নব্বইয়ের দশকে এবং বর্তমান দশকের প্রথম দিকে আমাকে অনেকবার নয়াদিল্লিতে
যেতে হয়েছে মহাত্মা গান্ধী ও বাংলা ভাগ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য। কাজ
করেছি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম
লাইব্রেরি, গান্ধী মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ও লাইব্রেরি প্রভৃতি গবেষণাগারে।
ওখানকার গবেষকদের সঙ্গেও পরিচয় ও কথাবার্তা হতো। তাঁরা আমাকে বইপত্রের
ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করতেন। বাংলাদেশে প্রকাশিত বাংলাদেশ সংক্রান্ত
লেখা আমিও তাঁদের কখনো দিয়েছি। ভারতের সাবেক হাইকমিশনার মুচকুন্দ দুবেও তখন
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) পড়াচ্ছিলেন। তিনিও বাংলাদেশের
লেখালেখির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। কারণ, তাঁর বিষয় ছিল সম্ভবত দক্ষিণ
এশিয়ার রাজনীতি। জেএনইউ-এর একজন অধ্যাপক একদিন আমাকে বললেন, মুজিব হত্যা ও
সামরিক শাসন জারি সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের রিপোর্টটি তাঁকে জোগাড় করে দিতে
পারি কি না। আমি তাঁকে বললাম, ওই ঘটনা নিয়ে কোনো তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল
বলে আমার জানা নেই। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তখন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার
বিচার শুরু হয়েছে।
ওই জাতীয় বিরাট ব্যাপারের বিচার পরের কথা, আগে দরকার তদন্ত কমিশন গঠন করে ঘটনার কারণ ও তার সঙ্গে কারা জড়িত এবং দায়িত্ব পালনে কারা ব্যর্থ হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা ও রিপোর্ট প্রকাশ। সেই কাজটি হয়নি। তবে বাংলাদেশের যে ঐতিহ্য তাতে তদন্ত কমিশন গঠিত হলেও যে তার রিপোর্টে নিরপেক্ষ সত্য—ইম্পার্শিয়াল ট্রুথ বেরিয়ে আসত সে সম্ভাবনা খুবই কম। তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান মার্কিনপন্থী হলে রিপোর্ট হতো এক রকম, চীনপন্থী হলে হতো আরেক রকম, সোভিয়েত, ভারতপন্থী হলে হতো অন্যরকম এবং পাকিস্তানপন্থী হলে হতো একেবারেই আলাদা। কয়েকদিন আগে শেখ ফজলুল করিম সেলিম তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি করেছেন এবং সে সময়ের সেনাবাহিনী প্রধান, উপপ্রধানদের প্রতি অভিযোগ উত্থাপন করায় তা নিয়ে কাগজে বিতর্ক হচ্ছে।
পনেরোই আগস্টের ঘটনাটি ঘটিয়েছিল স্রেফ সেনাবাহিনীর লোকেরা। তারাই—তারা ‘কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল’ লোক হোক বা গোটা সেনাবাহিনীই হোক—রাষ্ট্রপ্রধানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল এবং শুধু তাঁকে হত্যা নয়, সরকারও বদল করেছিল সেনাবাহিনীর লোকেরাই। সুতরাং ওই ঘটনায় সেনাবাহিনী প্রধান তাঁর দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। তাঁর ব্যর্থতা পরিমাপযোগ্য নয়। গত বছর এক টেলিভিশন টক শোতে তোফায়েল আহমেদ, জেনারেল সফিউল্লাহ ও আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আমি সবিনয়ে বলেছিলাম, সফিউল্লাহ ভাই, আপনি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তিনি বললেন, তা বলতে পারেন।
শেখ সেলিমও সেই কথাটিই বলেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাত্কারেও তিনি বলেছেন, ‘সফিউল্লাহ, জিয়া সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিলে তিনি নিহত হতেন না। এমনকি জিয়াও পরবর্তী সময়ে নিহত হতেন না। সফিউল্লাহ তখন সেনাপ্রধান ছিলেন, তাঁর দায়িত্ব কী? রাষ্ট্রপতি তাঁর সাহায্য চেয়েছেন। কিন্তু তিনি নীরব ছিলেন। রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করা তাঁর দায়িত্ব ছিল। নবাব সিরাজদ্দৌলা ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মিল আছে। সিরাজের নির্দেশ অমান্য করে সেনাপ্রধান মীর জাফর সেদিন নীরব ছিলেন। যদি মীর জাফর বেইমানি না করতেন তাহলে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হতো না। ২০০ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ...তখন প্রায় এক লাখ সেনাসদস্য ছিল, কিন্তু সফিউল্লাহ, জিয়া, খালেদ মোশাররফ, শাফায়েত জামিল কোনো পদক্ষেপ নেননি। ...এ ঘটনার নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের চেহারা উন্মোচন করা... [আমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য]।’
প্রত্যুত্তরে জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছেন, ‘আমি বর্তমানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গ্রামেগঞ্জে জনমত গঠনের কাজে ভূমিকা রেখে যাচ্ছি। আমি জানি না, এ কাজ থেকে বিরত রাখতে আমাকে কোনো মহল থেকে বিরক্ত করা হচ্ছে কি না।’ [প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট]
বিষয়টি বিরক্ত করা বা প্রীত করার নয়। এবং শেখ সেলিম কোনো ‘মহল’-এর মানুষ নন। জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছেন, তাঁর অবস্থান তিনি একটি বইয়ে তুলে ধরবেন। ‘বইটির খসড়া ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। এখন বইটির পরিমার্জন করছি, যাতে কেউ আঙুল তুলতে না পারে।’
এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে তিনি তাঁর দিকে কারও আঙুল তোলা বন্ধ করতেই নিজের সমর্থনে বইটি লিখছেন। সংগত ও যুক্তিযুক্ত কারণে কেউ যদি কারও দিকে আঙুল তোলে সে আঙুল বলপ্রয়োগ করে নিচে নামানো যাবে না। ওই দিনের পরিস্থিতি এবং তাঁর নিজের অবস্থান সম্পর্কে তিনি গত ৩৪ বছরে বহু জায়গায় আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। কোনো কোনো সময় তাঁর এক বক্তব্যের সঙ্গে আরেক বক্তব্যের বেমিল পাওয়া যাবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শব্দপ্রয়োগে তারতম্য ঘটেছে। সেদিন তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘খন্দকার মোশতাক আমাকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে ডিসমিস করেন।’ সামরিক বা বেসামরিক কোনো পদ থেকে ডিসমিস বা বরখাস্ত হওয়া খুবই খারাপ জিনিস। সেটা শাস্তি।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় (দায়রা মামলা নম্বর-৩১৯/৯৭) ‘আন্দাজী-৬৩ বছর’ বয়সে ‘সন ১৯৯৮ সালের ১৩/১ তারিখে’ দেওয়া লিখিত জবানবন্দিতে সফিউল্লাহ শুরুতেই বলেন, ‘১৯৭৫ সনের ২৪ আগস্ট অবসর গ্রহণ করি।’ আর এক অনুচ্ছেদে বলেন, ‘১৯৭৫ সনের ২৪ আগস্ট আমাকে সেনাপ্রধানের পদ হইতে অবসর দিয়া রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ করে। আমি একজন সরকারি কর্মচারী হিসাবে উক্ত নিয়োগ গ্রহণ করিতে বাধ্য হই। আমি ১৯৯১ সনের জুলাই মাস পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করি। এই সময় আমি নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হই নাই। তবে মাঝে মাঝে উড়ো চিঠিপত্র পাইয়াছি। সেনাপ্রধান হিসাবে নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হই নাই।’ [Criminal Reference under Section 374 of the Code of Criminal Procedure, 1997]
সেনাপ্রধান হিসেবেও তিনি নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হননি, বিদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবেও হননি, তাহলে কখন হলেন? দু-একটা উড়ো চিঠির ভয়েও প্রকম্পিত হওয়ার সাহসী মানুষের শোভা পায় না। উড়ো চিঠি সাংবাদিক থেকে স্কুলের হেডমাস্টার বা থানার বড় দারোগা পর্যন্ত অনেকেই পান। তা ছাড়া তাঁকে বেনামি চিঠি যে-ই দিক ফারুক-রশীদের লোকেরা নিশ্চয়ই দেয়নি। তাদের তো কদাচ কোনো ক্ষতি করেননি তিনি। বরং তাদের কথামতোই চলেছেন কয়েকটি দিন।
হাকিমের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, ‘আগস্ট মাসেই আমি সেনাপ্রধানের পদ হইতে মুক্ত হইয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করি। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বর্তমান জায়গায় অর্থাত্ সেগুনবাগিচায় ছিল। আমি সেনাভবন হইতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসা-যাওয়া করিতাম।...জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত ছিলাম।’
প্রথম আলোকে সেদিন তিনি আরও বললেন যে তাঁর নিরাপত্তার জন্য মোশতাক অশেষ উদ্বেগে ছিলেন। একদিন প্রেসিডেন্ট তাঁকে ডেকে বললেন, ‘আমি দেশের বাইরে যেতে রাজি আছি কি না। আমি বললাম, না।’ মোশতাক বললেন, ‘আমি তোমার নিরাপত্তার জন্যে এটা চাইছি। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের কী দশা হয়েছে, তা তো দেখেছ।’
অর্থাত্ দেশে থাকলে তাঁরও বঙ্গবন্ধুর দশা হতে পারে। তবে মোশতাক ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধন করার কথা নয়, বলে থাকলে বলেছেন ‘মুজিব’। সে যাক গে। আদালতে তিনি বলেছেন, ২৫ আগস্ট থেকেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘আসা-যাওয়া’ করেছেন। প্রথম আলোকে বললেন, মোশতাকের জবাব শোনার অপেক্ষা না করেই তিনি ধা করে তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। তারপর বাসায় পৌঁছে শোনেন, “ওপরের নির্দেশ হলো আমি যেন বাসা থেকে বের না হই (কেউ দৈবাত্ ক্ষতি করতে পারে)। ...কিছুদিন পরপর ওসমানী জানতে চাইতেন, ‘তুমি মত পাল্টেছ কি না।’ এরপর ৩ নভেম্বরে জেলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটে। সেখানে চার জাতীয় নেতাকে কারাগারের সংরক্ষিত হেফাজতে হত্যা করা হলো, তখন আমি আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হই। তারপর বিদেশে যাওয়ার পক্ষে মতামত দেই।...তবে মালয়েশিয়া সরকার আমার সম্পর্কে ভুল বুঝে আমাকে প্রথমে গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিল।” ক্যুর সঙ্গে যুক্তদের কোনো দেশ নিতে চায় না।
আদালতে বললেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘যোগদান’ ও ‘আসা-যাওয়া’ করি; এখন বলছেন, জেলখানায় হত্যাকাণ্ড না হলে রাষ্ট্রদূতের চাকরির তোয়াক্কা করতেন না। দুই রকম কথা হয়ে গেল। বই বেরোনোর পরে যদি কেউ আঙুল তোলে সে আঙুল মটকানো সম্ভব হবে না। অনেক স্মৃতিকথামূলক বই লেখকের বিপদ ডেকে আনে।
একই সময়ে দেওয়া বক্তব্যেও নানা রকম অসংগতি ও গোলমাল ধরা পড়ে। আদালতে লিখিত জবানবন্দিতে সফিউল্লাহ বলেন:
“১৫ই আগস্ট/৭৫ সকালে আমার ব্যাটম্যান দরজা ধাক্কা দিলে আমি বাহির হই এবং দেখি আমার ডিএমআই লে. কর্নেল সালাহউদ্দিন (ডাইরেক্টর, মিলিটারি ইনটেলিজেন্স) সেখানে উপস্থিত। আমাকে দেখেই সে জিজ্ঞাসা করে, স্যার, আপনি কি আরমার এবং আর্টিলারিকে শহরের দিকে যেতে বলেছেন? আমি বললাম, না তো! কেন? সে উত্তরে বলল, তারা তো রেডিও স্টেশন, গণভবন এবং ৩২ নম্বর রোডের দিকে যাইতেছে। তাহার কথা শুনে আমি শঙ্কিত হলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম, ডাজ শাফায়েত নো অ্যাবাউট ইট? শাফায়েত কি ইহা জানে? সে উত্তরে বলল, আমি জানি না স্যার। তখন তাহাকে বলিলাম, তুমি শীঘ্রই শাফায়েতের কাছে যাও।...তাহাকে পাঠাইয়া দিয়াই আমি রুমে ঢুকেই টেলিফোনে প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে (সম্ভবত পনেরোই আগস্ট সূর্য ওঠার অনেক পরে) চেষ্টা করি কিন্তু পাই না। পরে শাফায়েত জামিল, চিফ অব এয়ার স্টাফ খোন্দকার, চিফ অব ন্যাভাল স্টাফ এম এইচ খান, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমান, সিডিএম খালেদ মোশাররফকে টেলিফোন করি।...আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলি, তিনি আমার গলার আওয়াজ শুনে বলে উঠলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ আমি বলেছিলাম, আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস?”
কী সাংঘাতিক মর্মান্তিক ব্যাপার। বিপন্ন রাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বলছেন, তাঁর বাড়ি আক্রান্ত, তাঁর পুত্রকে হত্যা করা হয়েছে। তখন সেনাপ্রধান তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারেন কি না? ভাগ্যের নির্মম পরিহাস একেই বলে। তারপর জবানবন্দিতে বলা হচ্ছে: ‘আমার অফিসে অনুমান সকাল সাতটার সময় রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কথা শুনিয়াছি। আমি অফিসে অবস্থানকালে আমার ডেপুটি চিফও (জিয়া) আমার সামনেই বসিয়া ছিলেন।’ যত দূর জানা যায় শেষ রাতে ফোন তাঁকে বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন।
সফিউল্লাহর জবানবন্দির আট দিন আগে ৫ জানুয়ারি জবানবন্দিতে কর্নেল শাফায়েত জামিল আদালতে বলেন, ‘আমি দ্রুত ইউনিফর্ম পরিয়া মেজর হাফিজসহ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের দিকে রওনা দেই। পথিমধ্যে জে. জিয়াউর রহমানের বাসায় যাই এবং তাঁহাকে শেভরত অবস্থায় পাই। আমার নিকট হইতে ঘটনা শোনার পর তিনি বলিলেন, ‘সো হোয়াট, প্রেসিডেন্ট ইজ কিলড। ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার, আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন।’
পরবর্তীকালে জিয়া যা-ই করুন, ওই দিন ভোরে তো ভালো বুদ্ধিই দিয়েছিলেন। আততায়ীর হাতে যদি রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েই থাকেন, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল তো আছেন। সংবিধান অনুযায়ী তিনিই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। সেদিন যদি তা-ও হতো তাহলেও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা থাকত। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হতেন না, সামরিক শাসন আসত না।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সফিউল্লাহর কথা হয়েছিল কখন? গ্রীষ্মকালে শেষ রাত থেকে বেলা সাতটা তো দীর্ঘ সময়। ততক্ষণে তো ঢাকাবাসীসহ দুনিয়ার মানুষ জেনে গেছে। কারা কারা ষড়যন্ত্রে ছিলেন সেটা ভিন্ন কথা, সে জন্যই তদন্ত হওয়া দরকার, কিন্তু এখন এটা প্রমাণিত যে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা শেষ রাতেই জানতেন ৩২ নম্বরে কী হচ্ছে। দায়িত্ব নিজের কাঁধে না আসে তাই প্রত্যেকেই অন্যের কাছ থেকে শোনার ভান করেছেন, নিজে যে জানেন সে কথা চেপে গেছেন। বাস্তবতা হলো, ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে ওপরের পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের জীবনের দরজা খুলে যায়। বাকশাল সরকার থাকলে তা সম্ভব হতো না। যা ছিল প্রথমে একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকের প্রতিহিংসামূলক কাজ, তার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়ে নিল গোটা সেনাবাহিনী। একটি অবৈধ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের ফলে শুধু সরকার বদল নয়, বদলে গেল রাষ্ট্রের নীতি, আদর্শ ও চরিত্র।
জজ কাজী গোলাম রসুলের আদালতে লে. কর্নেল ডালিমের উকিল যখন জেরা শুরু করেন, তখন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো জেনারেল সফিউল্লাহ ফিট হয়ে যান। মূর্ছিত অবস্থায় তাঁকে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল। দায়রা আদালতের কাঠগড়ায় তিনি কী বললেন হয়তো সেটা মানুষ সত্য বলেই গ্রহণ করবে, কিন্তু ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাঁকে দাঁড়াতেই হবে। শেখ সেলিম না বললেও একদিন কেউ না কেউ আঙুল তুলবেই। বিশেষ পরিস্থিতিতে ভুল মানুষেই করে, তা অকপটে স্বীকার করা ভালো। তা না করার নাম আত্মপ্রবঞ্চনা।
সেই সময়টি ছিল সুবিধাবাদিতার, স্বার্থের জন্য প্রবলের কাছে আত্মসমর্পণের, নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দেওয়ার, ত্যাগ স্বীকারের চেয়ে আত্মস্বার্থের মওকায় থাকার। তাই শুধু সেনাপ্রধান এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে দোষারোপ করেই বা কী হবে? রাজনীতিকদের ছিল না নীতি ও আত্মবিশ্বাস, সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের ছিল না মেরুদণ্ড ও চারিত্রিক দৃঢ়তা, বেসরকারি আমলারা ছিলেন স্বার্থের কাছে সমর্পিত ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, ব্যবসায়ীরা চাইছিলেন তাঁদের স্বার্থের অনুকূল একটি পরিবেশ—তাতে দেশ যদি রসাতলে যায় তো যাক। সে অবস্থায় সেনাপ্রধানকে বলির পাঁঠা বানিয়ে কী লাভ? তদন্ত কমিশন হওয়া উচিত। তবে তাঁদের কাজের নির্ভুল তদন্ত করবে মহাকাল, তাঁদের বিচার হবে ইতিহাসের আদালতের কাঠগড়ায়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।
তারিখ: ০১-০৯-২০০৯
ওই জাতীয় বিরাট ব্যাপারের বিচার পরের কথা, আগে দরকার তদন্ত কমিশন গঠন করে ঘটনার কারণ ও তার সঙ্গে কারা জড়িত এবং দায়িত্ব পালনে কারা ব্যর্থ হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা ও রিপোর্ট প্রকাশ। সেই কাজটি হয়নি। তবে বাংলাদেশের যে ঐতিহ্য তাতে তদন্ত কমিশন গঠিত হলেও যে তার রিপোর্টে নিরপেক্ষ সত্য—ইম্পার্শিয়াল ট্রুথ বেরিয়ে আসত সে সম্ভাবনা খুবই কম। তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান মার্কিনপন্থী হলে রিপোর্ট হতো এক রকম, চীনপন্থী হলে হতো আরেক রকম, সোভিয়েত, ভারতপন্থী হলে হতো অন্যরকম এবং পাকিস্তানপন্থী হলে হতো একেবারেই আলাদা। কয়েকদিন আগে শেখ ফজলুল করিম সেলিম তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি করেছেন এবং সে সময়ের সেনাবাহিনী প্রধান, উপপ্রধানদের প্রতি অভিযোগ উত্থাপন করায় তা নিয়ে কাগজে বিতর্ক হচ্ছে।
পনেরোই আগস্টের ঘটনাটি ঘটিয়েছিল স্রেফ সেনাবাহিনীর লোকেরা। তারাই—তারা ‘কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল’ লোক হোক বা গোটা সেনাবাহিনীই হোক—রাষ্ট্রপ্রধানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল এবং শুধু তাঁকে হত্যা নয়, সরকারও বদল করেছিল সেনাবাহিনীর লোকেরাই। সুতরাং ওই ঘটনায় সেনাবাহিনী প্রধান তাঁর দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেন না। তাঁর ব্যর্থতা পরিমাপযোগ্য নয়। গত বছর এক টেলিভিশন টক শোতে তোফায়েল আহমেদ, জেনারেল সফিউল্লাহ ও আমি উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আমি সবিনয়ে বলেছিলাম, সফিউল্লাহ ভাই, আপনি দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তিনি বললেন, তা বলতে পারেন।
শেখ সেলিমও সেই কথাটিই বলেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাত্কারেও তিনি বলেছেন, ‘সফিউল্লাহ, জিয়া সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিলে তিনি নিহত হতেন না। এমনকি জিয়াও পরবর্তী সময়ে নিহত হতেন না। সফিউল্লাহ তখন সেনাপ্রধান ছিলেন, তাঁর দায়িত্ব কী? রাষ্ট্রপতি তাঁর সাহায্য চেয়েছেন। কিন্তু তিনি নীরব ছিলেন। রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করা তাঁর দায়িত্ব ছিল। নবাব সিরাজদ্দৌলা ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মিল আছে। সিরাজের নির্দেশ অমান্য করে সেনাপ্রধান মীর জাফর সেদিন নীরব ছিলেন। যদি মীর জাফর বেইমানি না করতেন তাহলে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হতো না। ২০০ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ...তখন প্রায় এক লাখ সেনাসদস্য ছিল, কিন্তু সফিউল্লাহ, জিয়া, খালেদ মোশাররফ, শাফায়েত জামিল কোনো পদক্ষেপ নেননি। ...এ ঘটনার নেপথ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের চেহারা উন্মোচন করা... [আমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য]।’
প্রত্যুত্তরে জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছেন, ‘আমি বর্তমানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গ্রামেগঞ্জে জনমত গঠনের কাজে ভূমিকা রেখে যাচ্ছি। আমি জানি না, এ কাজ থেকে বিরত রাখতে আমাকে কোনো মহল থেকে বিরক্ত করা হচ্ছে কি না।’ [প্রথম আলো, ২৯ আগস্ট]
বিষয়টি বিরক্ত করা বা প্রীত করার নয়। এবং শেখ সেলিম কোনো ‘মহল’-এর মানুষ নন। জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছেন, তাঁর অবস্থান তিনি একটি বইয়ে তুলে ধরবেন। ‘বইটির খসড়া ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। এখন বইটির পরিমার্জন করছি, যাতে কেউ আঙুল তুলতে না পারে।’
এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে তিনি তাঁর দিকে কারও আঙুল তোলা বন্ধ করতেই নিজের সমর্থনে বইটি লিখছেন। সংগত ও যুক্তিযুক্ত কারণে কেউ যদি কারও দিকে আঙুল তোলে সে আঙুল বলপ্রয়োগ করে নিচে নামানো যাবে না। ওই দিনের পরিস্থিতি এবং তাঁর নিজের অবস্থান সম্পর্কে তিনি গত ৩৪ বছরে বহু জায়গায় আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। কোনো কোনো সময় তাঁর এক বক্তব্যের সঙ্গে আরেক বক্তব্যের বেমিল পাওয়া যাবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শব্দপ্রয়োগে তারতম্য ঘটেছে। সেদিন তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘খন্দকার মোশতাক আমাকে সেনাপ্রধানের পদ থেকে ডিসমিস করেন।’ সামরিক বা বেসামরিক কোনো পদ থেকে ডিসমিস বা বরখাস্ত হওয়া খুবই খারাপ জিনিস। সেটা শাস্তি।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় (দায়রা মামলা নম্বর-৩১৯/৯৭) ‘আন্দাজী-৬৩ বছর’ বয়সে ‘সন ১৯৯৮ সালের ১৩/১ তারিখে’ দেওয়া লিখিত জবানবন্দিতে সফিউল্লাহ শুরুতেই বলেন, ‘১৯৭৫ সনের ২৪ আগস্ট অবসর গ্রহণ করি।’ আর এক অনুচ্ছেদে বলেন, ‘১৯৭৫ সনের ২৪ আগস্ট আমাকে সেনাপ্রধানের পদ হইতে অবসর দিয়া রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ করে। আমি একজন সরকারি কর্মচারী হিসাবে উক্ত নিয়োগ গ্রহণ করিতে বাধ্য হই। আমি ১৯৯১ সনের জুলাই মাস পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করি। এই সময় আমি নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হই নাই। তবে মাঝে মাঝে উড়ো চিঠিপত্র পাইয়াছি। সেনাপ্রধান হিসাবে নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হই নাই।’ [Criminal Reference under Section 374 of the Code of Criminal Procedure, 1997]
সেনাপ্রধান হিসেবেও তিনি নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হননি, বিদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবেও হননি, তাহলে কখন হলেন? দু-একটা উড়ো চিঠির ভয়েও প্রকম্পিত হওয়ার সাহসী মানুষের শোভা পায় না। উড়ো চিঠি সাংবাদিক থেকে স্কুলের হেডমাস্টার বা থানার বড় দারোগা পর্যন্ত অনেকেই পান। তা ছাড়া তাঁকে বেনামি চিঠি যে-ই দিক ফারুক-রশীদের লোকেরা নিশ্চয়ই দেয়নি। তাদের তো কদাচ কোনো ক্ষতি করেননি তিনি। বরং তাদের কথামতোই চলেছেন কয়েকটি দিন।
হাকিমের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, ‘আগস্ট মাসেই আমি সেনাপ্রধানের পদ হইতে মুক্ত হইয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করি। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বর্তমান জায়গায় অর্থাত্ সেগুনবাগিচায় ছিল। আমি সেনাভবন হইতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসা-যাওয়া করিতাম।...জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত ছিলাম।’
প্রথম আলোকে সেদিন তিনি আরও বললেন যে তাঁর নিরাপত্তার জন্য মোশতাক অশেষ উদ্বেগে ছিলেন। একদিন প্রেসিডেন্ট তাঁকে ডেকে বললেন, ‘আমি দেশের বাইরে যেতে রাজি আছি কি না। আমি বললাম, না।’ মোশতাক বললেন, ‘আমি তোমার নিরাপত্তার জন্যে এটা চাইছি। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের কী দশা হয়েছে, তা তো দেখেছ।’
অর্থাত্ দেশে থাকলে তাঁরও বঙ্গবন্ধুর দশা হতে পারে। তবে মোশতাক ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্বোধন করার কথা নয়, বলে থাকলে বলেছেন ‘মুজিব’। সে যাক গে। আদালতে তিনি বলেছেন, ২৫ আগস্ট থেকেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘আসা-যাওয়া’ করেছেন। প্রথম আলোকে বললেন, মোশতাকের জবাব শোনার অপেক্ষা না করেই তিনি ধা করে তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। তারপর বাসায় পৌঁছে শোনেন, “ওপরের নির্দেশ হলো আমি যেন বাসা থেকে বের না হই (কেউ দৈবাত্ ক্ষতি করতে পারে)। ...কিছুদিন পরপর ওসমানী জানতে চাইতেন, ‘তুমি মত পাল্টেছ কি না।’ এরপর ৩ নভেম্বরে জেলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটে। সেখানে চার জাতীয় নেতাকে কারাগারের সংরক্ষিত হেফাজতে হত্যা করা হলো, তখন আমি আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হই। তারপর বিদেশে যাওয়ার পক্ষে মতামত দেই।...তবে মালয়েশিয়া সরকার আমার সম্পর্কে ভুল বুঝে আমাকে প্রথমে গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিল।” ক্যুর সঙ্গে যুক্তদের কোনো দেশ নিতে চায় না।
আদালতে বললেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘যোগদান’ ও ‘আসা-যাওয়া’ করি; এখন বলছেন, জেলখানায় হত্যাকাণ্ড না হলে রাষ্ট্রদূতের চাকরির তোয়াক্কা করতেন না। দুই রকম কথা হয়ে গেল। বই বেরোনোর পরে যদি কেউ আঙুল তোলে সে আঙুল মটকানো সম্ভব হবে না। অনেক স্মৃতিকথামূলক বই লেখকের বিপদ ডেকে আনে।
একই সময়ে দেওয়া বক্তব্যেও নানা রকম অসংগতি ও গোলমাল ধরা পড়ে। আদালতে লিখিত জবানবন্দিতে সফিউল্লাহ বলেন:
“১৫ই আগস্ট/৭৫ সকালে আমার ব্যাটম্যান দরজা ধাক্কা দিলে আমি বাহির হই এবং দেখি আমার ডিএমআই লে. কর্নেল সালাহউদ্দিন (ডাইরেক্টর, মিলিটারি ইনটেলিজেন্স) সেখানে উপস্থিত। আমাকে দেখেই সে জিজ্ঞাসা করে, স্যার, আপনি কি আরমার এবং আর্টিলারিকে শহরের দিকে যেতে বলেছেন? আমি বললাম, না তো! কেন? সে উত্তরে বলল, তারা তো রেডিও স্টেশন, গণভবন এবং ৩২ নম্বর রোডের দিকে যাইতেছে। তাহার কথা শুনে আমি শঙ্কিত হলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম, ডাজ শাফায়েত নো অ্যাবাউট ইট? শাফায়েত কি ইহা জানে? সে উত্তরে বলল, আমি জানি না স্যার। তখন তাহাকে বলিলাম, তুমি শীঘ্রই শাফায়েতের কাছে যাও।...তাহাকে পাঠাইয়া দিয়াই আমি রুমে ঢুকেই টেলিফোনে প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে (সম্ভবত পনেরোই আগস্ট সূর্য ওঠার অনেক পরে) চেষ্টা করি কিন্তু পাই না। পরে শাফায়েত জামিল, চিফ অব এয়ার স্টাফ খোন্দকার, চিফ অব ন্যাভাল স্টাফ এম এইচ খান, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমান, সিডিএম খালেদ মোশাররফকে টেলিফোন করি।...আমি যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলি, তিনি আমার গলার আওয়াজ শুনে বলে উঠলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ আমি বলেছিলাম, আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট অব দ্য হাউস?”
কী সাংঘাতিক মর্মান্তিক ব্যাপার। বিপন্ন রাষ্ট্রপতি ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বলছেন, তাঁর বাড়ি আক্রান্ত, তাঁর পুত্রকে হত্যা করা হয়েছে। তখন সেনাপ্রধান তাঁকে নির্দেশ দিচ্ছেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারেন কি না? ভাগ্যের নির্মম পরিহাস একেই বলে। তারপর জবানবন্দিতে বলা হচ্ছে: ‘আমার অফিসে অনুমান সকাল সাতটার সময় রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে প্রথম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কথা শুনিয়াছি। আমি অফিসে অবস্থানকালে আমার ডেপুটি চিফও (জিয়া) আমার সামনেই বসিয়া ছিলেন।’ যত দূর জানা যায় শেষ রাতে ফোন তাঁকে বঙ্গবন্ধুই করেছিলেন।
সফিউল্লাহর জবানবন্দির আট দিন আগে ৫ জানুয়ারি জবানবন্দিতে কর্নেল শাফায়েত জামিল আদালতে বলেন, ‘আমি দ্রুত ইউনিফর্ম পরিয়া মেজর হাফিজসহ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের দিকে রওনা দেই। পথিমধ্যে জে. জিয়াউর রহমানের বাসায় যাই এবং তাঁহাকে শেভরত অবস্থায় পাই। আমার নিকট হইতে ঘটনা শোনার পর তিনি বলিলেন, ‘সো হোয়াট, প্রেসিডেন্ট ইজ কিলড। ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার, আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন।’
পরবর্তীকালে জিয়া যা-ই করুন, ওই দিন ভোরে তো ভালো বুদ্ধিই দিয়েছিলেন। আততায়ীর হাতে যদি রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েই থাকেন, উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল তো আছেন। সংবিধান অনুযায়ী তিনিই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। সেদিন যদি তা-ও হতো তাহলেও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা থাকত। মোশতাক রাষ্ট্রপতি হতেন না, সামরিক শাসন আসত না।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সফিউল্লাহর কথা হয়েছিল কখন? গ্রীষ্মকালে শেষ রাত থেকে বেলা সাতটা তো দীর্ঘ সময়। ততক্ষণে তো ঢাকাবাসীসহ দুনিয়ার মানুষ জেনে গেছে। কারা কারা ষড়যন্ত্রে ছিলেন সেটা ভিন্ন কথা, সে জন্যই তদন্ত হওয়া দরকার, কিন্তু এখন এটা প্রমাণিত যে শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা শেষ রাতেই জানতেন ৩২ নম্বরে কী হচ্ছে। দায়িত্ব নিজের কাঁধে না আসে তাই প্রত্যেকেই অন্যের কাছ থেকে শোনার ভান করেছেন, নিজে যে জানেন সে কথা চেপে গেছেন। বাস্তবতা হলো, ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরে ওপরের পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তাদের জীবনের দরজা খুলে যায়। বাকশাল সরকার থাকলে তা সম্ভব হতো না। যা ছিল প্রথমে একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈনিকের প্রতিহিংসামূলক কাজ, তার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়ে নিল গোটা সেনাবাহিনী। একটি অবৈধ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের ফলে শুধু সরকার বদল নয়, বদলে গেল রাষ্ট্রের নীতি, আদর্শ ও চরিত্র।
জজ কাজী গোলাম রসুলের আদালতে লে. কর্নেল ডালিমের উকিল যখন জেরা শুরু করেন, তখন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো জেনারেল সফিউল্লাহ ফিট হয়ে যান। মূর্ছিত অবস্থায় তাঁকে বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল। দায়রা আদালতের কাঠগড়ায় তিনি কী বললেন হয়তো সেটা মানুষ সত্য বলেই গ্রহণ করবে, কিন্তু ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাঁকে দাঁড়াতেই হবে। শেখ সেলিম না বললেও একদিন কেউ না কেউ আঙুল তুলবেই। বিশেষ পরিস্থিতিতে ভুল মানুষেই করে, তা অকপটে স্বীকার করা ভালো। তা না করার নাম আত্মপ্রবঞ্চনা।
সেই সময়টি ছিল সুবিধাবাদিতার, স্বার্থের জন্য প্রবলের কাছে আত্মসমর্পণের, নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দেওয়ার, ত্যাগ স্বীকারের চেয়ে আত্মস্বার্থের মওকায় থাকার। তাই শুধু সেনাপ্রধান এবং তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে দোষারোপ করেই বা কী হবে? রাজনীতিকদের ছিল না নীতি ও আত্মবিশ্বাস, সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের ছিল না মেরুদণ্ড ও চারিত্রিক দৃঢ়তা, বেসরকারি আমলারা ছিলেন স্বার্থের কাছে সমর্পিত ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, ব্যবসায়ীরা চাইছিলেন তাঁদের স্বার্থের অনুকূল একটি পরিবেশ—তাতে দেশ যদি রসাতলে যায় তো যাক। সে অবস্থায় সেনাপ্রধানকে বলির পাঁঠা বানিয়ে কী লাভ? তদন্ত কমিশন হওয়া উচিত। তবে তাঁদের কাজের নির্ভুল তদন্ত করবে মহাকাল, তাঁদের বিচার হবে ইতিহাসের আদালতের কাঠগড়ায়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।
তারিখ: ০১-০৯-২০০৯
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন