
গত
১০-১২ বছরে আমি দেশের কয়েকটি মুরগির খামার, মাছ চাষ প্রকল্প প্রভৃতি ঘুরে
দেখার সুযোগ পেয়েছি। যেসব খামার ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা
দক্ষ সেগুলোর আয়-উন্নতি অসামান্য। সেসবের মালিক ও কর্মচারী উভয় পক্ষই সুখে
রয়েছে। অযোগ্য ব্যবস্থাপনায় যেসব খামার পরিচালিত সেগুলোর অবস্থা ভালো না।
কোনো কোনোটি ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করতে পারে না। লোকসান দিতে দিতে একসময়
ধ্বংস হয়ে যায়।
ব্যক্তিমালিকানাধীন আরও নানা রকম ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছি। মালিক ও ব্যবস্থাপকেরা ঘুরিয়ে দেখান। একটি সফল জিনিস অন্যকে দেখানোর মধ্যেও রয়েছে আনন্দ। সাভার, গাজীপুর, জয়দেবপুর, আশুলিয়ার বহু পোশাকশিল্প-কারখানায় গেছি। আগুনটাগুন লাগলে বা শ্রমিক বিক্ষোভ হলেও যাই। শ্রমিক ও মালিকপক্ষের কথা শুনি। গত ২৫ বছরে এই শিল্পটি দাঁড়িয়ে গেছে। লাখ লাখ দরিদ্র নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের মজুরি অতি কম। সে জন্য কখনো তাদের অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সুযোগে বাইরের সমাজবিরোধীরাও ভাঙচুর, লুটপাটে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একবার সমকাল-এর প্রকাশক এ কে আজাদের হা-মীম গ্রুপের ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগানো হয়। সেদিন গোটা আশুলিয়া রণক্ষেত্র। বহু কষ্টে গেলাম। দেখি তখনো আগুন জ্বলছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। খুব খারাপ লাগল। অন্যান্য কারখানার জানালা-দরজার ক্ষতি হয়েছে। রাস্তার শ্রমিকদের বললাম, দাবি আদায়ের এটা পথ নয়। আলাপ-আলোচনাই উপযুক্ত উপায়। প্রয়োজনে ধর্মঘট-কর্মবিরতি হতে পারে। ভাঙচুর, আগুন লাগানো কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।
উচ্চমধ্যবিত্তের নারী আন্দোলন যা করতে পারেনি ৮০ বছরে, পোশাকশিল্প ও গ্রামীণ ব্যাংক প্রবর্তিত ক্ষুদ্রঋণ তা করেছে গত ২৫ বছরে। ভূতলবাসী দরিদ্র নারীদের কারখানার শ্রমিক বানিয়েছে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছে দুই-তিন কোটি নারীকে। বৈরী সমাজেও এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়ও তারা কারখানায় কাজ করে রাত ১০টায় ঘরে ফেরে।
নারীর ক্ষমতায়ন না হলেও উপার্জন করার ব্যবস্থাটা হয়েছে। তবে তা রাষ্ট্র করেনি, ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের দ্বারা হয়েছে। আরও হতো, যদি থাকত নারীর জীবনে সামাজিক নিরাপত্তা, যদি না থাকত যৌন হয়রানির মতো উপদ্রব। নারীর সেই নিরাপত্তাটুকুই নিশ্চিত করতে পারত রাষ্ট্র। ঘরে-বাইরে ওত পেতে থাকা বখাটে লম্পটের হাত থেকে নারীকে রক্ষার ব্যবস্থাটা রাষ্ট্র নিলে নারীর কাছ থেকে সমাজ আরও বেশি পেত, অন্যদিকে নারীও দেশকে দিতে পারত আরও বেশি। রাষ্ট্র নারীর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিমুহূর্তে তারা কোনো না কোনো রকমের সহিংসতার শিকার।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বহু যোগ্য মানুষ তৈরি হয়েছেন। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা সাফল্যের চিহ্ন রেখেছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে বড় বড় সরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানুষ চিকিৎসা পায় না, ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বড় বড় হাসপাতাল। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো ধ্বংসের পথে, অথচ ব্যক্তিমালিকানায় ক্লিনিকগুলো ভালো চলছে। কলকাতা ও ঢাকা মেডিকেলের পাস করা ডাক্তারদের মান ছিল যেকোনো উন্নত কমনওয়েলথ দেশের চিকিৎসকদের সমমানের। এখনো আমাদের বহু মেধাবী ডাক্তার রয়েছেন। তার পরও সরকারি হাসপাতালগুলো খুঁড়িয়ে চলছে। দোষ ডাক্তারদের নয়, ম্যানেজারদের—অর্থাৎ সরকারের।
দেশি ও বিদেশি কোনো কোম্পানির অফিসে ঢুকলে দেখা যায়, কী সুন্দর পরিবেশ! আমাদেরই ছেলেমেয়েরা কী দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। সরকারি অফিসগুলোতে হচ্ছে প্রচণ্ড বেগে টেবিল চাপড়ে গালগল্প। কেউ অফিসে না গেলে বেতন কাটা যায় না।
কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ম্যানেজারের দক্ষতার বিকল্প নেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের কাজ ম্যানেজারের কাজ। অযোগ্য অদক্ষ লোক কোনো কিছু গড়ে তুলতে পারে না। সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। আমি মুক্তাঙ্গন, শহীদ মিনার বা রাস্তার সমাবেশে চেঁচাতে পারি, মতবিনিময় সভায় টেবিল চাপড়াতে পারি, একটি ক্ষুদ্র মুদি দোকান চালাতে দিলেও পারব না। ওটার জন্য অন্য রকম দক্ষ লোক দরকার। আমার জীবনে আমি তিনবার ছাপাখানা করতে গিয়ে পুঁজিপাট্টা সব খুইয়ে ফেলি। প্রথম উদ্যোগ নিই ১৯৭০-এর সেপ্টেম্বরে। তিন-চার মাস পর ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি থেকেই হরতাল-ধর্মঘট ইত্যাদি শুরু হয়। তারপর মার্চে অসহযোগ আন্দোলন। ২৭ মার্চ তালা দিয়ে ঢাকা থেকে বিদায় নিই। খবর পেলাম, জুন মাসে অবাঙালি রাজাকাররা তালা ভেঙে টাইপরাইটার প্রভৃতি শুধু নয়, ট্রেডল মেশিনটিও খুলে নিয়ে গেছে। ষোলোই ডিসেম্বরের সপ্তাহ খানেক পর মালামালসহ মোহাম্মদপুর থেকে লুণ্ঠনকারীকে পাকড়াও করেছিলাম। আমার বন্ধুরা সারা দিন তাকে আটকে রেখে জীবনের শেষ শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। আমি ক্ষমা করে দিই।
তৃতীয়বার উদ্যোগ নিয়েছিলাম ১৯৮০-তে। সেই প্রেসেরও আয়ু ছিল তিন মাস। ওই তিন মাসে কিছু লন্ড্রির ক্যাশমেমো এবং লেটারহেড প্যাড ছাড়া একটিমাত্র কাজই করেছিলাম, তা হলো আওয়ামী লীগের নেতা সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সায়ীদের বঙ্গবন্ধু ও বাকশালের কৃষিনীতি সম্পর্কে একটি বই। তখন জিয়াউর রহমানের শাসনকাল। বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রশংসামূলক বই ছাপার উৎসাহ খুব কম প্রেসমালিকেরই ছিল। আমি বন্ধুকৃত্য করেছিলাম বটে, তবে উপকৃত হয়েছিলাম সাংঘাতিকভাবে। বই ছাপা-বাঁধাই শেষ, আমার প্রেস ব্যবসাও শেষ। আবু সায়ীদের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে ম্যানেজার, কম্পোজিটর ও মেশিনম্যানের বেতনটা দিয়ে তওবা করি, জীবনে আর কোনো ব্যবসা নয়। আসলে কোনো কিছু ভালোমতো পরিচালনা করতে গেলে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা ছাড়া হয় না।
শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। রাষ্ট্র পরিচালনা করার দায়িত্ব রাজনীতিকদের। রাজনীতিকদের পরিচালিত সরকার হলো রাষ্ট্রের ম্যানেজার। দেশে অসংখ্য দক্ষ ও যোগ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার প্রমুখ পেশাজীবী রয়েছেন। তাঁদের দিয়ে কাজ করানোর যোগ্যতা যদি রাজনৈতিক সরকারের না থাকে, তার দায় সরকারের, তাঁদের নয়। অবিচল দেশপ্রেমিক ও নিবেদিত সমাজসেবক শহীদ রণদাপ্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত ভারতেশ্বরী হোমস এবং কুমুদিনী হাসপাতাল চমৎকার চলছে। কোনো জেলার সরকারি স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল ও রকম চলে না কেন? দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিদেশিদের পরিচালিত কুষ্ঠ হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিক সুন্দরভাবে চলছে কী করে? আমাদের লোকেরাই সেখানে কাজ করছেন। জলছত্র, কাপ্তাই ও উত্তরবঙ্গের কুষ্ঠ হাসপাতালগুলো আমি ঘুরে দেখেছি। ওই সব জেলার সরকারি হাসপাতালের দুর্দশা কেন? পরিচালনার দোষ, অন্য কোনো কারণ নেই।
আকারে বাংলাদেশ লাইবেরিয়ার দেড় গুণের বেশি। জনসংখ্যা ৮০ গুণ। লাইবেরিয়ায় সম্ভবত ২০ লাখ, বাংলাদেশের ১৬ কোটি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্যোগ লাইবেরিয়ারও ছিল। বহুদিন ঔপনিবেশিক শাসনে তারাও ছিল। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও সামরিক অভ্যুত্থান সেখানেও হয়েছে। ১৯৮০-তে প্রেসিডেন্ট তোলবার্ট নিহত হন। গৃহবিবাদ ছিল মারাত্মক। সেসব কাটিয়ে উঠে লাইবেরিয়া শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। তার স্বীকৃতি তারা এবার পেয়েছে। প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ ও শান্তিবাদী মানবাধিকার নেতা লেমাহ বোয়িই কোনো রকম তদবির ছাড়াই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
মোটামুটি ভালোভাবে দেশ চালানোর মতো ১৬০০ মানুষ বাংলাদেশে সব শ্রেণী-পেশার মধ্যে রয়েছেন। সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনেও যথেষ্ট দক্ষ, সৎ ও দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা আছেন। উপযুক্ত কাজে তাঁদের বসালে তাঁরা ভালো করবেন। কিন্তু কে তাঁদের বসাবেন সঠিক জায়গাটিতে?
স্বজনপ্রীতি দুর্নীতির মতোই নিন্দনীয়। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অর্ধেক সর্বনাশ করেছে দুর্নীতি এবং বাকি অর্ধেক শেষ করেছে স্বজনপ্রীতি। স্বজনপ্রীতির সূচনা স্বাধীনতার পর থেকেই। যোগ্যতা-দক্ষতার কোনো মূল্য রইল না। চাচা-ভাতিজা, ভাগনে-ভাগনি, বোনজামাই, বেয়াই, শালা-শালী প্রভৃতি নানা রকম আত্মীয় এবং পূর্বপরিচিত চাটুকারদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হতে লাগল। অত্যন্ত যোগ্য ভিন্নমতাবলম্বীকে সরিয়ে তার জায়গায় বসানো হলো একজন অপদার্থ আত্মীয় বা চাটুকারকে। পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁরা যেকোনো কমনওয়েলথ দেশের দক্ষ কর্মকর্তাদের সমকক্ষ ছিলেন। তাঁদের অনেকে দুর্নীতিমুক্ত ছিলেন না, গণমুখী ছিলেন না বটে, তবে তাঁদের দক্ষতা ছিল। ভালো নেতৃত্ব তাঁদের দিয়ে ভালো কাজ করিয়ে নিতে পারত। কিন্তু সেই রকম নেতৃত্ব বাংলাদেশে কখনো ছিল না।
আমাদের দেশে কোটি কোটি মানুষ। প্রতিবছর লাখ লাখ মেধাবী ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে পাস করে বেরোচ্ছে। প্রতিবছর তাদের ভেতর থেকে প্রশাসনের জন্য, কূটনীতির জন্য, বিজ্ঞান গবেষণার জন্য, শিক্ষা বিভাগের জন্য, স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য এবং অন্যান্য বিভাগের জন্য ২৫০ জনকে নির্বাচন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুললে আজ আমরা পেতাম ১০ হাজার সুদক্ষ মানুষ। সরকার তা করেনি। আজ দেশের কোটি কোটি মেধাবী তরুণ-তরুণী তাদের মেধা প্রয়োগের পথ ও সুযোগ পাচ্ছে না। যে মেয়ে বা ছেলেটি রাষ্ট্রের আনুকূল্য পেলে হতে পারত একজন ভালো প্রশাসক, কূটনীতিক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, শিক্ষাবিদ বা জেনারেল, তাকে একদিন একজন অদক্ষ কর্মকর্তা হিসেবেই অবসর গ্রহণ করতে হবে। জাতি তার কাছ থেকে কিছুই পাবে না। সে জন্য সে দায়ী নয়, দায়ী রাষ্ট্র।
চুয়ান্নর নির্বাচনের আগে একটি স্লোগান শোনা যেত: তাগোর পোলা বিলাত যায়, মোগোর পোলা মইষ খেদায়। সেই স্লোগানটি ছিল খুব সঠিক। শাসকদের অপদার্থ ও অমেধাবী সন্তানেরা দেশের কোটি কোটি টাকা নষ্ট করে বিলাত-আমেরিকায় পাড়ি জমায়, সাধারণ মানুষের অত্যন্ত মেধাবী ছেলেমেয়েরা সুযোগের অভাবে অকালে হারিয়ে যায়। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করে না।
সবচেয়ে উদ্বেগের কথা হলো, মেধাবী ছেলেমেয়েরা আজ আর সরকারি চাকরিতে আসছে না। তাতে প্রশাসন হয়ে পড়েছে মেধাহীন। রাষ্ট্র চালানোর যোগ্যতা আমাদের আমলাতন্ত্রের থাকছে না। বিদ্যা-বুদ্ধিহীন দলীয় ক্যাডাররা অক্লেশে ঢুকে পড়ছে প্রশাসনে। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে প্রশাসনিক দক্ষতা বলে আর কিছুই থাকবে না।
যোগ্য ও মেধাবীদের মধ্যে যারা সুযোগ পাচ্ছে তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, ফোন কোম্পানিতে, এনজিও বা অন্য কোথাও ঢুকে পড়ছে। তাতে তাদের জীবনটা হয়তো ভালো কাটবে, কিন্তু দেশের কী লাভ? রাষ্ট্র তো তাদের মেধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আত্মীয়করণ, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিপ্রবণ রাজনীতির বিরুদ্ধে আজ দেশে দেশে যুবসমাজ বিদ্রোহ করছে। ‘আরব বসন্ত’ তার আভাসমাত্র। আমেরিকায় ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন চলছে। কোনো দেশেই অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতি আর বেশি দিন যুবসমাজ সহ্য করবে না। কোন দেশে কীভাবে তারা প্রতিবাদ করবে, তা সময়ই বলে দেবে।
একটি মহৎ ভাব ও গভীর আশা ছাড়া একটি জাতি টিকে থাকতে পারে না। বাঙালি জাতির সব আশা-ভরসা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। জাতি ও রাষ্ট্র আজ সর্বনাশের শেষ কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচলিত ধারার রাজনীতি, প্রথাগত নেতৃত্ব, দেশকে আর কিছু দিতে পারবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না। রাষ্ট্র যে ঠিকভাবে চলছে না, সেটা নেতাদের দোষ নয়। আসল ব্যাপার হলো, প্রচলিত নেতৃত্ব জানেন না একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কীভাবে চালাতে হয়। একটি মুরগির খামার চালাতে যেমন যোগ্যতা ও দক্ষতা দরকার, একটি রাষ্ট্র চালাতেও যোগ্যতা-দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। দেশীয় ক্যাডার বাহিনী ও বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে ক্ষমতায় কিছুকাল থাকা যায়—রাষ্ট্রের কল্যাণ করা যায় না। বৃহত্তর যুবসমাজ তাদের মেধাবিকাশের সুযোগ চায়, বেকারত্বের অভিশাপ নয়, তারা চায় কাজ। তারা ক্যাডার-রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তারা আধিপত্যবাদী বিদেশি হস্তক্ষেপে বিশ্বাস করে না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে চায়। দেশের কোটি কোটি যুবক-যুবতীর চোখের ভাষা আজও যারা পাঠ করতে পারেনি, তারা এখনো অন্ধকারে রয়েছে। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে যুবসমাজ খুব বেশি দিন চুপচাপ বসে থাকবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
ব্যক্তিমালিকানাধীন আরও নানা রকম ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছি। মালিক ও ব্যবস্থাপকেরা ঘুরিয়ে দেখান। একটি সফল জিনিস অন্যকে দেখানোর মধ্যেও রয়েছে আনন্দ। সাভার, গাজীপুর, জয়দেবপুর, আশুলিয়ার বহু পোশাকশিল্প-কারখানায় গেছি। আগুনটাগুন লাগলে বা শ্রমিক বিক্ষোভ হলেও যাই। শ্রমিক ও মালিকপক্ষের কথা শুনি। গত ২৫ বছরে এই শিল্পটি দাঁড়িয়ে গেছে। লাখ লাখ দরিদ্র নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের মজুরি অতি কম। সে জন্য কখনো তাদের অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সুযোগে বাইরের সমাজবিরোধীরাও ভাঙচুর, লুটপাটে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একবার সমকাল-এর প্রকাশক এ কে আজাদের হা-মীম গ্রুপের ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগানো হয়। সেদিন গোটা আশুলিয়া রণক্ষেত্র। বহু কষ্টে গেলাম। দেখি তখনো আগুন জ্বলছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। খুব খারাপ লাগল। অন্যান্য কারখানার জানালা-দরজার ক্ষতি হয়েছে। রাস্তার শ্রমিকদের বললাম, দাবি আদায়ের এটা পথ নয়। আলাপ-আলোচনাই উপযুক্ত উপায়। প্রয়োজনে ধর্মঘট-কর্মবিরতি হতে পারে। ভাঙচুর, আগুন লাগানো কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।
উচ্চমধ্যবিত্তের নারী আন্দোলন যা করতে পারেনি ৮০ বছরে, পোশাকশিল্প ও গ্রামীণ ব্যাংক প্রবর্তিত ক্ষুদ্রঋণ তা করেছে গত ২৫ বছরে। ভূতলবাসী দরিদ্র নারীদের কারখানার শ্রমিক বানিয়েছে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করেছে দুই-তিন কোটি নারীকে। বৈরী সমাজেও এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়ও তারা কারখানায় কাজ করে রাত ১০টায় ঘরে ফেরে।
নারীর ক্ষমতায়ন না হলেও উপার্জন করার ব্যবস্থাটা হয়েছে। তবে তা রাষ্ট্র করেনি, ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের দ্বারা হয়েছে। আরও হতো, যদি থাকত নারীর জীবনে সামাজিক নিরাপত্তা, যদি না থাকত যৌন হয়রানির মতো উপদ্রব। নারীর সেই নিরাপত্তাটুকুই নিশ্চিত করতে পারত রাষ্ট্র। ঘরে-বাইরে ওত পেতে থাকা বখাটে লম্পটের হাত থেকে নারীকে রক্ষার ব্যবস্থাটা রাষ্ট্র নিলে নারীর কাছ থেকে সমাজ আরও বেশি পেত, অন্যদিকে নারীও দেশকে দিতে পারত আরও বেশি। রাষ্ট্র নারীর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিমুহূর্তে তারা কোনো না কোনো রকমের সহিংসতার শিকার।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বহু যোগ্য মানুষ তৈরি হয়েছেন। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা সাফল্যের চিহ্ন রেখেছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে বড় বড় সরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মানুষ চিকিৎসা পায় না, ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বড় বড় হাসপাতাল। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো ধ্বংসের পথে, অথচ ব্যক্তিমালিকানায় ক্লিনিকগুলো ভালো চলছে। কলকাতা ও ঢাকা মেডিকেলের পাস করা ডাক্তারদের মান ছিল যেকোনো উন্নত কমনওয়েলথ দেশের চিকিৎসকদের সমমানের। এখনো আমাদের বহু মেধাবী ডাক্তার রয়েছেন। তার পরও সরকারি হাসপাতালগুলো খুঁড়িয়ে চলছে। দোষ ডাক্তারদের নয়, ম্যানেজারদের—অর্থাৎ সরকারের।
দেশি ও বিদেশি কোনো কোম্পানির অফিসে ঢুকলে দেখা যায়, কী সুন্দর পরিবেশ! আমাদেরই ছেলেমেয়েরা কী দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। সরকারি অফিসগুলোতে হচ্ছে প্রচণ্ড বেগে টেবিল চাপড়ে গালগল্প। কেউ অফিসে না গেলে বেতন কাটা যায় না।
কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ম্যানেজারের দক্ষতার বিকল্প নেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের কাজ ম্যানেজারের কাজ। অযোগ্য অদক্ষ লোক কোনো কিছু গড়ে তুলতে পারে না। সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। আমি মুক্তাঙ্গন, শহীদ মিনার বা রাস্তার সমাবেশে চেঁচাতে পারি, মতবিনিময় সভায় টেবিল চাপড়াতে পারি, একটি ক্ষুদ্র মুদি দোকান চালাতে দিলেও পারব না। ওটার জন্য অন্য রকম দক্ষ লোক দরকার। আমার জীবনে আমি তিনবার ছাপাখানা করতে গিয়ে পুঁজিপাট্টা সব খুইয়ে ফেলি। প্রথম উদ্যোগ নিই ১৯৭০-এর সেপ্টেম্বরে। তিন-চার মাস পর ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি থেকেই হরতাল-ধর্মঘট ইত্যাদি শুরু হয়। তারপর মার্চে অসহযোগ আন্দোলন। ২৭ মার্চ তালা দিয়ে ঢাকা থেকে বিদায় নিই। খবর পেলাম, জুন মাসে অবাঙালি রাজাকাররা তালা ভেঙে টাইপরাইটার প্রভৃতি শুধু নয়, ট্রেডল মেশিনটিও খুলে নিয়ে গেছে। ষোলোই ডিসেম্বরের সপ্তাহ খানেক পর মালামালসহ মোহাম্মদপুর থেকে লুণ্ঠনকারীকে পাকড়াও করেছিলাম। আমার বন্ধুরা সারা দিন তাকে আটকে রেখে জীবনের শেষ শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। আমি ক্ষমা করে দিই।
তৃতীয়বার উদ্যোগ নিয়েছিলাম ১৯৮০-তে। সেই প্রেসেরও আয়ু ছিল তিন মাস। ওই তিন মাসে কিছু লন্ড্রির ক্যাশমেমো এবং লেটারহেড প্যাড ছাড়া একটিমাত্র কাজই করেছিলাম, তা হলো আওয়ামী লীগের নেতা সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সায়ীদের বঙ্গবন্ধু ও বাকশালের কৃষিনীতি সম্পর্কে একটি বই। তখন জিয়াউর রহমানের শাসনকাল। বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রশংসামূলক বই ছাপার উৎসাহ খুব কম প্রেসমালিকেরই ছিল। আমি বন্ধুকৃত্য করেছিলাম বটে, তবে উপকৃত হয়েছিলাম সাংঘাতিকভাবে। বই ছাপা-বাঁধাই শেষ, আমার প্রেস ব্যবসাও শেষ। আবু সায়ীদের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে ম্যানেজার, কম্পোজিটর ও মেশিনম্যানের বেতনটা দিয়ে তওবা করি, জীবনে আর কোনো ব্যবসা নয়। আসলে কোনো কিছু ভালোমতো পরিচালনা করতে গেলে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতা ছাড়া হয় না।
শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। রাষ্ট্র পরিচালনা করার দায়িত্ব রাজনীতিকদের। রাজনীতিকদের পরিচালিত সরকার হলো রাষ্ট্রের ম্যানেজার। দেশে অসংখ্য দক্ষ ও যোগ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার প্রমুখ পেশাজীবী রয়েছেন। তাঁদের দিয়ে কাজ করানোর যোগ্যতা যদি রাজনৈতিক সরকারের না থাকে, তার দায় সরকারের, তাঁদের নয়। অবিচল দেশপ্রেমিক ও নিবেদিত সমাজসেবক শহীদ রণদাপ্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত ভারতেশ্বরী হোমস এবং কুমুদিনী হাসপাতাল চমৎকার চলছে। কোনো জেলার সরকারি স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল ও রকম চলে না কেন? দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিদেশিদের পরিচালিত কুষ্ঠ হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিক সুন্দরভাবে চলছে কী করে? আমাদের লোকেরাই সেখানে কাজ করছেন। জলছত্র, কাপ্তাই ও উত্তরবঙ্গের কুষ্ঠ হাসপাতালগুলো আমি ঘুরে দেখেছি। ওই সব জেলার সরকারি হাসপাতালের দুর্দশা কেন? পরিচালনার দোষ, অন্য কোনো কারণ নেই।
আকারে বাংলাদেশ লাইবেরিয়ার দেড় গুণের বেশি। জনসংখ্যা ৮০ গুণ। লাইবেরিয়ায় সম্ভবত ২০ লাখ, বাংলাদেশের ১৬ কোটি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্যোগ লাইবেরিয়ারও ছিল। বহুদিন ঔপনিবেশিক শাসনে তারাও ছিল। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও সামরিক অভ্যুত্থান সেখানেও হয়েছে। ১৯৮০-তে প্রেসিডেন্ট তোলবার্ট নিহত হন। গৃহবিবাদ ছিল মারাত্মক। সেসব কাটিয়ে উঠে লাইবেরিয়া শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে। তার স্বীকৃতি তারা এবার পেয়েছে। প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফ ও শান্তিবাদী মানবাধিকার নেতা লেমাহ বোয়িই কোনো রকম তদবির ছাড়াই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
মোটামুটি ভালোভাবে দেশ চালানোর মতো ১৬০০ মানুষ বাংলাদেশে সব শ্রেণী-পেশার মধ্যে রয়েছেন। সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনেও যথেষ্ট দক্ষ, সৎ ও দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা আছেন। উপযুক্ত কাজে তাঁদের বসালে তাঁরা ভালো করবেন। কিন্তু কে তাঁদের বসাবেন সঠিক জায়গাটিতে?
স্বজনপ্রীতি দুর্নীতির মতোই নিন্দনীয়। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অর্ধেক সর্বনাশ করেছে দুর্নীতি এবং বাকি অর্ধেক শেষ করেছে স্বজনপ্রীতি। স্বজনপ্রীতির সূচনা স্বাধীনতার পর থেকেই। যোগ্যতা-দক্ষতার কোনো মূল্য রইল না। চাচা-ভাতিজা, ভাগনে-ভাগনি, বোনজামাই, বেয়াই, শালা-শালী প্রভৃতি নানা রকম আত্মীয় এবং পূর্বপরিচিত চাটুকারদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হতে লাগল। অত্যন্ত যোগ্য ভিন্নমতাবলম্বীকে সরিয়ে তার জায়গায় বসানো হলো একজন অপদার্থ আত্মীয় বা চাটুকারকে। পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে যাঁরা চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁরা যেকোনো কমনওয়েলথ দেশের দক্ষ কর্মকর্তাদের সমকক্ষ ছিলেন। তাঁদের অনেকে দুর্নীতিমুক্ত ছিলেন না, গণমুখী ছিলেন না বটে, তবে তাঁদের দক্ষতা ছিল। ভালো নেতৃত্ব তাঁদের দিয়ে ভালো কাজ করিয়ে নিতে পারত। কিন্তু সেই রকম নেতৃত্ব বাংলাদেশে কখনো ছিল না।
আমাদের দেশে কোটি কোটি মানুষ। প্রতিবছর লাখ লাখ মেধাবী ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে পাস করে বেরোচ্ছে। প্রতিবছর তাদের ভেতর থেকে প্রশাসনের জন্য, কূটনীতির জন্য, বিজ্ঞান গবেষণার জন্য, শিক্ষা বিভাগের জন্য, স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য এবং অন্যান্য বিভাগের জন্য ২৫০ জনকে নির্বাচন করে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুললে আজ আমরা পেতাম ১০ হাজার সুদক্ষ মানুষ। সরকার তা করেনি। আজ দেশের কোটি কোটি মেধাবী তরুণ-তরুণী তাদের মেধা প্রয়োগের পথ ও সুযোগ পাচ্ছে না। যে মেয়ে বা ছেলেটি রাষ্ট্রের আনুকূল্য পেলে হতে পারত একজন ভালো প্রশাসক, কূটনীতিক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, শিক্ষাবিদ বা জেনারেল, তাকে একদিন একজন অদক্ষ কর্মকর্তা হিসেবেই অবসর গ্রহণ করতে হবে। জাতি তার কাছ থেকে কিছুই পাবে না। সে জন্য সে দায়ী নয়, দায়ী রাষ্ট্র।
চুয়ান্নর নির্বাচনের আগে একটি স্লোগান শোনা যেত: তাগোর পোলা বিলাত যায়, মোগোর পোলা মইষ খেদায়। সেই স্লোগানটি ছিল খুব সঠিক। শাসকদের অপদার্থ ও অমেধাবী সন্তানেরা দেশের কোটি কোটি টাকা নষ্ট করে বিলাত-আমেরিকায় পাড়ি জমায়, সাধারণ মানুষের অত্যন্ত মেধাবী ছেলেমেয়েরা সুযোগের অভাবে অকালে হারিয়ে যায়। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করে না।
সবচেয়ে উদ্বেগের কথা হলো, মেধাবী ছেলেমেয়েরা আজ আর সরকারি চাকরিতে আসছে না। তাতে প্রশাসন হয়ে পড়েছে মেধাহীন। রাষ্ট্র চালানোর যোগ্যতা আমাদের আমলাতন্ত্রের থাকছে না। বিদ্যা-বুদ্ধিহীন দলীয় ক্যাডাররা অক্লেশে ঢুকে পড়ছে প্রশাসনে। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে প্রশাসনিক দক্ষতা বলে আর কিছুই থাকবে না।
যোগ্য ও মেধাবীদের মধ্যে যারা সুযোগ পাচ্ছে তারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, ফোন কোম্পানিতে, এনজিও বা অন্য কোথাও ঢুকে পড়ছে। তাতে তাদের জীবনটা হয়তো ভালো কাটবে, কিন্তু দেশের কী লাভ? রাষ্ট্র তো তাদের মেধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আত্মীয়করণ, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিপ্রবণ রাজনীতির বিরুদ্ধে আজ দেশে দেশে যুবসমাজ বিদ্রোহ করছে। ‘আরব বসন্ত’ তার আভাসমাত্র। আমেরিকায় ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন চলছে। কোনো দেশেই অন্যায়-অবিচার-দুর্নীতি আর বেশি দিন যুবসমাজ সহ্য করবে না। কোন দেশে কীভাবে তারা প্রতিবাদ করবে, তা সময়ই বলে দেবে।
একটি মহৎ ভাব ও গভীর আশা ছাড়া একটি জাতি টিকে থাকতে পারে না। বাঙালি জাতির সব আশা-ভরসা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। জাতি ও রাষ্ট্র আজ সর্বনাশের শেষ কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। প্রচলিত ধারার রাজনীতি, প্রথাগত নেতৃত্ব, দেশকে আর কিছু দিতে পারবে বলে কেউ বিশ্বাস করে না। রাষ্ট্র যে ঠিকভাবে চলছে না, সেটা নেতাদের দোষ নয়। আসল ব্যাপার হলো, প্রচলিত নেতৃত্ব জানেন না একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কীভাবে চালাতে হয়। একটি মুরগির খামার চালাতে যেমন যোগ্যতা ও দক্ষতা দরকার, একটি রাষ্ট্র চালাতেও যোগ্যতা-দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। দেশীয় ক্যাডার বাহিনী ও বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে ক্ষমতায় কিছুকাল থাকা যায়—রাষ্ট্রের কল্যাণ করা যায় না। বৃহত্তর যুবসমাজ তাদের মেধাবিকাশের সুযোগ চায়, বেকারত্বের অভিশাপ নয়, তারা চায় কাজ। তারা ক্যাডার-রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না। তারা আধিপত্যবাদী বিদেশি হস্তক্ষেপে বিশ্বাস করে না। স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে চায়। দেশের কোটি কোটি যুবক-যুবতীর চোখের ভাষা আজও যারা পাঠ করতে পারেনি, তারা এখনো অন্ধকারে রয়েছে। রাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে যুবসমাজ খুব বেশি দিন চুপচাপ বসে থাকবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন