেতাদের দোষ দেওয়া যাবে না। বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী প্রথিতযশারা সামরিক একনায়ককে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এক লেখায় ঠিকই বলেছেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার সামরিক পরিচয় ঘুচে গিয়েছিল, জনগণের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ মিলছিল এবং সে কারণে তিনি তাঁকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যান। সেখানে তিনি ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে খাল খনন করেন বা মাটি-টাটি কাটেন।
সামরিক একনায়কেরা নানাভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আইয়ুবের মতো জিয়াও শিল্পী-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠী প্রযোজিত সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় কোরিয়ায় পাঠাতে প্রেসিডেন্ট জিয়া শুধু অর্থ অনুদান নয়, শিল্পী ও কলাকুশলীদের বিমানে ফ্রি টিকিটের ব্যবস্থা করে দেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকটি তিনি নিজে বেইলি রোডে গিয়ে উপভোগ করেন। তাতে তিনি সংস্কৃতিসেবীদের কৃতজ্ঞতাভাজন হন। প্রেসিডেন্ট এরশাদও শিল্পী-সাহিত্যিকদের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
এসবের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার পথ কণ্টকাকীর্ণ হয়। সামন্ততান্ত্রিক ধরনের নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্যতা পায়। ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনের ভার এখন দুই পরিবারের হাতে চলে গেছে। গত ১৬-১৭ মার্চ দিল্লিতে ইন্ডিয়া টুডে আয়োজিত একান্ত বৈঠকে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা সজীব ওয়াজেদ জয় যথার্থই বলেছেন: ‘উই হ্যাভ টু পলিটিক্যাল ডায়নেস্টিজ ইন আওয়ার কান্ট্রি। ওয়ান ইজ মাই ফ্যামিলি। দ্য আদার ওয়াজ ফাউন্ডেড বাই আওয়ার ফার্স্ট মিলিটারি ডিকটেটর।’ জনাব তারেকও সম্ভবত একই কথা বলবেন।
পারিবারিক বংশপরম্পরার শাসন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। পারিবারিক সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব যত যোগ্যই হোক, মানবকল্যাণে মাদার তেরেসার মতো ব্রতী হোক, তাঁকে জনগণের নেতা বলা যাবে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দলের নেতারা শীর্ষনেতার সহকর্মী। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্বে তাঁরা সহকর্মী নন, অধীনস্ত কর্মচারী বা হুকুমবর্দার।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ধারায় দল নয়, ডায়নেস্টি প্রধান। প্রবীণ নেতা আবদুল জলিলসহ অনেকেই এখন প্রকাশ্যে বলছেন, দলের ভেতরে কথা বললে বিপদ। তবে অসাবধানতাবশত একটি কথা তিনি স্বীকার করেছেন, একক সর্বময় নেতৃত্ব সৃষ্টিতে তাঁরা কয়েকজন সংস্কারপন্থীই প্রধান ভূমিকা পালন করেন। শুধু তাঁরা নন, কিছু প্রথিতযশা বিভিন্নজীবী ও নীতিবিদদের ভূমিকা আরও বেশি। 
গণতন্ত্র একটি ডিসকোর্স বা বিতর্ক ও চিন্তাশীল বিচার-বিশ্লেষণের বিষয়—ওপর থেকে কারও চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস নয়। কোনো প্রশ্নে ভিন্নমত পোষণ করে বিরোধিতা করা আর শ্রদ্ধাহীনতা এক কথা নয়। নেতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আনুগত্য রেখেও ভিন্নমত দেওয়া যায়। 
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাবে জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তা-ই বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারেন জননেতারা—প্রচলিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়। 
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভার শুধু নির্বাচন কমিশনের নয়। তার কাজ এক দিনেই শেষ। গণতন্ত্র শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন নয়, শুধু নেতার শাসন নয়, সবার শাসন। ছোট-বড় সব দলের অনির্বাচিত নেতাদের মতামতের মূল্য দিতে হয়। দক্ষ ও মেধাবী আমলা ও কূটনীতিকদের ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। সুযোগ্য ও সৎ সামরিক কর্মকর্তাদের কাজে লাগাতে হয়। সব পেশাজীবী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ব্যবসায়ী, শিল্পপতির পরামর্শ ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। অতি অল্পসংখ্যক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতার দাবিও গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হয়। সেসব সমন্বয় করতে পারেন শুধু একজন জননেতা—সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্বের পক্ষে তা সম্ভব নয়। 
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১২

চশমা, চটিজুতা ও ছাতা হারিয়ে কী পেলাম?



সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ১৩-১০-২০০৯
বিপুল ভোটারের অংশগ্রহণে ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাতে আমারও অবদান রয়েছে। বলতে লজ্জা নেই, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আমি খুইয়েছি আমার একটি চশমা, দেড় জোড়া চটিজুতা (এক জনসভায় এক জোড়া চুরি হয়, আরেক জনসভায় মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিয়ে নেমে দেখি এক পাটি নেই) এবং একটি ছাতা।
একবার এক জনসভায় পূর্ববর্তী বক্তার অফুরন্ত কথা শেষ হওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। ‘এই ধরনের গণতন্ত্র আমরা ছুড়ে ফেলে দিই’—বলেই উত্তেজিত অনলবর্শী বক্তা এমনভাবে বাহু উত্তোলিত বা প্রসারিত করলেন যে তাঁর হাত লেগে আমার চশমাটি ছিটকে গিয়ে পড়ল মঞ্চ থেকে ১০ হাত দূরে। এক শ্রোতা তত্ক্ষণাত্ ওটা উদ্ধার করল বটে, কিন্তু অক্ষত অবস্থায় নয়। এক মতবিনিময় সভায় গণতন্ত্রের একটা বিহিত করে বাড়ি ফেরার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে দেখি ছাতাটা নেই।
জুতা, ছাতা যা-ই হারাই না কেন, বাস্তবতা ও সত্য হলো সাধারণ সচেতন মানুষের মধ্যে গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেই আকাঙ্ক্ষার সপক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে গত পাঁচ-ছয় বছরে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল, সেমিনার, মতবিনিময় অনুষ্ঠান করেছে। তাতে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ যুক্ত ছিলেন। তবে অবসরপ্রাপ্তদের সংখ্যা ছিল আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। তাঁদের সম্মিলিত নামকরণ সিভিল সমাজ। ভাষাজ্ঞানহীন কেউ তার বঙ্গানুবাদ করেছিল সুশীল সমাজ। গণতন্ত্রের প্রবক্তা সেই নাগরিক সমাজের প্রধান চরিত্রগুলোর চারিত্রিক সংহতি অর্থাত্ তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও সততা নিয়ে মানুষের সন্দেহ ছিল। সন্দেহের কারণও ছিল বটে। কোনো দিন তাঁদের কিছু ত্যাগ করতে দেখেনি কেউ। আমাদের দেশে সামরিক-বেসামরিক আমলা, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি শ্রেণীর কাছে বড় থেকে বৃহত্তর চাকরিই জীবনের ধ্রুবতারা। সেদিকে তাকিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয় তাঁদের জীবনের গতি। তাঁদের কাছে একটি উঁচু বেতনের চাকরি পাওয়ার যে সুখ তার কাছে ম্লান প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গী হয়ে কোনো নির্জন হ্রদে নৌবিহার করা অথবা শিল্পা শেঠীকে নিয়ে জোছনারাতে সাগরসৈকতে ঘুরে বেড়ানো কিংবা মাধুরী দীক্ষিতের মায়াবী হাসির সামনে মুখোমুখি নির্জনে বসে থাকা।
কথিত সিভিল সোসাইটির একজন মানুষ হিসেবে আমি মাঝেমধ্যে গ্লানি বোধ করি। প্রথম যৌবনে আমরা অনেকেই অর্থকষ্ট ভোগ করেছি। এক জোড়া স্যান্ডেল ও দুটোর বেশি শার্ট ছিল না। পরে যত ভালো চাকরিই করি না কেন এবং দুটো গাড়ি থাকলেও আরও বেশির জন্য প্রাণ কাঁদে। পুরোনো মডেলের টয়োটায় মন ভরে না—নিজেরও না, গিন্নি-ছেলেমেয়েদের মন তো ওঠেই না। তাই পেনশনের অনেকগুলো টাকাসহ অবসরে গিয়েও কনসালটেন্সি বা একটি চাকরির জন্য উমেদারি করি, এনজিও গড়ে তুলি। তারপর সামাজিক অবস্থান মজবুত করতে দেশকে গণতন্ত্র উপহার দেওয়ার জন্য গোলটেবিলের আয়োজন করি এবং গণতন্ত্রের সভা থেকেই একেবারে সোজা বিমানবন্দর উড়োজাহাজ যেদিকে নিয়ে যায়।
সমালোচনা হতেই পারে। তবু অস্বীকার করা যাবে না যে আমাদের নাগরিক সমাজের বহু দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তারা মূলধারার সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলোর সহযোগিতায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে কাজ রাজনীতিকদের করার কথা তা করেছে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ। তারা সরকারকে চাপে রেখেছে, বিরোধী দলকেও তাদের ভুলের জন্য সমালোচনা করেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অনেক দিন থেকেই বিদেশিরা যুক্ত হয়েছে—একসময় ছিল তলে তলে, অর্থাত্ নেপথ্যে, এখন প্রকাশ্যে। বিদেশিদের আমাদের রাজনীতির অন্দরমহলে নিয়ে যাওয়ার কাজটি রাজনীতিকেরাই তাঁদের স্বার্থে করেছেন, অন্য কেউ নয়। তারপর বিদেশিদের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থে বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল নাগরিক সমাজের নেতাদের। তবে বিদেশিরা নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে শুধু আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রই করে যাচ্ছে সকাল সাতটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত—সেটাও মনে করা খুবই হীনম্মন্যতা এবং সে কথা বড় বড় শিরোনাম দিয়ে প্রচার করা আরও ক্ষতিকর।
গত নির্বাচন সম্পর্কে আবদুল জলিল সাহেব লন্ডনে যা বলেছেন তা বহুকাল উদ্ধৃত হবে। তাঁর বক্তব্যের সত্যতা-অসত্যতা প্রমাণও চাট্টিখানি কাজ নয়। তবে তাঁর বক্তব্য মানসিক ভারসাম্যহীন একজন মানুষের প্রলাপ মাত্র—এ কথা যে মনে করে তারও মানসিক ভারসাম্য নিয়ে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। অন্যান্য বিষয়েও তিনি যা বলেছেন তা নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই, তা তাদের দলের নিজস্ব ব্যাপার। বিব্রত হলে দলীয় নেতৃত্ব হবেন, অন্য কেউ নয়।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার খুব একটা বাজে অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। সরকার হয়ে উঠেছিল উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর উদার পৃষ্ঠপোষক। দুর্নীতি পেয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। ওই পরিস্থিতিতে ২০০৩-০৪ সাল থেকে সুশাসন, নির্বাচনী সংস্কার, নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি প্রভৃতি প্রশ্নে ‘রাজনৈতিক সংস্কার’-এর একটা দাবি ওঠে। সে ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করতে কয়েকটি সংগঠনও দাঁড়িয়ে যায়। কার কী উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল তা তারা ও তাদের পৃষ্ঠপোষকেরাই ভালো বলতে পারবেন। কীভাবে যেন আমিও ওগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে যাই। দেখেছি নির্বাচনী সংস্কার ও সুশাসনের কথায় বিএনপি-জামায়াত বিরক্ত হলেও সাধারণ মানুষ তাকে স্বাগত জানিয়েছে।
২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন-পূর্ববর্তী সাড়ে চার বছর অনেকের সঙ্গে আমিও বান্দরবান থেকে বাংলাবান্ধা, কক্সবাজার থেকে কুড়িগ্রাম, সুন্দরবন থেকে সুনামগঞ্জ ঘুরে বেরিয়েছি। অন্তত ৩৫টি সংগঠনের আমন্ত্রণে চার শর মতো আলোচনা সভা, গোলটেবিল, মতবিনিময়, মানববন্ধন, শোভাযাত্রা প্রভৃতিতে অংশ নিয়েছি। বিষয় একটাই: সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। একটি পর্যায়ে সেই প্রক্রিয়ায় বাধা আসে। দোষ শুধু জোট সরকারকে দেওয়া যাবে না, চৌদ্দদলীয় বিরোধী মহাজোটেরও ছিল। অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ১১ জানুয়ারি একটি প্রেরিত সরকার ক্ষমতাসীন হয়। সেই সরকারের খোসাটি ছিল বেসামরিক কিন্তু পুরো শাঁস ও আঁটি পর্যন্ত ছিল সামরিক। হরতাল-অবরোধে ক্লান্ত জনগণ সেই সরকার আসায় সাময়িক স্বস্তি বোধ করে। তাদের দুর্নীতিবিরোধী তত্পরতাও সমর্থন করে। কিন্তু অবিলম্বেই সেই সরকারের প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ডে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের একটিমাত্র কৃতিত্ব, তা হলো একটি ভালো ভোটার তালিকা তৈরি। নির্বাচনও শান্তিপূর্ণ হয়। ভোট পড়ে কিছুটা মাত্রার বেশি। তার পরও দেশে ও বিদেশে ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বিজয় অপ্রত্যাশিত ছিল না। এত বেশি অর্থাত্ ২৬২ আসন ছিল অপ্রত্যাশিত। অন্যদিকে তাঁর সরকারের ওপর জনগণ বিরক্ত হলেও বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাও কম ছিল না। নির্বাচনের আগের জনসভাগুলো থেকে তা বোঝা যায়। নির্বাচনের ১০-১২ দিন আগে কয়েকজন বিদেশি পর্যবেক্ষক আমাকে বলেছিলেন, সরকার গঠন না করতে পারলেও বিএনপি ভালো আসনই পাবে বলে তাঁদের ধারণা। এত কম অর্থাত্ ২৯টি আসন কাম্য ছিল না জনগণের। সে কারণেই সন্দেহ। মানুষ লক্ষ করেছে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে বৈরিতামূলক এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ একটি প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন জেনারেল মইন উ আহমেদ। তাঁকে পুরস্কৃত করারও একটা পাঁয়তারা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি না হলেও জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি করার আয়োজন প্রায় সাঙ্গ হয়ে এসেছিল। অথচ নির্বাচিত সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বই ছিল দুবছরী অনির্বাচিত সরকারের কাজের ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ। সে প্রসঙ্গেই জলিল সাহেব বলেছেন, ওই সরকারের সঙ্গে মহাজোটের নেতার একটা বোঝাপড়া হয়েছিল।
পুরো দিনটি বদলের ঘোষণা দিয়ে এই সরকার জনগণের রায় নিয়েছে। বাস্তবে দিনের একটি প্রহরের যদি পরিবর্তন ঘটাতে পারত এই সরকার তা হলেই জনগণ খুশি হতো। পুরো মেয়াদের ছয় ভাগের এক ভাগ পার করেছে সরকার। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো সরকার এমন সুশান্ত ও সহানুভূতিশীল বিরোধী দল পায়নি, যা পেয়েছে বর্তমান সরকার। ১৪৯টি আসন পেলেও তারা সংসদে যেত না। বিএনপি তার মহাসচিবকে করেছে দলের মুখপাত্র—দলটি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মুখপাত্র হতে পারল না। অন্যদিকে সরকারের মুখপাত্র অসংখ্য।
প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেছেন, পৃথিবীতে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার রয়েছে বিভিন্ন দেশে, বাংলাদেশে পেয়েছি আমরা উপদেষ্টাশাসিত সরকার। চমকের মন্ত্রিসভার সদস্য ও উপদেষ্টারা চমক লাগানো কথাবার্তা বলছেন প্রথম রাত থেকেই, তাঁদের ও এমপিদের পুত্ররা পিলে চমকে দেওয়া শুরু করেছেন পরদিন থেকে। এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডের এলাকার মানুষ শুধু নয়, কথায় কথায় চমকে উঠছে সারা দেশের মানুষ।
মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়া বিরোধী দল গত ১০ মাসে সরকারকে বিব্রত করার মতো কিছু করেনি। কিন্তু মন্ত্রীদের অনেকের কথাবার্তার ভাবে সরকারের মূর্তি বিএনপির মেরুদণ্ডের মতো অনেকখানি চুর্ণ হয়ে গেছে। যাঁরা জনগণের সেবক, বিশেষ করে যাঁদের ওপর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়, তাঁদের কথাবার্তা হবে পাথরের মতো ভারী, শিমুল তুলার মতো হালকা নয়। পিলখানার বর্বরতা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও বিডিআরের ডিজি এত রকম পরস্পরবিরোধী কথা বলেছেন, তা দিয়ে একটি বই হতে পারে। বিচার কোন আইনে হবে—একেক দিন একেক কথা। বিডিআরের আটককৃত সদস্যরা শুধু ‘হার্ট অ্যাটাকে’ই মরতে লাগলেন। নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা না করে বিডিআরের নাম ও পোশাক পরিবর্তন নিয়ে যা হলো তার জবাব একসময় মানুষ চাইবে। শেষ পর্যন্ত ডিজির ঈদ কার্ড নিয়ে যা হয়েছে তাতে প্রমাণিত হয়েছে অনেক ব্যাপারেই সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর বেগম জিয়াকে সরকার থেকে একট বাড়ি দেওয়া হয়। হঠাত্ শোনা গেল পিলখানায় নিহত সেনা অফিসারদের পরিবারকে দুটো করে ফ্ল্যাট দেওয়া হবে। সে ফ্ল্যাট নির্মিত হবে, অন্য কোথাও নয়, ৬ নম্বর শহীদ মইনুল সড়কে। কালবিলম্ব না করে বেগম জিয়াকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হলো। কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে—পিলখানার নিহতের পরিবার যদি দুটো ফ্ল্যাট পায় নিহত রাষ্ট্রপতির স্ত্রী দুটো বাড়ি পাবেন না কেন? তা ছাড়া সেনাবাহিনীর বহু সদস্য দেশে ও বিদেশে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হচ্ছেন। তাঁদের পরিবার দুটো ফ্ল্যাট পাবে না কেন? কাউকে কোনো কিছু দিয়ে ফেরত নেওয়াটা অনুচিত। কোনো ব্যাপারেই প্রতিহিংসার প্রকাশ ঘটানো আরও অনুচিত। যা হতে পারে তা হলো, আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বাড়িটাড়ি যা দেওয়া হয়েছে তা শুধু বেগম জিয়াই ভোগ করবেন, তাঁর সন্তানদের তাতে কোনো অধিকার থাকা উচিত নয়। যিনি দেশের জন্য ত্যাগ করেন তিনিই গুরুত্বপূর্ণ—তাঁর বংশধরেরা নয়।
হঠাত্ সংসদ থেকেই শোনা গেল, সাত বছর সেনাবাহিনীতে যেসব নিয়োগ পোস্টিং হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত হবে। প্রতিরক্ষা বিভাগ অন্য বিভাগের মতো নয়। সব জায়গা থেকে সব কথা ঘোষণা দিতে নেই। কিছু রীতি বা কনভেনশন সব রাষ্ট্র মেনে চলে। সেই রীতি ভাঙা হঠকারিতা অথবা অর্বাচীনতা। পৃথিবীর কোনো দেশে তিন বাহিনীর নেতিবাচক বিষয় সংসদে আলোচনা হয় না। সংসদীয় কমিটিতে হতে পারে।
সরকার ও তাদের কিছু স্বনামধন্য ব্যক্তি বলে বেড়াচ্ছেন, ১৯৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করবেন। কোন জ্ঞানে তা বলছেন আমার মতো পিএইচডিহীন মানুষের মাথায় তা আসে না। সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধিত হওয়া এক জিনিস, আর অতীতে ফিরে যাওয়া অন্য জিনিস। ওই সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ আছে। আওয়ামী লীগ কি চীন, কিউবা, ভেনেজুয়েলা বা উত্তর কোরিয়ার পথ গ্রহণ করতে চাইছে? তা যদি চায় ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বাগত জানাব, শান্তিবাদী বারাক হোসেন ওবামা স্বাগত জানালে ঢাকার রাজপথে আনন্দ মিছিলও করতে পারি। ১৯৭২-এর সংবিধানে সেক্যুলারিজমও ছিল—রাষ্ট্রে সেক্যুলারিজমের নামগন্ধ না থাকলেও। ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ করার বহু পথ আছে। ইউরোপের প্রত্যেক দেশেই ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক বা কনজারভেটিভ পার্টি আছে। বাংলাদেশে কেউ ইসলামিক গণতান্ত্রিক দল গঠন করতে চাইলে তা কোন যুক্তিতে বাধা দেওয়া হবে। বাধা দিলে উগ্র মৌলবাদ মাথা খাড়া করবে। ভারতেও মুসলিম লীগ রাজনীতি করছে। তা ছাড়া ১৯৭২-এর সংবিধানে রয়েছে কিছু মারাত্মক গলদ। এখন তা পুনঃপ্রবর্তন হবে আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী।
সরকারি দলের লোকদের সংযত আচরণ করতে হয়। কে কার জন্মদিন কীভাবে পালন করবে তা তাঁর ও তাঁর ভক্তদের ব্যাপার। জন্মদিন সকালবেলা কাঙালিভোজ দিয়ে করবে, না বিকেলে কেক কেটে করবে তা তাঁর মর্জি। বাংলাদেশের প্রতিটি ম্যাট্রিক বা এসএসসি পাস মানুষের দুটো জন্মদিন। ড. জাকির হোসেন ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মিডিয়ার মানুষ জানতে চেয়েছিলেন তাঁর জন্মদিন কবে। তিনি বলেছিলেন, ‘জন্মেছি যখন জন্মদিন একটা নিশ্চয়ই আছে।’ বেগম জিয়ার জন্মদিন পালন নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করাটা চরম রুচিবিবর্জিত কাজ। দুই বা সোয়া দুইবার তিনি হন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। যুগ যুগ মানুষ তাঁর ‘জন্মদিন’ পালন করবে। বাঙালির ১২৪ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে জঘন্য ক্ষুদ্রতার প্রকাশ ঘটেছে বেগম জিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও জন্মদিন নিয়ে প্রশ্ন তোলায়। এই নোংরামিকে ব্যক্তিগতভাবে আমি ধিক্কার জানাই।
সরকারের সামনে কত কাজ। সব বাদ দিয়ে হাবিজাবি ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আইন প্রতিমন্ত্রী বলতে থাকলেন, ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের বিচার ও শাস্তি হবে। আশ্বাসের পর আশ্বাস দিচ্ছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টারা। শ্রমমন্ত্রী শাহজাহান সাহেব বলেছেন, চিহ্নিত অপরাধীদের গুলি করে মারা চমত্কার কাজ। ফরিদপুরের আরেক মন্ত্রী জনগণকে গরুচোরদের চোখ উপড়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। বিচার বিভাগ চলছে নির্বাহী বিভাগের নির্দেশে। চিনি ব্যবসায়ীদের একটি চুলেও টান পড়ল না। দুর্নীতি দমন কমিশন এখন সরকারের হাতের মুঠোয়। মানবাধিকার কমিশনকে গলা টিপে ধরা হয়েছে।
সিরাজদ্দৌলা নাটকের সিরাজের কণ্ঠে কাল্পনিক সংলাপই যেন আজ নিরেট বাস্তবতা: গোলাম হোসেন, বাংলার আকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা...। মিয়ানমার আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, তারা সত্ প্রতিবেশীর মতো আচরণ করছে না। আমাদের সমুদ্রসীমার মাছ তারা নিয়ে যায়। সমুদ্রবক্ষে গ্যাস উত্তোলনে বাধা দেয়। তাদের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আমাদের অর্থনীতি ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। এখন তারা কোনো কারণ ছাড়াই বাংলাদেশ সীমান্তে সেনা জড়ো করছে। সরকারের পক্ষ থেকে কী করা হচ্ছে আমরা জানি না।
শুধু সরকারকে দোষ দেব না। কপাল আমাদের। অসহায় জনগণ নেতৃত্বহীন। আগের সেই আত্মত্যাগী ছাত্র ও যুবসমাজ নেই। সন্ত্রাসী আছে—সংগ্রামী ছাত্রনেতা নেই। নির্বাচন-পূর্ব বিপ্লবী সাংস্কৃতিক নেতারা এখন প্রাপ্তির জন্য দেনদরবারে ব্যস্ত। ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজের নেতা গণতন্ত্রের জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিতেও প্রস্তুত ছিলেন, তাঁরা ১০ মাস ধরে জীবিত যে আছেন তা বোঝার উপায় নেই। ১০ মাসের মধ্যে একবার প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে শুধু দেখা গেছে তাঁদের তত্পরতা। সুতরাং প্রার্থনা করি: আল্লাহই বাংলাদেশকে রক্ষা করুন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

গণতন্ত্রের জন্য সংবাদপত্র, কোনো গোত্রের জন্য নয়



সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ২০-০৭-২০১০
যাঁদের ধূমপানের নেশা আছে, তাঁরা সকালে ঘুম থেকে উঠেই হুক্কা বা সিগারেটে টান না দিলে অস্বস্তি বোধ করেন। ধূমপান না করলে অনেকের কোষ্ঠ পরিষ্কার হয় না। সিগারেট ধরিয়ে পায়খানায় ঢোকেন। এমন অনেক পাঠকও আছেন, যাঁরা সকালে খবরের কাগজে চোখ না বোলালে অস্বস্তি বোধ করেন। যাঁদের কোষ্ঠবদ্ধতা আছে, তাঁরা কেউ খবরের কাগজ হাতে নিয়ে নজরুল ইসলামের মতো লম্বা সময়ের জন্য বাথরুমে গিয়ে বসে থাকেন।
খবরের কাগজটি কীভাবে তৈরি হয়? কারা, কোথায় বসে লেখাগুলো লেখেন? সারা রাত কোথায় ছাপা হয়? সেসব বিষয় খুব অল্প পাঠকই জানেন, বা তাঁদের জানার প্রয়োজন আছে। ভোরবেলা পাঠক তাঁর হাতে কাগজটি পান অনেকটা অলৌকিকভাবে। রাস্তার পাঠক পত্রিকা কেনেন হকারের কাছ থেকে অথবা পত্রপত্রিকার স্ট্যান্ড থেকে। গ্রাহকদের যাঁরা একতলার বাড়িতে থাকেন, তাঁরা সকালে কাগজ পান জানালার নিচে। যাঁরা বহুতল ভবনে থাকেন, তাঁদের কাগজ আসে দরজার তলা দিয়ে। একালের অনেক আধুনিক পাঠক কাগজ স্পর্শ না করে নাশতার টেবিলে বসেন না। কারও থাকে এক হাতে চায়ের ধূমায়িত কাপ, আরেক হাতে খবরের কাগজ। আধুনিক জীবন ও খবরের কাগজ অবিচ্ছিন্ন। সংবাদপত্র ছাড়া আধুনিক রাজনীতিও অচল। গণতন্ত্রের জন্য সংবাদপত্র চাই-ই।
অনুমান করি, পৃথিবীতে এসে প্রথম চোখ মেলেই দেখে থাকব খবরের কাগজ। নিশ্চয়ই আমার আঁতুড়ঘরের বেড়ায় খবরের কাগজ সাঁটানো ছিল। কার্তিকের বিষণ্ন রাতে পদ্মার ঠান্ডা হাওয়া বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে আঁতুড়ঘরে না ঢুকতে পারে, সে জন্য পুরোনো খবরের কাগজ ব্যবহূত হয়ে থাকবে। আমার বাল্যশিক্ষা পড়া আর খবরের কাগজের শিরোনাম বানান করে পড়া একই সময় শুরু হয়। আমার বাবা ছিলেন খবরের কাগজের পোকা। পত্রিকা একটা হলেই হলো। আজাদ বা আনন্দবাজার পত্রিকা, মর্নিং নিউজ বা স্টেটসম্যান। সেকালে কাগজ সহজলভ্য ছিল না, গ্রামের পাঠক বা গ্রাহকদের জন্য তো নয়ই। গ্রামে কাগজ সকালবেলায় জানালার নিচে বা দরজার তলায় পাওয়া যেত না। কলকাতা ও ঢাকার কাগজ গ্রামে যেত তিন দিন পর। মঙ্গলবারের কাগজ পাওয়া যেত শুক্রবার সন্ধ্যায়। পোস্টাপিসের ডাকপিয়ন এসে দিয়ে যেতেন।
আমার অতি শৈশবে তিনটি ভাষার কাগজ আমি বাড়িতে দেখেছি। আমার মা বাংলা বলতে পারতেন না, বাংলা অক্ষরও চিনতেন না। তিনি পড়তেন উর্দু সাপ্তাহিক রোজানা-ই-হিন্দ্ বা কলকাতার অন্য কোনো কাগজ। খুব নিয়মিতও নয়। কাগজে লেখা হয় দুনিয়ার কোথায় কী ঘটছে। কে কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী, কে চিয়াং কাই-শেক, কে মাও সেতুং, কে দেশের রেলমন্ত্রী, চালের বাজারে আগুন লাগল কি না, আলু ও এলাচের দাম হঠাৎ কেন বাড়ল, কোন বেশরম মেয়েটি তার প্রাইভেট শিক্ষককে ভালোবেসে তার সঙ্গে পালিয়ে গেছে—এসব জানার আগ্রহ সব পাঠকের থাকে না।
শৈশবে যখন গ্রামে ছিলাম, বিশেষ করে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের আগে, ভরসা ছিল আজাদ ও ইত্তেফাক। তাও কয়েক দিনের বাসি কাগজ। সেটাই টাটকা মনে হতো। মাঝেমধ্যে কলকাতা থেকে আসত দৈনিক যুগান্তর। সেটার ছাপা ও লেখা আরও উন্নত। স্বাধীনতার পর প্রথম ১০ বছর, মোটের ওপর স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল, আইয়ুব ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের মাঝখানে বিরাট প্রাচীর উঠে যায়। কলকাতার কাগজ আসা বন্ধ হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে আমার ছোট চাচা, যিনি গ্রহণ করেছিলেন ভারতের নাগরিকত্ব, লোকের হাতে কলকাতার দৈনিক-সাপ্তাহিকের বান্ডিল পাঠাতেন।
সব মানুষের মতোই আমিও একদিন ছিলাম পাঠক, তারপর হয়ে গেলাম সংবাদপত্রের লেখক। তারপর পেশাদার সাংবাদিক। স্বাধীনতার আগে অনিয়মিতভাবে লিখলেও স্বাধীনতার পর দেশের প্রধান তিনটি কাগজ—ইত্তেফাক, সংবাদ ও দৈনিক বাংলার সাহিত্য সাময়িকীর প্রধান লেখকদের আমি ছিলাম একজন। বছরের পর বছর দৈনিক বাংলায় কবি আহসান হাবীব, ইত্তেফাক-এ রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই) এবং সংবাদ-এ আবুল হাসনাত আমার লেখাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রধান রচনা করেছেন। তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
তারপর শুরু হয় উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ রচনা। ইংরেজি-বাংলা সব কাগজেই লিখতাম। নিয়মিত লেখা শুরু হয় আজকের কাগজ থেকে। তারপর ভোরের কাগজ, প্রথম পর্যায়ের বাংলাবাজার পত্রিকা, প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল প্রভৃতি। ডেইলি স্টার পত্রিকায়ও বহুদিন লিখেছি। প্রধান কাগজের সম্পাদকদের অকৃপণ ভালোবাসা ও প্রীতি বর্ষিত হয়েছে আমার ওপর। মালিক-সম্পাদকদের মধ্যে সংবাদ-এর আহমদুল কবির, ইত্তেফাক-এর মইনুল হোসেন এবং আজকের কাগজ-এর কাজী শাহেদ আহমেদ আমাকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের যে সুযোগ দিয়েছেন, এর জন্য তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। যত দিন শামসুর রাহমান দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন, তত দিন ওই কাগজ ছিল আমাদের নিজস্ব।
নব্বইয়ের দশক এবং এই শতকের প্রথম দশকে কয়েকজন সম্পাদক বাংলাদেশের সংবাদপত্রে নতুন যুগের সূচনা করেন। তোয়াব খানের নেতৃত্বে জনকণ্ঠ, মতিউর রহমানের ভোরের কাগজ ও প্রথম আলো, মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রথমে বাংলাবাজার পত্রিকা এবং পরে মানবজমিন, গোলাম সারওয়ারের যুগান্তর ও সমকাল এবং আবেদ খানের সমকাল এবং এখন কালের কণ্ঠ বাংলাদেশের সংবাদপত্রের দিগন্তকে প্রসারিত করেছে। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম নতুন এক বলিষ্ঠ ধারার সৃষ্টি করেছেন। এসব দক্ষ সম্পাদকের দ্বারা যে আধুনিক সাংবাদিকতার সূচনা হয়েছে, তার জন্য তাঁদের সহযোগী একদল যোগ্য তরুণ সাংবাদিকের অবদানও বিরাট। তাঁরা নতুন যুগের সাংবাদিক। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষা নতুন ও আধুনিক। তৈরি হয়েছে গত পনেরো বছরে একদল দক্ষ ফটোসাংবাদিক। অর্থাৎ একটি উঁচু জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে আজ আমাদের সংবাদপত্র।
আমার চিন্তা প্রকাশে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজী শাহেদ আহমেদ, মাহফুজ আনাম, মতিউর রহমান, গোলাম সারওয়ার, মতিউর রহমান চৌধুরী, আবেদ খান যে স্বাধীনতা দিয়েছেন, নিশ্চয়ই অন্য লেখকেরাও তেমনটি ভোগ করেছেন। পত্রিকায় সম্পাদকের পাতায় রচনা লিখলেও আমি তো একজন পাঠকও বটে। শৈশবে একটি কাগজের জন্য পোস্টাপিসের পিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আজ সম্পাদক-প্রকাশকদের দয়ায় দরজার তলা ভরে যায় কাগজে। সবচেয়ে পুরোনো সৌজন্য কপিটি ইত্তেফাক। ৪১ বছর ধরে পাচ্ছি। সিরাজুদ্দীন হোসেন দিয়ে গিয়েছিলেন, আর বন্ধ হয়নি। ১০-১৫টি কাগজে প্রতিদিন চোখ বোলানোর সৌভাগ্য হয়। সংবাদপত্র পাঠ করে আজ সব সময় ভালো লাগে না। ভালো না লাগার কারণ অনেক রকম।
কয়েক দিন আগে ঢাকার বাইরে থেকে ফিরছিলাম। হাইওয়ের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার অদূরে ঝোপের আড়ালে গেল। আমি গাড়ি থেকে নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম। রাস্তার পাশের এক সবজির খেতে এক ভদ্রলোক কী যেন করছিলেন; তিনি উঠে এলেন সড়কের ওপর। কোনোভাবে তিনি আমাকে চিনলেন। ঝাড়া দিয়ে লুঙ্গির মাটি ফেলে তিনি ক্ষোভের সুরে বললেন, ‘কাগজে আপনারা সরকারের, বিরোধী দলের, প্রধানমন্ত্রীর, বিরোধীদলীয় নেত্রীর, মন্ত্রীদের দোষ, দুর্নীতি ও দুর্বলতার জন্য লেখালেখি করেন। পত্রিকার ভুলভ্রান্তি ও দোষের সমালোচনা করার উপায় কী?’
আমি তাঁকে বললাম, ‘সে সমালোচনা আপনারা করবেন। আপনাদের মতামতের মূল্য খুব বেশি।’ তখন তিনি কয়েকটি সংবাদের উল্লেখ করলেন উদাহরণ হিসেবে। তিনি জানতে চাইলেন, এসব সংবাদের উদ্দেশ্য কী, এসব সংবাদের ভিত্তি কী, এতে দেশের কোনো উপকার হবে কি না, এসব সংবাদে আদৌ কোনো সত্যতা আছে কি না।
ভদ্রলোকের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আমি কেউ নই। যেসব কাগজে ওই সব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেসব কাগজের সম্পাদক এবং যিনি বা যাঁরা ওই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তাঁরাই সঠিক উত্তর দিতে পারতেন। ওই ভদ্রলোকই প্রথম নন, তাঁর মতো প্রশ্ন আরও অনেকেই করেন। জবাব দিতে পারি না। ৩৫ বছরের বেশি আমি প্রত্যক্ষভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সহকারী সম্পাদক থেকে সম্পাদক পর্যন্ত হয়েছিলাম। পত্রপত্রিকার দোষ-গুণ আমার অজানা নয়। সমস্যাও আমার অজ্ঞাত নয়। বাঙালির গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আমাদের সংবাদপত্র পাকিস্তানি আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু তার পরও বলব, সব সময় কাগজের ভূমিকা ইতিবাচক ও নির্মল ছিল না। অনেক সময় সত্য ও ন্যায় থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে এবং তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গোটা জাতি। সেই ক্ষতির মাশুল গুনতে হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
১৯৪৮ সালে এক ব্যক্তিগত চিরকুটে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘কী করছে আনন্দবাজার পত্রিকা, যুগান্তর, অমৃতবাজার পত্রিকা আর হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড এবং ওদিকে আজাদ পত্রিকা। এরা চাইছে, দাঙ্গা ভালোমতো লাগুক। যাচ্ছেতাই মিথ্যাচার করছে এই কাগজগুলো। এপার থেকে মুসলমানরা ওপার চলে যাক, আর পূর্ববাংলা থেকে হিন্দুরা ভয়ে বাড়িঘর ফেলে এদিকে চলে আসুক। এদের থামাতে পারো কি না দ্যাখো।’
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কেউ কিছু করলে কে তাকে রুধিবে দিয়ে বালির বাঁধ। কোটি কোটি মানুষের সর্বনাশ হয়েছে, লাভবান হয়েছে কয়েকজন। পত্রিকা শুধু ঘটে যাওয়া খবর দেয় না, জনমত গঠন করে, বিশেষ পরিস্থিতির জন্য মানুষের মন তৈরি করে। তা ছাড়া একটি রাষ্ট্রে সরকার ছাড়াও বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী থাকে। তারাও সংবাদপত্রকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে।
স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আবার গণতন্ত্রকে হত্যা করতেও একশ্রেণীর সংবাদপত্র খুব বড় ভূমিকা রাখে। হিটলার দানব হয়ে ওঠার আগে সংবাদপত্র ছিল তাঁর প্রধান সহায়। তাঁর কাজকে অনেক দিন অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে সংবাদপত্র। তাঁর নীলনকশাকে দিয়েছে সমর্থন। তা ছাড়া বিভিন্ন দেশ আক্রমণের আগে ওই সব দেশের সরকারগুলোও হিটলারের নিন্দা করেনি। সুতরাং সেখানকার কাগজগুলোও করেনি। বহুকাল স্পেনের কাগজগুলো রিপাবলিকপন্থীদের নয়, স্বৈরাচারী ফ্রানসিসকো ফ্রাঙ্কোকেই সমর্থন দিয়েছে। পর্তুগালে একনায়ক আন্তনিও সালাজারকে টিকিয়ে রাখে সংবাদপত্র। ফিলিপাইনে ফার্দিনান্দ মার্কোসের স্বৈরশাসনকে পাকাপোক্ত করতে সংবাদপত্রই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। পরিহাসের মতো মনে হয়, তাদের পতনের পরে হিটলার, ফ্রাঙ্কো, সালাজার, মার্কোসকে ওই সব কাগজই বেশি নিন্দা করেছে। ইঙ্গো-মার্কিনপন্থী ইরানের শাহকে পত্রিকাগুলো প্রশংসায় সিক্ত করেছে বহু বছর। তারপর যেদিন আয়াতুল্লাহ খোমেনি তাঁকে এক কাপড়ে দেশ থেকে বিতাড়ন করেন, বিমানবন্দর পর্যন্ত জনগণ তাঁকে তাড়া করে, সেদিন ঘুরে যায় কাগজের সুর। লেখা হতে থাকে শাহ কত খারাপ শাসক ছিলেন। পঁচাত্তরের আগে এবং পরে আমরা তা দেখেছি।
সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে, বিশেষ করে গোয়েন্দা বিভাগ থেকে খবর সংগ্রহ করা সাংবাদিকদের প্রচলিত রীতি। চিরকাল সব দেশেই তা করা হয়। নানা কারণে সূত্রের নাম গোপন রাখা হয়। ১২-১৩ বছর ধরে দেখছি, গোয়েন্দা বিভাগই আগ বাড়িয়ে সাংবাদিকদের দিয়ে সংবাদ করাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা তথ্য নিজে যাচাই না করে সাংবাদিক প্রকাশ করতে পারেন না। আমাদের তা করা হচ্ছে।
তিনোদ্দীনের বিশেষ সরকারের সময় থেকে শুরু হয়েছে আরেক ধারা: অপরাধী বা রাজনৈতিক নেতাদের আটক করে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে। তারপর সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে একতরফা বলা হচ্ছে: ওই ব্যক্তি এই বলেছেন, ওই করেছেন এবং তাঁর অমুক অমুক নাশকতামূলক কাজ করার পরিকল্পনা ছিল। সব কাগজে নয়, কোনো কোনো কাগজে সেসব বানোয়াট কাহিনি বিশাল শিরোনাম দিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে। রিমান্ডের গোপন ঘরে ভয়-ভীতির মধ্যে কে কী বলল, তা সংবাদ নয়। সাংবাদিকদের কাছে অপরাধী কী বলল, তাই সংবাদ। কয়েক দিন বাদ দিয়েই সম্ভাব্য নাশকতার সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। আজ কতভাবে বাংলাদেশের ক্ষতি করা হচ্ছে, তার কিছু কিছু হিসাব জনগণ ঠিকই রাখে। কয়েক মাস আগে আমি কলকাতায় যাব। টিকিট করার জন্য বিমান অফিসে গেছি। ঢুকছি, দেখি দলবেঁধে অনেক লোক বেরোচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে বিদেশি আছেন দুজন। ওই দিন একটি বা একাধিক কাগজে ‘ভারতের একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত’ দিয়ে প্রতিবেদন করা হয়েছে ইসলামি জঙ্গিরা বাংলাদেশ বিমানে হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ খবর জানার পর কে চড়বে বিমানে? বিমান অফিস থেকে লোকগুলো দৌড়ে চলে গেলেন অন্য এয়ারলাইনসের অফিসে। তাঁদের পিছে পিছে আমিও দিলাম দৌড়। অন্য এয়ারলাইনসের টিকিট কিনলাম। এক খবরেই আমার বন্ধু জি এম কাদেরের কয়েক কোটি টাকা লোকসান হয়ে গেল।
ঢাকার বিদেশি দূতাবাসে হামলার সংবাদ হামেশাই হচ্ছে। এ জাতীয় সংবাদ প্রকাশের সুবিধা অনেক রকম। যদি সত্যি কখনো হামলা হয়, তাহলে যে কাগজে রিপোর্ট হয়েছে, তাঁরা লাফিয়ে উঠবেন। বলবেন: এ তো আমরা জানতাম, তাই আগেই সাবধান করে দিয়েছিলাম। অন্যদিকে এই ভুয়া বা বায়বীয় সংবাদ প্রকাশের পর যখন কিছুই ঘটবে না, তখন ওই সাংবাদিক বলবেন: আমরা লিখেছিলাম বলেই হামলাটি হয়নি। তা না হলে বিমানের সব উড়োজাহাজ জঙ্গিরা উড়িয়ে দিত। গুঁড়িয়ে দিত দূতাবাস।
এ জাতীয় সংবাদে অট্টহাসি হাসে দুই পক্ষ: এক পক্ষ, যাদের সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারা হাসতে হাসতে বলে: কত বড় বেকুব দেখো। কিছুই জানে না। আর হাসে সেই পক্ষ, যারা সত্যি সত্যি অপরাধ ঘটাবে। কখন ঘটাবে, তা শুধু তারাই জানে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে বর্বরতার পর গত সপ্তাহে চ্যানেল আইয়ের এক আলোচনায় মাহমুদুর রহমান মান্না, রিজভী আহমেদ ও আমি ছিলাম। আলোচনার মধ্যে উপস্থাপক মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একটি প্রধান দৈনিকের একটি রিপোর্ট আমাদের দেখালেন। তাতে রিপোর্টার একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে লিখেছেন: ছাত্রলীগের বর্তমান যে কমিটি, এটি হাওয়া ভবন থেকে মনোনীত হয়ে আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। রিপোর্টটি পড়ে আমার মনে হলো, রিপোর্টার বলতে চান, হাওয়া ভবনের সাবেক সর্বাধিনায়ক তারেক রহমান কয়েক বছর আগেই জানতে পারেন, আগামী ২০০৮-এর নির্বাচনে তাঁর আম্মা জিততে পারবেন না। সরকার গঠন করবেন শেখ হাসিনা। তখন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য প্রয়োজন হবে ছাত্রলীগের। সুতরাং আগেভাগে ছাত্রলীগে এমন নেতৃত্ব বসিয়ে যাবেন, যাঁরা চাপাতি ও রামদার সদ্ব্যবহারে সুদক্ষ এবং সহপাঠীদের খড়কুটোর মতো তিনতলা থেকে মাটিতে ছুড়ে ফেলবেন। মান্না ও রিজভী উভয়েই রিপোর্টটিকে বাজে ও রাবিশ বলে উড়িয়ে দিলেন। আমি বলেছিলাম, এ খবরটি গোয়েন্দারা সাত-আট বছর গোপন রাখলেন কেন? জাহাঙ্গীরনগরের ঘটনার আগের দিন তথ্যটি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পৌঁছে দেননি কেন? অর্থাৎ এ খবরটি কোনো গোয়েন্দা সূত্র দেয়নি, রিপোর্টারের মাথা দিয়েছে।
আমি যা বলতে চাই তা হলো সংবাদপত্রের কাছে মানুষের প্রত্যাশা প্রচুর। সেই প্রত্যাশা নষ্ট হয়ে গেলে পাঠক হতাশায় ভোগে। আমার এ লেখার দীর্ঘ ভূমিকায় আমি যা বলেছি, তার অর্থ হলো সংবাদপত্রের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সারা জীবনের। সাংবাদিকতা ও লেখালেখি ছিল আমার জীবিকার একমাত্র উপায়। সংবাদপত্রকে যখন কেউ সমালোচনা করে এবং সংগত কারণেই করে, তখন আমার গায়ে লাগে। আমি আহত হই।
পৃথিবীতে মন্দ গণতন্ত্র যেমন আছে, তেমনই অপসাংবাদিকতাও আছে। ভালো গণতন্ত্রের জন্য ভালো সংবাদপত্র অপরিহার্য। ব্যক্তিস্বার্থের কারণে রাজনীতিকদের কেউ খারাপ হতে পারেন, নীতি বিসর্জন দিতে পারেন, কিন্তু সাংবাদিকের নীতিভ্রষ্ট হওয়ার উপায় নেই। কোনো গোষ্ঠীর বা শাসকের লাঠিয়াল হওয়া সাংবাদিকের কাজ নয়। দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থ রক্ষাই তাঁর ব্রত। সত্যের পক্ষে অনড় থেকেই সেই ব্রত পালন করা সম্ভব। সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া তাঁর জন্য আত্মহত্যার শামিল।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

বাঙালির বিচারব্যবস্থার অতীত ও বর্তমান



সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ২৪-১১-২০০৯
যাঁরা পত্রপত্রিকায় উপসম্পাদকীয় রচনা লেখেন তাঁরা সাধারণ মানুষ। তাঁদের মুরোদ বা ক্ষমতা বলতে কিছুই নেই। তলোয়ার নেই; ঢাল নেই, লাঠিয়াল ও পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজ কিছুই নেই। জ্ঞানগম্যিও যে খুব বেশি আছে তাও নয়। কেউ কাগজে লেখেন অভ্যাসবশত, অনেকে লেখেন পেটের দায়ে। 
যাঁরা রাজনীতিবিদ, যাঁরা জনগণকে পরিচালিত করেন—তাঁরা অনেক বড়। রাজনীতিকদের মধ্যে যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান তাঁরা আরও বড়। ক্ষমতা তাঁদের সীমাহীন। শক্তিতে তাঁরা অপ্রতিরোধ্য। একটি রাষ্ট্রে ওপরে আসমানে বিশ্ববিধাতা, আর নিচে মাটিতে সরকার। অনেক ক্ষেত্রে বিধাতার ক্ষমতা সীমিত, কারণ তিনি একটি ব্রিজ, কালভার্ট বা ফ্লাইওভার বানাতে পারেন না; কোনো রকম টেন্ডার আহ্বানের ঝামেলা-ঝক্কির মধ্যে তিনি যান না; কিন্তু একটি সরকার তা পারে, যারা রাষ্ট্রপরিচালক, বিদ্যাবুদ্ধি থেকে শুরু করে বিত্তবিভব, পেশিশক্তি প্রভৃতি জাগতিক ব্যাপার তাদের পূর্ণ করায়ত্ত। সুতরাং তাদের পরামর্শ দেওয়া কোনো কলামলেখক বা অপ-এড রচনালেখকদের কম্ম নয়। তবে কখনো যে কেউ কেউ দেন তাও অভ্যাসবশত—প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য থেকে নয়।
কোনো দেশের জনগণ যখন নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র চায়, তখন তারা একটি সরকারও চায়। এমন একটি সরকার তাদের কাম্য যে সরকার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো পূরণ করতে সক্ষম। সব রাষ্ট্রেই চোরছ্যাঁচড় থাকবেই, তার জন্য এমন দাবি জনগণ করবে না যে তারা ঘরের দরজা খুলে নাক ডেকে ঘুমাবে, কিন্তু কোনো চোর তাদের ঘরে ঢুকবে না। জনগণ চায় আইনকানুন দ্বারা পরিচালিত একটি রাষ্ট্র এবং নিরপেক্ষ আইনকানুন প্রয়োগকারী একটি সরকার। অর্থাত্ রাষ্ট্রে যিনি দারোগা হবেন তিনি ঠিক চোর বা খুনির কোমরেই দড়ি দেবেন, অন্য কারও কোমরে কদাচ নয়। রাষ্ট্রে যিনি কাজী বা বিচারক হবেন তিনি কেউ দোষী সাব্যস্ত হলেই শুধু তাকে বন্দীখানায় আটকে রাখার অথবা ফাঁসিতে বা শূলে চড়িয়ে প্রাণদণ্ড দেওয়ার হুকুম দেবেন। নির্দোষ কোনো ব্যক্তির গায়ে আঁচড়টিও যাতে না লাগে সেদিকে তাঁকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে হবে। 
কোনো আধুনিক রাষ্ট্রে বা প্রজাতন্ত্রে প্রধান বিভাগ তিনটি: নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ। নির্বাহী বিভাগের কাজের সীমাসরহদ্দ নেই, কিন্তু পার্লামেন্ট বা আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগের কাজ সুনির্দিষ্ট। নির্বাহী বিভাগের কাজে সূক্ষ্মতা নাও থাকতে পারে, বহু কাজ তাদের করতে হয়, তাতে কিছু ভুলভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক। আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগের কাজ হতে হবে ত্রুটিহীন—কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে যতটা নির্ভুল করা সম্ভব। তবে মানবিক ভুল ধর্তব্যের মধ্যে নয়।
বাঙালি জাতির বিচারব্যবস্থার ঐতিহ্য অত্যন্ত গৌরবময়। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে পাকিস্তানি আমলের ২৪ বছর, তার আগে ইংরেজ শাসনের ১৯০ বছর এবং তারও আগে মুঘল ও সুলতানি আমলের ৬০০ বছর আমাদের ভূখণ্ডে যেসব ধরনের বিচারব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা মানের দিক থেকে যেকোনো সভ্য দেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে তুলনীয়। ব্রিটিশ-পূর্ব সময়ের কাজীর বিচারের কথা আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি। তখন শাসকেরা ছিলেন মুসলমান, কিন্তু বিচারব্যবস্থা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। ইসলামি ফিকাহ ও হিন্দুধর্মের স্মৃতিশাস্ত্র রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে ব্যবহূত হতো। কয়েক দিন ধরে আমি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ, মোহাম্মদ হাবিবের সহকর্মী, এস এ কিউ হুসাইনির Administration Under the Mughals নতুন করে পাঠ করেছিলাম। বইটি মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৪৯-এ এবং ঢাকায় মুদ্রিত ১৯৫১ সালে। অমূল্য গ্রন্থটি এখন দুর্লভ। হয় মূল ইংরেজিটি অথবা এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হওয়া দরকার। ভারতের ইতিহাসবিদদের কাছে এই গ্রন্থের কদর আছে বলে আমি জানি। গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়টি মুঘল বিচারব্যবস্থাসংক্রান্ত। এ ছাড়া শ্রীরাম শর্মার Mughal Government and Administration-এও মুঘল বিচারব্যবস্থার বিচারবিশ্লেষণ আছে। তাতে দেখা যাচ্ছে মুঘল প্রশাসনে ন্যায়বিচার ছিল তুলনাহীন। ভারতবর্ষের প্রধান বিচারপতিকে বলা হতো ‘কাজীউল কুজাত’। প্রত্যেক প্রদেশে আলাদা কাজীর আদালত ছিল—এখনকার হাইকোর্টের মতো। জেলা শহরগুলোতেও কাজী ছিলেন। প্রাদেশিক কাজীর নিচের ধাপগুলোয় যাঁরা বিচারক ছিলেন তাঁদের পদবি ছিল এ রকম: সরকার কাজী (ম্যাজিস্ট্রেট), পরগনা কাজী, মুফতি (অ্যাটর্নি), মিরআদল, কাজী-ই-আসকার প্রভৃতি। 
ইংরেজরা এসে মুঘলব্যবস্থা ও ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থার সমন্বয় ঘটান। অন্যদিকে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও শোষণ করলেও ব্রিটিশ ভারতের আদালত ছিল ন্যায়বিচারের পরাকাষ্ঠা। জজরা নিজেদের মনে করতেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। দুর্নীতি বা প্রভাবিত হওয়ার কথা তাঁদের সম্পর্কে কোনো দিন ওঠেনি। 
ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর তাদের বিচারব্যবস্থাই পাকিস্তান ও ভারতে প্রচলিত থাকে। ভারত উচ্চ আদালতের মান রক্ষা করে চলেছে। তবে কোনো কোনো হাইকোর্টের বিচারক দুর্নীতির অভিযোগে চাকরিও খুইয়েছেন। 
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি বিচারব্যবস্থাই চালু থাকে। এখনো আছে। আইনকানুন সব ইংরেজ আমলের, তবে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে যুগের প্রয়োজনে নতুন আইন। কিন্তু পদ্ধটিটি ব্রিটিশ। প্রক্রিয়া হিসেবে যা খুবই জটিল। কেউ মামলায় জড়ালে সে হবে ফতুর এবং ভারী হবে উকিলের পকেট। কোনো কোনো বিচারকের অবিচারকসুলভ আচরণ ও অসাধুতার কথাও কাগজে আসছে। কোনো মানুষই ফেরেশতা নয়, বিচারকও মানুষ। সময়ের হাওয়া যেকোনো পদের মানুষের গায়েও লাগা সম্ভব।
বিচারব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছি কারণ বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মামলা-মোকদ্দমার দেশ। কিছুকাল ধরে বাংলাদেশ সরকারকে এত বেশি মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করতে হচ্ছে যে ন্যাটো জোটভুক্ত সব দেশের সরকারকে সম্মিলিতভাবেও অত মামলায় লড়তে হচ্ছে না। তা ছাড়া আমাদের আদালত যত ঘন ঘন অবমাননা বোধ করে, অন্য কোনো দেশের কোর্ট তা করার প্রয়োজন বোধ করেন না। ভারতে আদালত ও বিচারকদের মধ্যে প্রাণবন্ত বিতর্ক হয়ে থাকে। প্রধান বিচারপতি থেকে আইন বিশেষজ্ঞগণ তাতে অংশ নেন। ভারতে হাইকোর্টের কোনো কোনো বিচারক অপরাধ করে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন এবং চাকরি খুইয়েছেন। মাস তিনেক আগে কলকাতা হাইকোর্টের একজন বিচারক কোল ইন্ডিয়ার টাকা নিজের নামে ব্যাংকে স্থায়ী জামানত হিসেবে রেখে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছেন। প্রধান বিচারপতি তাঁকে ইমপিচ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেছেন। সম্ভবত এত দিনে তাঁর চাকরি নেই। 
ব্যবস্থার কোনো দোষ নেই। ব্যবস্থাটা কার নিয়ন্ত্রণে সেটাই বড় কথা। এখনো যে ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত তা খারাপ নয়—আইন কীভাবে কে প্রয়োগ করছেন তাই বিচার্য। উঁচু মানসম্পন্ন আইনজ্ঞ ও বিচারকেরা যদি তা সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করেন তা হলে এ ব্যবস্থা থেকেই ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।
দেশের কাগজগুলোর প্রথম পাতা এখন পূর্ণ থাকে অপরাধ ও বিচার-সালিসের প্রতিবেদনে। সুষ্ঠু বিচারের প্রাথমিক শর্ত নির্ভুল তদন্ত। তদন্ত কর্মকর্তার সঠিক রিপোর্টের ভিত্তিতে সাক্ষীসাবুদের জবানবন্দির মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচারকাজ করা সম্ভব। ইংরেজি রিমান্ড শব্দটি আজ বাংলাদেশে বহুল ব্যবহূত শব্দ। ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত জানে রিমান্ড কী এবং কত প্রকার। অভিযুক্তকে পুলিশের হেফাজতে নিয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ ও স্বীকারোক্তি সংগ্রহের যে ব্যবস্থা বা হেফাজতে পুনঃপ্রেষণ করাকেই রিমান্ড বলে। এ প্রথা আগেও ছিল। কিন্তু এখনকার মতো তার অপব্যবহার ছিল না।
কোনো অভিযুক্তকে একবারই মাত্র রিমান্ডে নেওয়ার বিধান ছিল। সেটাও এক দিন-দুই দিনের জন্য। আজ পাঁচ-দশ দিন পর্যন্ত একজন অভিযুক্ত রিমান্ডে থাকছে। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশ হেফাজতে নিয়ে অভিযুক্তকে কী ধরনের নির্যাতন করা হচ্ছে বা তার সঙ্গে কেমন চাপমূলক আচরণ করা হচ্ছে তা ভুক্তভোগী ও নিপীড়নকারী কর্মকর্তারাই শুধু জানেন। এই প্রথা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তা ছাড়া আরও যা মারাত্মক ব্যাপার তা হলো, রিমান্ডের মাধ্যমে অনেক তদন্তকারী কর্মকর্তা নাকি আর্থিক সুবিধাও লাভ করছেন। যে ধরনের ব্যবস্থা তাতে তা হওয়া সম্ভব। একই অভিযুক্তকে বারবার দীর্ঘ সময়ের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার এই প্রথা আমাদের বিচারব্যবস্থাকে বিশ্বের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করছে। রিমান্ড আজ রাজনৈতিক নির্যাতনের নতুন সংস্করণ। এটা করে যাঁরা স্যাডিস্টিক সুখ পাচ্ছেন, তাঁদের ভবিষ্যত্ও যে শঙ্কামুক্ত নয় তাঁরা তা জানেন না।
সাম্প্রতিককালে আমাদের কাগজগুলো পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের সরবরাহ করা সত্য-মিথ্যা কথা দিয়েই বিরাট শিরোনাম করে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তাদের বক্তব্যও থাকবে, সেই সঙ্গে স্বাধীনভাবে সাংবাদিকদের অভিযুক্ত ব্যক্তির থেকে সংগ্রহ করা কথাও থাকবে—তবেই তা হবে সত্ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা। গত ১০-১২ বছরের চাঞ্চল্যকর মামলাগুলোর গোয়েন্দা বিভাগ কর্তৃক সরবরাহ করা খবরগুলো পর্যালোচনা করলে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়। অধিকাংশ খবরই মনগড়া, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শেষ পর্যন্ত শাস্তি না হোক, আসামিকে সাময়িকভাবে হলেও জনসমক্ষে হেয় করা গেল, সেটাই যেন বড় লাভ। 
বাংলাদেশের বর্তমান বিচারব্যবস্থার আর এক বৈশিষ্ট্য এই যে গায়ের জোরে হোক বা নির্বাচনের মাধ্যমেই হোক সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিচারকের রায় উল্টে যায়। এই প্রবণতা আমাদের বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। বড় বড় রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ সরকারের দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলার ক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহার বা সাজা মওকুফ হতে পারে। কিন্তু ফৌজদারি ও অন্য কোনো অপরাধের মামলায় সাধারণ আদালত থেকে দেওয়া সাজা মওকুফ করা বিচারব্যবস্থার প্রতি রাষ্ট্রের চরম অশ্রদ্ধার প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের চাঞ্চল্যকর ‘সেভেন মার্ডার কেস’-এর সাজাপ্রাপ্ত প্রধান আসামিকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান মুক্তি দিয়েছিলেন। তারপর সেই ব্যক্তিকে জিয়া ও এরশাদ সরকার ‘ভারত প্রতিরোধ সংগ্রামে’ ব্যবহার করেছেন। বহুকাল তাঁকে প্রতি মাসে নিয়মিত দেখা যেত ধানমন্ডি দুই নম্বর সড়কে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে জনা দশেক লোক নিয়ে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, পুলিশের হাতে স্মারকলিপি দিয়ে যেতে। সাবেক সেই ছাত্রলীগ নেতা আজ বিএনপিতে নেই বটে, স্বাধীন দল করেন এবং মুখে তাঁর বোল একটাই: ‘ভারতীয় আগ্রাসন।’ দেশের আর কেউ প্রতিরোধ না করুক তিনি একাই সেটা ঠেকাবেন।
রাষ্ট্রপতি প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদও তাঁর দলের এক খুনের আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়ে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার ক্ষমতা আছে। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’ রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতার ব্যবহার অতি বিরল। বহু দেশেই তা হয়ে থাকে মানবিক বিবেচনায়। যেমন কোনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যানসারের মতো কঠিন রোগে ভুগছে, বাঁচবেই আর অল্প কিছুদিন, তার নিজের বা মা-বাবার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরামর্শে তাঁর মৃত্যুদণ্ডটা শুধু মওকুফ হতে পারে, জেল থেকে মুক্তি নয়।
ক্ষমা মহত্তম গুণ। বাংলাদেশে তার প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। খবরে জানা গেল: ‘চারটি দুর্নীতির মামলায় ১৮ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি শাহাদাব আকবরের সাজা মওকুফ করে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। জাতীয় সংসদের উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহাদাব আকবর ২০০৮ সালে জরুরি অবস্থা চলাকালে পলাতক থাকা অবস্থায় সাজাপ্রাপ্ত হন। তিনি কখনো আত্মসমর্পণও করেননি।’ [প্রথম আলো, ১৩.১১.০৯]
সাজা মওকুফ হওয়া ব্যক্তি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২৬(২) ধারায় দুই বছর এবং ২৭(১) ধারার আওতায় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এ ছাড়া [আরও] এক বছর ও পাঁচ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ডসহ প্রায় দেড় কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তাকে আরও ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। শাহাদাব আকবরের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানার পুরোটাই রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দিয়েছেন।’
যে আইনে ওই ব্যক্তি সাজা পেয়েছিলেন এবং সৌভাগ্যবশত বেকসুর খালাস হয়ে গেলেন, ওই আইনে আরও অনেকে এখন সাজা ভোগ করছেন অথবা ‘পলাতক’ রয়েছেন পুলিশের নাকের ডগায়। তাঁদের কী উপায় হবে? তাঁরা ক্ষমা প্রার্থনা করলে কি ক্ষমা পাবেন? যদি তা না পান তাহলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য তা হবে এক নির্মম পরিহাস।
বিচারক ও আইনজীবীদের সমন্বয়েই বিচারব্যবস্থা। মানুষ যেহেতু অপরাধপ্রবণ প্রাণী, তাই বিচারব্যবস্থা মানব সমাজের প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান। মানবজ্ঞানের অর্থাত্ দর্শন-বিজ্ঞানের সূচনালগ্নেই ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গটি মানুষের মাথায় এসেছিল। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকেরা ন্যায়-অন্যায় ও ন্যায়বিচার নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিজ্ঞানপন্থী মুসলমান দার্শনিক আল্ কিন্দী, আল্ ফারাবি, আর-রাজী, ইবনে সিনা প্রমুখ এবং তাঁদের পরে ইবনে বাজা, ইবনে তোফায়েল, ইবনে বাজা রুশ্দ, ইবনে খলদুন প্রমুখ ন্যায়বিচার-বিধি বা থিওরি অব জাস্টিস নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনে ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমার চেয়ে বেশি জানেন আমাদের বিজ্ঞ আইনজীবীরা। আইনজীবীদের থেকে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়, উপসম্পাদকীয় লেখকদের থেকে নয়। যত বড় জঘন্য অপরাধেরই হোক না কেন বিচারপ্রক্রিয়া খুবই নিরাবেগ ব্যাপার। জাজমেন্ট বিষয়টিই হলো সত্য অনুসন্ধান করা, সেটা করতে হয় বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী ধারণার তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে। চোখ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে হোক বা বোধশক্তির দ্বারা হোক সত্যকে উত্ঘাটন করতে হবে যুক্তি (reason) দ্বারা বা অন্তর্নিহিত explanatory principle ব্যবহার করে, যেখানে বিচারের রায়ে (Judgement) কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। 
আদালতের দেওয়া রায়কে অত্যন্ত সংগত কারণ ছাড়া নাকচ করে দেওয়া অর্থাত্ শাস্তিপ্রাপ্ত দোষীকে ক্ষমা করা কি বিচারব্যবস্থার অবমাননা নয়? স্বজনপ্রীতি জিনিসটি খুবই নিন্দনীয়। এবং স্বজনপ্রীতিরও একটি স্তর থাকে। সেই স্তর অতিক্রম বাঞ্ছনীয় নয়।
আমরা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অনর্গল বলি। সে চেতনা হলো: আত্মসম্মানবোধ, আত্মনির্ভরশীলতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার। একটি উন্নত জাতি হিসেবে যদি আমরা পৃথিবীর মানুষের কাছে পরিচিত হতে চাই তাহলে বিচারব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা চলবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

নির্বাচনী ইশতেহার-বহির্ভূত এজেন্ডা



সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ২২-১২-২০০৯
কোনো কোনো অতি ছোট ঘটনা বা অতি অনুল্লেখযোগ্য দৃশ্য কোনো দিন ভোলা যায় না। তেমন একটি ঘটনার কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস হবে। অর্থাত্ বঙ্গীয় বর্ষাকাল। ট্যাক্সির আশায় কলকাতার আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড দিয়ে হাঁটছিলাম। আকাশ ভেঙে ঝমঝম করে বৃষ্টি এল। দৌড়ে গিয়ে উঠলাম, এক বহুকালের পরিত্যক্ত বাড়ির বারান্দায়। সে দালানের কয়েকটি কামরার ছাদ ধসে পড়েছে। কোনো কক্ষেই দরোজা-জানালার নাম-নিশানা নেই। নানা রকম গাছপালা-গুল্ম গজিয়েছে দেয়ালে-মেঝেতে। এক শ-দেড় শ বছর আগে এ বাড়িতে নিশ্চয়ই কত মানুষ বাস করত। বহুকাল যাবত্ মানুষ নয়, সাপ-ব্যাঙ-বেজিদের বাসস্থানে পরিণত হয়েছে বাড়িটি।
কোনো রকমে বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচার চেষ্টা করছি। হঠাত্ গলা কাশার আওয়াজ পেলাম। একটি ঘরের ভেতরে দৃষ্টি গেল। দেখি, পোড়োবাড়ির ভেতরের এক ঘরে বসে এক ক্ষৌরকার এক লোকের মাথা কামাচ্ছে।
প্রবল জোরে বর্ষণ শুরু হলো। অপরাহ্নেই যেন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এল। একপর্যায়ে দেখলাম, মাথা কামানো শেষে নাপিত পুরো শরীর কামানো শুরু করেছে। নাপিতের ক্ষুর চলতে থাকল অতি নিপুণ হাতে। আমার চোখ ততক্ষণে কপালে উঠে গেছে। 
নরসুন্দরের এই বিশেষ কাস্টমারটির হয়তো পরিশুদ্ধ হয়ে পাপমুক্তির প্রাথমিক প্রক্রিয়া ছিল ওটি। মনের মধ্যে যত আবর্জনাই থাক, শরীরের সবকিছু সাফ করে অতীতের পাপ ধুয়েমুছে নদীতে গিয়ে ডুব দিয়ে পরিশুদ্ধ হওয়ার আকুলতা কারও থাকলে দোষ কি?
অনেক দিন পরে ওই ঘটনাটি আমার মনে নতুন তাত্পর্য নিয়ে দেখা দেয়; বিশেষ করে ২৮ পৌষ যেদিন আমাদের দেশে এক গায়েবি সরকারের আবির্ভাব ঘটে। তাঁদের কর্মকাণ্ড দেখে আমার ওই পোড়োবাড়ির সেদিনের দৃশ্য বারবার মনে পড়তে থাকে। তাঁরা জাতির জীবনের যাবতীয় দোষ ও আবর্জনা এক সিটিংয়ে পরিষ্কার করতে চাইলেন। দুর্নীতির লেশমাত্র থাকবে না দেশে, তা নির্মূল ও দমন করতে কমিশন গঠিত হলো। যাঁরা অতীতে দুর্নীতি করেছেন—রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি—তাঁদের পিঠ মোড়া করে বেঁধে জালি দেওয়া প্রিজনভ্যানে নিয়ে তুললেন। দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত রেহাই পেলেন না। ফুটপাতকে ফিটফাট করতে হকারদের লাঠিপেটা করে তাড়ালেন। আইনবহির্ভূত বাড়িঘর স্থাপনাগুলোয় বুলডোজার দিয়ে মারলেন ঠেলা। ধমাধম বাড়িঘর দালানকোঠা ধসে পড়তে লাগল। আকাশচুম্বী র্যাংগ্স ভবনকেও ছাড় দিলেন না। নির্মল আনন্দে সেখানে পড়ল হাতুড়ির বাড়ি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের আড়াই শ গজের মধ্যে আধা ডজন শ্রমিকের লাশ ঝুলে রইল এক সপ্তাহ। হাজার হাজার বীর বাঙালি সেই দৃশ্য উপভোগ করল রাস্তায় দাঁড়িয়ে। বাঙালি নারীর রাঁধুনি হিসেবে সুনাম আছে, এক কাঁচকলা দিয়ে দশ ব্যঞ্জন তৈরি করতে পারে, কিন্তু সেনা নেতৃত্বাধীন সেই গায়েবি সরকার দেখিয়ে দিল, এক গোলআলু দিয়ে কত পদ রান্না করা সম্ভব। খাওয়ার টেবিলে আলুর আইটেমগুলো দেখে আমাদের মিডিয়া ও সমাজপতিরা বললেন, সোবহান আল্লাহ। একাত্তরের ডিসেম্বরে যে চালের দাম ছিল ৩৮ টাকা মণ, সরকার সেই চাল খাওয়াল ৪২ টাকা কেজি। দক্ষ কুমার যেভাবে মাটি ছেনে পুতুল বানায়, সেইভাবে ওই সরকার পুরোনো নেতৃত্ব বাতিল করে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করতে চাইল। রাশি রাশি টাকা ঢেলে গড়ল নতুন নতুন দল। একপর্যায়ে তাদের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ছিল, অথবা তাদের সঙ্গে ক্ষমতা শেয়ার করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বাদ সাধল জনগণ। আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকেরা পিছু হটলেন। হঠাত্ তাঁদের মধ্যে গণতন্ত্রের চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটল। বললেন, নির্বাচন দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জোটের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে কোনো রকমে কেঁদে বাঁচো।
গণতান্ত্রিক সরকার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে এ দেশের মানুষের কখনো কখনো, তবে গায়েবি সরকার আমরা দেখেছি বহুবার: ১৯৫৮-তে, ’৭৫-এ, ’৮২-তে এবং ২০০৭-এ। গায়েবি সরকার রাতারাতি অনেক কিছু সাফসুতরো করতে পারে, গণতান্ত্রিক সরকার তা পারে না। কিন্তু বারবার লক্ষ করেছি, আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের গুরু যেন গায়েবি সরকারগুলো। গায়েবি সরকারের স্বৈরাচারী ফিলোসফিকেই আদর্শ ও দর্শন হিসেবে গ্রহণ করে নির্বাচিত সরকারগুলো। আর একটি জিনিস লক্ষ করেছি যে গণতান্ত্রিক সরকারের নাভিশ্বাস না ওঠা পর্যন্ত তাদের হুঁশ হয় না। বাহাত্তর-পঁচাত্তরের সরকারের হুঁশ ছিল না, গায়ের জোরে তারা কাজ করা পছন্দ করত এবং তার মূল্য দিতে হয়েছে। ওই সরকারের কুমন্ত্রণাদাতা ও মোসাহেবদের গায়ে আঁচড়টিও পড়েনি।
১৯৯১-৯৬ সরকারের হুঁশ না থাকায় খেসারত দিতে হয়েছিল। ১৯৯৬-২০০১-এর সরকার প্রথম বছর দুই-তিন ভালোই ছিল, তারপর বেহুঁশ হয়ে পড়ে। মূল্য তাকেও দিতে হয়। ২০০১-২০০৬-এর সরকার অতিরিক্ত আসন পেয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ায় খুশিতে বেহুঁশের ঘোরে প্রথম দিন থেকেই গাইতে থাকে: প্রথম বাংলাদেশ আমাদের—শেষ করা পর্যন্তও বাংলাদেশ আমাদেরই। তাদের জুনিয়ার পার্টনারের কাছে গান-বাজনা হারাম, বাংলা গান আরও হারাম। তবু তাঁরা সুর না করে শুধু আওড়ান: বাংলাস্থান, পাকিস্তান, আরব জাঁহা হামারা, সারে জাঁহা আচ্ছা, বাংলাস্থান আচ্ছা। স্বাধীনতা আমরা এনেছি—ক্ষমতায় চিরকাল আমাদের থাকতে হবে। বিএনপি-জামায়াতের বাড়াবাড়িতে বিশ্বায়নের যুগে বিদেশি বন্ধুরাই যে মুখ ভার করল তা-ই নয়, দেশের মানুষও বেঁকে বসল। পরিণাম ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনী ম্যান্ডেট।
মানবজাতির রাজনৈতিক শব্দভান্ডারে কিছুকাল যাবত্ মার্কিনদের উদ্ভাবিত একটি নতুন শব্দ ‘রোডম্যাপ’ যোগ হয়েছে। দুনিয়াটা কোন দশকে কীভাবে চলবে, তার একটা মহা রোডম্যাপ করাই আছে। কোন দেশ কোন সরকারের নেতৃত্বে, কীভাবে চলবে, তার জন্য আছে আলাদা রোডম্যাপ। এবং সেই রোডম্যাপ মোতাবেক না চললে বা সরকার না চালাতে পারলে, কোথাকার কোন সরকারকে কীভাবে টোকা দিয়ে সরিয়ে দিতে হবে, তারও রোডম্যাপ আছে। তারপর কোন গোত্রকে কী প্রক্রিয়ায় রোডম্যাপ বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে হোক বা গায়েবি প্রক্রিয়ায় হোক, ক্ষমতায় বসাতে হবে, তারও রোডম্যাপ করা আছে। সুতরাং খাতির জমায় বসে থাকার কোনো কারণ নেই। সবই ওপরওয়ালাদের ইচ্ছা। অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল বেনজিরকে সরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানে এক রোডম্যাপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অন্য রকম রোডম্যাপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। নেপালে সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল আন্তর্জাতিক রোডম্যাপ মোতাবেক হয়নি, জনগণ মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টিকে বেশি ভোট দিয়ে ফেলে। বৃহত্তম দলের নেতা হিসেবে মাওবাদী নেতা পুষ্পকমল দহল প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী হন। গণতন্ত্রকে যাঁরা ধর্মশাস্ত্রের মতো পূজা করেন, তাঁরা এক বছরও প্রচণ্ডকে ক্ষমতায় থাকতে দিলেন না, তাঁকে ফেলে দিলেন। তাঁরাই আবার মিয়ানমারের সু চির জন্য সারা রাত জেগে চোখের পানিতে বুক ভাসান। সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক মিয়ানমারের পাশে চীন না থাকলে এত দিনে কতবার যে সেখানে সরকার বদল হতো, তার ঠিক নেই। এগুলোকে বলে রোডম্যাপ। বাংলাদেশ রোডম্যাপের বাইরে নয়।
প্রায় এক বছর হতে যাচ্ছে মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক রোডম্যাপের সঙ্গে সংগতি রেখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের একটি নির্বাচনী অঙ্গীকার ও নিজস্ব রোডম্যাপ ছিল। অঘোষিত কিছু এজেন্ডাও নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু এক বছরে সরকার নির্বাচনী ইশতেহারের চেয়ে ইশতেহার-বহির্ভূত ব্যাপারেই বেশি মনোযোগ দিয়েছে। বিরোধী দল হাত-পা-মেরুদণ্ড ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকায় সরকার নানা রকম এজেন্ডা বাস্তবায়নে বেশি উত্সাহ বোধ করছে। জনগণ জাতিগঠনমূলক কাজই পছন্দ করে, এজেন্ডা বাস্তবায়ন নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২১ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা তো দূরের কথা, চার বছর পরের নির্বাচনে যে জয়লাভ করা যাবে, সে ব্যাপারে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। শনিবার এক আলোচনা সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগকে কেউ ক্ষমতা থেকে হটাতে পারবে না। এ ধরনের চিন্তা হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা যদি কাজ না করি, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ না করি, তবে আবার ক্ষমতায় আসব—এমন চিন্তা আমি করি না। আমার মনে হয়, সাধারণ মানুষও করে না।’ [ইত্তেফাক]
কাকে উদ্দেশ করে তিনি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন বলা মুশকিল, তবে সঠিক কথাই বলেছেন। ওই একই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন ও প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম প্রশাসনে বিভিন্ন পদে থাকা রাজাকার এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকর্তাদের তালিকা দেওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তথ্য-প্রমাণসহ নাম বলতে পারলে সরকার ব্যবস্থা নেবে।
জনাব ইমাম শান্ত, নম্র ও অমায়িক ব্যক্তিত্ব; প্রশাসনিক ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের, প্রবাসী সরকারের তিনি ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তা। বাংলাদেশের প্রশাসনের নাড়ি-নক্ষত্র তিনি জানেন, তাঁর সমসাময়িক ও সামান্য পরবর্তী কর্মকর্তাদের চরিত্রও তাঁর ভালো জানা। একাত্তরের রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী কারও পক্ষে কি এখন চাকরিতে থাকা সম্ভব? তাঁরা তো ইতিমধ্যে অবসরে গেছেন। এখন যাঁরা চাকরিতে আছেন, তাঁদের চাকরি জীবনের শুরু আশির দশকে। এখন প্রশাসনে যদি রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধী বলে কর্মকর্তাদের খোঁজা হয়, তাহলে তা হবে হিংসা-প্রতিহিংসার খেলা। এ ঘোষণায় প্রশাসন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। 
সমস্যাজর্জরিত দেশে মন্ত্রিপরিষদের অসংখ্য কাজ। কেবিনেট সভায় বড় বড় ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। ১৪ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করেন, যদিও তা এজেন্ডাভুক্ত ছিল না। নতুন নাম কী হবে—এ নিয়ে উপস্থিত সদস্যরা একাধিক নাম প্রস্তাব করলেও হজরত শাহজালাল (রহ.) নামকরণের ব্যাপারে সব সদস্যই একমত পোষণ করেন। একই সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে যেসব স্থাপনার নামকরণ হয়েছিল, তা আগের নামে ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। 
নাম পরিবর্তনের নোংরা কাজটি খালেদা জিয়াও করেছিলেন। তাঁর নিজের নামে ও জিয়ার নামে বহু প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের আমলে সাভারে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের নাম করা হয়েছিল শেখ হাসিনার নামে। বিএনপি-জামায়াত সরকার যখন ওই নাম তুলে দেয়, তখন ঘৃণায় আমার রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল এবং আমি আমার কলামে প্রতিবাদ করেছিলাম। বরিশালে শহীদ জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বদলে বলার কিছু নেই, কিন্তু ‘জিয়া’র নাম পরিবর্তন কোনো রকম যুক্তির মধ্যে পড়ছে না। 
১৯৮১-তে জিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর নামে তত্কালীন সরকার বিমানবন্দরের নামকরণ করে। তখন বেগম জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন না। জিয়া শুধু সেক্টর কমান্ডার নন। পাঁচ বছর রাষ্ট্রের শাসক ছিলেন। দেশের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর সুনাম ছিল। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের শাসক ও তাঁদের ছেলেমেয়েরা দুর্নীতিগ্রস্ত। ব্যক্তিগত জীবনে জিয়া দুর্নীতির ঊর্ধ্বে ছিলেন। জিয়ার জানাজায় যত মানুষ হয়েছিল, পৃথিবীর কম মুসলমানের জানাজায় তত লোক হয়েছে। প্রতিটি দেশের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস থাকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১-র ইতিহাস জিয়াকে বাদ দিয়ে হবে না। প্রশাসক হিসেবে তিনি বাংলাদেশের কোনো শাসকের চেয়ে খারাপ ছিলেন, তা এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। জিয়া পাঁচ বছর বাংলার শাসক ছিলেন, শেরশাহ চার বছর ভারতের শাসনকর্তা ছিলেন—১৫৪০ থেকে ১৫৪৪। তাঁর নামে নয়াদিল্লিতে বিরাট শেরশাহ রোড আছে। 
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জিয়া পাঁচ বছরে একটি অসৌজন্যমূলক উক্তিও করেননি। নিহত হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে তিনি দক্ষিণ বাংলা থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আসার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে স্বাধীনতাসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার আন্তরিক প্রশংসা করছিলেন। তবে নিশ্চয়ই তাঁর রাজনীতি ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির বিপরীত আদর্শের রাজনীতি। জিয়ার রাজনীতির যখন আমরা মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করব, সেখানে তিনি সমালোচিত হবেন।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিমান প্রতিমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদেশে অবস্থানকালে বিমানবন্দর থেকে জিয়ার নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। পত্রিকায় খবর হওয়া মাত্র রাজপথে নেমে পড়েছিল মানুষ। জিয়ার কবরসংলগ্ন ক্রিসেন্ট লেক থেকে ভাসমান সাঁকোটি রাতের বেলা সিলেটে সরিয়ে নেওয়া হলেও অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এসব খুবই নিম্নমানের প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এসব করে কোনো অবস্থাতেই কেউ লাভবান হতে পারে না। জিয়ার পেছনে এই সরকার যত লাগবে, তত জিয়ার অনুরাগীরা বঙ্গবন্ধুর দোষত্রুটি খুঁজে বের করে প্রচার করবে। শেষ পর্যন্ত বেশি ক্ষতি কার, সেটা ভেবে দেখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা ছিটেফোঁটা পেয়ে ঘাপটি মেরে আছেন। কোনো বড় বিপর্যয় ঘটলেও তাঁরা নীরবতাই অবলম্বন করবেন, যেমন করেছিলেন ২৮ পৌষের পরে পৌনে দুই বছর। অথবা উদীয়মান শক্তিকে বলবেন: আমরা তো মহাজোট সরকারের কাজকারবার সমর্থন করিনি। তখন তা বললে পাওয়া যাবে নতুনদের থেকে নতুন সুবিধা। এ-ই তো হচ্ছে ৪০ বছর যাবত্। দুঃখের বিষয় হলো, সরকারকে সত্ পরামর্শ বা সাবধান করার কেউ নেই। 
তড়িঘড়ি করে যাবতীয় কাজ করতে গিয়ে গায়েবি সরকার নিজেদের জন্য যে বিপদ ডেকে এনেছিল, মহাজোট সরকারও সেই পথই ধরেছে। এই সরকারের হিতার্থীরা শনিবার এক আলোচনা সভায় বলেছেন, আওয়ামী লীগ আজও বিপদমুক্ত হয়নি। আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটতে পারে। আশার কথাও বলা হয়েছে: দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সন্ত্রাস দমন ও দলীয় টেন্ডারবাজি বন্ধ করতে পারলে আগামী ৫০ বছরেও বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না। পাটমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, ‘সরকারের ভেতরে যে অস্থিরতা চলছে, তা আমরা মোকাবিলা করতে পারছি না।’ এই সরকারের বিপর্যয় ঘটলে বিএনপিই যে ক্ষমতায় আসবে, তার নিশ্চয়তা কি? আরও তো ‘দেশপ্রেমিক’ শক্তি থাকতে পারে? পঁচাত্তরের আগস্টে জাসদ বা ভাসানী ন্যাপ ক্ষমতায় যায়নি, অজ্ঞাতনামারাই গিয়েছিল। 
যেকোনো দূরদর্শী ক্ষমতাসীন দলের উচিত, শত্রুর সংখ্যা কমিয়ে আনা, বাড়ানো নয়। গণতন্ত্রকামী প্রত্যেক মানুষ চায় একটি স্থিতিশীল সরকার এবং যথাসময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের পরিবর্তন। কিন্তু সরকার নিজেই যদি অস্থিতিশীলতা ডেকে আনে, তখন জনগণের কিছুই করার থাকে না। আশা করি, সরকার প্রতিপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের পরিচয় দেবে এবং খুব ভেবেচিন্তে কাজ করবে। 
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

পার্লামেন্ট



সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ২৮-০৯-২০১০
যাঁরা লন্ডনে থাকেন অথবা সেখানে ঘন ঘন যাওয়া-আসা করেন, তাঁরা টেমস নদীর তীরে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরের মানুষদের সম্পর্কে ভালো জানেন। বাইরে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ওই ভবনটি আমার একনজর দেখার সুযোগ হয়েছিল। ভবনটি আলিশান কি না, তার স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য কী, সেটা বড় কথা নয়। ওর ভেতরের অস্থায়ী বাসিন্দারা কেমন, সেটাই বিবেচ্য। কী কী কাজ তাঁরা কীভাবে করেন, কেমন তাঁদের আচার-আচরণ, দলের নেতার সম্পর্কে কণ্ঠে মধু ঢেলে হাত কচলে কী ভঙ্গিতে কথা বলেন এবং নিজেদের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে ওই কণ্ঠই বা কেমন বাঘের মতো গর্জে ওঠে, অথবা কচলানো হাত কীভাবে মহাবীর আলেকজান্ডারের তরবারির মতো শূন্যে উত্থিত হয়, তা দেখার সুযোগ পাইনি। তবে আরও কয়েকটি দেশের পার্লামেন্ট ভবন দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বাংলার মাটিতেও পার্লামেন্ট ভবন দেখেছি। একটি নয়, দুটি। দূর থেকেও নয়, তার ভেতরে গিয়ে। নাখালপাড়ার নিচু বাড়িটি দেখেছি, শেরেবাংলা নগরে লুই আই কানের সুউচ্চ স্থাপত্যটিও দেখেছি। সবশেষে গিয়েছি বহুদিন পর এবার অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণার দিন—সরকারের আমন্ত্রণে।
‘তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে’ অর্জিত ‘বাংলার মাটি’র পার্লামেন্ট ভবনটি পৃথিবীর কনিষ্ঠ পার্লামেন্ট ভবনের একটি। মালয়েশিয়ার যে পার্লামেন্ট ভবন দেখেছি, তার বয়স লুই কানেরটির চেয়ে কম। জার্মান, ফরাসি ও ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবন দেখলে সমীহ হয়। তাকিয়ে দেখে আমার মনে হয়েছে, ওই সব দেশের সব মানুষের চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে ওই ইমারতটির ইট-পাথরের মধ্যে। ইরান ও চীনের পার্লামেন্ট ভবন দেখে আমার অন্য রকম অনুভূতি হয়েছিল, সে কথা অন্য সময় বলব।
পৃথিবীর পার্লামেন্ট ভবনগুলো আমার চেয়ে বহুগুণ বেশি দেখেছেন বাংলার পার্লামেন্টের সদস্য—সংক্ষেপে এমপিরা। এমনকি তাঁদের কেউ ইসরায়েলের পার্লামেন্ট বা নেসেট (Knesset) ভবনটিও দেখেছেন, যদিও আমাদের রাষ্ট্রপতি ওই জঙ্গি রাষ্ট্রটিতে যাওয়ার অনুমতি বাংলাদেশের কোনো নাগরিককেই দেন না আমাদের পাসপোর্টে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ এবং মুসলিম উম্মাহর নিশানবরদার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের দুজন বিশিষ্ট এমপি চুপিসারে অন্তত একবার তেল আবিব বেড়িয়ে এসেছেন। কত তারিখে তাঁরা গিয়েছিলেন, তা আমি বলব না। বলপেন গুঁতিয়ে খাই। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আমাদের সাহস না থাকতে পারে, চক্ষুলজ্জা আছে। তা ছাড়া ইসরায়েলের মনোরম নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে যাওয়া এমপিদের একজন আজ পরলোকে। মৃত ব্যক্তির রেফারেন্স দিয়ে গালগল্পমূলক উপসম্পাদকীয় রচনা লেখা আমার স্বভাববিরুদ্ধ।
দেশের ভেতরে যখন এক দলের নেতারা আরেক দলের নেতাদের চিবিয়ে খান, ঢাকার রাজপথ উত্তাল, তখন আমাদের দুই এমপি একে অপরের হাত ধরে বাংলার মাটি থেকে গিয়ে ইসরায়েলের মাটিতে ঢুকে পড়েন। ওখানকার প্রকৃতির শোভা দেখে তাজ্জব হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়তো বলেছিলেন, ‘আহ্, কী সুন্দর দেশ! আমাদের সোনার বাংলাও এই রকম হবে।’ তাঁর মুসলিম জাতীয়তাবাদী সহকর্মীটি হাতে চাপ দিয়ে বলেছিলেন: ‘সোনার বাংলা আর পিতলের বাংলা, যা-ই করেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি সংবিধানে যা কিছু বসাইয়া গেছেন তাতে হাত দিয়েন না।’
আজ দেশে দেশে যে পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি দেখছি, তার সূচনা ১৯৭৩ সালে বলে আমাদের বালক-বালিকাদের কেউ মনে করতে পারেন। আসলে তা ঠিক নয়। আধুনিক পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সূচনা বহু আগে। ৭০০ বছর তো হবেই! ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে বলা হয় ‘মাদার অব পার্লামেন্টস’। কারণ প্রায় সব দেশের আধুনিক পার্লামেন্ট গঠিত হয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আদলে। পার্লামেন্টের আরেক নাম ‘লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি’ বা আইনপ্রণয়নকারী পরিষদ। আমাদের পার্লামেন্টের আমরা নাম দিয়েছি ‘জাতীয় সংসদ’। 
আধুনিক পার্লামেন্টগুলোর রীতিনীতি ও কার্যক্রম ব্রিটেনের মাদার পার্লামেন্ট থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। স্পিকার মাঝবরাবর উঁচুতে বসা। তাঁর ডান দিকে সামনে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহকর্মীরা এবং বাঁ দিকে সামনে বিরোধীদলীয় নেতা ও তাঁদের দলের সদস্যরা। তবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অনেক অপ্রীতিকর ও বিয়োগাত্মক ব্যাপারই হয়েছে, কিন্তু বাঁ দিকের আসন বণ্টন নিয়ে কোনো দিন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়নি। তা থেকে সংসদ বর্জন তো নয়ই। ‘বর্জন’ শব্দটি ব্রিটিশদের অভিধানে অনেক কাল ছিল না।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কোনো সদস্য বক্তব্য দিতে চাইলে তিনি তাঁর হ্যাট খুলে আসন থেকে উঠে দাঁড়াননি এবং গলা ফাটিয়ে চেঁচামেচি না করে স্পিকারের অনুমতির অপেক্ষায় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ওপর দিয়ে গত ৭০০ বছরে বহু ঝড় বয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। আবার তা নির্মাণ করা হয়েছে একই জায়গায়।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার মাস তিনেক আগে হিটলার ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবনে বোমা ফেলেন। ভয়াবহভাবে বিধ্বস্ত হয়। রবিবাবু ভয় পেয়ে যান। ভাবলেন, এই বুঝি ব্রিটিশ সভ্যতা শেষ হতে যাচ্ছে। সভ্যতার সংকটের কথা তাঁর মাথায় আসে। কিন্তু কোনো জাতির অদম্য মনোবল থাকলে যেকোনো ক্ষতি সে পুষিয়ে নিতে পারে। যুদ্ধের পরে একই জায়গায় পার্লামেন্ট ভবন পুনর্নির্মাণ করা হয়।
সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেনেও বহুকাল নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। ১৯১৮ সালে নারীরা ভোটাধিকার পান। তবে ৩০ বছরের বেশি বয়স্করাই ভোট দিতে পারতেন। ১৯২৮ থেকে নারী ভোটারদের বয়স কমিয়ে ২১-এ আনা হয়।
আমেরিকার কংগ্রেস বা সেখানকার পার্লামেন্ট সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার দরকার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও প্রতিনিধি সভা সম্পর্কে বাঙালি যা জানে, তা আমেরিকার সাধারণ মানুষও জানে কি না সন্দেহ। আমাদের রাজনীতিকেরা নানা ব্যাপারে নালিশ নিয়ে ওখানকার কংগ্রেস সদস্যদের কাছেই ধরনা দেন।
প্রকৃতপক্ষে, অন্য দেশের পার্লামেন্ট সম্পর্কে কথা বলার অধিকার আমার নেই। যেটুকু জানি তা আমাদের দেশের পার্লামেন্ট সম্পর্কেই। প্রথম পার্লামেন্টের সদস্যরা কীভাবে নির্বাচিত হন, তা আমার খুব ভালোভাবে জানা আছে।
বাংলাদেশের প্রথম সংসদের প্রথম অধিবেশন থেকে শেষ অধিবেশনটি পর্যন্ত সবগুলোতেই উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনের প্রচারাভিযানে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর অন্যান্য সহকর্মীর সঙ্গে সারা দেশ হেলিকপ্টারে ঘোরার সুযোগও হয়েছিল। ভারতের হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার তুষার পণ্ডিত, স্টেটসম্যান-এর মানস ঘোষ, যুগান্তর-এর সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত ও দিল্লির কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে থাকতেন।
নামমাত্র বিরোধী দল থাকলেও খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল কোনো কোনো আসনে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভাসানী ন্যাপ ও নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের। এমন অনেকের জন্য বঙ্গবন্ধু সারা দেশ ঘুরেছেন, যাঁরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও জয়ী হতে পারতেন না।
বিচারপতি ইদ্রিস ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কিছু আসনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তাঁরও বিশেষ কিছু করার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর কথা আলাদা। তিনি ছাড়া আর যে দশজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, তা ছিল গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ভারতের পত্রপত্রিকায় তা নিয়ে কঠোর সমালোচনা হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসনে জয়ী হয়। জাসদ পেয়েছিল গোটা তিনেক। ভাসানী ন্যাপ একটি এবং স্বতন্ত্র তিনটি আসন। বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ভাগ্য ৭ মার্চ ১৯৭৩ নির্ধারিত হয়ে যায়।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে প্রথম সংসদটির অধিবেশন বসেছিল নাখালপাড়ার বাড়িটিতে। প্রথম অধিবেশন বসে ৭ এপ্রিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সংসদনেতা ও প্রধানমন্ত্রী। আতাউর রহমান খান বিরোধীদলীয় নেতা। সংসদে বিরোধী দলকে অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে দেখতে হতো। বঙ্গবন্ধু নিজের দলের ও বিরোধী দলের সদস্যদের সঙ্গে নানা রকম রসিকতা করতেন।
প্রথম সংসদ ছিল প্রাণহীন। বিরোধী দলের সদস্য জনা কয়েক হওয়ায় তাঁরা লম্বা বক্তব্যের সুযোগ পেতেন। তবে মনে পড়ে, সরকারি দলের কোনো কোনো সদস্য যেমন শাহ মোয়াজ্জেম প্রমুখ, বিশেষ করে সত্তর-একাত্তরের বিখ্যাত চার ছাত্রনেতার একজন যাত্রাদলের অধিকারীর মতো অনর্গল বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করে পার্লামেন্ট ভবন কাঁপিয়ে তুলতেন। স্পিকারের সাধ্য ছিল না তাঁকে থামান। যেদিন বাকশাল গঠিত হয়, সেই বিশেষ দিনে অবজারভার সম্পাদক ওবায়দুল হক, জনপদ সম্পাদক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও আরও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদকের সঙ্গে আমিও গ্যালারিতে বসা ছিলাম। সেদিন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘দেশ এক অবৈধ গ্রাম্যতার দিকে’ যাচ্ছে। বিল পাস হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু বারান্দায় তা নিয়ে আমাদের সঙ্গে রসিকতা করেন। সেদিন দুজন ছাড়া কোনো সদস্য বাকশাল গঠনের বিরোধিতা করেননি। পদত্যাগ করার তো প্রশ্নই আসে না।
পেটের দায়ে কাগজে নানা রকম রচনা লিখি।
অনেকে যাঁরা দেশ নিয়ে ভাবিত, ফোনে ও সশরীরে যোগাযোগ করেন। বিচিত্র বিষয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করেন অথবা পরামর্শ দেন। দেশে বেশুমার সমস্যা, লেখার বিষয় অন্তহীন। সেদিন একজন অনুরোধ করলেন, উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতি রায় দিয়েছেন, ব্রিটিশ জেনারেল ক্রসওয়েলের মতো জেনারেল জিয়ারও মরণোত্তর বিচার হওয়া উচিত। মোশতাকেরও বিচার হওয়া দরকার। আপনার কলামে বিষয়টি নিয়ে শক্ত করে লেখেন। 
পরামর্শদাতাকে আমি বললাম, খোন্কার সাহেবের বিচার ইতিহাস করেছে। ইতিমধ্যে বিধাতা তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন। ডালিম-ফারুকদের বিচার করেছে আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের কারও কারও ফাঁসি হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় ১৫ আগস্টের বর্বরতার বিচার অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আরও বেশ কিছু মানুষের বিচারকাজ বাকি আছে।
পরামর্শদাতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন এবং বললেন, তাঁদের সঙ্গে মরণোত্তর হলেও জিয়ার বিচারও হওয়া দরকার।
আমি বললাম, না, জিয়ার নয়। তাঁর বিচার হবে পরে। তাঁর আগে অতি অল্প কয়েকজন বাদে ওই পার্লামেন্টের সব সদস্যের বিচার করতে হবে। আজ না হোক, একদিন হবে। কেউ না করলে ইতিহাস করবে। ইতিহাস তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেবে বিশ্বাসঘাতকতা ও বেইমানির জন্য। 
তিনি বললেন, তারা কারা?
আমি বললাম, তাঁরা আমাদের প্রথম পার্লামেন্টের মাননীয় সদস্যগণ।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল বলে ’৭৩-এর পার্লামেন্টের সদস্যরা সংসদ ভবনে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারির শীতের মধ্যে রাত-দিন কষ্ট করে বঙ্গবন্ধু তাঁদের জিতিয়ে এনেছিলেন। অধিকাংশ এমপিকে ছোট ভাই ও পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। তা করুন বা না করুন, সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ নিয়ে তাঁরা সংসদে ঢোকেন। বঙ্গবন্ধু যেদিন সপরিবারে নিহত হন, সেদিন তাঁদের সাংবিধানিক কর্তব্যটা কী ছিল? ওই দিন বা ১৬ আগস্ট তাঁরা সংসদ অধিবেশনে বসে সংবিধান রক্ষা করলেন না কেন? কেন তাঁরা ডালিম-ফারুকদের ভৃত্যে পরিণত হলেন? কেন তাঁরা ঢাকা থেকে পালিয়ে গিয়ে কেউ দূর-সম্পর্কের চাচাশ্বশুরের বাড়ির গোয়ালঘরে আশ্রয় নিলেন, কেউ গেলেন বঙ্গভবনে মোশতাকের শীর্ণ পায়ে হাত বোলাতে? 
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৫৯ ঘণ্টা পর ১৭ আগস্ট বিকেল চারটার দিকে আমি জাওয়াদুল করিমের সঙ্গে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। আরও সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ছিলেন। সেখানে কাদের দাঁত বের করা হাসি দেখেছি, তা বলা সম্ভব নয়। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার জন্য কারা তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের পায়ে পড়েন, তা তাঁরা ভুলে গেলেও অনেকেই ভোলেননি। এই হলো প্রথম পার্লামেন্টের সদস্যদের কথা।
দ্বিতীয় পার্লামেন্টেও আমি প্রথম দিন থেকেই ছিলাম। সেখানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ২০৭টি আসন, আওয়ামী লীগ (মালেক উকিল) ৩৯, মুসলিম লীগ ১২, জাসদ আট, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (ছদ্মবেশী জামায়াত) আট, আওয়ামী লীগ (মিজান চৌধুরী) দুটি আসন পায়। দ্বিতীয় সংসদ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বেইমানি করেনি, কিন্তু গণতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ওই সংসদই বেগম খালেদা জিয়াকে একাধিক বাড়ি ও ১০ লাখ টাকা দেয়। ওই সংসদের সদস্যরাই এরশাদ যেদিন (২৪ মার্চ, ১৯৮২) ক্ষমতা দখল করেন, সেদিন গভীর নীরবতা অবলম্বন করেন। প্রতিবাদ করেননি, বরং সন্ধ্যার দিকে কেউ কেউ এরশাদের আত্মীয়স্বজন ও বান্ধবীদের কাছে গিয়ে ধরনা দিয়েছেন।
অর্থাৎ মেয়াদ পূরণের আগেই আমাদের প্রথম ও দ্বিতীয় সংসদের সদস্যরা স্বৈরশাসকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সেই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে আমাদের সংবাদপত্র।
খবরের কাগজের রচনা লেখক না হয়ে যদি বড় পুলিশ কর্মকর্তা হতাম, তাহলে আল্লাহকে হাজের নাজের মেনে বলতাম, বাংলার মাটিতে পার্লামেন্টের সদস্যরা মানুষ খুন না করলেও গণতন্ত্র হত্যার সহায়তাকারীর ভূমিকাটা সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু শ্যাল বি দ্য...’-এর সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার মাটির সংবাদপত্র কোনো স্বৈরশাসককেই ছাড় দেয়নি। সংবাদপত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের সঙ্গে থেকে লড়াই করে বলপেন দিয়ে—পিস্তল, চাপাতি ও রামদা দিয়ে নয়। জনগণের দেওয়া রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে একদল মানুষ লুই আই কানের নকশা করা লাল বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সাংবাদিকেরা শপথ নেন না, তাই শপথ ভঙ্গের প্রশ্ন আসে না; মাননীয় এমপিরা দিব্যি শপথ ভঙ্গ করেন। যাঁদের গণতন্ত্র সংহত করতে ও রক্ষা করতে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করার কথা, তাঁরা গণতন্ত্র হত্যায় সহায়তা করেন। 
‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘৩০ লাখ’—শব্দগুলো যাঁদের ঠোঁটের আগায় লেগে থাকে সারাক্ষণ, তাঁদের আমি হাতজোড় করে প্রশ্ন করতে চাই, সেই ৩০ লাখের মধ্যে পার্লামেন্টের মেম্বর আছেন কতজন? সাংবাদিক খুব বেশি নেই, তবে জনা পনেরো তো আছেনই। যেমন শহীদ সাবের, সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজামউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নাজমুল হক, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, এম এ মান্নান, আবুল বাশার—সব থোকা থোকা নাম। 
লাল বাড়ির প্রকাণ্ড ঘরে দাঁড়িয়ে যাঁদের হাত বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিষ উদিগরণ করতে গিয়ে, সেই মাননীয়দের আমি সবিনয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই, একাত্তরে কয়জন পার্লামেন্টের মেম্বারের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল? তারা ২৫-২৬ মার্চ গণহত্যা শুরুর প্রথম প্রহরেই দ্য পিপল, সংবাদ ও ইত্তেফাক-এর অফিস-ছাপাখানা পুড়িয়ে দেয়। লেখক-সাংবাদিক শহীদ সাবের পুড়ে কয়লা হন। সেদিন কোনো এমপি কয়লা হয়েছিলেন কি?
ষোলোই ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজী রেসকোর্সের ঘাসের মধ্যে গিয়ে হাঁটু ভেঙে না বসলে আরও অন্তত ১০০ সাংবাদিকের ঠাঁই হতো রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে। সংবাদপত্রের ‘নেতিবাচক’ ভূমিকা নিয়ে পৌনে দুই ঘণ্টা বক্তব্য দেওয়া সবাইকে মানায় না। সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই, তাদের আরও মানায় না। কোনো সংস্কৃতিমান মানুষ কার্টুনকে ভয় করে না। রাশিয়ায় গিয়ে পোল্যান্ডের যে রাষ্ট্রপতি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলেন কিছুদিন আগে, তাঁর সরকারকে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বড় রকমের অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে চেয়েছিলেন। তা নিয়ে জার্মান পত্রিকায় কার্টুন হয়েছিল, পোলিশ নেতাকে কোলে বসিয়ে মেরকেল দুধ দিচ্ছেন। ওই অশ্লীল কার্টুনের জন্য সম্পাদককে জার্মান পার্লামেন্ট ভবনে তলব করার দাবি ওঠেনি। প্রিন্সেস ডায়ানার ছেলে উইলিয়ামের বাবা কে, তা নিয়ে সংবাদপত্র প্রশ্ন তুলেছে। ওই সম্পাদককে ওয়েস্টমিনস্টার হলে তলব করার দাবি করেননি কোনো ব্রিটিশ এমপি। 
কোনো সভ্য দেশের পার্লামেন্টে মাননীয়রা ক্ষমতাহীন সাংবাদিকদের নিয়ে যা খুশি তা-ই আলোচনা হয় না। বলা হচ্ছে, কয়েকজন এমপি ও মন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে গালাগাল করেছেন, সকলে নন। কথাটা আমি মেনে নিতে নারাজ। একজনও তো প্রতিবাদ করেননি বা তাঁদের থামিয়ে দেননি। মৌন সম্মতি সকলের রয়েছে, তা বোঝার জন্য বড় মাথার দরকার হয় না। 
হিটলারের পার্লামেন্ট প্রথমেই সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত হানে। মুসোলিনির ইতালির অবস্থাও তাই। যেসব সাংবাদিক সভা-সমাবেশ কাভার করেন, তাঁরা জানেন, আমি সব সময় আমাদের সংবাদমাধ্যমের অসংগতি ও ভুলভ্রান্তির সমালোচনা করি। সাংবাদিকেরা দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর সংবাদ পত্রিকা করতে পারে। তার জন্য প্রেস কাউন্সিলে নালিশ করা যায়। প্রেস কাউন্সিলই সম্পাদক ও প্রতিবেদককে তলব করবে। পার্লামেন্টের মেম্বাররা তলব করলে তা কেমন জমিদার বা দারোগাগিরি মনে হয়। ৩৬ বছর আমি সংবাদমাধ্যমে ছিলাম। কাগজের সম্পাদকও ছিলাম। তাই সম্পাদকদের যখন কোনো কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে, তখন তা আমার গায়ে এসে বিঁধে।
পার্লামেন্ট রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। প্রতিনিধিস্থানীয় মানুষেরাই সেখানে যান। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, জনগণের সুখ-দুঃখ-বেদনা, জাতির ভবিষ্যৎ ও দেশের স্বার্থসংক্রান্ত বিষয় সেখানে আলোচিত হবে। ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রকাশের জায়গা পার্লামেন্ট নয়। যত কষ্টই পাই, আশা করি, আমাদের সংসদও একদিন একটি আদর্শ পার্লামেন্টে পরিণত হবে। 
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।