সৈয়দ আবুল মকসুদ
গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথের কাঁটাগুলো অপসারণের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের।
পৃথিবীর বহু দেশেই বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বিচিত্র বাধা ছিল।
গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই। কোনো একটি মত কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া
নয়, নানা মতাদর্শের সমন্বয়ের ভেতর দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বাংলাদেশের
প্রধান দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা কমিয়ে আনা মোটেই কোনো কঠিন
ব্যাপার নয়। শুধু দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা
অনেক দুঃখের তিমিরের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বিশ্ববাসী অনেকের আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে পারবে না। কারণ তার ভূমি কম, প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত এবং জনসংখ্যা ঘনবসতিপূর্ণ; কিন্তু তাদের আশঙ্কা বা অনুমান অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান থেকে সরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্টই ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বড় পাকিস্তানের অবস্থাই আজ শোচনীয়। কিন্তু বাংলাদেশ আরও ভালো থাকতে পারত, যদি এখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন অব্যাহত থাকত। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে শুরুতেই পুঁতে রাখা ছিল কিছু কাঁটা। দিন দিন কাঁটার সংখ্যা বেড়েছে। সেই কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে জনগণের পা; কিন্তু সেই কাঁটা থেকে সুবিধা নিয়েছেন একশ্রেণীর জনবিরোধী রাজনীতিক, জনবিচ্ছিন্ন আমলা আর সামরিক শাসক ও তাদের দোসররা।
বাংলাদেশের চলি্লশ বছরের ইতিহাস নির্বাচিত সরকারের স্বৈরশাসন, অসাংবিধানিক সামরিক সরকারের স্বৈরাচার এবং গণতান্ত্রিক সরকারের অনাচারে ভরপুর। সরকারি দল ও বিরোধী দলের অসহযোগিতামূলক ও সংঘাতপূর্ণ অবস্থান বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে একটি অন্ধকারময় অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আইনের শাসনের অভাবে জনগণের জীবনে নেমে এসেছে প্রায় অসহনীয়
দুর্দশার অবস্থা।
বাংলাদেশ হাজার বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমন্বিত সাংস্কৃতিক দেশ। বাংলাদেশের সমাজ পরমতসহিষ্ণুতার সমাজ। সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় এক সময় ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদিতা হলো অন্ধকারের জিনিস। সেই অন্ধকার দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ এবং এ ক্ষেত্রে তার সফল না হয়ে উপায় নেই।
অপরাজনীতির ভেতরেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে গেছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। এ ক্ষেত্রে সরকারের চেয়ে বেশি কৃতিত্ব বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। অনেক বাধার ভেতর দিয়ে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের কাজ করতে হয়। তারপরও আজ দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ এক বিকাশমান অর্থনীতি। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে এবং গণতান্ত্রিক সুশাসন থাকলে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাবে, সে সম্ভাবনার কথা বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে যে বাধা তা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধের মারাত্মক অভাব। অথচ বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা অপরিহার্য। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সংসদে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা না করে তা নিয়ে রাজপথে সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। তাতে সমস্যা থেকেই যায়, সমাধান হয় না। এ বিষয়টিই আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট।
গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথের কাঁটাগুলো অপসারণের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। পৃথিবীর বহু দেশেই বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বিচিত্র বাধা ছিল। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই। কোনো একটি মত কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, নানা মতাদর্শের সমন্বয়ের ভেতর দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা কমিয়ে আনা মোটেই কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা।
অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কোনো লাভ হবে না। তাতে শুধু হবে শক্তিক্ষয়। বাড়বে তিক্ততা। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি আলোকিত বাংলাদেশ গড়তে হলে সব দলের নেতাদেরই কিছু ছাড় দিতে হবে। ভিন্নমতের সঙ্গে বৈরিতা না করে সহযোগিতার সঙ্গে কাজ করার মনোভাব না থাকলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ধর্মান্ধতার অন্ধকার আপনাআপনি দূর হবে, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রের অস্থিরতাও কমে আসবে।
পৃথিবীর যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বড় ভূমিকা রাখছে। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া আজ খুবই বিকশিত। সব দলের মতামতই মুহূর্তের মধ্যে জনগণের কাছে পেঁৗছে যাচ্ছে। তা ছাড়া দলীয় রাজনীতির বাইরে বিভিন্ন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও তাদের চিন্তা-ভাবনার কথা প্রকাশ করছেন। তাতে জনগণের চেতনার মান বাড়ছে। সব মতামত বিবেচনা করে তারা নিজেরা একটি স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। ফলে রাজনীতিকরা মানুষকে দীর্ঘ সময় বোকা বানিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটতে পারবে না। জনগণ যখন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় তখন নেতারা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে না। বহু সংগ্রাম করে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতা নষ্ট রাজনীতির স্বার্থে নয়, ব্যবহৃত হবে জনগণের স্বার্থে এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। এটাই বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের দাবি।
স্বাধীনতা অর্জনের আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধে যে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, হারিয়েছেন সহায়-সম্পদ এবং নারীসহ সাধারণ মানুষ সহ্য করেছেন অকল্পনীয় নির্যাতন, সেসব মানুষের স্বপ্ন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। শাসকশ্রেণী সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। সংবিধান কাটাছেঁড়ার ফলে আজ পরস্পরবিরোধিতায় পরিপূর্ণ। মূলনীতি হিসেবে মূল সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপিত হয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও আছে, বিসমিল্লাহও আছে। তাতে আধুনিক গণতান্ত্রিক সংবিধানের চরিত্রটি থাকল না।
তারপরও সংবিধান জনগণকে যে অধিকার দিয়েছে তাও আজ রক্ষিত হচ্ছে না। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষের মৌলিক অধিকারকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। রাষ্ট্রে আজ কিছু নতুন উপদ্রব দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে মহামারীর মতো। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা শোচনীয়। প্রশাসনে দক্ষতার অভাব, দলীয়করণ সর্বত্র। এসবই মানুষের সৃষ্টি। সুতরাং তার সমাধান সম্ভব।
পৃথিবীর অনেক দেশই আজ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি জটিল সমস্যায় জর্জরিত। সেদিক থেকে আমাদের অবস্থান অনেক ভালো। কিন্তু প্রত্যাশিত রকম ভালো নয়। ভালো না থাকার পথে যেসব বাধা তা শনাক্ত করার দায়িত্ব যে কোনো সচেতন মানুষের; কিন্তু তার সমাধান করতে পারেন শুধু নেতারাই। সব রকম অন্ধকারমূলক অবস্থাকে হটিয়ে সবার অংশগ্রহণে মঙ্গল-আলোকে আলোকিত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে_ এ আমাদের প্রত্যাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ :লেখক ও গবেষক
অনেক দুঃখের তিমিরের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বিশ্ববাসী অনেকের আশঙ্কা ছিল বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে পারবে না। কারণ তার ভূমি কম, প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত এবং জনসংখ্যা ঘনবসতিপূর্ণ; কিন্তু তাদের আশঙ্কা বা অনুমান অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান থেকে সরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্টই ভালো অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বড় পাকিস্তানের অবস্থাই আজ শোচনীয়। কিন্তু বাংলাদেশ আরও ভালো থাকতে পারত, যদি এখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন অব্যাহত থাকত। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে শুরুতেই পুঁতে রাখা ছিল কিছু কাঁটা। দিন দিন কাঁটার সংখ্যা বেড়েছে। সেই কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে জনগণের পা; কিন্তু সেই কাঁটা থেকে সুবিধা নিয়েছেন একশ্রেণীর জনবিরোধী রাজনীতিক, জনবিচ্ছিন্ন আমলা আর সামরিক শাসক ও তাদের দোসররা।
বাংলাদেশের চলি্লশ বছরের ইতিহাস নির্বাচিত সরকারের স্বৈরশাসন, অসাংবিধানিক সামরিক সরকারের স্বৈরাচার এবং গণতান্ত্রিক সরকারের অনাচারে ভরপুর। সরকারি দল ও বিরোধী দলের অসহযোগিতামূলক ও সংঘাতপূর্ণ অবস্থান বাংলাদেশকে রাজনৈতিকভাবে একটি অন্ধকারময় অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আইনের শাসনের অভাবে জনগণের জীবনে নেমে এসেছে প্রায় অসহনীয়
দুর্দশার অবস্থা।
বাংলাদেশ হাজার বছর ধরে হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমন্বিত সাংস্কৃতিক দেশ। বাংলাদেশের সমাজ পরমতসহিষ্ণুতার সমাজ। সেখানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় এক সময় ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদিতা হলো অন্ধকারের জিনিস। সেই অন্ধকার দূর করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের মানুষ এবং এ ক্ষেত্রে তার সফল না হয়ে উপায় নেই।
অপরাজনীতির ভেতরেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে গেছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে। এ ক্ষেত্রে সরকারের চেয়ে বেশি কৃতিত্ব বেসরকারি উদ্যোক্তাদের। অনেক বাধার ভেতর দিয়ে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের কাজ করতে হয়। তারপরও আজ দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ এক বিকাশমান অর্থনীতি। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে এবং গণতান্ত্রিক সুশাসন থাকলে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ এ অঞ্চলের অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাবে, সে সম্ভাবনার কথা বিদেশি বিশেষজ্ঞরাও বলছেন।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে যে বাধা তা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধের মারাত্মক অভাব। অথচ বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যা অপরিহার্য। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সংসদে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা না করে তা নিয়ে রাজপথে সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। তাতে সমস্যা থেকেই যায়, সমাধান হয় না। এ বিষয়টিই আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সংকট।
গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথের কাঁটাগুলো অপসারণের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। পৃথিবীর বহু দেশেই বিভিন্ন সময় গণতন্ত্রের যাত্রাপথে বিচিত্র বাধা ছিল। গণতন্ত্রে নানা মত, নানা পথ থাকবেই। কোনো একটি মত কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, নানা মতাদর্শের সমন্বয়ের ভেতর দিয়েই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য রয়েছে তা কমিয়ে আনা মোটেই কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। শুধু দরকার রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা।
অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কোনো লাভ হবে না। তাতে শুধু হবে শক্তিক্ষয়। বাড়বে তিক্ততা। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে একটি আলোকিত বাংলাদেশ গড়তে হলে সব দলের নেতাদেরই কিছু ছাড় দিতে হবে। ভিন্নমতের সঙ্গে বৈরিতা না করে সহযোগিতার সঙ্গে কাজ করার মনোভাব না থাকলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ধর্মান্ধতার অন্ধকার আপনাআপনি দূর হবে, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রের অস্থিরতাও কমে আসবে।
পৃথিবীর যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বড় ভূমিকা রাখছে। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া আজ খুবই বিকশিত। সব দলের মতামতই মুহূর্তের মধ্যে জনগণের কাছে পেঁৗছে যাচ্ছে। তা ছাড়া দলীয় রাজনীতির বাইরে বিভিন্ন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও তাদের চিন্তা-ভাবনার কথা প্রকাশ করছেন। তাতে জনগণের চেতনার মান বাড়ছে। সব মতামত বিবেচনা করে তারা নিজেরা একটি স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। ফলে রাজনীতিকরা মানুষকে দীর্ঘ সময় বোকা বানিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটতে পারবে না। জনগণ যখন সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয় তখন নেতারা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারে না। বহু সংগ্রাম করে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা তাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতা নষ্ট রাজনীতির স্বার্থে নয়, ব্যবহৃত হবে জনগণের স্বার্থে এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। এটাই বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের দাবি।
স্বাধীনতা অর্জনের আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধে যে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছেন, হারিয়েছেন সহায়-সম্পদ এবং নারীসহ সাধারণ মানুষ সহ্য করেছেন অকল্পনীয় নির্যাতন, সেসব মানুষের স্বপ্ন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। শাসকশ্রেণী সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। সংবিধান কাটাছেঁড়ার ফলে আজ পরস্পরবিরোধিতায় পরিপূর্ণ। মূলনীতি হিসেবে মূল সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপিত হয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও আছে, বিসমিল্লাহও আছে। তাতে আধুনিক গণতান্ত্রিক সংবিধানের চরিত্রটি থাকল না।
তারপরও সংবিধান জনগণকে যে অধিকার দিয়েছে তাও আজ রক্ষিত হচ্ছে না। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। শাসকশ্রেণীর স্বার্থে মানুষের মৌলিক অধিকারকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন আসে না। রাষ্ট্রে আজ কিছু নতুন উপদ্রব দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে মহামারীর মতো। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা শোচনীয়। প্রশাসনে দক্ষতার অভাব, দলীয়করণ সর্বত্র। এসবই মানুষের সৃষ্টি। সুতরাং তার সমাধান সম্ভব।
পৃথিবীর অনেক দেশই আজ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি জটিল সমস্যায় জর্জরিত। সেদিক থেকে আমাদের অবস্থান অনেক ভালো। কিন্তু প্রত্যাশিত রকম ভালো নয়। ভালো না থাকার পথে যেসব বাধা তা শনাক্ত করার দায়িত্ব যে কোনো সচেতন মানুষের; কিন্তু তার সমাধান করতে পারেন শুধু নেতারাই। সব রকম অন্ধকারমূলক অবস্থাকে হটিয়ে সবার অংশগ্রহণে মঙ্গল-আলোকে আলোকিত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে_ এ আমাদের প্রত্যাশা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ :লেখক ও গবেষক