এক শ্রেণীর ঘাস বড় হতে হতে বাঁশে পরিণত হয়েছে। বাঁশ বিধাতা বানিয়েছিলেন
প্রধানত মানুষের লাঠি হিসেবে ব্যবহূত হতে। বন্য জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে
বাঁচতে সুদূর অতীতে মানুষ বাঁশ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত পাথর প্রভৃতির
সঙ্গে। তারপর মানুষ বাঁশ ব্যবহার করতে লাগল শত্রুর মাথা ফাটানোর কাজে।
বাঁশের বহু গুণ। বিচিত্র তার ব্যবহার। লাঠির ব্যবহার খুবই সীমিত। কারণ, মানুষ সারাক্ষণ শত্রুবেষ্টিত থাকে না। জীবনের বেশির ভাগ সময় মানুষ মারামারি না করে সুখশান্তিতে বসবাস করে। তা করতেও বাঁশের প্রয়োজন হয়। দালান ও ঘরবাড়ি তৈরির কাজে, ঘরের বেড়া বানাতে, মই বানাতে, ঝুড়ি তৈরি করতে বাঁশের প্রয়োজন। কোথায় কবে কার মাথা ফাটানো হবে, তার জন্য বাঁশকে বসিয়ে না রেখে মানুষ প্রতিদিনের কাজে বিধাতার এই বিচিত্র উদ্ভিদকে ব্যবহার করতে থাকে। সাঁকো ও নৌকার ছই থেকে কবরের ভাড়া হিসেবে বাঁশের ব্যবহার এখন প্রতিমুহূর্তে। নিষ্ঠুরতার মতো সৌন্দর্যবোধও মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। ফুলের সাজি, বিয়ের গায়েহলুদের বরণডালা বানাতে বাঁশ প্রয়োজন। তবে বাঁশের সত্যিকারের সদ্ব্যবহার সম্ভব লাঠি হিসেবেই।
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বাঁশের ইংরেজি নাম বিকৃত করে বলতেন বম্বু। দখলদার ব্রিটিশ সরকারকে বম্বু দিয়ে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে তিনি যুবসমাজকে আহ্বান জানাতেন। তিনি নিজে বাঁশের সদ্ব্যবহার করেছেন জীবনে মাত্র দুইবার। একবার ছাত্রজীবনে। কেউ একজন বলেছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ আর কি এমন কবি—’! রাস্তার পাশে পড়ে ছিল এক বাঁশ। সেটা তুলে বক্তার মাথায় এক বাড়ি। দ্বিতীয় বার তিনি বাঁশের এস্তেমাল করেন ঢাকায়। এখনকার মহাজোটের দক্ষিণ ঢাকার ওয়ারীতে। রানু সোমকে গান শিখিয়ে বেরিয়ে এলে মুসলমান গুণ্ডারা তাঁকে আক্রমণ করে। তারা সংখ্যায় ৮-১০ জন হলেও তাদের ধারণা ছিল না আক্রান্ত লোকটির শরীরে কতটা শক্তি। আশপাশে বিরাট বাঁশ কিছু পড়ে ছিল। নজরুল তার একটি তুলে বন্ বন্ করে ঘোরাতে থাকেন। সেই ঘূর্ণায়মান বাঁশে মাথা ফাটে কয়েকজনের। তারা ওয়ারী থেকে সোজা দক্ষিণ ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল। তবে নজরুল দুইবারই ব্যবহার করেছিলেন শুকনো বাঁশ—কাঁচা বাঁশ নয়।
কুড়ি শতকের শুরুর দিকে বৃহত্তর বাংলায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিল একটি: কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ভাগ্যাহত পূর্ববাংলায় সবেধন নীলমণি ভালো হাসপাতাল ছিল একটি। দক্ষিণ ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতাল। সেটা মেডিকেল কলেজ ছিল না। এখন বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ কত, তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কারণ, আমার লেখা যখন ছাপা হবে, তখন হয়তো দেখা যাবে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা আর একটি বেড়েছে। তবে দেশের ভালো কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজের একটি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
ওই হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ১৮১টি কর্মচারী পদের বিপরীতে আবেদন করেন ৯০০ জন। ২৩ জানুয়ারি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হয়। পরীক্ষা-টরীক্ষা যা-ই হোক মহানগর আওয়ামী লীগ ও মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতারা ৭০ জন কর্মচারী নিয়োগের কোটা দাবি করেন। দাবি পূরণ না হওয়ায় কলেজে ধর্মঘটও পালন করে ছাত্রলীগ। ওদিকে জাতীয় পার্টির সাংসদ ও দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল আসিফ শাহরিয়ার ৪০ জন কর্মচারী নিয়োগের কোটা দাবি করেন। কিন্তু তাতে রাজি হননি হাসপাতালের পরিচালক। এতে ক্রোধ হয় সাংসদের।
পদ ১৮১টি চৌদ্দদলের প্রধান দুই দল যদি ৭০+৪০=১১০টি নেয়, বাকি থাকে ৭১টি। অবশিষ্ট ১২ দলের ১১টি ছয়টি করে কোটা পেতে পারে। একটি দল পাবে পাঁচটি। পাঁচটি যে দল পাবে, তার নেতাদের মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক।
খুবই বিরক্তিকর বাস্তবতা হলো, ১৪ দলের বাইরে সরকারে নেই এমন দলও দেশে আছে। তাদেরও কিছু সমর্থক আছে। তারা ট্যাক্স দেয়। দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। তাদের সাংবিধানিক অধিকার ১৪ দলের লোকদের সমান। যোগ্যতা অনুসারে চাকরিবাকরি পাওয়া তাদেরও সাংবিধানিক অধিকার। তাদের চাকরি পেতে যদি ২০১৫ অথবা ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, তা হবে সরকারের দিক থেকে সংবিধান লঙ্ঘন করা। সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো আইনসংগত পেশা বা বৃত্তিগ্রহণের...অধিকার থাকিবে।’ ঐতিহাসিক পঞ্চম সংশোধনীর সময়ও এমন কোনো কথা যোগ করা হয়নি যে, ‘সরকারি দলগুলির লোকদের বাইরে অন্য কোনো দলের সমর্থক লোকদের যত যোগ্যতাই থাকুক তাহাদের সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো পদে নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সরকারি দলের বাইরের লোকদের চাকরির জন্য আবেদন করা আইনত দণ্ডনীয়।’
কর্মচারী নিয়োগে তাঁর সমর্থকদের কোটারি দাবিতে মাননীয় সাংসদ ‘গঙ্গাচড়া থেকে ১৫টি ট্রাকে সাত-আটশ জাপার নেতা-কর্মী নিয়ে মেডিকেল কলেজ ঘেরাও করতে আসেন। তাঁরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হাসপাতাল গেটে জমায়েত হন।...সেখান থেকে মিছিল নিয়ে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ নিয়ে প্রথমে পুলিশ ও জাপা নেতা-কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া বাধে। পরে সংঘর্ষে যোগ দেয় হাসপাতালের কর্মচারী ও এলাকার সাধারণ মানুষ।’ [দৈনিক সমকাল]
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চাকরির কোটার দাবিতে আসা মাননীয় সাংসদের ‘কর্মী-সমর্থকদের হাতে ছিল কাঁচা বাঁশের লাঠি।’ লাঠিগুলো যে সত্যিই কাঁচা বাঁশের ছিল তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে পত্রপত্রিকায় যে রঙিন ছবি ছাপা হয়েছে, তাতে উত্তোলিত বংশদণ্ডগুলোকে রীতিমতো সবুজ দেখা যাচ্ছে। ধূসর রঙের শুকনো বাঁশের লাঠি একটিও নেই। ঝাড় থেকে সদ্যকাটা বাঁশ দিয়েই তৈরি করা হয়েছে লাঠি। বাঁশ সাবাড় করে বিশেষ উদ্দেশ্যেই লাঠিগুলো তৈরি। এই কাঁঁচা বাঁশের লাঠি মেডিকেল হাসপাতালের পরিচালককে উপহার দেওয়ার জন্য যে তৈরি হয়নি, তা অনুমানেই আমরা বলতে পারি।
আমাদের সাধারণ লোকের বুদ্ধিতে যা বুঝি তা হলো, চাকরির দাবি খালি হাতেও এসে করা যেত। তবে একটি জিনিস আমরা অবশ্যই মূল্যায়ন করব তা হলো, রামদা, চাপাতি ও গোলাবারুদের চেয়ে কাঁচা বাঁশের লাঠি হাজার গুণে ভালো। লাঠি অন্তত হাত দিয়ে ঠেকানো সম্ভব। আমরা জানি, পানির ছিটা দিলে লগির বাড়ি খেতে হয়, ঢিল ছুড়লে পাটকেলটি খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাঁচা বাঁশের লাঠি নিয়ে কাকে মারতে এসেছিলেন জানি না, কিন্তু অনেকেই মার খেয়েছেন, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জখম হয়েছেন অনেকে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক যা তা হলো, মাননীয় সাংসদ নিজেই তাঁরই তৈরি কাঁচা বাঁশের লাঠির আঘাতে মাথা ফাটিয়ে এখন হাসপাতালে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে আক্রমণকারীদের রণনৈপুণ্যের ছবি তুলতে গেলে হাসপাতাল চত্বরে সাতজন সাংবাদিককে বাঁশ দিয়ে পেটান সাংসদের কর্মীরা। সাংবাদিকদের উদ্ধার করতে পুলিশ তাঁদের লাঠিপেটা করে। এক পর্যায়ে হাসপাতালের কর্মচারীরা এসে ধাওয়া দেন সাংসদ ও তাঁর লোকদের। সাংসদ শাহরিয়ারকে মাটিতে ফেলে কাঁচা বাঁশ দিয়ে পেটান কয়েকজন ক্ষুব্ধ কর্মচারী। ১২ জন পুলিশ, সাতজন সাংবাদিক, হাসপাতালের কর্মচারীসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। আতঙ্কে রোগী ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। কোনো রোগী অবশ্য হার্টফেল করে মারা যাননি।
কাঁচা বাঁশওয়ালাদের দল থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ২০১৪ সালে তাঁরা সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। আর বিরোধী দলে নয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিরোধী দলে থাকতে চায় তো থাকুক গিয়ে। তাহলে এই ধৈর্যচ্যুতি কেন? মাত্র দুটি বছরই তো!
সংসদীয় গণতন্ত্রে দুই রকম দল থাকে। এক শ্রেণীর দল ক্ষমতাসীন। আরেক শ্রেণীর দল সরকারের বাইরে, যার নাম বিরোধী দল। এর মাঝে বাংলাদেশে আছে আর এক রকম দল। সে দল যখন প্রয়োজন তখন সরকারি এবং সরকারে থেকেও যখন বিরোধীর ভূমিকায় অভিনয় করার প্রয়োজন তখন বিরোধী। এই রকম দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কয়েকটি আছে। এগুলো সরকারি দলও, বিরোধী দলও। এগুলোকে আমরা নামকরণ করতে পারি: সর-বিরোধী দল, আরও সংক্ষেপে সর্বিরোধী দল।
ক্ষমতায় যেতে চাইলে বেশি আসন, বেশি ভোট দরকার। ভারতবিরোধী যে ভোটগুলো আছে, তা বিএনপি থেকে শুধু নয়, আওয়ামী লীগ থেকেও নিজেদের দিকে আনা দরকার। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশের হতভাগ্য নদনদী।
ভারত সফর করে এসেই উত্তাল গতিতে ছুটছেন নেতা। নদনদীর প্রতি গভীর ভালোবাসা উথলে উঠেছে। দেশের মানুষের পানির অধিকারের প্রশ্নে তিনি মেধা পাটেকারের চেয়ে বেশি আপসহীন। গাড়িতে চড়িয়া নেতা করিছেন লংমার্চ। লংমার্চের কৃতিত্ব একচেটিয়া খালেদা জিয়াকে দেওয়া যায় না। তিস্তার পানির হিস্যা ও টিপাইমুখের জন্য অমূল্য জীবন দিতে প্রস্তুত। ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নদীতে চড়া পড়া নিয়ে লিখেছেন কাঁদো নদী কাঁদো। এখন লংমার্চের বাহার দেখে মৃতপ্রায় নদীগুলোকে আমরা বলব: হাসো নদী হাসো। আগামী নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের নদনদীরা আনন্দে ফেটে পড়বে। নদীদরদি নেতা বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছেন। এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে? তখন দেশবাসী তাঁকে ভূষিত করবে নতুন উপাধিতে: নদীবন্ধু। লংমার্চ শুরুর পর সেটা অবশ্য এখনো দেওয়া যায়।
একটি ছোট দুর্বল দেশ কত রকম অত্যাচার ও উপদ্রব সহ্য করবে? চারদিক হিংসায় সয়লাব। সেটা না হয় মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তার ওপরে ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রও না হয় প্রতিহত করা সম্ভব। কিন্তু মিথ্যাচার? প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, এমনকি প্রচারমাধ্যমের লোকদেরও মিথ্যাচারে বাধ্য করা হচ্ছে। হিংসা, ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচারও মেনে নেওয়া গেল। জনগণের সঙ্গে করা হচ্ছে নানা রকম প্রতারণা ও ছলচাতুরি। এসব তো আছেই, এর মধ্যে কেউ কেউ শুরু করেছেন তামাশা। এত উপসর্গ নিয়ে কীভাবে একটি জাতি টিকে থাকবে?
অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে গেছে, এরপর মানুষ বলবে, আমরা ভাত কাপড়, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, বাসস্থান কিছুই চাই না। আমাদের অন্তত একটুখানি সামাজিকভাবে শান্তিতে থাকতে দাও। আমাদের মনের ওপর অত্যাচার করার অধিকার কারও নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বাঁশের বহু গুণ। বিচিত্র তার ব্যবহার। লাঠির ব্যবহার খুবই সীমিত। কারণ, মানুষ সারাক্ষণ শত্রুবেষ্টিত থাকে না। জীবনের বেশির ভাগ সময় মানুষ মারামারি না করে সুখশান্তিতে বসবাস করে। তা করতেও বাঁশের প্রয়োজন হয়। দালান ও ঘরবাড়ি তৈরির কাজে, ঘরের বেড়া বানাতে, মই বানাতে, ঝুড়ি তৈরি করতে বাঁশের প্রয়োজন। কোথায় কবে কার মাথা ফাটানো হবে, তার জন্য বাঁশকে বসিয়ে না রেখে মানুষ প্রতিদিনের কাজে বিধাতার এই বিচিত্র উদ্ভিদকে ব্যবহার করতে থাকে। সাঁকো ও নৌকার ছই থেকে কবরের ভাড়া হিসেবে বাঁশের ব্যবহার এখন প্রতিমুহূর্তে। নিষ্ঠুরতার মতো সৌন্দর্যবোধও মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। ফুলের সাজি, বিয়ের গায়েহলুদের বরণডালা বানাতে বাঁশ প্রয়োজন। তবে বাঁশের সত্যিকারের সদ্ব্যবহার সম্ভব লাঠি হিসেবেই।
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বাঁশের ইংরেজি নাম বিকৃত করে বলতেন বম্বু। দখলদার ব্রিটিশ সরকারকে বম্বু দিয়ে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে তিনি যুবসমাজকে আহ্বান জানাতেন। তিনি নিজে বাঁশের সদ্ব্যবহার করেছেন জীবনে মাত্র দুইবার। একবার ছাত্রজীবনে। কেউ একজন বলেছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ আর কি এমন কবি—’! রাস্তার পাশে পড়ে ছিল এক বাঁশ। সেটা তুলে বক্তার মাথায় এক বাড়ি। দ্বিতীয় বার তিনি বাঁশের এস্তেমাল করেন ঢাকায়। এখনকার মহাজোটের দক্ষিণ ঢাকার ওয়ারীতে। রানু সোমকে গান শিখিয়ে বেরিয়ে এলে মুসলমান গুণ্ডারা তাঁকে আক্রমণ করে। তারা সংখ্যায় ৮-১০ জন হলেও তাদের ধারণা ছিল না আক্রান্ত লোকটির শরীরে কতটা শক্তি। আশপাশে বিরাট বাঁশ কিছু পড়ে ছিল। নজরুল তার একটি তুলে বন্ বন্ করে ঘোরাতে থাকেন। সেই ঘূর্ণায়মান বাঁশে মাথা ফাটে কয়েকজনের। তারা ওয়ারী থেকে সোজা দক্ষিণ ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল। তবে নজরুল দুইবারই ব্যবহার করেছিলেন শুকনো বাঁশ—কাঁচা বাঁশ নয়।
কুড়ি শতকের শুরুর দিকে বৃহত্তর বাংলায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিল একটি: কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ভাগ্যাহত পূর্ববাংলায় সবেধন নীলমণি ভালো হাসপাতাল ছিল একটি। দক্ষিণ ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতাল। সেটা মেডিকেল কলেজ ছিল না। এখন বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ কত, তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কারণ, আমার লেখা যখন ছাপা হবে, তখন হয়তো দেখা যাবে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা আর একটি বেড়েছে। তবে দেশের ভালো কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজের একটি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
ওই হাসপাতালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ১৮১টি কর্মচারী পদের বিপরীতে আবেদন করেন ৯০০ জন। ২৩ জানুয়ারি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা হয়। পরীক্ষা-টরীক্ষা যা-ই হোক মহানগর আওয়ামী লীগ ও মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতারা ৭০ জন কর্মচারী নিয়োগের কোটা দাবি করেন। দাবি পূরণ না হওয়ায় কলেজে ধর্মঘটও পালন করে ছাত্রলীগ। ওদিকে জাতীয় পার্টির সাংসদ ও দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের ভাতিজা হোসেন মকবুল আসিফ শাহরিয়ার ৪০ জন কর্মচারী নিয়োগের কোটা দাবি করেন। কিন্তু তাতে রাজি হননি হাসপাতালের পরিচালক। এতে ক্রোধ হয় সাংসদের।
পদ ১৮১টি চৌদ্দদলের প্রধান দুই দল যদি ৭০+৪০=১১০টি নেয়, বাকি থাকে ৭১টি। অবশিষ্ট ১২ দলের ১১টি ছয়টি করে কোটা পেতে পারে। একটি দল পাবে পাঁচটি। পাঁচটি যে দল পাবে, তার নেতাদের মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক।
খুবই বিরক্তিকর বাস্তবতা হলো, ১৪ দলের বাইরে সরকারে নেই এমন দলও দেশে আছে। তাদেরও কিছু সমর্থক আছে। তারা ট্যাক্স দেয়। দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। তাদের সাংবিধানিক অধিকার ১৪ দলের লোকদের সমান। যোগ্যতা অনুসারে চাকরিবাকরি পাওয়া তাদেরও সাংবিধানিক অধিকার। তাদের চাকরি পেতে যদি ২০১৫ অথবা ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, তা হবে সরকারের দিক থেকে সংবিধান লঙ্ঘন করা। সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যোগ্যতাসম্পন্ন প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো আইনসংগত পেশা বা বৃত্তিগ্রহণের...অধিকার থাকিবে।’ ঐতিহাসিক পঞ্চম সংশোধনীর সময়ও এমন কোনো কথা যোগ করা হয়নি যে, ‘সরকারি দলগুলির লোকদের বাইরে অন্য কোনো দলের সমর্থক লোকদের যত যোগ্যতাই থাকুক তাহাদের সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনো পদে নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সরকারি দলের বাইরের লোকদের চাকরির জন্য আবেদন করা আইনত দণ্ডনীয়।’
কর্মচারী নিয়োগে তাঁর সমর্থকদের কোটারি দাবিতে মাননীয় সাংসদ ‘গঙ্গাচড়া থেকে ১৫টি ট্রাকে সাত-আটশ জাপার নেতা-কর্মী নিয়ে মেডিকেল কলেজ ঘেরাও করতে আসেন। তাঁরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হাসপাতাল গেটে জমায়েত হন।...সেখান থেকে মিছিল নিয়ে হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ নিয়ে প্রথমে পুলিশ ও জাপা নেতা-কর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া বাধে। পরে সংঘর্ষে যোগ দেয় হাসপাতালের কর্মচারী ও এলাকার সাধারণ মানুষ।’ [দৈনিক সমকাল]
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চাকরির কোটার দাবিতে আসা মাননীয় সাংসদের ‘কর্মী-সমর্থকদের হাতে ছিল কাঁচা বাঁশের লাঠি।’ লাঠিগুলো যে সত্যিই কাঁচা বাঁশের ছিল তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে পত্রপত্রিকায় যে রঙিন ছবি ছাপা হয়েছে, তাতে উত্তোলিত বংশদণ্ডগুলোকে রীতিমতো সবুজ দেখা যাচ্ছে। ধূসর রঙের শুকনো বাঁশের লাঠি একটিও নেই। ঝাড় থেকে সদ্যকাটা বাঁশ দিয়েই তৈরি করা হয়েছে লাঠি। বাঁশ সাবাড় করে বিশেষ উদ্দেশ্যেই লাঠিগুলো তৈরি। এই কাঁঁচা বাঁশের লাঠি মেডিকেল হাসপাতালের পরিচালককে উপহার দেওয়ার জন্য যে তৈরি হয়নি, তা অনুমানেই আমরা বলতে পারি।
আমাদের সাধারণ লোকের বুদ্ধিতে যা বুঝি তা হলো, চাকরির দাবি খালি হাতেও এসে করা যেত। তবে একটি জিনিস আমরা অবশ্যই মূল্যায়ন করব তা হলো, রামদা, চাপাতি ও গোলাবারুদের চেয়ে কাঁচা বাঁশের লাঠি হাজার গুণে ভালো। লাঠি অন্তত হাত দিয়ে ঠেকানো সম্ভব। আমরা জানি, পানির ছিটা দিলে লগির বাড়ি খেতে হয়, ঢিল ছুড়লে পাটকেলটি খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাঁচা বাঁশের লাঠি নিয়ে কাকে মারতে এসেছিলেন জানি না, কিন্তু অনেকেই মার খেয়েছেন, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জখম হয়েছেন অনেকে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক যা তা হলো, মাননীয় সাংসদ নিজেই তাঁরই তৈরি কাঁচা বাঁশের লাঠির আঘাতে মাথা ফাটিয়ে এখন হাসপাতালে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রথমে আক্রমণকারীদের রণনৈপুণ্যের ছবি তুলতে গেলে হাসপাতাল চত্বরে সাতজন সাংবাদিককে বাঁশ দিয়ে পেটান সাংসদের কর্মীরা। সাংবাদিকদের উদ্ধার করতে পুলিশ তাঁদের লাঠিপেটা করে। এক পর্যায়ে হাসপাতালের কর্মচারীরা এসে ধাওয়া দেন সাংসদ ও তাঁর লোকদের। সাংসদ শাহরিয়ারকে মাটিতে ফেলে কাঁচা বাঁশ দিয়ে পেটান কয়েকজন ক্ষুব্ধ কর্মচারী। ১২ জন পুলিশ, সাতজন সাংবাদিক, হাসপাতালের কর্মচারীসহ আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। আতঙ্কে রোগী ও তাঁদের আত্মীয়স্বজন দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। কোনো রোগী অবশ্য হার্টফেল করে মারা যাননি।
কাঁচা বাঁশওয়ালাদের দল থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, ২০১৪ সালে তাঁরা সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। আর বিরোধী দলে নয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিরোধী দলে থাকতে চায় তো থাকুক গিয়ে। তাহলে এই ধৈর্যচ্যুতি কেন? মাত্র দুটি বছরই তো!
সংসদীয় গণতন্ত্রে দুই রকম দল থাকে। এক শ্রেণীর দল ক্ষমতাসীন। আরেক শ্রেণীর দল সরকারের বাইরে, যার নাম বিরোধী দল। এর মাঝে বাংলাদেশে আছে আর এক রকম দল। সে দল যখন প্রয়োজন তখন সরকারি এবং সরকারে থেকেও যখন বিরোধীর ভূমিকায় অভিনয় করার প্রয়োজন তখন বিরোধী। এই রকম দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কয়েকটি আছে। এগুলো সরকারি দলও, বিরোধী দলও। এগুলোকে আমরা নামকরণ করতে পারি: সর-বিরোধী দল, আরও সংক্ষেপে সর্বিরোধী দল।
ক্ষমতায় যেতে চাইলে বেশি আসন, বেশি ভোট দরকার। ভারতবিরোধী যে ভোটগুলো আছে, তা বিএনপি থেকে শুধু নয়, আওয়ামী লীগ থেকেও নিজেদের দিকে আনা দরকার। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশের হতভাগ্য নদনদী।
ভারত সফর করে এসেই উত্তাল গতিতে ছুটছেন নেতা। নদনদীর প্রতি গভীর ভালোবাসা উথলে উঠেছে। দেশের মানুষের পানির অধিকারের প্রশ্নে তিনি মেধা পাটেকারের চেয়ে বেশি আপসহীন। গাড়িতে চড়িয়া নেতা করিছেন লংমার্চ। লংমার্চের কৃতিত্ব একচেটিয়া খালেদা জিয়াকে দেওয়া যায় না। তিস্তার পানির হিস্যা ও টিপাইমুখের জন্য অমূল্য জীবন দিতে প্রস্তুত। ঔপন্যাসিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নদীতে চড়া পড়া নিয়ে লিখেছেন কাঁদো নদী কাঁদো। এখন লংমার্চের বাহার দেখে মৃতপ্রায় নদীগুলোকে আমরা বলব: হাসো নদী হাসো। আগামী নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের নদনদীরা আনন্দে ফেটে পড়বে। নদীদরদি নেতা বাংলাদেশে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছেন। এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে? তখন দেশবাসী তাঁকে ভূষিত করবে নতুন উপাধিতে: নদীবন্ধু। লংমার্চ শুরুর পর সেটা অবশ্য এখনো দেওয়া যায়।
একটি ছোট দুর্বল দেশ কত রকম অত্যাচার ও উপদ্রব সহ্য করবে? চারদিক হিংসায় সয়লাব। সেটা না হয় মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তার ওপরে ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্রও না হয় প্রতিহত করা সম্ভব। কিন্তু মিথ্যাচার? প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, এমনকি প্রচারমাধ্যমের লোকদেরও মিথ্যাচারে বাধ্য করা হচ্ছে। হিংসা, ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচারও মেনে নেওয়া গেল। জনগণের সঙ্গে করা হচ্ছে নানা রকম প্রতারণা ও ছলচাতুরি। এসব তো আছেই, এর মধ্যে কেউ কেউ শুরু করেছেন তামাশা। এত উপসর্গ নিয়ে কীভাবে একটি জাতি টিকে থাকবে?
অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে গেছে, এরপর মানুষ বলবে, আমরা ভাত কাপড়, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, বাসস্থান কিছুই চাই না। আমাদের অন্তত একটুখানি সামাজিকভাবে শান্তিতে থাকতে দাও। আমাদের মনের ওপর অত্যাচার করার অধিকার কারও নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।