শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১২

আওয়ামী লীগের সরকারগুলো



বিরোধী দল যত দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করবে, সরকারের জন্য তত মঙ্গল দুই সপ্তাহ আগে স্বাধীন বাংলাদেশ পূর্ণ করেছে তার প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার পূর্ণ করছে তার তিন বছর। তবে আওয়ামী লীগের দেশ শাসনের অভিজ্ঞতা তিন বছরের নয়: তিন বছর সাড়ে ১০ মাস, পাঁচ বছর এবং তিন বছর—মোট ১১ বছর সাড়ে ১০ মাসের। স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান-যুগে দলটি দুই বছর প্রাদেশিক সরকার চালিয়েছে পঞ্চাশের দশকে। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ তার শাসনকালের এক যুগ পূর্ণ করতে যাচ্ছে। যে দল তিন দফায় প্রায় ১২ বছর সরকারে থাকে, সে দলের নেতাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার উপায় নেই।
কাগজপত্রের ভিত্তিতে কথা বলতে গেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক বাজে ও বিরক্তিকর বিষয়কে বাদ দেওয়া যায় না। পনেরোই আগস্টের নারকীয় বর্বরতার পরে খোন্দকার মোস্তাক আহমদের সরকারটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সেনাবাহিনী-সমর্থিত সরকার। আওয়ামী লীগেরই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদধন্য একটি অংশ ১৯৭৫-এর ২ নভেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতাশীল ছিল। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেনা-সমর্থিত সরকার ছিল রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ও প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারটি। জিয়া-এরশাদের শাসন ছিল নির্ভেজাল সামরিক শাসন।
শেখ হাসিনা তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের আট বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছেন। কোনো রাজনৈতিক নেতার জন্য এ এক বিরল সৌভাগ্যের কথা। জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আট বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করা সামান্য কৃতিত্ব নয়। যদি তুলনা করে কথা বলি, তা হলে বলতে হয়, শেখ হাসিনার সরকার চালানোর অভিজ্ঞতা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন, এমনকি জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের চেয়ে বেশি। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের আট বছর পূর্তি উপলক্ষে আমি তাঁকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাই।
প্রতিষ্ঠাকালীন নেতারা এবং পঞ্চাশের দশকের নেতারা এখন প্রায় কেউই বেঁচে নেই। তা সত্ত্বেও ৬২ বছর বয়স্ক আওয়ামী লীগ একটি সমৃদ্ধ ও সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল। বর্তমানে তিন প্রজন্মের নেতার সমাবেশ ঘটেছে এই দলে। শেখ হাসিনার সুবিধা এখানে যে, এই তিন প্রজন্মের সঙ্গেই তিনি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এবং তিন প্রজন্মের কাছেই তিনি সমানভাবে গৃহীত।
আমরা দলের লোক না হয়েও আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদের সরকারকেই খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম সরকারের নেতাদের খুব ভালোই জানতাম। তাঁদের দু-চারজন ছাড়া সবাই ছিলেন একেবারে জনগণের ভেতরের মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন না। কারও হাতে ব্রিফকেস দেখেছি বলে মনে পড়ে না। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে করতে তাঁরা জননেতা হন।
ষাটের দশকের তরুণ নেতাদের স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারে একটি বড় ভূমিকা ছিল। শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ নেতাকে বঙ্গবন্ধু তৈরি করছিলেন। বঙ্গবন্ধু কোনো জেলায় সফরে গেলে তাঁর রাজনৈতিক সচিব হিসেবে তোফায়েল আহমেদ অবধারিতভাবে তো থাকতেনই, অন্য যুবনেতারাও ঘুরেফিরে থাকতেন। কখনো তাঁদের সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ আমারও হয়েছে। তাঁদের জনসম্পৃক্ততা ছিল প্রশ্নাতীত। তখন প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ছিলেন সুশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ। তাঁরা ছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, ফরেন সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিস, অ্যাকাউন্টস সার্ভিস প্রভৃতি ক্যাডারের কর্মকর্তা। জনসম্পৃক্ত রাজনীতিক ও দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত সরকার খুব দুর্বল ছিল না। কিন্তু ভেতর থেকে দুর্নীতি ও বাইরে থেকে ‘চাটার দল’ সেই সরকারকে শেষ করে দেয়। তৃতীয় বছরে গিয়ে চিরকালের জনগণের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
একটি নতুন রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা খুব বেশি দরকার। পাকিস্তান আমলে দুবার সামরিক শাসন এসেছে, দুবারই তা ছিল রক্তপাতহীন। বাংলাদেশে ঘটল রক্তাক্ত অভ্যুত্থান। শুধু যে সরকারের স্থিতিশীলতা নষ্ট হলো তাই নয়, রাষ্ট্রের মূলনীতি, আদর্শ ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্রও আমূল বদলে গেল।
দুবার সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করায় সংসদীয় রাজনীতিতে শেখ হাসিনার ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তা ছাড়া তাঁর আর একটি গুণ হলো, তিনি সংসদ অধিবেশনে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন, যা তাঁর দলের অনেক সদস্যই থাকেন না। তাঁরা ব্যস্ত থাকেন তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে। ১৯৯৬-তে যখন তিনি অন্য দু-একটি ছোট দলের সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তিনি প্রশাসক হিসেবে নতুন হলেও সংসদীয় রাজনীতিতে ছিলেন অভিজ্ঞ। তিনি যে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন, সেখানে কয়েকজন ছাড়া সবাই ছিলেন নতুন, কিন্তু গণমুখী রাজনীতিতে তাঁদের ছিল দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। জনগণের আবেগ-অনুভূতি তাঁদের অজানা ছিল না।
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ও কূটনীতি বিষয়ে শেখ হাসিনার প্রথম সরকার মন্দ করেনি। অর্থনীতি মোটের ওপর ভালো ছিল। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি সরকারকে খানিকটা বেকায়দায় ফেলে দেয়। কৃষিতে ভালো করে। আওয়ামী লীগ সরকারের সাংস্কৃতিক নীতি সবসময়ই ভালো। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ করা ছাড়াও, চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। কিন্তু দলের কয়েকজন সন্ত্রাসী ধর্ম-পিতার বাড়াবাড়িতে সরকারের প্রতি জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলে। ফলে ২০০১-এ বিএনপি-জামায়াতের কাছে ঘটে শোচনীয় পরাজয়।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার এবং তাদের ক্ষমতা ছাড়ার দুই বছর দুই মাস পর নির্বাচন হয়। ওই দুই বছরে দেশে বহু ঘটনা ঘটে। উদ্দিনদের কার্যকলাপে দুই বছরে খালেদা জিয়া সরকারের অপকর্ম ও দুর্নীতির কথা মানুষ প্রায় ভুলে গিয়েছিল। ওই সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল, বিএনপির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া। কিন্তু খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা নস্যাৎ করার ক্ষমতা উদ্দিনদের ছিল না। ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির অত কম আসন পাওয়ার কথা নয়। তবে যা হওয়ার তা হয়ে যায় এবং দেশবাসী ও বিশ্ববাসী ওই ফলাফল মেনে নেয়। কারণ মানুষ মহাজোটকেই ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে—বিএনপি-জামায়াতের জোটকে নয়।
মহাজোট সরকার ৬ জানুয়ারি ’০৯ সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে যখন শপথ গ্রহণ করে, তখন সেই অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণার আগেই কেউই জানতেন না কারা কারা তাতে থাকছেন। অনেকটা যেন লটারিতে পুরস্কৃত হওয়ার মতো। যাঁরা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন বলে অনুমান করেছিলাম, তাঁদের ১২-১৪ জনের নাম যখন ঘোষিত হলো না, তখন মনটা খারাপ হলো। মন্ত্রিত্ব তাঁদের প্রাপ্য ছিল। তাঁরা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হলে সরকার, আওয়ামী লীগ এবং দেশের উপকার হতো।
কাঁচা রসিকতা করে মন্ত্রিসভাকে আমাদের অনেকে ‘কচি-কাঁচার আসর’ বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁদের সঙ্গে আমি তীব্র দ্বিমত পোষণ করেছি। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে প্রথম কয়েক বছর যাঁরা মন্ত্রী হন, তাঁদের অনেকেরই বয়স ছিল ৩০-৩৫। মন্ত্রী হওয়ার জন্য ৭০ বছর বয়স, বরফের মতো সাদা চুল অথবা চকচকে টাক এবং বাঁধানো-দাঁতওয়ালা মানুষের প্রয়োজন হয় না। দলের নীতি-আদর্শ ও নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতি অঙ্গীকার কতটা, তাঁর মন্ত্রণালয়ের বিষয়ের প্রতি তাঁর ধারণা কতখানি স্বচ্ছ, আমলাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা কী পরিমাণ, নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতা কেমন—সেসবই বিবেচ্য। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে করতেই একজন সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন।
কোনো নির্বাচিত সরকারকে জবাবদিহি করতে হয় দুই জায়গায়, দুবার। প্রথমে জনগণের কাছে প্রতিদিন। দ্বিতীয়বার কিছুটা দেরিতে—ইতিহাসের কাছে। বহু সরকারের বহু দৈনন্দিন ব্যর্থতা জনগণ ক্ষমা করে এবং এক সময় ভুলে যায়। কিন্তু ইতিহাস যদি তার প্রশ্নের সঠিক জবাব না পায়, সে ছাড়ার পাত্র নয়। ইতিহাস ক্ষমা করে না।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাতে যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল, তার অর্ধেক বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেই ইতিহাসে ওই সরকার প্রশংসিত হতো। কিন্তু গত তিন বছরে দেখা গেল, ঘোষিত ইশতেহার থেকে সরে গিয়ে অঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নেই সরকার বেশি ব্যস্ত। আওয়ামী লীগের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি ছিল ‘গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ’ দেওয়া। কিন্তু তিন বছরে হয়েছে তার বিপরীত। বাংলাদেশে তিন বছরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে একদলীয় গণতন্ত্র। বিরোধী দলগুলোর সহযোগিতা ও পরামর্শ নেওয়া তো দূরের কথা, মহাজোটের শরিক দলগুলোরও কোনো ভূমিকা নেই সরকারে। শরিক দলগুলোর বড় নেতাদের কিছু পদ ও সুবিধা দিয়ে শান্ত করে রাখা হয়েছে। তাঁদের কাজ শুধু সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়া।
বর্তমান সংসদে তিন বছরে একতরফাভাবে যত আইন ও বিধিবিধান পাস হয়েছে, আগের আটটির কোনোটিতে অত হয়নি। নবম সংসদ পরিণত হয়েছে একটি রাবার স্ট্যাম্পে। বাইরে থেকে সব সিদ্ধান্ত হয়ে আসছে, শুধু অনুমোদনের ছাপ্পরটা পড়ছে এখানে। বাইরে বলতে যে সরকারি দলের নির্বাহী কমিটিতে অথবা সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হচ্ছে, তাও নয়। ফলে অনেক ভুল ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত হয়েছে এই সংসদে। কিছুই সংসদে আলোচনা হয়নি। বর্তমান আইনের এমন সব সংশোধনী আনা হয়েছে, যার সঙ্গে জনগণের ও জাতীয় স্বার্থের কোনো সম্পর্ক নেই। যা করা হয়েছে তা সবই গোষ্ঠীর স্বার্থে। এই সংসদের প্রত্যেক সদস্যকে তার জন্য ইতিহাসের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না, সে বিরোধী দল যত মন্দই হোক, বিরোধী দলের মন্দ কাজগুলো দেখার দায়িত্ব জনগণের, সরকারের নয়। বিরোধী দল যত দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করবে, সরকারের জন্য তত মঙ্গল। বিরোধী দল দাঙ্গা-হাঙ্গামা করলে সরকার অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে তা প্রতিহত করবে। দোষীদের ধরে জেলে ঢোকাবে, ফাঁসিতে ঝোলাবে। কিন্তু তারা সভা-সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়ামাত্র তা প্রতিহত করার উদ্যোগ নেওয়া চরম অগণতান্ত্রিক আচরণ, পুলিশ ও অনুগত গোয়েন্দাদের দিয়ে এমবেডেড মিডিয়াকে বলাল: তারা নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছে, নেবে, নিয়েছিল প্রভৃতি। প্রধান বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কর্মসূচির দিন তাঁদের অফিস থেকে রাস্তায় নামতে না দেওয়া—গণতন্ত্রের মুখে পদাঘাত ছাড়া কিছু নয়। এসব দৃশ্য শুধু জনগণ নয়, দাতা দেশের লোকেরাও বড় বড় চোখ করে দেখে থাকেন। হরতাল আহ্বানকারীরা রাস্তায় নামতে পারেন না, হরতাল বিরোধিতাকারীদের পুলিশকে সঙ্গী হিসেবে নিয়ে রাজপথে উত্তাল নৃত্য।
জনগণ চেয়েছিল সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আগের জোট সরকারের মতোই মহাজোট সরকারের ভূমিকা শূন্য এবং নিন্দনীয়। যেকোনো ধরনের বড় অপরাধ করেও সরকারি দলের লোকেরা রাষ্ট্রের আনুকূল্যে বেঁচে যাচ্ছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের নিপীড়ন করা হচ্ছে বর্বরোচিতভাবে।
বিএনপি দলীয়করণ করেছিল। আওয়ামী লীগ অঙ্গীকার করেছিল প্রশাসনকে দলীয়করণ করবে না। কিন্তু প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে যা ঘটেছে গত তিন বছরে, তাকে দলীয়করণ বললে খুব কম বলা হয় এবং দলের মেধাবীরাও নয়, ব্যক্তিগত পছন্দের চরম অযোগ্য-অপদার্থ লোক নিয়োগ ও পদোন্নতি পাচ্ছেন। এমন সর্বনাশা অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, আগামীবার মহাজোটই যদি পুনর্নির্বাচিত হয়, তারা সচিব বানানোর মতো যোগ্য অফিসার তো পাবেই না, উপজেলা চালানোর মতো অফিসারও পাওয়া যাবে না। দক্ষ আমলা শ্রেণী ছাড়া শক্তিশালী গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র হয় না।
অনেকেরই কানে কথাটা মধুর শোনাবে না। তা হলো, ২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশ যতটুকু শক্তিশালী ছিল, ২০১২-তে তাঁর সময়ের বাংলাদেশ তা নেই। একটি নতুন রাষ্ট্র ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকবে, সেটাই প্রত্যাশা মানুষের। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়েছে তার বিপরীত। যদিও গত ৩২ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়েছে। তা হলে আজ রাষ্ট্র দুর্বল কেন?
নষ্ট রাজনীতির কারণে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিটি নষ্ট হয়ে গেছে। সাংবিধানিক আইনকানুন ও রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানের অব্যাহত অবমাননা রাষ্ট্র ও সমাজকে শেষ করে দিয়েছে। অনিয়ম ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। ভাদ্র মাসে বন্যার সময় কাঁচা মরিচের দাম ২৫০ টাকা কেজি হলে, ৫০ গ্রাম ধনেপাতা ৪০-৫০ টাকা হলে, পেঁয়াজের কেজি ৫০ টাকা হলে, রসুনের দাম বাড়লে দেশ রসাতলে যায় না। চাল-আটার দাম বাড়া, বাস-ট্রাকের ভাড়া বাড়া, বছরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য তিন-চারবার বাড়ানো সাময়িক ব্যাপার। মানুষ কষ্ট পায়, কিন্তু দেশ তাতে ধ্বংস হয় না। কিন্তু ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চড়া দাম দিয়েও যদি না পাওয়া যায়, তখন জনগণের কাছে স্বাধীন রাষ্ট্র অর্থহীন হয়ে পড়ে।
খুব যোগ্য আমলা ও টেকনোক্র্যাট প্রশাসন চালানোর জন্য খুব দরকার। কিন্তু তাঁরা রাজনীতিবিদদের বিকল্প নন। আওয়ামী লীগের মধ্যে বহু নিবেদিত নেতা শুধু নন, সব শ্রেণী-পেশার মধ্যেই আওয়ামী-সমর্থক যোগ্য মানুষ রয়েছেন। অন্তত ৩০ জন নেতাকে আমি ৪৫ বছর যাবৎ জানি, যাঁদের যোগ্যতায় তারতম্য থাকতে পারে, কিন্তু জনগণের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। জনস্বার্থবিরোধী কাজ তাঁরা করবেন না। আশি ও নব্বইয়ের দশকে ছাত্রলীগ করে এসেছেন এমন বহু যুবনেতাকে জানি, যাঁরা দেশের জন্য কাজ করতে সক্ষম এবং প্রস্তুত। সরকার তাঁদের ব্যবহার করতে পারেনি বলে তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য করে টাকাপয়সা বানানোর দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
নির্বাচিত-অনির্বাচিত যেসব নেতা ও নীতিনির্ধারক গত তিন বছর দেশ চালিয়েছেন, তাঁদের কল্যাণ কামনা করি। তবে সবিনয়ে বলতে চাই, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আপসহীন বর্ষীয়ান, নবীন নেতা ও আমলাদের যদি সরকারে যুক্ত করা না হয়, তাহলে আগামী দিনগুলো হবে জনগণের জন্য চরম হতাশার।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। 
সৈয়দ আবুল মকসুদ | তারিখ: ০৩-০১-২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন